নীলকণ্ঠা পর্ব-৮

0
1965

#নীলকণ্ঠা

৮।
আপাদমস্তক ভিজে ছিপছিপে হয়ে আছে ফায়াজের। শার্ট ভিজে শরীরের চামড়ার সাথে লেগে রয়েছে। জিন্স ভিজে ভারী হয়েছে। শরীরে মৃদু কাঁপুনি লাগছে। বাহিরে তখন সাঁইসাঁই বাতাস। বর্ষনের ভারী ফোটার তাণ্ডবলীলা চলছে ছোট্ট গ্রামের কোলে। রাস্তায় বিছানো কাদা ফায়াজের গোড়ালি পর্যন্ত লেগেছে। জুতার নিচে কাদা মাটির ভারি আস্তরণ। আতর আলি দরজা খুলে একপাশে দাঁড়ালো। ফায়াজ ভেতরে ঢুকতেই পরপর দুটো হাচি দিয়ে বসলো। ডান হাতের উল্টোপিঠে নাক ডলে ভেতরে যেয়ে দাঁড়ালো। আতর আলি দরজা বন্ধ করে আফসোসের কন্ঠে বলল,
হায় হায় আল্লাহ! সাহেব তো পুরা ভিজ্জা গেছেন।

হ্যা। ইয়ে, আমার জুতায় অনেক কাদা মাটি। এটা নিয়ে ভেতরে গেলে পুরো ঘর নোংরা হবে। আপনি কি আমাকে কোন পরিষ্কার জুতা এনে দিতে পারবেন? ফায়াজের গলা বসে গেছে। চোখ জ্বালা করছে। মাথায় হাতুরি পেটার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। আতর আলি ফায়াজের কথাটা শুনে ভীষণ খুশি হলেন। ঘর নোংরা হলে তাকেই আবার কষ্ট করে পরিষ্কার করতে হবে। আতর আলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
জ্বি জ্বি সাহেব। আনতাছি। আপনের ব্যাগ টা আমারে দেন।

ফায়াজের কাঁধের ব্যাগ বড় পলিথিনে মোড়ানো। এর ভেতর মোবাইল, মানিব্যাগ এবং কিছু অতি জরুরী কাগজপত্র। মূলত এই পলিথিনের জন্যই মোবাইল, মানিব্যাগ এবং জরুরী কাগজপত্র এই যাত্রায় রাক্ষুসে বর্ষন থেকে বেঁচে গেল।

না ঠিক আছে সমস্যা নেই। আপনি একটু কষ্ট করে জুতা এনে দিলেই হবে।

আতর আলি মাথা হেলিয়ে তড়িঘড়ি করে জুতা আনতে চলে গেলেন। ফিরে এলেন মিনিট চারেক পর। হাতে এক জোড়া জুতা। ফায়াজ কাদা মাখা জুতা খুলে আতর আলির এনে দেয়া জুতা পড়ে নিল। নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আতর আলি বাধ সাধলেন।

সাহেব খাড়ান খাড়ান। বলে প্রায় দৌড়ে ভেতরে গেলেন। মিনিট পাড় হতেই জলন্ত মোম নিয়ে হাজির হলেন।
সাহেব, এইডা নেন। ঘরে বাতি নাই।

ফায়াজ মোমবাতি হাতে নিয়ে প্রশ্ন করলো,
কারেন্ট কখন গেছে?

অল্পেকটু আগে।

বাড়িতে সৌরবিদ্যুত নেয়?

সেইটা আবার কি সাহেব? আতর আলি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকালো।

আতর আলির সাথে কথা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই ফায়াজের। ঠান্ডায় হাড় পর্যন্ত কাঁপছে। রাতে জ্বর আসবে এটা এখনই নিশ্চিত সে। ফায়াজ আর কথা বাড়ালো না ছোট শব্দে ‘কিছু না’ বলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

_______
জামা কাপড় বদলাতে বদলাতে ফায়াজ দুই তিনটা হাচি দিয়ে বসলো। শীতে কাপাকাপি অবস্থা। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ফোনে সময় দেখলো। আটটা বেজে পনেরো মিনিট। তোয়ালে চেয়ারের মাথায় রেখে ব্যাগ থেকে পলিথিন ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের এক কোণঘেঁষে রাখলো। ব্যাগ নিয়ে বসলো বিছানার উপর।
কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?

ব্যাগের চেন খুলে কাগজপত্র বের করছিল ফায়াজ। কারো কথা শুনে সেগুলা ফের ব্যাগে ঢুকিয়ে মাথা তুললো। রেনুকা বিছানার পাশে দাঁড়ানো। ফায়াজ ব্যাগের চেন লাগিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
কারো ঘরে ঢুকতে হলে নক করার মতো নুন্যতম কমসেন্স কি আপনার নেই?

ফায়াজের উগ্র কথার ধরনে থতমত খেল রেনুকা। ইতস্ততভাবে বলল,
দুঃখিত ভুল হয়ে গেছে।

ফায়াজ ভ্রু কুঁচকে রসহীন বলল,
এখানে কি কাজ আপনার কেন এসেছেন?

রেনুকা এগিয়ে এলো। বলল,
আপনি সারাদিন বাড়ি ছিলেন না। কোথায় গিয়েছিলেন?

রেনুকার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফায়াজ বলল, আপনি আমাকে এত জিজ্ঞাসাবাদ করছেন কেন আর আমি সারাদিন কোথায় ছিলাম, কি করছিলাম সেই কৈফিয়ত কি আমি আপনাকে দিব?

জিজ্ঞাসাবাদ বলছেন কেন? আপনার জন্য আমার চিন্তা হচ্ছিল তাই জিজ্ঞাস করলাম।

ফায়াজ রেনুকার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রেনুকার মতিগতি বুঝার চেষ্টা করলো। এরপর তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
মানে? আমার জন্য চিন্তা হচ্ছিলো আপনার? তবে আমার জানা মতে আমার জন্য চিন্তা হবে এমন সুসম্পর্ক কিন্তু আমাদের নয়।

একে অপরের শত্রু হবো এমন খারাপ সম্পর্কও কিন্তু আমাদের নয়। ফায়াজের কথার পিঠ্র রেনুকা বলল।

আপনি অলরেডি আমার শত্রু হয়ে গেছেন।

রেনুকা এক প্রকার বিস্মৃত ভাব নিয়ে বলল,
মানে? কিন্তু কিভাবে? কি করেছি আমি?

আমার কাজে যে বাধা দেয়, সে কোন অংশে আমার শত্রু থেকে কম নয়। ফায়াজ অকপটে বলল।

রেনুকা শব্দ করে নিশ্বাস ফেলল। বলল,
দেখুন আপনি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ আপনি আপনার কাজ করবেন আর তা বাদ দিয়ে আপনি কিনা একটা অসুস্থ মেয়েকে সুস্থ করতে লেগে পড়েছেন।

আমি আমার কাজই করছি আর আপনার যদি এখন আমার সাথে খোশগল্প করা ইচ্ছা থাকে তাহলে দুঃখিত। আমি খুবই ক্লান্ত, এখন বিশ্রাম নিব।

রেনুকার মুখটা চুপসে গেল। সে এসেছিল ফায়াজের সাথে ভাব জমাতে যাতে পরীর ধারনা ফায়াজের মাথা সরিয়ে ফেলতে পারে কিন্তু এখানে এসে অপমানিত হতে হবে ভাবে নি। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে ভেঙ্গে পড়ছে সে। বারবার নিজের পরাজয় মানতে কষ্ট হচ্ছে। নিজের বুদ্ধির উপর সন্দেহ হচ্ছে। তার বুদ্ধি কি কমে গেছে? এমন সব কাজ করছে যার করনে বার বার ফায়াজের কাছে অপমানিত হতে হচ্ছে। রেনুকা নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রেনুকার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে নিজের বিছানার কাছে আসতেই কারেন্ট চলে এলো। ফায়াজ ফু দিয়ে মোম নিভিয়ে ব্যাগ আলমারিতে রেখে তালা মারলো। এরপর বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। বসার ঘরে আমেনাকে দেখতে পেল ফায়াজ। আমেনা রান্নাঘরে যাচ্ছিল। ফায়াজ পেছন থেকে ডাক দিল।
খালা শুনুন।

জ্বি বলেন।

পরী খেয়েছে?

না এখন খাওয়াবো।

ওষুধ খাইয়েছিলেন সকালে আর দুপুরে?

আমেনা মলিন মুখে মাথা নত করলো। ফায়াজ ভ্রু কুচকালো। জিজ্ঞাস করলো,
কি হয়েছে?

সাহেব, ওষুধ খাওয়াইতে পাড়ি নাই।

মানে? কেন? আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে গেলাম না?

আমেনা দুঃখি কন্ঠে বলল,
সবই ঠিক ছিল সাহেব কিন্তু ওষুধ তো বক্সে পাই-ই নাই। অনেক খুজছি কিন্তু পাই নাই।

পান নি মানে? ওষুধ কোথায়?

জানি না সাহেব।

পরীকে পুকুর ঘাটে নিয়ে গিয়েছিলেন?

আমেনা এবার প্রায় কেঁদে দিবে। তার কন্ঠ কাঁপছে। সে নিজেই দেখছে ফায়াজ কত খাটছে পরীর পিছে কিন্তু আজ একদিন তার কাঁধে দায়িত্ব পড়েছে সেটাও সে পালন করতে ব্যর্থ। কম্পিত কণ্ঠনালী দিয়ে আমেনার কথা বের হলো।

নিতে চাইছিলাম কিন্তু রেনুকা ম্যাডাম নিতে দেয় নাই। পরী মায়ে জিদ ধরছিল তাও যাইতে দেয় নাই।

বলেই কেঁদে দিল আমেনা। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে বলল,
আমারে মাফ কইরা দেন সাহেব। পরী মায়ের খেয়াল রাখতে পাড়ি নাই। যা যা বলছিলেন কিছুই মানতে পড়ি নাই। মাফ কইরা দেন।

ফায়াজ কোমরে একহাত রেখে অন্য হাতের দু আঙ্গুলে কপাল ঘষলো। এই মুহুর্ত্বে আমেনার উপর প্রচুর বিরক্ত লাগছে। একটা মাত্র কাজ সেটাও সে ঠিক ভাবে করতে পাড়লো না। ফায়াজ ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলল,
কাঁদতে হবে না। যা হবার তো হয়েই গেছে। আপনি পরীর খাবার নিয়ে আসুন। আমি ওর ঘরে আছি।

আমেনা ঘাড় কাত করে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। ফায়াজ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর এক শব্দ তুলে সেখান থেকে চলে গেল।

_______
পরীর ঘরের দরজা খোলা। সে বিছানার মাঝখানে বসে নিচু হয়ে কি যেন দেখছে। ফায়াজ এগিয়ে যেয়ে বিছানায় তাকাতেই খানিকটা চমকালো। পরী খুব মনোযোগী হয়ে তার ঘড়ি দেখছে। পরী এই ঘড়ি কোথায় পেল? পরী সাদা রঙের একটা জামা পড়েছে। জামার গলায় আর হাতায় রঙিন ফুলের কারুকার্য। লম্বা চুলে বেনুনী বাধা। ফায়াজের ঘড়ির দিকে পরীর গভীর মনোযোগ। ফায়াজ আরো এগিয়ে যেয়ে গলা খাদে নামিয়ে পরীকে ডাকলো। পরী মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো। ফায়াজের দিকে তাকালো। ফায়াজ কোমল হাসলো। এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞাস করল,
ভালো আছো?

পরীর নড়চড় নেই। প্রশ্নের উত্তর দেয়ার তাড়াহুড়ো নেই। ফায়াজ পরীর সামনে বিছানায় বসলো। বললো, বলো ভালো আছি।

পরী এখনও তাকিয়ে আছে ফায়াজের দিকে। ফায়াজ আবার বলল, বলো ভালো। ভা-লো। বলো তো পরী ভা-লো।

পরী একবার অন্য দিকে তাকিয়ে আবার ফায়াজের দিকে তাকালো। ফায়াজ বলল,
হ্যা বলো ভা-লো।

পরী এবার বলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু কি বলবে সেটা আবার ভুলে গেল। ফায়াজ আবার বলল,
বলো ভালো। ভা-লো।

ভালো। পরীর কম্পিত কন্ঠ তবুও স্পষ্ট। ফায়াজ চমকালো পরীর কন্ঠ শুনে। এত স্পষ্ট কন্ঠ সে খুব কমই শুনেছে। পরী আবার বলল, ভালো।

ফায়াজ বলল, আছি। বলো আছি।

আ-আছি। আছি।

হ্যা। এবার বলো ভালো আছি।

ভালো আছি।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here