#নীলকণ্ঠা
১৮।
ফায়াজ ক্রুদ্ধ চাহুনি নিক্ষেপ করলো শ্রাবণের দিকে। ফায়াজের চাহুনি অগ্রাহ্য করে নিজ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো শ্রাবণ। জিন্সের পকেটে দুহাত পুড়ে আগ্রহী কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,
কি হয়েছে ফায়াজ? তোমাকে এত উদ্বিগ্ন লাগছে, কোন সমস্যা?
ফায়াজ তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। শ্রাবণের বাক্য ধরনে মনে হচ্ছে সে উপহাস করে কথাটা জিজ্ঞাস করেছে। এক ধরনের বোকা মানুষ আছে যারা ইশারা ইঙ্গিত বুঝতে পারে না। তাদের সব কিছু ভেঙ্গে বুঝাতে হয় আর এক ধরনের ধূর্ত মানুষ আছে যারা সব কিছু বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকে। তারা বড্ড চতুর প্রকৃতির হয়। ফায়াজ তার কন্ঠে কঠোরতা ঢেলে বলল,
আমার বাবা একটা কথা বলতেন।
শ্রাবণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলো। ফায়াজ বলল,
যে জেগে জেগে ঘুমের ভান ধরে থাকে তাকে শত চেষ্টায়ও ঘুম থেকে তোলা যায় না।
শ্রাবণ পকেট থেকে হাত বের করে দুদিকে মেলে ওম ছেড়ে দাঁড়ালো। বলল,
তখন বললে তুমি পরীর জন্য চিন্তা করছিলে কিন্তু চিন্তা করার মতো কিছু তো দেখলাম না। তা তুমি কি নিয়ে চিন্তা করছিলে?
ফায়াজ চোয়াল শক্ত করে সরাসরি তাকালো শ্রাবণের চোখের দিকে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
সেটা বুঝার বোধশক্তি থাকা প্রয়োজন ছিল আপনার।
শ্রাবণ দৃষ্টি সরিয়ে পুকুরজলে তাকালো। রোদের আলোর টুকরোতে সোনালী হয়েছে জলের ক্ষানিকটা। সবুজ শ্যাওলা জন্মেছে পুকুরের কিনারায়। পুকুরের দিকে দু-এক কদম এগিয়ে গেল। তর্জনী আঙ্গুলে কানের পেছনে চুলকে বুকে হাত বেধে দাঁড়ালো। বলল,
হয়ত কিন্তু তুমি এত দিশেহারা কেন? পরীকে না পেয়ে মামা মানে মইনুর শেখও তো এত অস্থির হচ্ছে না।
কারণ, তিনি পরীর বাবা-ই না। বলেই থেমে গেল ফায়াজ। নিরবে শুকনা ঢোক গিললো। শ্রাবণ বাম ভ্রু উঁচু করে তাকালো। ফায়াজ চোখ সরালো। শ্রাবণ তার ঘাড় হালকা কাত করে সরু চোখে তাকালো। বলল,
অনেক কিছুই জানো দেখছি।
ফায়াজ কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। কখনও কখনও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরী হয়ে পড়ে এবং কখনও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কথার স্রোতে ফায়াজ কথাটা বলে বড্ড বেশি ভুল করে ফেললো তা এখন বুঝতে পারছে। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
গ্রামের মানুষ বলেছেন।
শ্রাবণ ঠাট্টার সুরে বলল,
হ্যা, দেখলাম গ্রামের মানুষের সাথে তোমার সখ্যতা ভালোই। কি যেন নাম? ওহ হ্যা, আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহর তোমার জন্য পাঠানো মাছ দেখলাম। বেশ বড় কিন্তু মাছটা।
ফায়াজের রাগের পরিমাণ বাড়ছে। শ্রাবণ এইসময়ে তার সাথে মশকরা করছে। ফায়াজের এখন ইচ্ছে হচ্ছে শ্রাবণের পেটানো খাড়া নাক বরাবর তার পুষ্ট হাতের ঘু/সিতে নাক ফা/টি/য়ে দিতে। ইচ্ছে থাকলেও সবসময় সব কিছু কথা যায় না। ফায়াজ পরিস্থিতির মেনে সব কিছু হজম করে নিল।
_______
মধ্যাহ্নভোজে কাতল মাছের বড় মাথা দেখেই পরী আনন্দে গদগদ। বারবার মাছের মাথার দিকে তাকাচ্ছে। সে এর আগে কখনই মাছের এত বড় মাথা দেখে নি। অথবা দেখেছে মনে নেই। খাবার ঘরের বড় টেবিলটায় বসেছে পাচঁজন। সকলের দৃষ্টিতে মইনুর শেখ ও শ্রাবণ মামা ভাগ্নে হলেও অগোচরে তাদের এক ভিন্ন সম্পর্ক বর্তমান। মইনুর শেখের পাশের চেয়ারে বসেছে শ্রাবণ আর শ্রাবণের পাশের চেয়ারে রেনুকা। এসের তিনজনের বিপরীতে বসেছে পরী আর ফায়াজ। ফায়াজ পরীর মুখে ভাতের লোকমা তুলে দিচ্ছে। পরীর কৌতুহলী চঞ্চল দৃষ্টি ফায়াযের চোখ এড়ায়নি।
নিশ্চুপ খাবার ঘরে শ্রাবণ শব্দ উচ্চারণ করলো মইনুর শেখের সূক্ষ্ম চোখ ইশারায়। ভূমিকা শুরুতে শ্রাবণ গলা খাঁকারি দিলো। সুমিষ্ট হেসে পরীকে মৃদু স্বরে ডাকলো।
পরীর চঞ্চল চোখ চারপাশ আওড়াতে-আওড়াতে শ্রাবণের দিকে তাকালো তবে বেশীক্ষণ তাঁকিয়ে রইলো না। শ্রাবনের ডাক যে সে শুনেছে ইশারা ইঙ্গিতে সেটা বুঝিয়ে দিল।
শ্রাবণ পরীর দিকে তাকিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ এক হাসি দিয়ে বলল,
বিকেলে আমার সাথে ঘুড়তে যাবে পরী?
ঘুড়তে যাওয়া মানে আনন্দের জায়গায় যাওয়া, আনন্দে সময় কাটানো। বন্দি বাড়ির মধ্যে থাকতে হবে না। বাহিরে যাওয়া যাবে। সকালে যেমন গিয়েছিল পুকুর ঘাটে। পরী কোনরূপ বিচার বিবেচনা ব্যতীত সম্মতিতে মাথা ঝাঁকালো। শ্রাবণ চওড়া হেসে আড়চোখে মইনুর শেখের দিকে তাকালো। তিনি বেশ মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছেন। আশেপাশের কোন খরব তার নেই, যেন টেবিলে একা বসে খাচ্ছেন।
মইনুর শেখের অভিজ্ঞ অভিনয়ে শ্রাবণ মাথা নামিয়ে মনে মনে হাসলো। একজন গুরুগম্ভীর মানুষ, পরিপক্ক অভিনেতা। তার মনে কি চলে সে কাউকে বুঝতে পর্যন্ত দেয় না। শ্রাবণ নিজ মনে হেসেই ভাতের লোকমা মুখে দিল।
শ্রাবণ তখনও জানে না তার ঠিক সামনে ফায়াজ কড়া চোখে তাকিয়ে আছে। খাবার থেমে যাওয়ায় পরী একবার প্লেটের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার ফায়াজের দিকে। আর ফায়াজ তাকিয়ে আছে শ্রাবণের হাস্যজ্জল চেহারার দিকে। পরী আবার তাকালো প্লেটের ভাতের দিকে। ভাবছে তার তো খাওয়া শেষ হয় নি তাহলে ফায়াজ তাকে খাওয়াচ্ছে না কেন? পরী তার অনামিকা, কনিষ্ঠা এবং বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ফায়াজের বাহুর টিশার্ট টেনে ধরলো। ফায়াজ ঘাড় ঘুড়িয়ে পরীর দিকে তাকালো। চোখে পড়লো পরীর মলিন মুখশ্রী। ফায়াজ হুস শব্দে নিশ্বাস ছাড়লো। কোমল হেসে পরীর মুখে ভাত তুলে দিল। রাগটাকে ভেতরে চেপে রেখে পরীর দিকে তাকিয়ে হাসি টেনে রাখলো।
_______
দুপুরের ভুঁড়ি ভোজের পর সবাই নিজেদের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তবে ফায়াজের মনে অন্য চিন্তা। পরীকে শ্রাবণের সাথে বাহিরে পাঠানো যাবে না। সেই চিন্তা নিয়েই গত পনেরো মিনিট ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারী করে চলছে।
ফায়াজ প্রতিবার-ই মইনুর শেখের ঘরের দরজা খোলা পেয়েছে। আজও তেমন। মইনুর শেখ তার বিলাসবহুল চেয়ারে আয়েশ করে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তিনি জেগে আছেন কিনা ফায়াজ বুঝতে পাড়ছে না। এসেছিল কড়া কথায় কিছু শুনিয়ে দিতে কিন্তু এখন দ্বিধায় পড়ে গেল। মুখ দিয়ে হাল্কা বিরক্তিসূচক শব্দ তুলে ঘর থেকে বের হতে নিলেই মইনুর শেখের কন্ঠ কানে এলো।
কিছু বলবে?
ফায়াজ তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে তাকালো। মইনুর শেখের তখনও চোখ বন্ধ। ফায়াজ কপালে ভাজ ফেললো। মইনুর শেখ এবার চোখ খুললেন। সোজা হয়ে বসে চেয়ারের হাতলে হাত রাখলেন। সরাসরি তাকালেন ফায়াজের দিকে। আবার জিজ্ঞাস করলেন,
কিছু বলবে?
ফায়াজের কপালের ভাজ মিলে গেল। ফায়াজ ঘরের ভেতর আরো দু কদম এগিয়ে এলো। বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে বলল,
আপনি পরীকে শ্রাবনের সাথে বাহিরে যাওয়ার অনুমতি কিভাবে দিতে পারেন?
কেন পারি না? মইনুর শেখের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর।
কারণ, এরপর ফায়াজ আর কিছু ভেবে পেল না। যেসব যুক্তি ভেবে এসেছিল সেটা একান্ত তার কাছে যুক্তিযুক্ত মইনুর শেখের কাছে নয়। সে যদি বলে শ্রাবণ ঠিক মানুষ না তাহলে মইনুর শেখ হয়ত বলবেন সে আমার বোনের ছেলে আমি তাকে খুব ভালো চিনি। অবশ্য ফায়াজ নিজেও শ্রাবণের খারাপ কোন দিক দেখে নি। পরীর সাথে দেখা করা বা পুকুর ঘাটে বসে থাকা খারাপ কিছু নয়। তার উপর সে পরীর ফুপ্পির ছেলে। পরীর ভাই। ফায়াজ মইনুর শেখের দিকে তাকালো।
তিনি বাম ভ্রু হালকা উঁচু করে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলল,
কারণ?
কারণ মানে কারন হলো ফায়াজের কথা গুলো এলোমেলো হয়ে গেল। ফায়াজকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়কে মইনুর শেখ উপভোগ করছেন, যদিও সেটা তার চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না।
কারণ পরী এখন আমার দায়িত্বে। সহসা ফায়াজ বলে উঠলো। মইনুর শেখ স্পষ্ট তাকালেন। নিজের কথায় যুক্তি খুঁজে না পেয়েও ফায়াজ তাতেই অটল রইলো। মইনুর শেখ বেশ গোপনীয়তা বজায় রেখে শ্বাস নিলেন। নিজস্ব ভঙ্গিমায় ভারী স্বরে বললেন,
সে তোমার দায়িত্ব তবে সেটা মাত্র কিছুদিনের জন্য আর আমার মেয়ে চিরদিনের জন্য। ওর ভালো মন্দ বিচার করার জন্য আমি আছি।
ফায়াজ নিরবে শুনছে। মইনুর শেখ আবার বললেন, সেসব না হয় বাদ দিলাম। তুমি নিজেই তো চাও পরী বাহিরে ঘুড়বে, আনন্দে থাকবে, ওর মানসিক প্রশান্তি বাড়াবে তাহলে এখন বাধা দিচ্ছো কেন? তুমিও তো অনেকবার ওকে বাহিরে নিয়ে গিয়েছিলে আমার বারন তো শোন নি।
ফায়াজ ভাবছে মইনুর শেখ একজন ধূর্ত মানুষ। কথার জাল বুনে ফায়াজকেই অপরাধি সাব্যস্ত করবে। ফায়াজ আর কিছু ভাবতে পারলো না। তার আগেই মইনুর শেখ বললেন,
নাকি এসবের পেছনে তোমার অন্য উদ্দেশ্য আছে?
ফায়াজ এবার সরু চোখে তাকালো। অনিচ্ছাকৃত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
কি বলতে চাচ্ছেন আপনি? আমার দ্বারা পরীর কোন ক্ষতি হবে?
আমি কিন্তু সেটা বুঝাই নি। মইনুর শেখের অনুত্তেজিত শান্ত কন্ঠ। মইনুর শেখের শান্ত কন্ঠস্বরে ফায়াজ সরু চোখে তাকালো। পৃঠিবীর সকল মানুষ থেকেই কিছু না কছু জানার আছে, শেখার আছে। আল্লাহ তা’আলা প্রতিটি মানুষকে বিশেষ গুণাবলীসহকারে সৃষ্টি করেছেন। যেমন মইনুর শেখের ধূর্ত বুদ্ধি এবং যে কোন পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা। ফায়াজ এখন পর্যন্ত মইনুর শেখকে উত্তেজিত অথবা রাগান্বিত দেখে নি।
ফায়াজ কথা ঘুড়ালো। বলল,
তারমানে আপনি পরীকে শ্রাবণের সাথে বাহিরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন?
মইনুর শেখ চেয়ারের হাতলে কনুই রেখে থুঁতনির নিচে হাতের উল্টো পিঠ ঠেকিয়ে বলল,
অবশ্যই।
_______
আব্দুল্লাহর চায়ের দোকানে তিন-চার জন মানুষের ছোট-খাটো ভীর জমেছে। তারা কিছু নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করছে। ফায়াজকে আসতে দেখে আব্দুল্লাহ বিশাল হাসি উপহার দিলো। বসা থেকে উঠে আপ্যায়িত ভঙ্গিতে বলল,
সাহেব ভালো আছেন?
ফায়াজ সৌজন্য হাসলো। বলল,
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি?
জ্বি সাহেব আল্লাহর রহমাতে ভালো আছি। এরপর ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল,
সাহেব বসেন বসেন।
ফায়াজ হাত নাড়িয়ে বলল,
ব্যস্ত হবেন না। বসছি আমি।
আব্দুল্লার দোকানে উপস্থিত মানুষের কৌতুহল দৃষ্টি আব্দুল্লা আর ফায়াজের দিকে। ফায়াজকে দেখে গ্রামের মনে হচ্ছে না। ফায়াজ আশেপাশে তাকিয়ে কাঠের ব্যাঞ্চে বসলো। আশেপাশের সকলের কৌতুহলী চাহুনি তার দৃষ্টি এড়ালো না। ফায়াজ লঘু হেসে বলল,
আপনার পুকুরের মাছ খুবই সুস্বাদু ছিল। ধন্যবাদ আপনাকে।
পরম আনন্দে আব্দুল্লার চোখ চকচক করে উঠলো। তার পরিশ্রম যেন স্বার্থ্যক।
চলবে…
®উম্মে কুমকুম