নীলকণ্ঠা পর্ব-১৯

0
1286

#নীলকণ্ঠা

১৯।
গুমোট পরিবেশে বয়ে চলছে শীতল হাওয়া। ধূসর মেঘে ঢাকা পড়েছে বিশাল আকাশটা। দীপ্তিমান চাঁদের আলো তার চারন ফেলতে পারছে না ধরনীতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে যখন চারপাশ ছেয়ে আছে তখন সেই রাজ্যের অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল কল্পনা- জল্পনায় ব্যস্ত ফায়াজ। রাতের দ্বিতীয় ভাগের শুরুর সময়। বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছেদ ঘটেছে। কোথায় যেন বিদ্যুৎ তারের উপর গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়েছে। অনেকক্ষন, কতক্ষন জানা নেই। স্থির ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজ। মানুষ যখন অন্যমনস্ক থাকে তখন তার সময়ের হিসাব ঠিক থাকে না। বেশ খানেক মশা উড়ছে। কানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভনভন শব্দ করছে। মশা কি সমসময়ই আওয়াজ করতে করে উড়ে নাকি শুধু কানের পাশ দিয়ে উড়ার সময়ই শব্দ তোলে?

কি ব্যপার লেখক সাহেব? এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছো যে?

ফায়াজ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে, নিজের মুখের উপর ধরে রেখেছে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট। ঘুটঘুটে কালো আঁধারের মাঝে শুধু শ্রাবণের মুখমণ্ডল দৃশ্যমান। ফায়াজ সামনে তাকালো। এই মুহূর্তে তাঁর কোনো ইচ্ছে নেই শ্রাবণের সাথে কোন প্রকার কথায় জড়ানোর।

প্রশ্নের জবাব না পেয়ে শ্রাবন এগিয়ে গেল। ফোনের ফ্লাশ লাইট বন্ধ করে যেয়ে দাঁড়ালো ফায়াজের পাশে। ফায়াজ ঠিক আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ আবার প্রশ্ন করলো,

তোমার অন্ধকার পছন্দ নাকি অন্যকে অন্ধকারে রাখতে?

ফায়ার গম্ভীর চোখে তাকালো। তার গাম্ভীর্য, রোষাবিষ্ট মুখটা অন্ধকারেই মিলিয়ে রইল। শিরশির করা বাতাসগুলো শার্টের কাপড় ভেদ করে শরীরে লোমকূপে ঢুকছে। ফায়াজ দৃষ্টি ফেরালো। শ্রাবণ মিটমিট করে হাসছে। ফায়াজের আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে হলো না। শ্রাবণ যখন বুঝল ফায়াজ চলে যাবে তখনই সে আবার প্রশ্ন করল,

লেখকরা নাকি লেখালেখি ছাড়া থাকতে পারে না কিন্তু এখানে এসে থেকে তোমাকে একবারও লেখালেখি করতে দেখলাম না যে?

ফায়ার যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল কিন্তু শ্রাবণের প্রশ্ন শুনে থেমে গেল। শ্রাবণের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,

আমি আমার লেখালেখি লোক দেখিয়ে করি না। আমার লেখালেখি একান্ত আমার। কাউকে দেখানোর জন্য আমি লিখি না।

শ্রাবণ ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে নিজের মুখের উপরে ধরল। ফাইয়াজের কাঁধে হাত রেখে বলল,

আরে ব্রো এভাবে রেগে যাচ্ছ কেন? আমি তো জাস্ট এমনি বললাম।

ফায়াজ নিরস কন্ঠে বলল,

আমার ঘুম পেয়েছে এখন ঘুমাতে যেতে হবে।

শ্রাবণ ফায়াজের কাঁধ ছাড়েনি। কাঁধে হাত চেপে বললো,

যাবে তো ব্রো। আসো একটু গল্প করি ।

ফায়ার না বোধক মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাবে তার আগে শ্রাবণ তাকে থামিয়ে দিলো। বলল,

আসো আসো। নো এক্সকিউজ।

ফিরতি জবাবে ফায়াজ আর কিছু বলল না। শ্রাবণ ফাইয়াজের কাঁধ ছেড়ে দাড়ালো। ফোনের ফ্লাশ লাইট বন্ধ করে দিল। ফোনের ফ্ল্যাশ বন্ধ করতেই ফের ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারপাশ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

শ্রাবণ বলল,

আচ্ছা, তোমার লেখালেখি শুরু হয় কিভাবে? আই মিন কবে থেকে?

আমি আমার পার্সোনাল কথা কারো সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছুক নই।

তুমি এভাবে নিচ্ছো কোন কথাটা? সব লেখকের কাছে তো প্রথম প্রশ্ন এটাই হয়ে থাকে।

আমি নিজেকে এত বড় লেখক মনে করি না যাকে প্রশ্নটা করা যাবে।

শ্রাবণ দুঠোট চেপে শব্দ করে শ্বাস নিয়ে নিশ্বাস ছাড়লো। এরপর বলল,

কয়টা বই বের হয়েছে তোমার? ফরজের আগেই শ্রাবণ আবার বলল,

এটা বলা যাবে নাকি এটাও পার্সোনাল?

একটা বই বের হয়েছে।

শ্রাবণ বলল,

নাম আঁধারে তুমি। বলেই হঠাৎ হাসতে হাসতে বললো,

সেখানেও আধার মানে অন্ধকার। আচ্ছা, তোমার কি অন্ধকার পছন্দ?

ফায়ার এক শব্দে উত্তর দিল, হ্যা।

অন্ধকার কাদের পছন্দ জানো?

ফায়াজ কিছু বলল না। শ্রাবণ বলল,

অন্ধকার তাদের পছন্দ যারা পাপ লুকাতে চায়।আলোতে পাপ লুকানোর সম্ভব নয়।

ফায়ার ভ্রু কুচকালো। শ্রাবণ এসব কথা বলছে কেন? কি পাপ লুকালোর কথা বলছে? শ্রাবনকি ফায়াজকে বোঝাচ্ছে? ফাইয়াজ যখনই জিজ্ঞাসা করবে তখনই শ্রাবণ বলল,

জাস্ট কিডিং ব্রো।

ফায়াজ এবারে আর চুপ থাকতে পারলো না নিজের চোয়াল শক্ত করে কটমট করে তাকিয়ে বলল,

সব সময় সব পরিস্থিতিতে সব কিছু নিয়ে মজা করা আমি পছন্দ করিনা।

ফাইয়াজ আর সেখানে দাঁড়ালো না অন্ধকারের মাঝে হনহনিয়ে চলে গেল বাড়ির ভেতরে।

_______
ফায়াজ কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বের হচ্ছিল তখন দেখতে পেল মইনুর শেখ বাইরে দরজার দিকে যাচ্ছেন। তোকে পরে কল দিচ্ছি বলে ফোন পকেটে পুরে মইনুর শেখের দিকে এগিয়ে গেল। পিছন থেকে ডাক দিল,

শুনুন।

মইনুল শেখ পেছনে ফিরে তাকালেন। ফায়াজ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। ফায়াজকে জিজ্ঞাস করল,

কিছু বলবে?

আপনার সাথে কিছু কথা ছিল?

এখনই বলাটা খুব জরুরী?

আপনি কি খুব ব্যস্ত?

মইনুর শেখ পাঞ্জাবির হাতা উঠিয়ে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলেন। বললেন,

পনেরো মিনিটে বলতে পারলে বলো নয়তো পরে শুনব।

পাশের গ্রামে আমার এক বন্ধুর বিয়ে। আমার সেখানে যেতে হবে।

মইনুর শেখ চোখ ছোট করে তাকালেন। বললেন,

হ্যাঁ যাবে, তো?

ফায়াজ কোন প্রকার ভনিতা ছাড়াই বলব,

আমি চাচ্ছি পরীকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে।

ফায়াজের কোন কথায় মইনুর শেখের আগ্রহ না থাকলেও এ কথাটা শুনে তার আগ্রহ হলো। তিনি সরু চোখে তাকালেন ফায়াজের দিকে। জিজ্ঞাস করলেন,

মানে বুঝলাম না। সেখানে পরীর ঠিক কি কাজ? আর তাছাড়া তুমি কি পরীর মানসিক অবস্থা নিয়ে মশকরা করছ?

একদমই না। আমি ওর ব্যাপারে একজন ডক্টরের সাথে কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন এসব অনুষ্ঠানে গেলে পরীর মানসিক অবস্থার অবনতি হবে না বরং আরও উন্নতি হবে। সে যত মানুষের সাথে মিশবে ততই তার জন্য ভালো এবং আশা করছি আপনি অবশ্যই এটা চাইবেন পরীর যেন মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়।

মইনুর শেখ ফায়াজের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করে ওকে কিভাবে তোমার সাথে একা থাকবো ছাড়বো?

ফায়ার হালকা ভ্রু উচিয়ে মইনুর শেখকে পর্যবেক্ষণ করল। তিনি ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন সেটা ধরার চেষ্টা করলো। তীক্ষ্ণ ও সরু বুদ্ধির মানুষের সাথে তর্কে না জড়িয়ে বুদ্ধির সাথে কথা বলতে হয়। ফায়াজ বলল,

আমি এখানে যতদিন আছি আপনার কি একবারও মনে হয়েছে আমি পরীর কোন খারাপ চাই?

মইনুল শেখ নিজ মনে হাসলেন। থুতনির শুভ্র রঙা দাড়িতে হাত চুলকে বললেন,

যদ সব চোখে দেখা যেত তাহলে দুনিয়াতে ভালো রুপি খারাপ মানুষের অসস্তি থাকতো না।

আমি আপনার থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেছি এই জন্য অনুমতি নিচ্ছি। যদি আপনি অনুমতি দিন আমি পরীকে নিয়ে যাব কিন্তু আপনি যদি অনুমতি না দিন তাহলেও আমি পরীকে আমার সাথে নিয়ে যাব।

মইনুর শেখেত ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ পড়ল।
কি বলতে চাচ্ছো তুমি?

আমার কথা শেষ, আপনার হাতে অতিরিক্ত আরো দশ মিনিট বাকি।

কিন্তু আমি পরীকে তোমার সাথে একা ছাড়বো না। পরীকে যদি যেতে হয় তাহলে শ্রাবণও যাবে তোমাদের সাথে।

মিস্টার শ্রাবণ কেন আমাদের সাথে যাবেন?

কারন আমি তোমাকে ভরসা করি না।

ফায়াজ বুকে হাত বেঁধে দাঁড়ালো। বলল,

আমার দ্বারা যদি পরীর কোন ক্ষতি হয় তাহলে আমার দ্বারা তোর মিস্টার শ্রাবণেরো ক্ষতি হতে পারে। তাহলে তার প্রতিরক্ষার জন্য আপনি আর কাকে পাঠাবেন।

শ্রাবণ তার প্রতিরক্ষা নিজে করতে পারে। অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন নেই তার।

ফায়াজ ব্যঙ্গ হাসলো।
আচ্ছা দেখা যাক সে কতটুকু তা প্রতিরক্ষা করতে পারে।

_______
পরী।

মেলায় ফায়াজের কিনে দেয়া কাঠের গোলক হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছে পরী। গোলকটাকে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছে। গোলকের উপর ফুলের কারুকার্যে আঙ্গুল বুলাচ্ছে। ফায়াজ পরীর দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পরীকে ডাক দিতেই পরী তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুড়ালো। ফায়াজ সুন্দর হাসি টানলো। এগিয়ে বিছানায় এসে বসলো। পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাস করল,

কি করছো পরী?

পরী হাতের গোলকটা তুলে দেখালো।

ফায়াজ হাসি প্রশস্ত করলো। পরী সুস্থ্য হয়ে উঠছে। ফায়াজ যা চাচ্ছিল সেভাবেই চলছে। ফায়াজ পরীর মাথা থেকে হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলের উপর থেকে তেলের বোতল নিয়ে ফিরে এলেন পরীর কাছে। বিছানায় পরীর পেছনে উঠে হাটু গেড়ে বসে পরীর মাথায় তেল দেয়া শুরু করলো। পরম যত্ন এবং মমতায় পরীর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে ফায়াজ।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here