নীলকণ্ঠা পর্ব-৫

0
2007

#নীলকণ্ঠা

৫।
বর্ষন তেজ কমেছে সম্পূর্ণ। দূর আকাশে দেখা মেললো রামধনুর সাত রঙের। সূর্যের দেখা মেললেও বাড়ির দক্ষিণাকাশ ধূলিসাৎ মেঘাচ্ছন্ন। পুকুর ঘাটে বিশালাকার গাছ গুলো দাঁড়িয়ে ছায়া দিচ্ছে। সেই ছায়ায় বাঁধানো ঘাটে নীল ফ্রক পড়ে বসে আছে পরী। তার অনড় দৃষ্টি জলে ভেজা পদ্মে। পরীর কিছুটা পেছনে বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে আছে ফায়জ। আমেনা ছিল এতক্ষন সেখানেই। কিছুক্ষন আগে বাড়ির ভেতরে গিয়েছে। ফায়াজ সামনে এগিয়ে গেল, পরীর পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই পরী সতর্ক হয়ে নড়েচড়ে বসলো। নত মাথায় দৃষ্টি এলোমেলো হলো পরীর। ফায়াজ পরীর দিকে তাকিয়ে বলল,
পদ্মফুল নিবে পরী?

পরী কিছু বলব না। নত মাথায় খানিক থেকে থেকে হুক হুক শব্দ করছে। দু হাতের আঙ্গুল নাড়াচ্ছে। উত্তরের অপেক্ষায় ফায়াজ তাকিয়ে আছে পরীর দিকে। পরী নিরুত্তর। ফায়াজের মনে হঠাৎ অদ্ভুত ইচ্ছে জাগলো। পাগলাটে ইচ্ছে বলা চলে। ফায়জ পকেট থেকে মানিব্যাগ, মোবাইল বের করে পরীর পেছনে ঘাটে রাখলো। জুতা খুলে রেখে হঠাৎ ঝাপ দিল পুকুর জলে। আকস্মিক ঘটনায় পরী চমকে লাফিয়ে উঠলো বসা থেকে। ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তাকালো ফায়াজের দিকে। ফায়াজ সাঁতরে যেয়ে দুটো পদ্মফুল নিয়ে আবার সাঁতরে ফিরে এলো। পানি থেকে উঠে এলো। শার্ট, প্যান্ট ভিজে পানি পড়ছে। ফায়াজ বাম হাতে চুল গুলো পেছনে ঠেলে পরীর দিকে এগিয়ে গেল। পরীর ভয় কমেছে কিন্তু এখনও সে বিস্ময়ে আছে। ফায়াজ কোমল হাসলো। পরীর দিকে দুটো পদ্ম এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও।

পরী চোখ সরালো। অন্যদিকে তাকিয়ে ফের মাথা দোলাতে শুরু করলো। ফায়াজ তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। হাত নামাতে যাতেই পরী ফায়াজের হাত থেকে পদ্মদুটো নিলো। ফায়াজ সন্তুষ্ট হাসলো।

আসসালামু আলাইকুম।
মইনুর শেখ সালামের উত্তর দিয়ে ছাদের রেলিংয়ের উপর হাত রাখলো। প্রথম থেকেই তার দৃষ্টি পুকুর ঘাটে ছিল। ফোনের ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো।
কেমন আছেন ভাই?

মইনুর শেখ শান্ত দৃষ্টিতে পুকুর ঘাটে তাকিয়ে বললেন,
আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তোমার কি খবর?

জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

তোমার সাথে কিছু কথা বলতে কল করেছি।

জ্বি ভাই, বলেন।

তুমি ফায়াজ আহমেদ নামে যাকে আমার বাড়িয়ে পাঠিয়েছো

জ্বি ভাই।

পরীর ব্যপারে তার আগ্রহ বেশি। সে পরীর দেখাশোনা শুরু করেছে এবং সেটাও আমাকে এক প্রকার হুমকি দিয়ে। সে বলেছে সে পরীকে সুস্থ করবে।

ফোনের ওপাশ থেকে জাফরের আঁৎকে উঠার শব্দ এলো। বলছেন কি ভাই?

হ্যা।

এখন কি করবেন? ওকে ঢাকা চলে আসতে বলব?

এখন না। দুই-তিন সময় নাও।

জ্বি ভাই যা বলবেন। আমাকে ক্ষমা করবেন ভাই। আমি জানতাম না ফায়াজ এমন কিছু করে বসবে।

ক্ষমা চাইতে হবে না। রেনুকাকে বলছি নজর রাখতে।

জ্বি ভাই। সাবধানে থাকবেন।

মইনুর শেখ নিঃশব্দে কল কেটে ফোন পাঞ্জাবির পকেটে রাখলেন। দু হাত রেলিংয়ে রেখে পুকুর ঘাটে তাকালো। ঘাট খালি। না আছে ফায়াজ, না আছে পরী।

_______
পরী পদ্মদুটো হাতে নিজের নতুন ঘরের বিছানায় বসে আছে। আলো ঝলমলে ঘর। ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। পরী মাথা দোলাতে দোলাতে ঘরের চারপাশ দেখছে। মৃদু হুক হুক শব্দ তুলছে। ঘরটা তার পছন্দ হয়েছে কিন্তু কোন কিছু পছন্দ হলে কি প্রতিক্রিয়া করতে হয় এটা সে জানে না অথবা হয়ত ভুলে গেছে। বদ্ধ ঘরে জীবনযাপনে পরী অনেক কিছুই ভুলে গেছে।

পরী বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে দাঁড়ালো। অনড়দৃষ্টি রাখলো বাহিরে। রেনুকা ভ্রু কুঁচকে ঘরের ভেতর পর্যবেক্ষণ করছে।

এখানে কি করছেন?

গম্ভীর তিক্ত কন্ঠ শুনে রেনুকা মৃদু কেপে পেছনে তাকালো। ফায়াজ ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে আছে। রেনুকা স্বাভাবিক হয়ে বলল,
এই ঘরে ও কি করছে? আর এসব কে করেছে?

ফায়াজ দু কদম এদিকে এলো। প্যান্টের পকেটে দুহাত পুরে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালো।
পরী এখন থেকে এই ঘরেই থাকবে আর এভাবে ঘর সাজাতে আমি বলেছি।

রেনুকা ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল, আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। এত কিছুর অধিকার আপনাকে দেয়া হয় নি।

ফায়াজ তাচ্ছিল্য হাসলো। পরীর দেখাশোনার অধিকার মানে তার সংশ্লিষ্ট সব কিছুর অধিকার।

ফায়াজ আর রেনুকার কথার মাঝেই মইনুর শেখ ঘরের সামনে এলেন। ফায়াজ আড়চোখে মইনুর শেখের দিকে তাকিয়ে বলল,
এরপর থেকে পরীর সাথে যা যা হবে ওর ভালোই জন্যই হবে।

মইনুর শেখ সরাসরি তাকালেন ফায়াজের দিকে। ফায়াজ ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে সেখান থেকে চলে গেল।

_______
আজ দ্বিতীয় দিন ফায়াজ বাড়ি থেকে বের হয়েছে। জঙ্গল পেড়িয়ে রাস্তায় উঠতেই সেদিনের টং দোকানির দেখা মেললো। দোকানি ফায়াজকে দেখে সৌজন্য হাসলো।
কেমন আছেন সাহেব?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন?

আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। চা দিব সাহেব?

না। এখন আর চা খাবো না। একটু তাড়ায় আছি।

কই যান?

ফার্মেসি খুঁজতে বেরিয়েছি। আপনি বলতে পাড়েন এখানে ফার্মেসি কোথায়?

ওষুধের দোকান?

জ্বি।

চলেন আমি আপনারে নিয়া যাই।

ফায়াজ ব্যস্ত হয়ে বলল, না না ঠিক আছে। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আপনি শুধু ঠিকানাটা বলে দিন আমি খুঁজে নিব।

দোকানি উঠে দাড়ালো। তালা চাবি হাতে নিয়ে বলল,
সমস্যা নাই সাহেব। এখন এমনিও বাড়ি যাব। আর গ্রামে চিপা রাস্তার অভাব নাই। আপনে পারবেন না। আমার সাথে চলেন।
ফায়াজ নিরবে সম্মতি দিল। দোকান বন্ধ করে চাবি শার্টের পকেটে রেখে বলল, চলেন।

ফায়াজ হাসলো। আপনার নাম কি?

আব্দুল্লাহ।

সুন্দর নাম। আমি ফায়াজ। পেশায় একজন লেখক।

আপনে লেখক?

জ্বি।

কিছুক্ষনের মাঝেই ফায়াজ আর আব্দুল্লাহর বেশ জমে গেল। কথার এক পর্যায়ে আব্দুল্লাহ বলল,
আপনে অনেক ভালো মানুষ, সাহেব।

ফায়াজ হাসলো। আমি ভালো মানুষ? কি করে বুঝলেন?

এই যে আপনে শহরের মানুষ তাও আপনের কোন দেমাগ নাই। কত সুন্দর ভাবে আমার সাথে কথা বলতেছেন। কিন্তু গ্রামেরই অনেক মানুষ আছে যাগো দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না।

যেমন?

জাহিদ সরদার, মিঞ্জু কাজি, মইনুর শেখ, সোহেল রা…

মইনুর শেখ? আব্দুল্লাহর কথার মাঝে ফায়াজ প্রশ্ন করলো।

হ্যা।

ফায়াজ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাস করল,
কেন কি করেছেন তিনি?

আব্দুল্লাহ বলতে যেয়েও থেমে গেল। কথা বলতে বলতে ভুলেই গিয়েছিল ফায়াজ মইনুর শেখের বাড়ির মেহমান। না সাহেব কিছু না।

আমি কাউকে কিছু বলব না। আপনি আমাকে বলতে পাড়েন।

আব্দুল্লার চুপ থাকার কারন এত সহজে ফায়াজ ধরে ফেলবে আব্দুল্লাহ বুঝে নি। প্রথমে কিছুটা আমতা আমতা করলো কিন্তু পরক্ষনে নিচু স্বরে বলল,
সাহেব, মইনুর শেখ অনেক দেমাগি মানুষ কিন্তু এই পর্যন্ত কারো সাথে উঁচু গলায় কথা বলে নাই। কাউরে যদি অপছন্দ হয় তার সব শেষ কইরা দেয়।
আব্দুল্লাহ থেমে আবার বলল, পরী নামের যেই মাইয়া আছে ওনার বাড়ি, সে মইনুর শেখের আপন মাইয়া না। তার বউয়ের আগের ঘরের মাইয়া। গ্রামের লোক বলাবলি করে পরীর বাপের অনেক সম্পত্তি আর সেগুলা সব পরীর নামে। সম্পত্তির লোভে মইনুর শেখ পরীর বাপেরে মাইরা পরীর মায়েরে বিয়া করছে আর পরীরে নিজের কাছে রাখছে যাতে সম্পত্তি সে পায়।

আপনি পরীর বাবাকে চেনেন?

না সাহেব। শুনছি ওর বাপের বাড়ি চার গ্রাম পরে সরিষাবাড়ী এলাকায়।

ফায়াজ চুপ রইলো। আব্দুল্লাহ আরো অনেক কথা বললো। কথা বলতে বলতে রাস্তা ফুরিয়ে গেল। তারা চলে এলো ফার্মেসিতে। ফায়াজ লিস্ট অনুযায়ী কিছু ওষুধ নিল।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here