নীলকণ্ঠা পর্ব-৬

0
1993

#নীলকণ্ঠা

৬।
ফায়াজ ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরলো। নিজের ঘরে যাওয়ার আগে একবার পরীর ঘরের দিকে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো পরী বিছানায় শুয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। সকালের সেই পদ্ম দুটো নেতিয়ে আছে। পরীর মোলায়ের হাতের কঠোর মুঠোয় নেতিয়ে যাওয়া পদ্মফুলের লতা। কোন বিশেষ কারন ছাড়াই ফায়াজ হাসলো। চলে গেল নিজের ঘরে। ফ্যান ছেড়ে বসলো চেয়ার টেনে। প্রচুর ঘেমেছে সে। প্রায় দুই ঘন্টার মতো হেটে পায়ের পাতায় মৃদু ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।

কিছুক্ষন বসে পকেট থেকে ফোন বের করে কল করলো। হ্যালো রাফসান।

হ্যা, বল।

ওষুধ গুলো এনেছি। এরপর?

সব পেয়েছিস?

হ্যা।

আচ্ছা, কথা হচ্ছে পরীকে তো ভিডিও কলে দেখলাম তবে সামনা সামনি দেখলে হয়ত আমার জন্য বেশি সুবিধা হতো।

কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? পরীকে ঢাকা নেয়া প্রায় অসম্ভব। ফায়াজের চিন্তিত কন্ঠ।

রাফসান ঠোঁট চেপে ছেড়ে বলল, ভিডিও কলে পরীকে যতটা দেখলাম ওর আচার-ব্যবহার দেখে আমার মনে হচ্ছে চিকিৎসাটা বৃথা যাবে না।

হুম। কি কি করতে হবে?

হ্যা। শোন, প্রথমত মানসিক রোগের চিকিৎসা একটি দলগত প্রচেষ্টা বা টিমওয়ার্ক বলতে পাড়িস। যাকে বলা হয় বায়ো-সাইকো-সোশ্যাল বা মনো-জৈব-সামাজিক পদ্ধতি। ওষুধ কাজ করে রাসায়নিক পদার্থ বা নিউরোট্রান্সমিটারের ওপর, সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং কাজ করে জ্ঞানীয় বিকাশ (কগনিশন), আচরণ ও মনের গড়নের ওপর।

ফায়াজ মনোযোগ দিয়ে রাফসানের কথা শুনলো। বলল, কিন্তু এখানে টিমওয়ার্ক করার কোন পরিবেশ নেই। বাড়ির বেশিরভাগ মানুষই চায় না পরী সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাক।

এর কারন কি?

আমি জানিনা।

আচ্ছা, পরীর মানসিক রোগটা কত দিনের?

আমার জানা মতে ছোট থেকে।

এর পেছনে বিশেষ কারন?

আমি নিশ্চিত না।

আচ্ছা সমস্যা নেই। প্রথমিক দিকে মানসিক সমস্যা ওষুধেই ঠিক হয় কিন্তু যখন সেটা বেশি দিনের হয় তখন মানসিক সাস্থের উন্নতির জন্য ওষুধের পাশাপাশি এক বা একাধিক থেরাপির প্রয়োজন পড়ে। পুরোটাই নির্ভর করছে রোগীর মানসিক ও শারীরিক সাস্থের ওপর। এর মধ্যে আছে সাইকোথেরাপি। এই পদ্ধতিতে একজন রোগ বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রোগীর অবাস্তব ও ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করে ইতিবাচক ও যুক্তিসম্মত চিন্তা আনতে সাহায্য করেন। চিকিৎসক রোগীকে তাঁর সমস্যা খুলে বলতে সাহায্য করেন। নিজের সমস্যা নিজে বুঝতে পারলে বাকি চিকিৎসা খুব সহজ হয়ে যায়।

কিন্তু পরী পুরোপুরিভাবে বিপর্যস্ত। মানে, সে তার রোগ নিয়ে কিছুই বলতে পারবে না।

তবে তুই যদি ওর সাথে বেশি মিশিস। ওর পছন্দের কাজ গুলো করিস, বাস্তব চিন্তার সাথে পরিচিত করাস তাহলে কাজটা সহজ হয়ে যাবে।

বুঝতে পেরেছি। আর?

এরপর হলো ইন্টারপার্সোন থেরাপি বা আইপিটি। এখানে রোগীকে কথা বলতে সাহায্য করা। স্বাভাবিক কথাবার্তা ও চালচলন ব্যাহত হতে থাকলে ওষুধপত্রের পাশাপাশি আইপিটির প্রয়োগ করা যেতে পারে। রোগী যদি সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নেন তবেই দ্রুত আরোগ্যলাভ সম্ভব।

আর একটা হলো ফ্যামিলি থেরাপি। রোগী এবং তাঁর পরিবার উভয়ের মধ্যেকার সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে এই প্রক্রিয়া ব্যাবহার করা হয়। রোগীর সুস্থতার জন্যে তা জরুরি। কিন্তু তোর কথা মতে পরীর পরিবার ওকে এই বিষয়ে সাহায্য করবে না।

ফায়াজ তপ্ত নিশ্বাস ফেললো।

রাফসানও কিছু একটা ভেবে বলল,
আচ্ছা তুই কি ওর পরিবারের সাথে কথা বলতে পাড়িস না? মানে যেন তারা পরীকে এই থেরাপিতে সাহায্য করে?

ব্যপারটা কঠিন তবুও আমি চেষ্টা করব। ফ্যামিলি থেরাপিতে আর কি কি করতে হবে?

চিকিৎসক ভাল করে বিচার করে দেখেন যে ঠিক কি কারণে পারিবারিক অশান্তি হচ্ছে যা রোগীর সাস্থের অবনতির কারণ। সেইমত তারপর সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হয়।

চিকিৎসক প্রথমেই রোগীর পরিবারের লোকজনকে রোগ সম্বন্ধে বোঝান। রোগের কারণে তৈরি হওয়া বিপদজনক হিংস্র আচরণ সামাল দেওয়া এবং নিজের প্রিয়জনের পাশে দাঁড়ানোর গুরুত্ব বোঝানো হয়। প্রিয়জনের সহায়তা ও রোগীর ইচ্ছা ছাড়া সুস্থতা পাওয়া অসম্ভব। দীর্ঘদিন ধরে যারা মনোরোগীর সাথে বাস করছেন, তাঁদের জন্য এই থেরাপি খুবই প্রয়োজনীয়। যেহেতু ওখানে কোন চিকিৎসক নেই তাই তোকেই পরীর পরিবারের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে। মনে রাখবি এই থেরাপিগুলোর সঠিক ব্যবহার রোগীকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু থেরাপিতেই কাজ হয়। ওষুধের দরকার হয় না। বুঝেছিস আমার কথা।

হ্যা। কিন্তু তুই যেই ওষুধ গুলোর কথা বললি সেগুলো কতদিন খাওয়াতে হবে?

খাওয়াতে থাক। আমি বলব। আর সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার থেকে ওষুধের লাভ অনেক বেশি। আর আমি না করা অব্দি ওষুধ বন্ধ করা যাবে না।

আচ্ছা।

আর নিয়মিত ওষুধ খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমে যেতে পারে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যদি না কমে আমাকে জানাবি।

ফায়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
এসবে কাজ হবে তো? পরীকে যত দ্রুত সম্ভব ঠিক করতে হবে।

রাফসান সন্দিহান হয়ে বলল, যত দ্রুত মানে?

থতমত খেলো ফায়াজ। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বলল,
মানে আমি তো বেশি দিন নেই এখানে। তাই আর কি। আর আমি চাই পরী স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক জলদি।

হ্যা। আর আমাকে পরীকে আচার আচরন সম্পর্কে জানাবি।

আচ্ছা। রাখি তাহলে।

ফায়াজ কান থেকে ফোন সরিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। জানালা দিয়ে ওদূরে ঘন জঙ্গলে তাকালো। সন্ধ্যা নেমে আসছে। ঘন জঙ্গল আধার কালো। গা ঝিমঝিম শিহরণে ভরপুর এক জঙ্গল। ফায়াজের বেশ আপন আপন লাগছে। জঙ্গলের কালো আধারে তাকিয়ে থাকতে এক অদৃশ্য শান্তি অনুভূত হচ্ছে ফায়াজের। যেন অনেকদিনের পরিচয়।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here