নীলকণ্ঠা পর্ব-২৬

0
1584

#নীলকণ্ঠা

২৬|
বৈকালিনের শেষের ভাগ। বৃক্ষরাজির দাম্ভিক ছায়া পুকুর জলে ভাসছে। মৃত্তিকায় তাপ কমে শিতল হচ্ছে। আকাশ রঙ পাল্টে হচ্ছে লাল কমলা। পুকুরের পাড়ে দুজন দাঁড়িয়ে। একজন পাগল প্রায় অন্যজন তাকে শান্ত করতে ব্যস্ত। পরী দাঁতে দাতঁ চেপে ফায়াজের বাহু খামচে ধরে নাড়াচ্ছে। ফায়াজ পরীর হাত ধরে থামানোর চেষ্টা করে বলল,

পরী থামো। পরী কথা শোন।

পরী থামছে না। ফায়াজের বাহু খামচে চলছে। দাঁতে দাঁত চেপে ইইই শব্দ করছে। ফায়াজ পরীর দু হাত নিজের একহাতের মুঠোয় নিয়ে অন্য হাত পরীর মাথায় রেখে বলল,

পরী শান্ত হও। লক্ষী মেয়ে তুমি। আমার কথা শোন।

পরীর শরীর কাঁপছে। ফায়াজের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য জবরদস্তি করছে। ফায়াজ বড় শ্বাস নিয়ে পরীর মাথায় রাখা হাত পরীর পিঠে নামিয়ে পরীকে এক হাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল। পরী ছটপট করতে করতে এক পর্যায়ে বলে ফেলল,

বাবার কাছে যাবো।

তৎক্ষণাৎ ফায়াজের বোধগম্য হয় নি পরীর কথা। কিছু সময় পর যখন বুঝতে পারলো ফায়াজ পরীকে সামনে এনে বলল,

কি বললে?

পরী পুরোদমে ঘেমে উঠেছে। কাঁদার ফলে চোখের জল ঘর্মাক্ত গলায় নেমেছে। এলোমেলো চুল মুখের সাথে লেপ্টে আছে। ওড়না পড়ে আছে জমিনে। পরীর শরীর তিরতির করে কাঁপছে। নাক ফুলে ফুলে উঠছে। ফায়াজ পরীর হাত ছেড়ে গালে লেপ্টে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দুহাত পরীর কানের পাশে রেখে ফের জিজ্ঞাস করল,

কি বলবে পরী? আবার বলো।

বা-বাবার কাছে যাবো-যাবো। পরীর কম্পিতকন্ঠ।

ফায়াজ পরীর দিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞাস করল,

কে তোমার বাবা?নাম জানো?

পরী অন্যমনষ্ক হয়ে পড়লো। ফায়াজের থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে ফেলফেল করে চেয়ে রইলো। ফায়াজ কেন যেন হাসলো। একহাত পরীর গালে রেখে অন্যহাত মাথার ডানে বুলিয়ে বলল,

চলো। বাবার কাছে যাই।

পরী মাথা নামিয়ে ফায়াজের দিকে তাকালো। ওড়না উঠিয়ে পরীর কাঁধে ঝুলিয়ে হেসে বলল,

চলো।

_______
মইনুর শেখ গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছেন এক পাশে। মাহবুবুর রহমান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে উঠে মইনুর শেখের কাছে গেলেন। বিরস কন্ঠে বললেন,

এসব কি মিস্টার মইনুর শেখ? আপনি কি দয়া করে আমাকে এক্সপ্লেইন করবেন?

কি জানতে চান?

মাহবুবুর রহমান ছোট নিশ্বাস ফেলে বললেন,

আপনি বলেছেন আপনার মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে আর এরা বলছে আপনার মেয়ে বিয়ে খেতে গেছে।

দেখুন, এই মুহুর্ত্বে আপনাকে সব খুলে বলা সম্ভব নয়। আগে আমার মেয়েকে উদ্ধার করুন এরপর যা জিজ্ঞাস করার করবেন।

মাহবুবুর রহমান নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে অসন্তোষ হলেন। জিজ্ঞাস করলেন,

কিডন্যাপারের ছবি আছে?

মইনুর শেখ বললেন, না।

আপনার মেয়ের ছবি তো আছে না কি?

হ্যা আছে।

মইনুর শেখ পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন করে পরীর ছবি দেখালেন। মাহবুবুর রহমান মইনুর শেখের ফোন থেকে নিজের ফোনে ছবি নিলেন। পরীর ছবির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বললেন,

ঠিক আছে। আমি আজ আসি।

মইনুর শেখ মাথা নাড়ালেন।

মাহবুবুর রহমান বেরিয়ে যেতেই মইনির শেখের ফোন বেজে উঠলো। সরিষাবাড়ী থেকে নুরু মিয়ার কল দেখেই মইনুর শেখের দম বন্ধ হয়ে এলো। প্রায় এক বছর পর ফোন এলো তার। অন্যান্য সময়ে হয়ত মইনুর শেখ এতটা বিচলিত হতেন না যেমনটা ফায়াজের আলমারিতে পরীর বাবার ছবি দেখার পর এখন হচ্ছেন। মাহবুবুর রহমানকে মইনুর শেখ মিথ্যে বলেছিল। ফায়াজের আলমারিতে পরীর বাবা অর্থাৎ সোয়েব আহমেদের ছবি দেখেই ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। ফায়াজের আলমারিতে এই ছবি কি করে এলো? কিন্তু এখন নুরু মিয়ার ফোন পেয়ে মইনুর শেখ নিশ্চিত কিছু একটা ঘটছে।

হ্যালো।

আসসালামু আলাইকুম স্যার।

হ্যা বলো কি খবর?

স্যার বাড়িতে দুইজন আইছে।

মইনুর শেখ ভ্রু কুঁচকালেন। একপলক সবার দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। যেতে যেতে জিজ্ঞাস করলেন,

কারা?

স্যার, একলোক আর পরী।

মইনুর শেখ বিজলির মতো চমকে উঠলেন। তার পা থেকে গেল মাঝ পথেই। বুক ঢিপঢিপ করছে। হাটুর নিচ থেকে পা কেমন কাঁপছে। তিনি কোন মতে পাশের দেয়াল ধরে হেলে দাঁড়ালেন। কথা বলতে পারছেন না। শব্দগুলো দলা পাকিয়ে কণ্ঠনালিতে ভীড় জমিয়েছে। মইনুর শেখ ঢোক গিলে জিজ্ঞাস করলেন,

কে কে গেছে পরীর সাথে?

স্যার চিনি না আমি। তয় কিছুদিন আগেও তারে এই এলাকায় দেখছিলাম। লম্বা কইরা, ফর্সা, জুয়ান পোলা।

মইনুর শেখের অস্থিরতা বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজায় হাত দিয়ে সেটা দেহ থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছে। মইনুর শেখ বড় বড় দম নিয়ে বলল,

এখন তারা কোথায়?

বাড়ির মইধ্যে গেছে।

তুমি কোথায়?

কলাবাগানে।

এখনই বাড়ি যাও। তাদের দিকে নজর রাখো। আর আমাকে খবরা খবর বলবে।

নুরু মিয়া ফোন কানে রেখেই মাথা কাত করে বলল,

আইচ্ছা স্যার।

মইনুর শেখ চেয়াল ছেড়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে গেল। কল দিল শ্রাবণকে। গত রাতে বলেছে আজ সকালের মধ্যে সে ফায়াজ আর পরীর কাছে থাকবে। শ্রাবণকে কল করতেই শুনলো ফোনের ওপাশ থেকে এক নারী কণ্ঠী বিনয়ী সুরে বলল,

দুঃখিত। এই মুহূর্তে আপনার কাঙ্খিত নাম্বারটিতে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন।

মইনুর শেখ আবার কল দিল। সেই নারী কন্ঠী ফের একই কথা বললেন। মইনুর শেখ বিছানায় ফোন রাখলেন। হাটুর উপর কনুই রেখে দুহাতে মুখ ঢেকে নিচু হয়ে বসলেন। ভাবছেন যেভাবেই হোক পরিস্থিতি করতে হবে। এভাবে অস্থির হয়ে পরলে চলবে না। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে। হঠাৎ মনে পড়লো নুরু মিয়ার বলা একটা কথা। কিছুদিন আগেও ফায়াজ সরিষাবাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু কেন? মইনুর শেখ অংক কষাতে নামলেন। ফায়াজের মস্তিষ্কে কি চলছে সে ধরতে পাড়লেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

_______
পরী বিছানায় শুয়ে আছে। সে জ্ঞান হারিয়েছে। হাতে আকরে ধরে আছে একটা ফটো ফ্রেম। সেই ফটোতে দুজন মানুষ রয়েছে। তারা হলেন সোয়েব আহমেদ এবং
সোফিয়া খানম। অর্থাৎ পরীর বাবা মা। পরীর সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক সজাগ না হলেও বাবা মায়ের ছবি দেখে ঝাপসা কিছু স্মৃতি মস্তিষ্ককে নাড়া দিয়েছে। পরীর ঝাপসা স্মৃতি মস্তিষ্ককে জানান দিয়েছে এরা তার জনক-জননী।

ফায়াজ বিছানায় পরীর পায়ের কাছে বসে আছে। দৃষ্টি আবদ্ধ পরীতে। ফায়াজের মনে শান্তি বিরাজ করছে। সে যা চেয়েছিল তার কিছুটা হলেও সে সম্পূর্ণ করতে পেরেছে। চারদিকে মাগরিবের আজান পড়ছে। ধিরে ধিরে চোখে ছানি পরা ঝাপসা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ। দিনের আলো নিভে যাচ্ছে। ফায়াজ চারপাশে তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বহু দিন জনমানব শূন্য বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফায়াজ ঘরের দরজা পেরিয়ে সামনে যাতেই নুরু মিয়ার সাথে দেখা হলো। তার হাতে হারিকেন। টিমটিম জ্বলছে আগুনের শিখা। হারিকেনের হলুদ আলো কাচের প্রাচীর ঘিড়ে ছেয়ে আছে। কেরোসিনের গন্ধ আসছে নাকে। নুরু মিয়া ডান হাতে হারিকেন তুলে দাঁড়ালো। হারিকেনের হলুদাভ আলোতে নুরু মিয়ার মুখের ডানপাশ জ্বলজ্বল করছে। ফায়াজ বলল,

ওহ আপনি এসেছেন? ভালোই হলো। আপনার নাম জানা হয় নি।

আমার নাম নুরু মিয়া।

ফায়াজ মৃদু হাসলো। বলল,

আপনি কি এখানে থাকেন?

জ্বে।

এখানে রান্নার ব্যবস্থা আছে?

জ্বে।

আচ্ছা। রান্না করে কে?

আমিই।

ফায়াজ হারিকেনের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞাস করল,

হারিকেন কি একটাই।

জ্বে না।

তাহলে এক কাজ করুন এটা এখানে রেখে যান। চারদিকে তাকিয়ে বলল,

অন্ধকার হয়ে গেছে।

নুরু মিয়া হাতের হারিকেন ফায়াজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন।

ফায়াজ হারিকেন নিয়ে ঘরে একটা জলচৌকিতে রেখে এলো। পরী এখনও আগের মতো শুয়ে আছে। ফায়াজ ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে নুরু মিয়াকে আর পেল না। ফায়াজ ফোনের টর্চ ফেলে এদিক সেদিক তাকালো। নুরু মিয়ার দেখা মেললো না।

_______
মইনুর শেখ অনেক্ষন চুপচাপ বসে আছেন। রেনুকা একবার ঘরে উকি দিয়েছিল। মইনুর শেখকে নিস্তেজ বসে থাকতে দেখে রেনুকা আর ঘরে ঢোকার সাহস পায় নি। ফিরে এসেছে দরজা থেকে। উত্তেজনায় মানুষের মস্তিষ্ক সঠিক কাজ করে না। মস্তিষ্ককে সময় দিতে হয়, শান্ত রাখতে হয়। মইনুর শেখ নিজেকে স্বাভাবিক করেছে। এবং তার মস্তিষ্ক কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। মইনুর শেখ মাথা তুলে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলেন। পুরো ঘর আধারে ছেয়ে আছে। নিস্তব্ধ, নিরবতার মাঝে মইনুর শেখ ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিলেন। ফোন হাতে নিয়ে খোলা জানালার কাছঘেঁষে দাঁড়ালেন। কল দিলেন জাফরকে।

আসসালামু আলাইকুম ভাইজান। ওইদিকের খবর কি?

আমাকে এখনই ফায়াজের নাম্বার ম্যসেজ করো। বলে মইনুর শেখ ফোন রেখে দিলেন। ফোনের ওপাশে জাফর কিছুক্ষন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফোনের দিকে চেয়ে ফায়াজের নাম্বার মইনুর শেখের মোবাইলে ম্যসেজ করলো। মইনুর শেখ ম্যসেজ পেয়ে আবার কল দিল।

হ্যালো অফিসার।

মাহবুবুর রহমান বললেন,

জ্বি মইনুর সাহেব বলুন।

আপনার কাজটা সহজ করে দেই।

মানে?

কিডন্যাপারের নাম্বার ম্যসেজ করছি আপনাকে। নাম্বার ট্রেস করে খুঁজে পেতে সুবিধা হবে।

ফোনের ওপাশে মাহবুবুর রহমান ভাবলেন কিডন্যাপার এত বোকা হবে কিডন্যাপ করে ফোন খোলা রাখবে? মাহবুবুর রহমান অল্পসময় নিরব থেকে বললেন,

আচ্ছা দিন। আমি দেখছি।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here