নীলাম্বরীর_প্রেমে Tuhina pakira পর্ব : ২১

#নীলাম্বরীর_প্রেমে
Tuhina pakira
পর্ব : ২১

“বয়স তখন বড্ড অল্প
ওইতো সবে ষোড়শী।
ভালোবাসাটা নেহাতই আবেশ;
ওই যে, ছোট্ট মানবী।

ভালোবাসার তরুণ যুবক
দিলো না তাকে স্বীকৃতি।
ভালোবাসাটা নেহাতই আবেশ;
ওই যে, ছোট্ট মানবী।।”
–( তুহিনা)

— দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ একটা গাড়ি এসে থামলো স্পর্শের মামার বাড়ি। একে একে স্পর্শ, দিহান, আয়ান, দ্রুতি ভিতরে চলে গেলো। স্পর্শের দুই মামা। বড়ো মামা ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-” কেমন আছিস? কতদিন পর আসলি বলতো?”

-” আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?”

-” ওই চলছে। চল ফ্রেশ হয়ে নিবি।”

-” তুমি ওদের নিয়ে যাও আমি একটু আসছি।”

ওদের কে রেখে স্পর্শ বেরিয়ে পড়লো। গন্তব্য আয়ুর মামার বাড়ি, ওদের দুই জনেরই একই জায়গায় মামার বাড়ি। কাল সকালে যখন শুনলো আয়ু বাড়িতে নেই, তখন ওর খুব রাগ উঠেছিল। অপর দিকে কেউ ঠিক জানেও না। সারাদিন চারিদিকে খোঁজ করে না পেয়ে স্পর্শ যখন অস্থির হয়ে যাচ্ছিল তখনই একটা ফোন কল আসে। তারপর সকাল সকাল একসঙ্গে বেরিয়েও পড়েছে।

চারিদিকে ধু ধু করছে মাঠে। কেউ তেমন নেই এখানে। স্পর্শ একাই হেঁটে চলেছে। সামনেই কতকগুলো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। স্পর্শকে বেশি দূর যেতে হলো না, তার আগেই কারোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।

-” তোর ঢেঁড়শ বোন কোথায় পলাশ?”

পলাশ এতক্ষণ পুকুরের পাড়ের একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে আকাশ দেখছিল। স্পর্শের গলা শুনে একগাল হেসে ওকে জড়িয়ে ধরলো।

-” বাবা, এই তো কাল রাতে কল করলাম এর মধ্যেই চলে এলি? এতো ভালোবাসা?”

-” বেশি না বকে তুই বলে আয়ু কোথায়? ”

-” আরে রাগছিস কেনো? ওই তো ঐখানে বাগানে ওর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরছে। তুই দাঁড়া আমি ডেকে আনছি।”

পলাশ একছুটে আয়ুর কাছে গিয়ে ওকে ডেকে আনলো। স্পর্শ তখন পুকুরের দিকে ঘুরে তাকিয়ে রয়েছে।

-” আরে দাদা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস। দেখ ওখানে ছায়া ছিল এখানে রোদ….”

আর কিছু বলতে পারলো না। সামনে স্বয়ং স্পর্শ দাঁড়িয়ে। স্পর্শ আয়ুর দিকে তাকালো না, আয়ুর পিছু পিছু আসা সজল আর রুহিকে শক্ত গলায় বলল,

-” তোমরা যেখানে ছিলে সেখানে যাও। এখানে কি আছে? পলাশ তুই ,,,,”

পলাশকে বলার আগেই ও রুহি , সজলকে ইশারা করে পিছু ঘুরে হাঁটা দিল। স্পর্শ ক্ষেপেছে আজ।

স্পর্শ আয়ুর দিকে না তাকিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে তাকিয়ে রইল। আয়ু খুব ভালোই বুঝেছে, স্পর্শ আজ ক্ষেপেছে। পরপর দুই – তিনবার ঢোক গিলে ও স্পর্শের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু যখন দেখলো স্পর্শ কথা বলছে না, তখন ও যেতে উদ্যত হলো।

-” ওখান থেকে এক পা নড়বি তো, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ”

স্পর্শের ধমকে রীতিমতো আয়ু চমকে গেলো। হাত দুটো মুঠো করে ধরে একটা আঙ্গুলের সঙ্গে আরেকটা আঙ্গুল ঘষে চলেছে। স্পর্শ আবারও চিৎকার করে বললো,

-” কোন সাহসে তুই এখানে এসেছিস? তুই জানিস না আমরা সবাই একসঙ্গে পিকনিকের প্ল্যান করে ছিলাম? ”

আয়ু চুপ করে আসামীর ন্যায় নীচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। স্পর্শ আয়ু কে চুপ করে থাকতে দেখে পিছন ফিরে ওর দুই হাত শক্ত করে ধরে বললো,

-” কী রে, কানে কথা যায় না? কেনো এসে…..”

স্পর্শ পুরো থমকে গেলো আয়ু কে দেখে। মুখের কথাগুলো যেনো শব্দহীন হয়ে পড়লো। সামনে যেনো কোনো এক নীলাম্বরী দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীল বর্ণের শাড়িটা গ্রামবাংলার মেয়েদের মতো পড়েছে, আঁচলটা কোমরে দুই – তিন পাক দিয়ে গোঁজা, মাথায় সুন্দর করে খোঁপা করে রেখেছে, হাতে রেশমী চূড়ি পড়ে আয়ুর দিক থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল। এই মেয়েটাকে পারলে স্পর্শ ওর বুকের মধ্যে পুরে রাখে।

স্পর্শকে চুপ করে থাকতে দেখে আয়ু মাথা তুলে ওর দিকে তাকালো। স্পর্শের চোখের দিকে তাকিয়ে আয়ু যেনো হারিয়ে গেলো, স্পর্শ ওর চোখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আয়ুর নিশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে। আয়ু আর তাকাতে পারলো না, লজ্জায় মাথা নামিয়ে উল্টো দিকে ফিরে চোখ বন্ধ করে নিলো। বুকের বাম দিকটা কেমন যেনো হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে, সারা শরীর যেনো এই মুহূর্তে অবশ হয়ে যাবে। আয়ুর কাছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেনো কষ্টসাধ্যব্যাপার। কিন্তু ও লজ্জায় এক পা ও সামনে বাড়াতে পারছে না। হাতের কাঁচের রেশমী চুড়িগুলো এক একটা করে টানতে লাগলো। আয়ু কে ঘিরে রেখেছে এক ঝাঁক লজ্জা। আচ্ছা স্পর্শ কী এখনও ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে? কথাটা ভেবেই আয়ুর লজ্জা যেনো দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলো। কড়া রোদে মাঠে কেউ নেই। দুএকজন কে দেখা যাচ্ছে তবে অনেক দূরে।

গুণে গুণে তিনটে চুড়ি ভেঙে মাটিতে পড়ল। চুড়ি ভাঙার রিন রিন শব্দে আয়ুর হুশ ফিরল। না ও আর এখানে থাকবে না। ধুলো মাখা খালি পায়ে ছুটে পালাতে যেতেই পিছন থেকে স্পর্শ ওর হাত ধরে ফেললো,

-” পালাচ্ছিস যে বড়ো?”

স্পর্শের প্রশ্নের উত্তর তো দূর ওর দিকে তাকালো না পর্যন্ত। ভালোবাসার মানুষটা যদি তোমার হাত ধরে তাহলে বুঝি এইরকম অনুভূতি হয়, যেমনটা ওর হচ্ছে?

আয়ু কে চুপ করে থাকতে দেখে স্পর্শ ওর হাতটা টেনে ওর মুখোমুখি দাঁড় করালো। তৎক্ষণাৎ আয়ু চোখ বন্ধ করে ফেললো, স্পর্শ আস্তে করে আয়ুর চোখে ফু দিতেই আয়ু কেঁপে উঠে স্পর্শের হাতটা খামচে ধরলো। স্পর্শ মুগ্ধ চোখে আয়ুর দিকে তাকিয়ে রইল,

-” আচ্ছা যা বলতে হবে না। শুধু এটা বল তুই এত সেজেছিস কেনো? কার জন্যে এতো সাজ আয়ু? একে বারে নীল শাড়িতে নীলাম্বরী?”

স্পর্শের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে আয়ু একটু সরে দাঁড়ালো ওর থেকে। নাহলে নির্ঘাত ওর হৃদয় ওখানেই বন্ধ হয়ে যেতো। আয়ু বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেললো।

-” কারোর জন্যে না তো? আর আমি সেজেছি তো তোমার কী?”

-” আমারই তো সব কিছু। এই যে তুই এত সুন্দর করে সেজে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস এতেও আমার সব কিছু। আবার আমাকে ভুল বুঝে মিথিলার কথা শুনে আমার থেকে দূরত্ব বাড়ানো, এতেও আমার সব কিছু। ”

আয়ু চমকে স্পর্শের দিকে তাকালো।

-” মিথিলার একটা কথা শুনে এতোটা দূরত্ব বাড়িয়ে দিলি। কিন্তু আমাদের একসঙ্গে ছোটো থেকে বড়ো হওয়া, একে অপরের সঙ্গে মারামরি, ঝগড়া, খুনশুটি তুই সব ভুলে গেলি। কী করে ভুলে গেলি?”

আয়ু মাথা নীচু করে ফেললো।

-” আই অ্যাম সরি স্পর্শ দা। আর কখনও হবে না। মিথিলা দি আমাকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছিল শুনি নি। পড়ে তো মিথিলা দির বিয়ে হয়ে যায়। সেই দিন মামার বাড়ি আসার সময় আমার সঙ্গে মিথিলা দির দেখা হয়। সেই দিন কী মনে করে সব কথা শুনে ছিলাম। তুমি না, মিথিলা দির তোমাকে ভালো লাগতো। আর কিছু না।”

-” তাহলে আগেই যখন জেনে গিয়ে ছিলিস, এখানে এলি কেনো? বাড়ি যেতে কষ্ট হচ্ছিল?”

আয়ু গালে হাত দিয়ে মাথা দুলিয়ে জ্ঞানী দের মতো বললো,
-” না মানে, আমি ভাবলাম তোমাকে যখন বিনা দোষে কষ্ট দিয়েছি তাহলে আর দুটো দিন দিলে ক্ষতি কিছু নেই, তাই না?” আর তাছাড়া তুমিও তো দিয়েছ। আমাকে নাকি ভালো বাসে না , মিথ্যুক।”

-” তোমরা গালে দু খানা চড় হাঁকাবো, তখন ব্যাথায় চিৎকার করে কাঁদলেও দেখবো না।”

আয়ু পুরো ঝগড়া করার মতো কোমরে হাত রেখে বলল,

-” উহু, বলেছে। আমি এখন স্ট্রং গার্ল, আমি আর বাচ্চাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদি না। আর তাছাড়া জ্ঞান হবার পর থেকে তো তোমার হাতের চড় খাবো শুনেই এলাম, আজ পর্যন্ত মারতে তো পারলে না। আর এমনিতে ভবিষ্যতে পারবেও না।”

-” আমার সামনে এসে কথাটা বল একবার।”

-” সামনেই তো আছি। আর কতো সামনে যাবো?”

তবুও আয়ু একটু এগিয়ে গেলো। স্পর্শের হাতটা ধরে বললো,

-” নাও মারো দেখি।”

স্পর্শ জোর করে ওর হাতটা ছাড়াতে চাইলো, কিন্তু আয়ু কিছুতেই ছাড়বে না।

-” বলছিনা মারো। আমি আজ তোমার হাতের চড় খেয়ে দেখবো তেতো, ঝাল নাকি মিষ্টি?”

স্পর্শ জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিলো। আয়ু একগাল হেসে বলল,
-” দেখলে তো পারলে না। এই জন্যেই তো আমি তোমায় এত্তো ভালোবাসি। ”

-” তাতে কী আমি তোকে ভালবাসি নাকি? আমি তো আমার নীলাম্বরীর প্রেমে আবেশিত।”

আয়ু এবার খানিক হেসে স্পর্শের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো,
-” বাসো, ভালোবাসো। খুব খুব ভালোবাসো। আগে বুঝেও ঠিক মত বোঝা হয়ে ওঠেনি। তবে এখন ঠিকই বুঝি। তাই তো ভাবি, নীল শাড়িতে নীলাম্বরী বলে আমাকে, আর সে কিনা অন্য নীলাম্বরীকে ভালোবাসে। ”

স্পর্শ আয়ুর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে কিছু বের করে আয়ুর সামনে বসে পড়লো।

-” আরে কি করছো? পায়ে হাত দিও না। ”

স্পর্শ কোনো কথা না শুনে আয়ুর এক পায়ে একটা নূপুর পরিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

– আরেক পায়ের নূপুর টা দে ?”

আয়ু একবার পায়ের দিক তো একবার স্পর্শের দিকে তাকালো। বোকা বোকা হেসে বলল,

-” হারিয়ে গেছে।”

স্পর্শ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

-” তুই ওটা হারিয়ে ফেলেছিস, নাকি আমার উপর রাগ করে কোথাও ফেলে দিয়েছিস? আয়ু তুই এমন একটা কাজ কী করে করলি?”

স্পর্শ রাগ দেখিয়ে হনহন করে কিছুটা এগিয়ে গেলো। আর আয়ু মন খারাপ করে বললো,

-” বিশ্বাস করো ওটা হারিয়ে গেছে। আমি ফেলিনি ওটা। ”

আয়ুর মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলো। স্পর্শ ওকে সামান্য একটা দায়িত্ব দিয়েছিল, ও সেটাও ঠিক মতো পালন করতে পারলো না।

আয়ুর ভাবনার মাঝে কিছু একটা ওর মাথায় এসে টোকা লেগে নীচে পড়ে গেলো।

-” একটা সামান্য কাজও তোকে দিয়ে হয় না।”

-” কী ছুড়লে তুমি এটা?”

আয়ু মাথায় হাত দিয়ে নীচে তাকিয়ে জিনিসটা তুলে দেখলো এটা ওর হারিয়ে যাওয়া নূপুর।

-” স্পর্শ দা তুমি তারমানে,,,,”

আয়ু স্পর্শের দিকে ছুটে গেলো । স্পর্শ ও ভো দৌড় দিল। আজ আয়ু ধরতে পারলে বেধড়ক পিটুনি দেবে।

-” দাঁড়াও বলছি।”

-” আজ মার খেতে চাই না। আজ আমার নীলাম্বরী আমার মনের পাশাপাশি নিজের হয়েছে। আজ আমি আনন্দ করবো আমার নীলাম্বরী কে নিয়ে। তোর সঙ্গে ছুটোছুটি খেলতে পারবো না। যা বাড়ি যা।”

-” যতই ফালতু বকো না কেনো, ঘুরে ফিরে সেই আমার কাছেই তোমাকে আসতে হবে।”

-” আসবোনা, যা ভাগ।”

(চলবে )
{ বিঃ : ভুল ক্ষমা করবেন । ভালো কিংবা খারাপ কেমন হয়েছে জানাবেন । হ্যাপি রিডিং }

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here