নীলকণ্ঠা পর্ব-২৫

0
1300

#নীলকণ্ঠা

২৫|
বিশাল ঘরটায় আসবাবপত্রের সংখ্যা সীমিত। ঘরের মাঝ বরাবর একটা বিছানা, ডানে বড় একটা কাঠের আলমারি। জানালার সামনে একটা টেবিল আর চেয়ার। বা পাশে সোফা সাথে সেন্টার টেবিল। মাহবুবুর রহমান জানালার কাছে গেলেন। জানালার পাল্লা খুলে বাহিরে তাকালেন। পুকুর আর অন্ধকারাবৃত ঘন জঙ্গল চোখে পড়লো। মাহবুবুর রহমান জানালার আরো কাছে এগিয়ে আশেপাশে তাকালেন। আশেপাশে চোখ রেখেই মইনুর শেখকে জিজ্ঞাস করলেন,

এত নিরিবিলিতে বাড়ি করলেন যে?

এটা আমার পৈতৃক বাড়ি।

মাহবুবুর রহমান জানালা থেকে মুখ সরিয়ে বললেন,

আপনার বাবা নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করতেন বুঝি?

মইনুর শেখ বললেন,

জ্বি। জনকোলাহল তার পছন্দ ছিল না, আমারও পছন্দ না।

আপনারা বাপ-বেটা দেখি বড্ড অসামাজিক। মাহবুবুর রহমান ঠাট্টার সুরে বলে হাসলেন।

মইনুর শেখ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। মাহবুবুর রহমান নিজের মতো হেসে শব্দ করে গলা পরিষ্কার করলেন। আলমারির কারুকার্যে হাত বুলিয়ে মইনুর শেখের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। বললেন,

চমৎকার কারুকার্য। এটা কিডন্যাপার ব্যবহার করেছে?

মইনুর শেখ বললেন, হ্যা।

মাহবুবুর রহমান আলমারির হাতল ধরে খোলার চেষ্টা করলেন কিন্তু খুলছে না। তালা বদ্ধ। মাহবুবুর রহমান নিচু হয়ে হাতল নিরিক্ষন করতে করতে বললেন,

এক্সট্রা চাবি আছে?

হ্যা আছে। বলে মইনুর শেখ উঁচু গলায় রেনুকাকে ডাকলো। ডাকার কিছু মিনিটের মধ্যেই রেনুকা চলে এলো। রেনুকা দরজায় দাঁড়াতেই মইনুর শেখ বললেন,

এই আলমারির চাবি নিয়ে আসো।

রেনুকা মাথা নেড়ে চলে গেল। মাহবুবুর রহমান হাতল ছেড়ে দাঁড়ালেন। টেবিলের কাছে গেলেন। টেবিলের আশেপাশে নিচে তাকালেন। টেবিলের নিচে ওষুধের খালি পাতা পড়ে আছে। মাহবুবুর রহমান নিচু হয়ে ওষুধের পাতা তুলে নিলেন। উল্টে পাল্টে দেখে মইনুর শেখের দিকে এগিয়ে গেলেন। মইনুর শেখের সামনে ওষুধের পাতা ধরে জিজ্ঞাস করলেন,

এটা কিসের ওষুধ?

মইনুর শেখ সরু চোখে তাকালেন। কিছুক্ষন তাকিয়ে বললেন, আমি জানি না।

আচ্ছা। মাহবুবুর রহমান ওষুধের পাতা সরিয়ে পকেটে ভরলেন। রেনুকা চাবি নিয়ে এলো। মাহবুবুর রহমান আলমারি খুললেন। পুরো আলমারি খালি পড়ে আছে। আলমারির ড্রয়ারগুলো একে একে খুলে দেখলেন। সব খালি। আলমারির নিচের তাকে চোখ পড়তেই দেখলেন একটা কাগজ। মাহবুবুর রহমান হাটু গেড়ে বসলেন। কাগজ হাতে নিতেই দেখলেন একজন পুরুষের ছবি। ছবি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মইনুর শেখের দিকে ছবি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,

এটা কার ছবি, জানেন?

মইনুর শেখ ছবির দিকে তাকাতেই হৃদয় কেপে উঠলো। পায়ের তলার জমি কাঁপছে নাকি তিনি কাঁপছেন বুঝতে পাড়লেন না। মাথায় ঝিমঝিম শুরু হলো। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। মাহবুবুর রহমান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন।

আপনি ঠিক আছেন?

মইনুর শেখ ছবি থেকে চোখ সরিয়ে মাহবুবুর রহমানের দিকে তাকালেন। কয়েকবার চোখ ঝপ্টে ঢোক গিলে মাথা নাড়িয়ে বলল,

না, না চিনি না।

আপনি নিশ্চিত?

হ্যা।

আপনি ভালো করে দেখুন।

মইনুর শেখ মাহবুবুর রহমানের থেকে চোখ সরিয়ে বললেন,

প্রয়োজন নেই।

মাহবুবুর রহমান ঠোঁট চেপে মইনুর শেখের সামনে থেকে ছবি সরিয়ে নিজের সামনে ধরলেন। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সেটাও প্যান্টের পকেটে ভরে নিলেন। মইনুর শেখ পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে মুখ মুছে নিলেন। মাহবুবুর রহমান বিছানার তোষক তুলে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললেন,

বাড়িতে কে কে থাকেন?

মইনুর শেখ দুবার শব্দ করে গলা খেঁকারি দিলেন। বড় শ্বাস নিয়ে বললেন,

আমি, আমার মেয়ে পরী, রেনুকা কিছুক্ষন আগে যে চাবি নিয়ে এলো, রান্নাবান্নার জন্য আমেনা আর বাড়িঘর দেখার জন্য আতর আলি।

মাহবুবুর রহমান বিছানায় তোষক ফেলে বললেন,

আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই।

মইনুর শেখ নিরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

_______
বাড়ির দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছে পরীর মুখভঙ্গির তত পরিবর্তন লক্ষ করছে ফায়াজ। পরীর শ্বাস ফুলে উঠেছে। ফায়াজের হাতের মুঠোয় থাকা পরীর মোলায়েম হাতটা মৃদু মৃদু কাঁপছে। পরী ভ্রু কুঁচকে নাকের পাটা ফুলিয়ে চারপাশ দেখছে। বাড়ির দিকে কিছু কদম এগিয়ে যেতেই থেমে গেল পরীর পা। ফায়াজ তাকালো পরীর দিকে। পরী ডানে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে আছে। পরীর দৃষ্টি অনুসরণ করে ফায়াজ সেদিকে তাকালো। অযত্নে পড়ে থাকা এক পুকুর। শ্যাওলা, আগাছায় পরিপূর্ণ। পরীর চোখ চকচক করে উঠলো।

পরী ছুটে চলে যেতে চাচ্ছে সেদিকে, শুধু পারছে না ফায়াজের মুঠোয় তার হাত থাকায়। ফায়াজের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আর বিরবির করছে, অ্যা অ্যা অ্যা…

ফায়াজ পরীর দিকে তাকালো। পরীর স্থির দৃষ্টি। ফায়াজ পরীর হাত শক্ত করে মুঠো করে মৃদু স্বরে ডাকলো।

পরী। পরী?

পরী শুনলো না। সে হাত ছাড়াতে চাচ্ছে আর বিরবির করছে, অ্যা অ্যা…

ফায়াজ ফের ডাকলো কিন্তু জবাব পেল না। ফায়াজ পরীর হাত নিজের মুঠো থেকে মুক্ত করতেই সময় ব্যয় না করে ছুটে গেল পুকুরের দিকে। ফায়াজও গেল পরীর পেছনে। পরী ছুটতে ছুটতে হাপিয়ে উঠলো। যেয়ে দাঁড়ালো পুকুর ঘাটে। আগাছাগুলো বিশালাকার গাছের গুড়ি বেয়ে পুকুর জলে নেমেছে। ক্ষুদ্রাকার বুনোলতা বেড়েছে হাটু সমান। সবুজ শ্যাওলা গুলো স্থায়ী হয়েছে কারুকার্য বিশিষ্ট বাধানো ঘাটে। পরী হাপাতে হাপাতে তাকিয়ে আছে সেদিকে। পুকুরে পদ্মপাতার জায়গায় কচুরিপানা ভেসে বেড়াচ্ছে। ফায়াজ পরীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার দৃষ্টি পরীর দিকে। পরী বুক ভরে বড় শ্বাস নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে পুকুরে তাকিয়েই আনমনে বলে উঠল,

বাবা।

বাবা বলতেই পরীর স্থির দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠলো। হৃদপিন্ডে তরঙ্গ বয়ে গেল। দ্রুত বেগে অস্থির দৃষ্টি ফেলে বাবা বলে বিরবির করতে লাগলো। বিরবির করতে করতেই একসময় চেঁচিয়ে উঠলো, বাবা…

ফায়াজ এগিয়ে পরীর পাশে দাঁড়ালো। পরী ফায়াজের দিকে তাকালো পুকুরের দিকে ইশারা করে বলল,

বাবা, বাবা।

ফায়াজ বলল,

কে বাবা?

বাবা বিরবির করতে করতেই ভাবুক হয়ে উঠলো পরী। পরক্ষনেই বাঁধানো ঘাটের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,

বাবা, বাবা, বাবা।

ফায়াজ মাথা নাড়ালো। বলল,

হ্যা বাবা। কিন্তু কে সে? তুমি চেনো? চেনো তাকে?

পরী চোখ মুখ বন্ধ করে ঢোক গিললো। মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে উঠলো নিমিষেই। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে নিজের চুল টেনে ধরলো।

_______
মাহবুবুর রহমান বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রেনুকা, আমেনা আর আতর আলি। আমেনা মাথায় আচল টেনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহবুবুর রহমান গভীর চোখে সবার মনোভাব পর্যবেক্ষণ করছেন।

তো আমেনা বেগম বলুন।

হঠাৎ মাহবুবুর রহমানের কন্ঠে আমেনা মৃদু কেপে উঠলো। নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলল,

জ্বি স্যার।

কিডন্যাপার কেমন ছিল?

আমেনা কিডন্যাপার অর্থ বুঝলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, অ্যা?

অপহরণকারী কেমন ছিল? ফায়াজ আহমেদ।

অপহরণকারীও আমেনা বুঝলো না কিন্তু ফায়াজের নাম শুনেই আমেনার মুখ উজ্জ্বল হলো। সাবলীন কন্ঠে বলল,

ফায়াজ সাহেব খুব ভালো মানুষ, স্যার।

আই সি। তো, আপনার সাথে তার শেষ দেখা কবে হয়েছিল?

গতকালকে সকালে। যাওয়ার সময় বলে গেছিলো।

মাহবুবুর রহমান ভ্রু কুচকালো। আমেনার দিকে তাকিয়ে ভাবছে কিডন্যাপার কিডন্যাপ করার সময় এই মহিলাকে বলে গিয়েছে। মাহবুবুর রহমান ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বলল,

কি বলে গিয়েছিল?

ভালো ভাবে থাকতে বলছে আর তাড়াতাড়ি আসবে বলছে।

তাড়াতাড়ি আসবে মানে? এখানে আসবে?

জ্বি স্যার।

কোথায় গিয়েছে আপনাকে বলেছে?

বিয়াতে গেছে স্যার। তার বন্ধুর।

মাহবুবুর রহমানের চোখে বিস্ময়। এটা কি শুধু আপনাকেই বলেছে?

আতর আলি এবার মুখ খুললো। বলল,
আমিও জানি স্যার।

আমেনা বলল,
পরী মায়েরে নিয়া গেছে। আর এক সাহেবও গেছে। কি জানি নাম? শ্রাবণ, শ্রাবণ সাহেবও গেছে।

মাহবুবুর রহমান মইনুর শেখের দিকে তাকালেন। সোফা ছেড়ে উঠে মইনুর শেখের কাছে গেলেন। বললেন,

কি চলছে এসব?

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here