নীলকণ্ঠা পর্ব-২৪

0
1190

#নীলকণ্ঠা

২৪|
মইনুর শেখের অস্থিরতা কমার বদলে আরো বেড়ে গেল। প্রথমে অস্থির ছিলেন শ্রাবণের সাথে কথা বলতে না পেড়ে আর এখন অস্থির হয়ে আছেন শ্রাবণের সাথে কথা বলে। তার চিন্তা চেতনা শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। ভাবনারা ছুঁয়েছে আকাশ। প্রচুর অস্থিরতার দরূন ঘেমে উঠছেন বার বার। দুশ্চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। মইনুর শেখ বিছানায় হাত চেপে মাথা নামিয়ে বসে আছেন। তার অস্থিরতা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রেনুকা টের পাচ্ছে না। মইনুর শেখ মাথা তুললেন পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে কপাল, নাক, চোখের নিচের ঘাম মুছে নিলেন। ফোন করলেন জাফরকে। মইনুর শেখের গলা কাঁপছে। ফোনের ওপাশ থেকে জাফরের আওয়াজ এলো। তিনি সুমিষ্টস্বরে সালাম দিল। মইনুর শেখের সব শব্দ যেন কণ্ঠনালীতে এসে আটকে গেল। ফোনের ওপাশ থেকে জাফর হ্যালো হ্যালো করছে। মইনুর শেখ ঢোক গিলে গলা পরিষ্কার করে নিজেকে স্বাভাবিক করে সালামের উত্তর দিল। জাফর হাস্যজ্জল কন্ঠে বলল,

ভাইজান কেমন আছেন? অনেক দিন পর কল দিলেন।

মইনুর শেখ জবাব দিলেন না। সরাসরি প্রশ্ন করলেন,

ফায়াজকে কিভাবে চেন তুমি?

হঠাৎ ফায়াজের নাম শুনে জাফর চিনতে পাড়লো না। প্রশ্ন করল,

জ্বি?

মইনুর শেখ গুরু গম্ভীর কন্ঠে আবার জিজ্ঞাস করলেন,

ফায়াজ আহমেদকে কিভাবে চেন তুমি? কোথায় পরিচয় তার সাথে তোমার?

জাফরের এবার ফায়াজের কথা মনে পড়লো। যে এখন মইনুর শেখের বাড়িতে অবস্থান করছে। জাফর হালকা সুরে টেনে বলল,

ওহ ফায়াজ। ওর সাথে বই মেলায় দেখা হয়েছিল। তখনই পরিচয়। ওর বই কিনেছিলাম আমি।

ফায়াজের ব্যপারে কি কি জানো? থাকে কোথায়? কে কে আছে পরিবারে?

জাফর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলল,

এত কিছু তো জানি না ভাইজান।

মইনুর শেখ বিরক্তি কন্ঠে বললেন,

তাহলে কি জানো? কোথায় থাকে জানো?

জাফর কন্ঠ নামিয়ে বলল, জ্বি না ভাইজান। পরক্ষনেই প্রশ্ন করলো,

কিন্তু এসব জিজ্ঞাস করছেন কেন ভাইজান?

মইনুর শেখ এবারও জাফরের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। প্রশ্নের বিপরীতে কঠিন কন্ঠে বললেন,

জানা নেই শোনা নেই যে কাউকেই আমার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলে? জানো না আমার বাড়ির পরিস্থিতি? অপরিচিত একজনকে কি করে এখানে পাঠালে তুমি?

জাফর মিনিমিনিয়ে বলল,

অপরিচিত না, ফায়াজ তো আমার পরিচিত।

কেমন পরিচিত? তার সম্পর্কে কিছু জানো না, দু একদিনের সাক্ষাতকারে এত বিশ্বস্ত হয়ে গেল?

ভাইজান,ফায়াজ আমাকে কাজে সাহায্য করেছিল। ছেলেটা ভালো। কিন্তু কি হয়েছে?

মইনুর শেখ এবার না থাকতে পেড়ে বলে ফেললেন,

ফায়াজ এখানে পরীর জন্য এসেছে।

মইনুর শেখের বলতে দেড়ি কিন্তু জাফরের প্রতিক্রিয়া করতে দেড়ি হয় নি। তিনি বিদ্যুৎ চমকের মতো উচ্চ স্বরে বলল,

কি? কি বলছেন ভাইজান? পরীর জন্য? মানে পরীর খবর সে কি করে জানলো?

জানি না আমি। মইনুর শেখ চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিলেন।

জাফর অশান্ত কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,

এখন কি করবেন ভাইজান? পুলিশ?

মইনুর শেখ চুপ রইলেন খানিকক্ষণ। জাফর আবার জিজ্ঞাস করল,

ফায়াজ কি করছে এখন?

বাড়ি নেই। পরীকে নিয়ে কোন বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছে।

কি বলেন ভাইজান? আপনি পরীকে ফায়াজের সাথে একা ছাড়লেন! জাফরের কন্ঠে বিস্ময়।

না। একজনকে পাঠিয়েছি। মইনুর শেখ বিস্তারিত কিছু বললেন না। ক্ষানিকখন চুপ থেকে ফোন রেখে দিলেন।

__________
সকাল থেকেই বিয়ে বাড়ির সবার মুখ কিছুটা থমথমে। গত রাতের ঘটনা না চাইতেও সকলের সামনে চলে এসেছে। সামনা সামনি কেউ কিছু না বললেও অগোচরে কেউ কথা শুনানো ছাড়ছেন না। জয়ের মামি তো বলেই ফেললেন,

ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা! বাড়ির জামাইয়ের গায়ে হাত তোলে।

পরীর এতে কিছু যায় আসে না। তার এলোমেলো মস্তিষ্ক কথা গুলো গুছিয়ে অর্থ বের করতে পাড়ে না। সে শুধু তাকিয়ে থাকে। সে শান্ত, অব্যাকুল, অবিচলিত। কারন তার পাশে ফায়াজ আছে। পরী ফায়াজের বাহুতে হাত পেঁচিয়ে বসে আছে। নামাজের পর পর সবাই রওনা দিবে মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ফায়াজকে দেখে জয় এগিয়ে এলো। পরীর দিকে তাকিয়ে দেখে সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। জয় ফায়াজের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,

ও বাড়ি যাবি কখন?

একটু পরে রওনা দিব।

আচ্ছা। আমি গাড়ি বলে রেখেছি। যে কোন সমস্যায় আমাকে বলবি।

ফায়াজ মৃদু হাসলো। এই হাসিতে বন্ধুর প্রতি বন্ধুর কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠলো। ফায়াজ বলল,

খুব বিরক্ত করছি রে তোকে। তোর এই বিশেষ দিনগুলোতেই তোর আমার কথা চিন্তা করতে হচ্ছে।

জয় ফায়াজের কাঁধে হালকা চাপড় মেরে বলল,

আরে ধুর কি বলিস। তুই আমার যা উপকার করেছিস তার সামনে এসব কিছুই না।

ফায়াজ প্রশস্ত হাসলো। জয় বলল,

ঢাকা যাবি কবে?

ফায়াজ পরীর দিকে এক নজর চেয়ে নিয়ে বলল,

নিশ্চিত জানি না। দেখি আল্লাহ কবে নেয়।

ঢাকা গেলে দেখা করবি কিন্তু।

অবশ্যই।

__________
জয়ের গ্রাম পাড় হয়েছে ত্রিশ মিনিট। রাস্তা বাকি আর কিছুক্ষনের। পরী ফায়াজের পাশে বসে আছে। ফায়াজ পরীর দিকে তাকালো। পরীর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছে সে। পিচঢালা রাস্তা থেকে কাচা রাস্তায় নেমেছে গাড়ি। প্রচুর গাছগাছালি রাস্তার দু ধারে। গাড়ি এসে থামলো মরীচাধরা বড় পুরোনো গেইটের সামনে। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ফায়াজের দিকে তাকালো। বলল,

স্যার এইখানে?

ফায়াজ গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। গেইটের ওপরপাশে মাটির সরু রাস্তা। ফায়াজ ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যা। এখানেই।

ফায়াজ গাড়ি থেকে নেমে পরীকে নামালো। গাড়ির সামনের দিকে যেয়ে হালকা ঝুকে ড্রাইভারকে বলল, আমার ফোন নাম্বার আছে না আপনার কাছে?

জ্বি স্যার।

কোন সমস্যা হলে কল দিবেন।

জ্বি স্যার।

ফায়াজ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পরীর হাত মুঠোয় নিয়ে পা বাড়ালো গেইটের দিকে। গেইটে তালা নেই। ফায়াজ গেইটে ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে গেলো। পরী চারপাশে, উপরের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ পরীকে নিয়ে কিছুদূর যেতেই ভেতর থেকে একজন বয়স্ক লোক ডৌড়ে এলো। হাপাতে হাপাতে জিজ্ঞাস করল,

এই কারা আপনেরা? কই যান? খাড়ান খাড়ান।

ফায়াজ দাঁড়িয়ে পড়লো। বয়স্ক লোকটা হাফ হাটা একটা শার্ট আর ফ্যাকাসে সবুজ রঙের একটা লুঙ্গি পড়ে আছে। ডৌড়ে আসার কারনে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন।

কারা আপনেরা? কই যান? বলতে বলতে লোকটা পরীর দিকে তাকালো। পরীর দিকে তাকাতেই ভ্রু কুচকালেন। কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। লোকটি পরীর থেকে চোখ সরিয়ে ফায়াজের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,

আপনেরা?

ফায়াজ এবার মুখ খুললো। পরীর দিকে ইশারা করে লোকটিকে জিজ্ঞাস করল,

আপনি ওকে চেনেন?

লোকটি আমতা আমতা করলেন। ফায়াজের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। ফায়াজ উত্তরের আশায় কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। লোকটিকে চুপ থাকতে দেখে ফায়াজ জিজ্ঞাস করল,

আপনি এই এলাকার?

লোকটি বিরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

ফায়াজ বলল,

আপনি ভেতর থেকে আসলেন। এখানে কাজ করেন?

লোকটি মাথা নাড়লো। বলল,

হ্যা।

__________
অফিসার, আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।

এবং সে আপনার বাড়িতে গত কয়েকদিন যাবত থেকে আসছে। মাহবুবুর রহমান চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন।

মইনুর শেখ মাথা নাড়িয়ে বললেন,

জ্বি।

নাম কি তার?

ফায়াজ আহমেদ।

পেশা?

লেখক।

মাহবুবুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছিলেন। মইনুর শেখের কথা শুনে চায়ের কাপ নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন। উৎসুক কন্ঠে বললেন,

লেখক একজন কিডন্যাপার? ইন্টারেস্টিং।

মইনুর শেখ নিরবে নিশ্বাস ফেললেন। মাহবুবুর রহমান বললেন,

কিডন্যাপের পর কিডন্যাপার কোন কল দিয়েছিল? আই মিন মুক্তিপণের জন্য?

না। মইনুর শেখ ছোট্ট শব্দে উত্তর দিলেন।

মাহবুবুর রহমান চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে রেখে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলেন। বললেন,

কিডন্যাপ হয়েছে কি করে বুঝলেন এবং কখন বুঝলেন?

মইনুর শেখ ছোট নিশ্বাস ফেলে বললেন,

গত কাল রাত থেকে।

আই সি। আচ্ছা কি মিস্টার ফায়াজ আহমেদ আই মিন কিডন্যাপারের ঘরটা দেখতে পাড়ি যেখানে সে এতদিন অবস্থান করেছে?

জ্বি।

মাহবুবুর রহমান সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,

তাহলে চলুন।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here