নীলাম্বরীর_প্রেমে
Tuhina pakira
পর্ব : ১৮
সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ স্পর্শ মোড়ের মাথার চায়ের দোকানে চলে যায়। অরূপ আর সাদ আগে থেকেই ওখানে বসে রয়েছে। এতদিন পর বন্ধুকে দেখে দুজনে গিয়ে স্পর্শ কে জড়িয়ে ধরে।
-” স্পর্শ তুই তো আরও কিউট ড্যাশিং হয়ে গেছিস?”
-” সাদ তোর ফালতু বকা বন্ধ কর। ”
-” সাদ কী এমন ভুল কথা বলেছে? তুই তো আরও স্মার্ট হয়ে গেছিস।”
-” বেশি বকিস না অরূপ। কেমন আছিস তোরা? কতো দিন পর সামনা সামনি হলাম বল!”
-” আমি তো বিন্দাস আছি। তবে অরূপের টা জানি না। ইদানিং খুব ব্যস্ত।”
সাদের কথায় তাল মিলিয়ে স্পর্শ ও বললো,
-” হ্যাঁ আমিও তাই দেখছি। যখনই ফোন করছি ফোন ব্যস্ত। কী ব্যাপার ভাই? ”
-” ব্যাপার তেমন কিছুই না। মা আমার জন্যে মেয়ে দেখেছে। ওই, তার সাথেই কথা বলি। আর কিছু না।”
অরূপ বেশ লাজুক হেসে কথাটা বললো। হঠাৎই ওর পিঠে জোরে খুশিতে ছোট ঘুষি মেরে উঠলো সাদ।
-” ওরে বাপরে মরে গেলাম। ওই শয়তান মারলি কেনো?”
-” আরে ভাই খুশির ঠেলায়। তুই তো আমাকে খুশি করে দিলি ভাই। তাড়াতাড়ি বিয়েটা কর। আমি তো আর ওয়েট করতে পারছি না। ”
-” বিয়ে তো অরূপের হবে। তোর এত কিসের মজা?”
-” আরে বুঝিস না কেনো স্পর্শ। অরূপের বিয়েতে অনেক মেয়ে আসবে ওখান থেকে আমিও আমার সেটিং করে নেবো। এই সিঙ্গেল লাইফ ভালো লাগে না। বাড়িতে মা বিয়ে কর কর করে মাথা খারাপ করে ফেলছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই বলছে মেয়ে দেখতে। আমার কাকার মেয়ের এক বন্ধুর জন্যে আবার সম্বন্ধ নিয়েও চলে গিয়েছিল।”
স্পর্শ হেসে তিনটে চা বলে বেঞ্চে বসে বললো,
-” তা তো ভালোই। তো বিয়ে করে নে।”
-” তুই কর না। আমায় বলিস কেনো। আমি তো দু – তিন বছর প্রেম করে তারপর বিয়ে করবো। আমি কি আর অরূপের মতো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করবো নাকি?”
-” কে যেনো তার বাপকে যমের মতো ভয় পায়?”
-” হ্যাঁ তাইতো। এই অরূপ, কে সেই ভাগ্যবান?”
সাদের মুখ চুপসে গেল। ওর মুখ দেখে স্পর্শ আর অরূপ হেসে উঠলো। আসলে সাদ যতই বড়ো বড়ো কথা বলুক না কেন, ও ওর বাবাকে ভীষণ ভয় পায়। সাদের বাবা আর্মিতে ছিলেন ১২ বছর। ওনার মুখের হাসির কথাও মনে হয় গর্জন মেশানো। ওনার একবার ‘বাবু’ আওয়াজে পারলে সাদের এখনও কাপড়ে চোপরে হয়ে যায়। বাইরে যতই ফাঁকা ডায়লোগ দিক না কেনো। বাড়িতে বাবার কথায় এখনও ওঠে বসে সাদ। তবে বাবাকে ভীষন ভালবাসে।
সাদ কথা ঘোরানোর জন্যে চা বিক্রেতাকে বললো,
-” ভোলা কাকু চা হয়েছে?”
ভোলা চা এর ছোটো হাড়িতে কয়েকটা এলাচ ফেলে দিয়ে বললো,
-” এইতো হয়ে গেছে সাদ বাবা। ”
স্পর্শ ও ওর বন্ধুদের আড্ডা খানা বলা যেতে পারে এই ভোলা শর্মার চায়ের দোকান। তরুণ থেকে বৃদ্ধ সকলেরই সময় কাটানোর জায়গা এটা। আজ শনিবার হওয়ায় অনেকেই এখানে আড্ডা দিতে চলে এসেছে। গরম গরম চায়ের সাথে প্রজাপতি বিস্কুট কিংবা বাসনা এতে আড্ডা জমে ক্ষীর। ভোলা কাকু চায়ের ভাঁড় তিনটে ওদের দিকে এগিয়ে দিল।
-” কেমন আছো স্পর্শ বাবা?”
মধ্য বয়স্ক ব্যাক্তিটি তার ছোটো ব্যাক্তিদের বাবা , বাছা সম্বোধন করে।
-” আমি খুব ভালো আছি কাকা। তুমি কেমন আছো? ”
-” এই চলে যাচ্ছে। অনেকদিন পর তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।”
-” আমারও খুব ভালো লাগছে।”
অন্য খদ্দেরদের ডাকে ভোলা কাকু নিজের কাজে চলে গেলো।
-” হ্যাঁ রে, আমাদের মিথিলা শাকচুন্নির কী খবর?”
-” ওর খবর তো জিঙ্গালালা হুই হুই।”
সাদ দুই হাত তুলে নাচের স্টাইলে কথাটা বলল। স্পর্শ আর অরূপ হেসে দিল। অরূপ চায়েতে চুমুক দিয়ে বললো,
-” তোর সঙ্গে কথা হয় না স্পর্শ?”
-” ওই পেত্নীর কথা কি বলবো, প্রথম প্রথম দিনে কতবার যে ফোন করতো তার ইয়াত্তা নেই। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর থেকে ফোন করতো ওই সপ্তাহে একবার। তারপর তো আর ফোনই করে না। মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে কেমন আছিস আর কি করছিস জিজ্ঞেস করতো। তারপর এখন তো কথাই হয় না।”
-” ওকে তো কেউ বলিনি তুই এসেছিস। ও জানতে পারলে ঠিকই দেখা করতো।”
অনেক দিন পর তিন বন্ধু মিলে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলো। অরূপ আর সাদ চলে গেলো ওদের বাড়ি। কেবল স্পর্শ বসে রইলো। ভোলা কাকুকে আর একটা চা দিতে বলে ও তাকিয়ে রইল রাস্তার দিকে। এই রাস্তা দিয়ে নীলাম্বরী আসলেও আসতে পারে। বলা যায় না, মানুষ যখন কাউকে দেখার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে অপেক্ষা করে; তখন দমকা হাওয়ায় মতো কখনো কখনো তার সঙ্গে দেখাও হয়ে যায়। আর স্পর্শের এখন নীলাম্বরীকে দেখার তীব্র ইচ্ছে করছে। যদি দেখা হয়, যদি দু- একটা কথা হয় তাহলে কি খুব খারাপ হবে? খুব কী খারাপ হবে তার সঙ্গে সোডিয়ামের আলোর ভিড়ে কয়েক মুহূর্ত পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটলে?
♣
স্পর্শের সঙ্গে ওর মনের নীলাম্বরীর দেখা আদৌ হবে কিনা তা তো ঠিক জানিনা। তবে তার জীবনের আয়ুরেখার দেখা তো হতেই হতো। তাই তো দমকা হাওয়ায় মতো স্পর্শের বহু আকাঙ্খিত দৃষ্টি তার প্রতিবেশীনীর উপরেই পড়লো।
স্পর্শ সবে গরম চায়ে প্রথম চুমুক দিয়েছে। আয়ু অটো থেকে নামলো বলতে গেলে স্পর্শকে দেখতে দেখতে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আয়ু পার্সে কিছু খুঁজতে লাগলো। ভ্রু কুঁচকে স্পর্শ আয়ুর দিকে তাকিয়ে চা খেতে গিয়ে গরম চা মুখে পুরে ফেললো। কোনো মতে মুখের চা ঘিটে মুখে হাওয়া পুড়লো আবার বের করলো। চা টা খুব বেশি পরিমাণ গরম নেই। তাও জিভ হালকা জ্বলছে। ভোলা কাকার কাছে গিয়ে মানিব্যাগ থেকে অরূপ, সাদের এক কাপ করে আর ওর দুটো চায়ের চল্লিশ টাকা দিয়ে স্পর্শ গাড়ি আসছে কিনা দেখে রাস্তা পেরোলো।
-” কী হয়েছে?”
আয়ু পাশে তাকিয়ে দেখলো স্পর্শ৷ কিন্তু ওকে কিছু না বলে নিজের ব্যাগটা একবার চেক করে অটোওয়ালাকে বললো,
– ” দাদা দেখুন না আপনার কাছে ১০০ টাকা খুচরো হবে না৷ আমার কাছে ২০ টাকা খুচরো নেই৷ ”
– ” দিদি আমি তো বললাম আমার কাছে খুচরো হবে না৷ আপনি আশেপাশে দোকানে দেখুন যদি পান৷ ”
স্পর্শ আয়ুর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো৷ কেনো ওকে বললেই তো হয়৷ ও তো জিজ্ঞেসও করলো ওর কি হয়েছে। স্পর্শ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বললো,
-” খুচরো লাগবে এটা বলতে কি তো খুব কষ্ট হচ্ছে? হলে বল , সামনেই একটা হাতুড়ে ডক্টর বসে ওর কাছে তবে নিয়ে যাই।”
আয়ু চুপ করে স্পর্শের দিকে গাল ফুলিয়ে তাকালো।
-” কতো টাকা দাদা? ”
-” ২০ টাকা।
স্পর্শ পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে অটোওয়ালাকে দিতেই তিনি অটো নিয়ে চলে গেলো।
স্পর্শ পকেটে মানিব্যাগ রেখে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
-” চল আয়ু। বাড়ি যাবি তো তুই?”
আয়ুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্পর্শ পিছনে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-” এই যে ম্যাডাম চলুন। ”
আয়ু কিছু না বলে স্পর্শের দিকে ওর হাতের টাকাটা এগিয়ে দিল। স্পর্শ পকেট থেকে আবারও মানিব্যাগ বের করে হাঁটা দিল। আয়ুও ওর পিছু পিছু এলো। কিছুক্ষণ মানিব্যাগটা দেখে স্পর্শ ওটা আয়ুকে দেখার জন্যে ওর সামনে ধরলো। আয়ু একবার ব্যাগের ভিতরটা দেখে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে খুচরো নোট কিছু নেই।
-” ঠিক আছে , আমি বাড়ি গিয়ে খুচরো করে দিয়ে দেবো।”
স্পর্শ পকেটে ব্যাগটা রাখতে রাখতে বললো,
-” তোর কি মনে হয় আমি বলবো আমাকে টাকা দিতে হবে না? ওই সব এখন অতীত। আগে বাবার টাকায় চলতাম তাই কিছু মনে হতো না। তবে এখন কষ্ট করে অর্জিত টাকা খরচ করতে খুবই মায়া হয়।
একটা মানুষ কতো পরিশ্রমের পর মাস শেষে নিজের পারিশ্রমিক পায় সেটা তারাই বোঝে। অনেকে তো নিজের প্রাপ্য পারিশ্রমিক টুকুও পায় না।”
আয়ু মন দিয়ে স্পর্শের কথা গুলো শুনলো। নিজের বাগের সাইড থেকে দুটো চকলেট লজেন্স বের করে একটা স্পর্শের দিকে এগিয়ে দিল। স্পর্শ লজেন্স এর প্যাকেট খুলে লজেন্স মুখে দিল।
-” ঘুষ দিলি আমাকে?”
-” আমি বড়ো সৎ মানুষ। ঘুষ টুস আমার অভিধানে নেই।”
-” আচ্ছা, তুই সৎ মানুষ! ”
-” এতে এতো অবাক হওয়ার কী আছে?”
-” না ওই আরকি। ”
নির্জন রাস্তায় দুজনে হেঁটে চলেছে। যেমনটা স্পর্শ চেয়েছিল, তার নীলাম্বরীর সাথে হাঁটতে। কিন্তু এটা তো আয়ু। তাহলে কি স্পর্শের ইচ্ছেটা ইচ্ছেই থেকে গেলো? আর আয়ু, আচ্ছা আয়ুর মনের কোনো চোরা আঁধারে স্পর্শকে নিয়ে এমন কোনো ভাবনা কি কখনো ছিল? হয়তো ছিল। তবে ভবিষ্যত তো জানি না। হয়তো আয়ু এখনও চায় স্পর্শের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সারাটা জীবনের এক একটা মুহূর্ত পার করতে।
-” আচ্ছা আয়ু, দুই দিন হলাম আমি এসেছি। তুই একবারও তো বললিনা আমি কেমন আছি?”
আয়ু সামনের রাস্তার একটা ছোটো ইটকে পা দিয়ে ধাক্কা মেরে বললো,
-” কিছু মানুষকে দেখলে বোঝা যায়, সে কেমন আছে। সেই সেন্স থেকে আমার মনে হয়েছে তুমি ভালোই আছো।”
-” আগে কেমন ছিলাম বলতে পারবো না। তবে এই দুই দিন খুব ভালো আছি বুঝলি। ”
-” কেনো এই দুই দিন কী এমন ছিল?”
-” গেস কর।”
আয়ু মলিন হেসে বলল,
-” বুঝলাম। তো তোমার নীলাম্বরী কেমন আছে?”
দুহাত বুকের মাঝে গুজে স্পর্শ হাসলো। কিছু মানুষ বুঝেও বোঝে না; আর কিছু মানুষকে বোঝালেও বোঝেনা।
-” আছে তো। তবে সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করে সে বেশ ভালো আছে। আমাকেও করেছে। আমি কথা বাড়াই নি তার কথা মেনেই নিয়েছি। তবে কি বলতো, সে বড্ড অভিমানী। তার অভিমান এই আছে এই নেই। কখনো মনে হয় সে খুব করে অভিমান করে। আবার কখনো মনে হয় সে ঠিক মতো অভিমান করতেই পারে না। সে ভাবে আমাকে এড়িয়ে চললে আমার থেকে দূরে যাওয়া যায়। কিন্তু সে এটা বোঝে না, পাখি যতই দূর আকাশে যাক না কেনো। তার শেষ ঠিকানা তার সুখের নীড়ই হয়। সেও ঠিক ঘুরে ফিরে আমার কাছেই আসে।”
স্পর্শকে লুকিয়ে আয়ু তপ্ত একটা নিশ্বাস ফেললো। ভাবনাটা হলো, স্পর্শ বোঝেনি। কিন্তু এর আসল ভাব, স্পর্শ সবটাই দেখেছে, অনুভব করেছে। কারোর হৃদয় জোড়া চাপা লুকোনো অব্যক্ত কষ্টও সে উপলব্ধি করেছে। কিন্তু সে কিছুই বললোনা। ভনিতা সে করেই গেলো।
-” আয়ু ?”
-” হুহু।”
-” আমি অভিমানীর মলিন হাসি দেখতে ভালোবাসি। আহা! বড়ো ভালোবাসি।”
-” এটা কি তবে তোমার নিষ্ঠুরতা ভাববো?”
-” মানুষ ভাবে অনেক কিছুই তবে সব ভাবনা নিষ্ঠুরতা না। কিছু ভাবনা মনের গহীন ভালোবাসাও হয়। শুধু বুঝতে বেলা পড়ে যায়।”
(চলবে )
{ বিঃ : বড়ো করে দিয়েছি। গল্পটা দুদিন খাপছাড়া লেগেছে নিজের কাছেও। আজকের টা কী ঠিক হলো? ভুল ক্ষমা করবেন । ভালো কিংবা খারাপ কেমন হয়েছে জানাবেন । হ্যাপি রিডিং }