নীলকণ্ঠা পর্ব-৭

0
1844

#নীলকণ্ঠা

৭।
অপরাহ্ন লগ্ন। কোমল রৌদ্রের রাজত্ব। বাড়ির চারপাশের গাছ গাছালির দরূন ছাদে রৌদ্র প্রবেশে বেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তবুও মুঠো মুঠো রৌদ্রে আবেশিত ছাদ। একটা মাঝারি আকারের টুলে বসে আছে পরী। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আমেনা পরীর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। পরী হাত নাড়াচ্ছে, মাথা ঝাঁকাচ্ছে কিন্তু কোন বিরবির করছে না। আমেনা খুব যত্নসহকারে এবং সাবধানে পরীর চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। পরীকে ছোট থেকেই আমেনা নিজের মেয়ে থেকে কম ভাবতো না। শরীরের রঙ অত্যাধিক সাদা হলেও কখনও ফ্যাকাসে বা প্রাণহীন লাগে নি পরীকে। তার চোখদুটোর গভীরতায় যে কেউ পড়ে যাবে। এই ছোট্ট জানটা কত কষ্ট পেতে পেতে বড় হয়েছে ভেবলেই শরীর কাটা দেয় আমেনার। আমেনা তেল দিয়ে বেনুনী বেধে দিল পিরীর চুলে। হাতের তেল শাড়ির আচলে মুছে পরীর গালে হাত থেকে কোমল হেসে বলল,
মাশা আল্লাহ।

ফায়াজ এতক্ষন ছাদের রেলিংয়ে কোমর ঠেকিয়ে বুকে হাত গুঁজে হেলে দাঁড়িয়ে ছিল। আমেনার চুল বাধা শেষে এগিয়ে এলো পরীর দিকে। হাটু ভেঙ্গে বসলো পরীর সামনে। পরী দৃষ্টি মেলালো। গতদিনের পর পরী ফায়াজকে দেখলে সরে যায় না। পরীর এলোমেলো মস্তিষ্ক তাকে জানান দিয়েছে ফায়াজ তার পছন্দের পুকুরঘাটে নিয়ে গিয়েছিল, বদ্ধ ঘর থেকে ঝলমলে আলোময় ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। ফায়াজ ঠোঁট প্রশস্ত করে মোলায়ের হাসলো। পরী নির্বিকার। সে শুধু তাকিয়ে আছে। ফায়াজ তার হাসি অব্যাহত রেখে জিজ্ঞাস করল,
এখানে কেমন লাগছে, পরী?

পরী বুঝলো না। তবে তার মেলানো দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেল। মস্তিষ্ক শব্দগুলোর অর্থ খোজার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পরী মৃদু স্বরে বিরবির শুরু করলো। বিরবির করা কোন কথাই ফায়াজের কাছে স্পষ্ট হলো না। ফায়াজ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞাস করলো,
ঘুড়তে যাবে?

পরী তাকালো না। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বিরবির করে চললো। ফায়াজ ভ্রু কুচকালো। হঠাৎ মনে পড়তেই বললো, পরী পুকুরঘাটে যাবে? পুকুর ঘাটে?

বিরবির থেকে গেল। তাকালো ফায়াজের দিকে। ফায়াজ বুঝলো পুকুরঘাট খুব পরিচিত শব্দ পরীর কাছে।

একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। এখন পরীকে নিয়ে পুকুরঘাটে যাওয়ার কি দরকার?

কর্কশকন্ঠের উৎস খুঁজে পেল ছাদের দরজায়। রেনুকা দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ উঠে দাঁড়ালো। রেনুকা এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
পরীকে সন্ধ্যায় বাহিরে নেয়া নিষেধ আছে স্যারের।

এখন পরীর দায়িত্ব আমার।
ফায়াজের স্বাভাবিক কন্ঠ। রেনুকা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ফায়াজের কার্যকলাপে রেনুকা মাঝে মাঝে প্রচন্ড রেগে যায়। মনে হচ্ছে তার জিনিস অন্য একজনের দখলে। কিন্তু সে মইনুর শেখের জন্য না পাড়ছে কিছু বলতে আর না পারছে এসব সহ্য করতে। রেনুকাকে চুপ থাকতে দেখে ফায়াজ আবার বলে উঠলো,
গত কাল থেকে পরী একবারও উত্তেজিত হয় নি বা ভাঙ্গচুর করে নি। এর মানে তো এই দাঁড়ায় যা হচ্ছে পরীর অনুকূলে হচ্ছে। তাই না রেনুকা ম্যাডাম?

ফায়াজের খোঁচা মারা কথা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পেড়েছে রেনুকা। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে তাকালো ফায়াজের দিকে। এরপর বড় বড় পা ফেলে শব্দ তুলে হেটে ছাদ থেকে নেমে গেল।

_______
স্যার আসবো?

মইনুর শেখ নড়েচড়ে বসলেন। ভেতর থেকেই উঁচু স্বরে অনুমিত দিলেন। হ্যা আসো।
রেনুকা দরজা ঠেকে ভেতরে ঢুকলো। মইনুর শেখ বিছানায় বসে আছে আর বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন কাগকপত্র।
স্যার কি ব্যস্ত?

না। বসো।

রেনুকা চেয়ার টেনে বসলো। তাকালো মইনুর শেখের হাতের দিকে। তার হাতে কিছু পুরোনো ছবি। রেনুকা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করল,
এগুলো কাদের ছবি স্যার?

মইনুর শেখ রেনুকার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো। একটা ছবি রেনুকার দিকে এগিয়ে বলল,
সোফিয়া, পরীর মা আর আমার স্ত্রী।

রেনুকা হাত বাড়িয়ে ছবিখানা নিল। মিষ্টি রঙের শাড়িতে রূপালী পার। উজ্জ্বল মুখে অমায়িক হাসি লেগে রয়েছে। রেনুকা কিছুক্ষন ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
ম্যাডাম খুব সুন্দর ছিলেন।

হু। ছোট্ট শব্দে সম্মতি জানালেন মইনুর শেখ। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

ম্যাডামকে অনেক মিস করেন তাই না?

সোফিয়াকে ভালোবাসি আমি। পরীর বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার অনেক আগে থেকে ভালোবাসি আমি। এখনও বাসি। আগামীতেও বাসবো।

মইনুর শেখ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন জানালার কাছে। বাহিরে তাকালেন। বললেন,
সোফিয়া আর আমি একই গ্রামে ছিলাম কিন্তু সোয়েব আহমেদ, পরীর বাবা। সে ঢাকা থেকে গিয়েছিল আমাদের গ্রামে। তার পূর্বপুরুষদের কারো ভীটে ছিল গ্রামে সেখানে গিয়েছিল। এগ্রিকালচার নিয়ে পড়া লেখার শুবাধে চাষাবাদে সমস্যা হয় নি তার। গ্রামের মানুষকে চাষাবাদে অনেক সাহায্য করেছিল সে। সবাই তাকে পছন্দ করতো। দেখতে দেখতে আমার সাথেও তার ভালো সম্পর্ক হয়, এরপর গভীর বন্ধুত্ব। দুজন দুজনকে ছাড়া কিছু বুঝতাম না। একদিন জনতে পাড়ি সোফিয়াকে সে পছন্দ করে আর সোফিয়াও।
মইনুর শেখ থামলেন। ফেললেন দীর্ঘশ্বাস। রেনুকাও চুপ রইলো। মইনুর শেখ আবার বললেন,
কিন্তু আমি সোফিয়াকে পেয়েছিলাম বন্ধুর মতো। সোফিয়া জানতো না আমি কখনও ওকে ভালোবেসেসি।

রেনুকা ছবি হাতে নিয়েই চেয়ার ছাড়লো। বলল,
ম্যাডামের যখন পরীর বাবার সাথে বিয়ে হয় তখন পরীর বাবার সাথে আপনার বন্ধুত্ব ছিল?

আমি ওদের বিয়েটা মানতে পাড়ি নি। গ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও মন টেকে নি। গ্রামে থাকলে সোফিয়ার সাথে অন্তত দেখা হবে ভেবে আমি আবার গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। যাকগে বাদ দাও। পরী কোথায়?

ও ঘরেই আছে। তবে

মইনুর শেখ ফিরে তাকালেন। সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞাস করলেন, তবে কি?

সকাল থেকে ফায়াজ নামের ব্যক্তিকে কোথাও দেখছি না।

কোথায় গিয়েছে?

ঠিক বলতে পাড়ছি না।

মইনুর শেখ চুপ করে কিছু ভাবলেন। এরপর বলবেন,
এমনিতেও ওর দিন ঘনিয়ে আসছে। থাক দুদিন নিজের ইচ্ছে মতো।

_______
বিলেন থেকেই ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। বিজলি পড়ছে আলো করে। মেঘেরা গম্ভীর কন্ঠে গর্জে উঠছে। সন্ধ্যা থেকেই অঘোষিত বর্ষনের তাণ্ডব শুরু হলো সাথে হমকা হাওয়া। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো। পুরো বাড়িতে আধার নেমে এলো। রেনুকা ফোনের ফ্লাস জ্বালিয়ে আমেনা আর আতর আলিকে ডাকতে ডাকতে বসার ঘরে এলো। আমেনাকে আর আতর আলিকে ডেকে বলল,
তাড়াতাড়ি মোম জ্বালিয়ে সবার ঘরে দাও আর তুমি জানালা গুলো লাগাও। দেখছো না বারবার বারি খাচ্ছে?

আতর আলি মাথা কাত করে দ্রুত পায়ে জানালার কাছে গেল।
মুখে মধু নাই। সারাদিন বসে থাকে তাও মেজাজ তার গরমই থাকে।
বিরবির করে বলতে বলতে জানালার কাছে দাঁড়াতেই কারো অবয়ব দেখে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো আতর আলি।

এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন? দরজা খুলুন ভিজে গেছি পুরো।

আতর আলি হাতে থাকা টর্চ অবয়বের মুখে মারলো। ফায়াজ কাক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আতর আলি বড় বড় দম ফেললো। খুব ভয় পেয়েছিল বেচারা। সাহেব আপনে বলেই দ্রুত যেয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালো।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here