নীলকণ্ঠা পর্ব-১০

0
1615

#নীলকণ্ঠা

১০।
দূর্বল শরীর নিয়ে ফায়াজ বসে আছে পুকুর ঘাটে। তার দৃষ্টি কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে থাকা পরীর দিকে। মেয়েটাকে অবেলায় ঘুমিয়ে পড়তে দেখে বেশ অবাক হয়েছিল ফায়াজ, পরক্ষনে ভাবলো এসব হয়ত ওষুধের জন্য হচ্ছে। বেলা সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি ঘড়ির কাটা। পরীর পা দুটো একসাথে ভাজ করে হাটু পেটের কাছে রাখা। হাত দুটো একসাথে মাথার কাছে ফায়াজের কোলে। পরীর কোমল স্নিগ্ধ মুখশ্রী প্রতিমার অনুরূপ। পরীর চকচকে সাদা গালে এক ছিটে রোদ্দুর পড়েছে। সোনালী রঙা হয়েছে সেই অংশটুকু। টানা টানা চোখের ঘন পাপড়িগুলো মিলেমিশে একাকার। ফায়াজ বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল পরীর ঘুমন্ত পাপড়িগুলোতে বুলিয়ে এলোমেলো করে দিল। ফের আঙ্গুল বুলিয়ে সেগুলোকে এক সারিতে আনলো। বৃদ্ধাঙ্গুলের কাজ করতে করতে নিজ মনেই হাসলো ফায়াজ। এরপর হাত চালিয়ে দিল পরীর চুলের ভাজে। পরীর রেশমী চুলে হাত বুলাতে ভালো লাগছে। গত কাল আমেনা পরীকে শ্যাম্পু করিয়ে দিয়েছে। পরীর চুল থেকে সুন্দর একটা ঘ্রাণ বের হচ্ছে। ফায়াজ পরীর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে পুকুরে তাকালো। চারটা ফুটন্ত পদ্ম সাথে দুটো কলির বিশালাকার পাতার মাঝে ঠাই হয়েছে। দুটো প্রজাপতি ডানা ঝাপটে উড়ে চলছে পদ্মগুলোর আশেপাশে। একবার ডান পাশে যাচ্ছে একবার বাম পাশে যাচ্ছে কিন্তু ফুলের উপর বসছে না। আরো কিছুক্ষন বসে ফায়াজ ঠিক করলো এবার ভেতরে যাবে। পরীর মাথায় বিলি কাটা অবস্থায় পরীকে নিচু স্বরে ডাকলো। পরী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ফায়াজের ডাক সে শুনলো না। ফায়াজ আবার ডাকলো।
পরী। পরী উঠো। বাড়ির ভেতরে যাবো। পরী।

পরী হালকা নড়ে উঠলো কিন্তু ঘুম ভাঙ্গলো না। হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলো ফায়াজের পেটের উপরের শার্ট। শার্টের অংশটুকু কুঁচকে রইলো পরীর হাতের মুঠোয়। ফায়াজ আবার ডাকতে যেয়েও থেমে গেল। পরীর আচার আচরনে পরবর্তিন হয়েছে সেটা রাফসানকে বলা বাকি। ফায়াজ আরো কিছুক্ষন বসলো। এরপর হুট করেই ঘুমন্ত পরীকে কোলে তুলে নিল। পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। পরীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। টেনে টুনে শার্ট ঠিক করে ঘর থেকে বের হতেই দেখলো রেনুকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফায়াজের সাথে চোখাচোখি হতেই নিঃশব্দে অন্যদিকে চলে গেল। ফায়াজের কপালে ভাজ পড়লো। রেনুকা কি তার উপর নজর রাখছে?

সাহেব আপনারা চলে আসছেন?

আমেনার প্রশ্নে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো ফায়াজ। বলল,
হ্যা। পরী ঘুমাচ্ছে। ঘন্টা খানেক পর ওকে গোসল করিয়ে খাইয়ে দিবেন।

আমেনা মাথা নাড়ালো।

ফায়াজ ঘরে যেয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে শুয়ে পড়লো। মাথা ভাড় ভাড় লাগছে। শুয়ে পড়তেই চোখে ঘুম নেমে এলো। বার বার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় ঘুম অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ফায়াজের ঘুম ভাঙ্গলো আজান শুনে। চোখ মেলে চারপাশে তাকালো। আজান শুনে বুঝতে পাড়লো না কোন ওয়াক্তের আজান পড়ছে। ফায়াজ দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসলো। সময় দেখার জন্য ফোন খুঁজতে বালিশের পাশ হাতরালো। সময় তখন একটা বেজে তিন মিনিট। ফায়াজ কনুই সোজা করে আবার শুয়ে পড়লো। শরীরটা একটু ভালো লাগছে। উঠে গোসল করে ঘর থেকে বের হলো। পরীর ঘরের দিকে যেতেই আমেনার কন্ঠ ভেসে এলো। আমেনা অনুনয়ের সুরে বলছে,
মা, দয়া করে একটু খাও। তোমার পছন্দের খাবার নাও। মা একটু খাও।

ফায়াজ কপালে ভাজ টেনে এগিয়ে গেল। পরীর ঘরের দরজায় দাঁড়ালো। আমেনা পরীর মুখের কাছে খাবার নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু পরী খাচ্ছে না। হয় আমেনার হাত সরিয়ে দিচ্ছে নয় নিজের মুখ সরিয়ে নিচ্ছে আর আমেনা অনবরত অনুরোধ করে যাচ্ছে। ফায়াজ দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আমেনা ফায়াজের দিকে করুন চোখে তাকালো। ফায়াজ যেয়ে বিছানার ওপর পাশে পরীর সামনে বসলো। পরী বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ পরীর দিকে হালকা ঝুকে বলল,
পরী খাচ্ছো না কেন? ক্ষিদে পায় নি?

পরী জবাব দিল না। সে মাথা নত করে বসে আছে। ফায়াজ আবার বলল,
পরী তো ভালো মেয়ে, লক্ষী একটা মেয়ে। সে সবার কথা শোনে তাই না?

আমেনা ফায়াজের কথায় স্বায় দিয়ে বলল, হ্যা। পরী মা তো খুব ভালো।

হ্যা। এখন দেখবেন পরী খাবে তাই না পরী? দেখি বড় একটা হা করো তো। বলে আমেনাকে ইশারা দিল। আমেনা ভাতের লোকমা পরীর মুখের সামনে নিতেই পরী বাম হাতে ঝামটা মেরে আমেনার হাত সরিয়ে দিল। আমেনার হাত থেকে কিছু ভাত বিছানায় পড়লো। আমেনা বাম হাতে ভাত গুলো তুলে অন্য বাটিতে রাখলো। ফায়াজ আরো ঝুকে পরীর মুখের কাছে গেল। গলা খাদে নামিয়ে বলল,
খেয়ে আমরা পুকুর ঘাটে যাবো। ঠিক আছে?

ফায়াজ সোজা হয়ে বসলো। পুকুর ঘাটের কথা বলে পরীকে সব করানো সম্ভব কিন্তু এখানে ফায়াজকে ভুল প্রমাণিত করে পরী ঠিক আগের মতোই বসে রইলো। ফায়াজ পুরোপুরিভাবে বিস্মৃত। পরী পুকুরঘাটের কথা শুনেও চুপ আছে কিভাবে? পরী কি শুনতে পেল না? ফায়াজ এবার উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল,
হ্যা আমারা পুকুর ঘাটে যাবো। পরী তুমি যাবে? পুকুর ঘাটে? তোমাকে পদ্মফুল এনে দিব। যাবে না?

ফায়াজের কথা খরচ হলো ঠিকই কিন্তু পরীর নড়চড় হলো না। ফায়াজ বুঝলো না পরীর হঠাৎ করে কি হলো। সে আমেনার দিকে তাকিয়ে বলল,
ওকে সকালের ওষুধ খাইয়েছিলেন?

হ্যা সাহেব।

ফায়াজ ফের পরীর দিকে ঘুড়লো। বিচলিত হয়ে বলল,
কি হয়েছে পরী? খাবে না কেন? খাবার পছন্দ হয় নি? অন্য কিছু খাবে? কি খাবে বলো আমি নিয়ে আসছি।

পরী তবুও চুপ। ফায়াজ কয়েক সেকেন্ড ভাবলো খাবার খেয়ে ওষুধ খেতেই হবে পরীকে। গতকাল দুবেলার ওষুধ বাদ পড়েছে। ওষুধ বাদ দেয়া যাবে না কোন মতে। এরপর বলল,
আচ্ছা এটা তোমাকে খেতে হবে না। আমি তোম্মার জন্য মজার খাবার নিয়ে আসছি।

বলে বিছানা থেকে নামতে যাওয়ার আগেই পরী ফায়াজের বাহুর শার্ট খামচে ধরলো। দ্রুত ধরার চেষ্টা করায় শুধু অনামিকা আর কনিষ্ঠা আঙ্গুলেই ধরতে পাড়লো। ফায়াজ পরীর দিকে তাকালো। পরীর মতিগতি কিছুই বুঝতে পাড়ছে না।
আমি যাব না?

পরী ফায়াজের দিকে তাকিয়ে নেই। সে তার এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে চারপাশে তাকাচ্ছে। হঠাৎ করে ফায়াজ বলে উঠলো,
পরী আমার হাতে খাবে? আমি খাইয়ে দিব তোমাকে?

পরী হ্যা বা না কিছু বলল না। তার দৃষ্টি স্থিরও হলো না কিন্তু যখন ফায়াজ তার মুখে খাবার তুলে দিল সে না-ও করলো না। চুপচাপ চিবিয়ে চললো মুখের খাবারটুকু।

_______
ফায়াজের সুস্থ্য হতে পুরো একদিন লেগে গেল। পূর্বাকাশে উদিত সূর্যের নমনীয় কিরণ চোখের পাতায় আচড় কাটতেই তন্দ্রা কাটলো ফায়াজের। চোখের কোণে তন্দ্রার শেষটুকু রেশ কাটিয়ে বিছানা ছাড়লো। খটখট শব্দে কাঠের জানালার পাল্লা খুলে বাহিরে দৃষ্টি ফেললো। আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে। জানালার পাল্লা খুলতেই একগুচ্ছ সূর্যালোক ফায়াজকে কোমল আলিঙ্গনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। নিজেকে বিলিন করে দিয়ে স্থির হলো। সূর্যোদয়কালে ধরনীর অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো ফায়াজ। জানালা থেকে সরে এসে চেয়ারের হাতলের উপর বাদামী রঙা শার্ট নিয়ে শরীরে জড়ালো। বক্ষের দুটো বোতাম লাগিয়ে ঘরের দরজা খুলে বাহিরে পা রাখলো। উদ্দেশ্য আজ সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা।

পুরো বাড়ি নিশ্চুপ। সচরাচর বাড়ির সকলে এই সময়ে ঘুম থেকে উঠে না। ফায়াজও না। আজ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে নি। ফায়াজের ধারনা ভুল হলো যখন দরজার সামনে আতর আলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। হলুদ আর গোলাপি রঙের মিশ্রণে লুঙ্গি আর সাদা ফতুয়া পড়া। ডান হাতে বাজারের ব্যাগ ভাজ করা।
ফায়াজকে আসতে দেখে বলল,
আরে সাহেব এত্ত সকালে উইঠা পড়ছেন যে আইজ?

ঘুম ভেঙ্গে গেল। আপনি বাজারে যাচ্ছেন?

হ সাহেব।

এত সকালে বাজার বসে?

আতর আলি চারপাশে তাকিয়ে বলল,
এইতো সাহেব এখন ধরেন বসতে শুরু হইবো। আমি যামু একটু পর। বাজারের পহেলা ভাগে সব তাজা পাওন যায়।
আতর আলি থেমে বললেন,
সাহেব, আপনে কই যান?

যাচ্ছি না কোথাও। আচ্ছা এই বাড়িতে কি একটাই রাস্তা?

আতর আলি বুঝলো না। সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করল, মানে?

ফায়াজ বাড়ির সামনের রাস্তার দিকে হাত ইশারা করে বলল,
মানে, এই বাড়ি থেক বের হওয়ার রাস্তা কি এটাই?

আতর আলি ঘাড় ঘুড়িয়ে রাস্তাটা দেখে নিল।
না সাহেব। রাস্তা তো আরো আছে কিন্তু সেই রাস্তায় চলাফেরা কম হয়।

কোথায় সেগুলো?

পুকুর পাড়ের পাশ দিয়া একটা আছে আর বাড়ির পিছ বরাবর দুইটা।

ফায়াজ সন্দিহানের সুরে বলল,
কিন্তু বাড়ির পেছনে তো জঙ্গল। এই রাস্তা কোথায় গিয়েছে?

একটা খাল এরপর অন্য গ্রামের রাস্তা।

ফায়াজ একবার তাকালো সেদিকে। আতর আলি জিজ্ঞাস করল,
সাহেব বাজারে যাইবেন?

না আপনি যান। আমি একটু আশপাশ ঘুরি।

আতর আলি মাথা কাত করে বলল,
আইচ্ছা সাহেব। তাইলে আমি যাই।

জ্বি।

ফায়াজ তাকিয়ে রইলো আতর আলির যাওয়ার দিকে। ফায়াজের মনে প্রবল ইচ্ছে জাগলো জঙ্গলের রাস্তার দিকে যাওয়ার। মনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে পা বাড়ালো জঙ্গলের দিকে।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here