#নীলকণ্ঠা
২৩।
ফায়াজ যেই ঘরে শুয়েছে সেই ঘরের ফ্যান ঘড়ঘড় শব্দ করে। ফায়াজের ঘুম আসছে না। এত শব্দে কি ঘুম আসে? ফায়াজ কিছুক্ষন বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে বসে। ফ্যানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে ফ্যান বন্ধ করে এলো। এবার হলো আর এক বিপত্তি। ফ্যান বন্ধ করার কয়েক মিনিটের মাথায়ই ফায়াজের শরীর ঘামতে শুরু করল। কিছুক্ষনের মধ্যেই শরীর ঘেমে টিশার্ট শরীরের সাথে মিশে রইলো। রাত প্রায় একটার বেশি। বাড়ির সবাই যে যার ঘরে ঘুমিয়েছে। এই সময়ে ঘর বদল করা একটা ঝামেলা। ফায়াজ হাতের উল্টা পিঠে ঘর্মাক্ত কপাল মুছে জানালা খুলে দিল। বাতাসের বালাই নেই। চারপাশ সুনসান নিরবতা, কেমন থম মেরে আছে।
বাড়ির বাহিরে লাল, নীল, হলুদ বাতি জ্বলছে। এক রঙের বাতি নিভছে আবার অন্য রঙের বাতি জ্বলছে। কখনও দু রঙের বাতি একসাথে জ্বলছে একসাথে নিভছে। প্যান্ডেলের কাজ শেষ। ফায়াজের ঘরের জানালা দিয়ে প্যান্ডেলের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। বাড়ির চারদিকের বড় বড় গাছের ছায়া। ফায়াজ ছোট একটা নিশ্বাস ছেড়ে জানালা থেকে সরতে নিলেই হঠাৎ জানালার পাশে ছায়া সরে যাতে দেখেই ফায়াক দাঁড়িয়ে পড়লো। ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেল জানালার কাছে। জানালার গ্রিল ধরে আরো এগিয়ে বাহিরে তাকালো। ছায়ার শেষাংশ দেখা গেল। বাড়ির ভেতর ঢুকছে। ফায়াজ সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। এত রাতে কে বাড়িতে ঢুকছে? ফায়াজ বাহিরে যেয়ে দেখবে কিনা ভাবলো। ঘামে শরীর ভিজে জবজব করছে। ফায়াজ আবার ফ্যান ছেড়ে দিল। ফ্যান ছেড়ে বিছানায় বসতেই পিতলের কিছু পড়ে ঝনঝন করে উঠলো। ঝনঝন শব্দটা বেশিমেয়াদী ছিল না, মাঝ পথেই যেন কেউ শব্দটা গলা চেপে থামিতে দিল।
ফায়াজের এবার সন্দেহ হলো। পাশের ঘরে শুয়েছে পরী। পরীর সাথে আছে যুথি। নতুন জায়গায় পরীকে একা রাখতে চায় নি তাই এই ব্যবস্থা। ফায়াজ কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করলো। কিন্তু কোন শব্দ কানে এলো না। তবুও নিশ্চিত হতে ফায়াজ দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিতেই মুহূর্তে ঘর আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ফায়াজ পা টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে পাশের ঘরের দিকে গেল। দরজা খানিকটা ফাকা করা। ফায়াজ উকি দিল ঘরে। ঘরে হাল্কা রঙের একটা বাতি জ্বলছে। ঝাপসা দেখা যাচ্ছে সব। বিছানার পাশে চোখ পরতেই ফায়াজের ভ্রু কুঁচকে গেল। ফায়াজ যথা সম্ভব চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। পরীর দিকের বিছানার পাশে কারো অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ফায়াজের মস্তিষ্ক তড়িৎবেগে সচল হয়ে উঠলো। বেশি দেড়ি করলে ঘোর বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে।
ফায়াজ দ্রুত ঘরে বাতি জ্বালিয়ে অবয়বের কাছে গেল। ঘটনা ঘটতে এত কম সময় পেয়ে অবয়ব যেন নড়তে ভুলে গেল। ফায়াজ কাছে যেতেই বুঝতে পেল সে কোন ছেলে। রাগে ফায়াজের শরীর রি রি করছে। এখানেও কেউ পরীর ক্ষতি করার চেষ্টা করছে? নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। জঘন্য এক গালি দিয়ে শার্টের পেছনের কলার ধরে দাড় করালো। নিজের দিকে ফিরিয়ে ঠাটিয়ে এক চ/ড় বসালো শ্যামলা গালে। চ/ড় খেয়ে ছেলেটা গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ দু হাতে ছেলেটির কলার চেপে ধরল। উঁচু গলায় জিজ্ঞাস করল,
কে পাঠিয়েছে তোকে? কার কথায় পরীর কাছে এসেছিস? মইনুর শেখ পাঠিয়েছে তোকে? বল।
ঘুমের মাঝে এত কাছ থেকে উঁচু গলার আওয়াজ শুনে যুথির ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার ঘরে কিছু চলছে বুঝতে একটু দেড়ি হলো। সে ঘুম চোখে চেয়ে দেখলো ফায়াজ কারো কলার চেপে তাকে মা/র/ছে। যুথির মস্তিষ্ক যখন কাজ করতে শুরু করলো সে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তার ঘরে মা/রা/মা/রি হচ্ছে। ফায়াজ কাউকে মা/র/ছে। যুথি তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে পরলো। অশান্ত কন্ঠে ফায়াজকে জিজ্ঞাস করল,
ভাইয়া উনি কে? আপনি মা/র/ছেন কেন? কি হয়েছে?
রাগে ফায়াজের মুখ লাল হয়ে গেল। ঘর্মাক্ত কপালে চুল এসে নিজেদের মতো জায়গা করে নিয়েছে। ফায়াজ ছেলেটার নাক বরাবর ঘু/ষি দিতেই ছেলেটা নাকে হাত চেপে মা গো বলে আর্তনাদ করে উঠলো। নাকের ব্যথায় চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। ছেলেটার কন্ঠ শুনে আঁৎকে উঠলো যুথি। ফায়াজ ছেলেটাকে ধরলেই যুথি ফায়াজের বাহু টেনে ধরে। অস্থির হয়ে বলে,
ভাইয়া ছাড়ুন। ছাড়ুন ওকে।
ফায়াজ ছাড়লো না। কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
ও কার কথায় এখানে এসেছে জানতে হবে আমাকে। এই তোকে কে পাঠিয়েছে বল।
আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আমি… ছেলেটি কন্ঠ খুবই দুর্বল শোনালো।
ফায়াজ চেঁচিয়ে উঠলো,
বল তোকে কে পাঠিয়েছে? পরীর কাছে কেন এসেছিস? বল।
সুনসান নিরব পরিবেশ মুহূর্তের মধ্যে আলোড়িত হয়ে উঠেছে। বাড়িতে মানুষে ভরপুর। অনেকে ঘরে বিছানায় শুতে পারে নি। তারা বসার ঘরে, খাবার ঘরে মেঝেতে কেউ বা সোফায় শুয়েছে। হঠাৎ মধ্যরাতে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে কয়েকজনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘরের বাহিরে কতক মানুষের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। নিজের শক্তিতে যখন ফায়াজকে থামাতে পারলো না তখন যুথি কেঁদে দিল। দুজনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলো। যুথির ঘরের ভেতর উকি দিতেই সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। মধ্যরাতে এসব দেখবে কেউ আশা করে নি। যুথির তিনজন মামাতো ভাই এসে ফায়াজের হাতের মুঠো থেকে ছেলেটার কলার আলাদা করলো। ফায়াজকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। সে বার বার ছুটে যাচ্ছে ছেলেটার দিকে। যুথি ছেলেটার কাছে যেয়ে শাওন শাওন করছে আর কাঁদছে। যুথির আর ওর এক মামাতো ভাই শাওনকে বিছানার একপাশ বসালো। শাওনের অবস্থা বেগতিক। সে হাপাচ্ছে। এসবের মাঝে অনেকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জয়, জিসান আরো কয়েকজন ঘরে এলো। জয় এগিয়ে গেল ফায়াজের কাছে। ফায়াজ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্ঠা করছে। জয় জিজ্ঞাস করলো,
কি হয়েছে এখানে? ফায়াজ কি হয়েছে?
রাগে ফায়াজের কপালের রগ ভেসে উঠেছে। ফায়াজ কোন শব্দ করছে না। জিসান যেয়ে যুথিকে বলল,
কি হয়েছে বলবি তো?
যুথি ওড়না দিয়ে নাক আর চোখের জল মুছে কোন মতে বলল,
আমি জানি না। ঘুম ভেঙ্গে দেখি ফায়াজ ভাইয়া শাওনকে মা/র/ছে।
জয় শাওনকে জিজ্ঞাস করল,
শাওন কি হয়েছে? আর তুমি কখন এসেছো?
শাওন হাপাচ্ছে। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। জিসান আবার জিজ্ঞাস করায় শাওন বলল,
আমি জানি না ভাইয়া। আমি কিছুক্ষন আগে এসেছি। যুথিকে সারপ্রাইজ দিব বলে। ফায়াজকে ইশারা করে বলল, হঠাৎ উনি এসে আমাকে মা/র/তে শুরু করলো।
জয় ফায়াজকে ছাড়িয়ে নিল। জিজ্ঞাস করল,
তুই ওকে মা/রছিলি কেন? কি করেছে ও?
ফায়াজ চোয়াল শক্ত করে উচ্চ কন্ঠে বলল,
ঘুমের মধ্যে ও পরীর অসভ্যতামি করছিল।
ফায়াজের কথা শেষ হতেই শাওন বলে উঠল,
না না আমি এমন কিছুই করি নি।
ফায়াজ বলল,
ওহ তাই না? তাহলে পরীর পাশে কি করছিলি?
আমি আমি তো যুথিকে খুজছিলাম।
তুই যুথিকে খুজছিলি পরীর পাশে?
পরী কে? আমি চিনি না।
এই মিথ্যা বলবি না। বলে ফায়াজ এগিয়ে যেতেই জয় ফায়াজের বাহু টেনে থামালো। বলল,
শান্ত হ ফায়াজ। ওর তো পরীকে চেনার কথা না। ও যুথির হাজব্যান্ড।
যুথির হাজব্যান্ড শুনেই যেন ফায়াজের মস্তিষ্ক শিথিল হয়ে গেল। আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকালো জয়ের দিকে। বলল, কি?
ও শাওন। আমাদের যুথির হাজব্যান্ড। ওদের আকদ হয়েছে চার মাস হলো।
ফায়াজ কথা বলার ভাষা খুঁজে পেল না। সে বাম হাতের দু আঙ্গুলে কপাল চেপে ধরলো। সে কি পাগল হয়ে গেছে। সব যাচাই না করেই আক্রমণ করে বসলো। ফায়াজ আড়চোখ তাকালো শাওনের দিকে। যুথির ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুচছে। গালের পাশে, নাকের আগা লাল হয়ে আছে। ফায়াজ থা/প্প/ড় আর ঘু/ষি মেয়েছিল। জয় ফায়াজের ভুলটা ধরতে পেরেছে এবং ফায়াজ কেন এত উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল সেটাও বুঝেছে। জয় ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে শিপন বলে কাউকে ডাক দিয়ে বলল,
ফ্রিজ থেকে বরফ আর এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।
_______
পরিবেশটা ঠান্ডা হলো। সকল ভুল বোঝা বুঝির সমাপ্তি ঘটলো। ফায়াজ নিজের কাজে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাইলো। শাওন খুব সরল মনের মানুষ। মানুষের মাঝে মিশে যায় দ্রুত। যুথি ওড়না দিয়ে বরফ পেঁচিয়ে শাওনের গালে ডলছে। শাওন ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
ভাই, আপনি অনেক জোড়ে মা/রে/ন।
ফায়াজ লজ্জা নিয়ে হাসলো একটু। যুথি বরফ ডলতে ডলতে বলল,
সারপ্রাইজ দিবে আর?
আজ তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে যেয়ে আমিই সারপ্রাইজ হয়ে গেছি, বলে শাওন শব্দ করে হাসলো। এরপর মনে হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
ওহ। যার জন্য এত কিছু সে কই?
যুথি বলল, কার কথা জিজ্ঞাস করছো।
কি যেন নাম? ওহ হ্যা পরী।
জয় বিছানায় ইশারা করে বলল,
ওই যে তোমার পেছনে ঘুমিয়ে আছে।
শাওন ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকালো। পরী পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। শাওন মিছে মিছে আফসোসের সুরে বলল,
বোন তোমার জন্য এত মার খেলাম। একটু সহানুভূতি দেখালা না আমাকে।
চলবে…
®উম্মে কুমকুম
(আসসালামু আলাইকুম, পেইজের রিচ কমে গিয়েছে প্রচুর। তাই সবার টাইমলাইনে গল্প যাচ্ছে না। অনুগ্রহপূর্বক যারা গল্প পড়বেন সাড়া দিবেন। গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।)