নীল চিরকুট পাঠ-২

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

২.

সারারাত উত্তেজনায় ছটফট করে ভোর চারটার দিকে ঘুমুতে গেল নম্রতা। কলেজে তখন ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। পরীক্ষার আগের দিনের ক্লাসটা তখন ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ। সারা বছর টু টু করে ঘুরে বেড়ানো নম্রতাদের জন্য শীট, নোট কালেক্ট করার সেই এক মোক্ষম সময়। কিন্তু নম্রতার মাথায় পরীক্ষার চিন্তা খেলল না। পরীক্ষার প্রতি সেনসেটিভ নম্রতা গ্রীষ্মের ঝুম বৃষ্টি মাথায় করে কলেজে গেল ঠিক, কিন্তু দু’মিনিটও টিকল না। ক্লাসরুমের পেছন দরজা দিয়ে নীরাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনলো। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে নয়টার দিকে শাহাবাগ গ্রন্থাগারে গিয়ে পৌঁছাল তারা। গ্রন্থাগার তখন মাত্রই খুলেছে। নম্রতা উত্তেজনা নিয়ে দ্বিতীয় তলার দিকে ছুট লাগাল। নীরা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ এতোদিন আমার শুধু সন্দেহ ছিল। আজ প্রমাণ হয়ে গেল যে তুই মারাত্মক পাগল। কাল বিকেলে মাত্র চিঠি লিখলি। আজই উত্তর পেয়ে যাবি? তোর কি ধারণা? মানুষ তোর চিঠির জন্য হা-হুতাশ করে মরে যাচ্ছে?’

নীরার কথায় নম্রতার উৎসাহ খানিক মিইয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপাল থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়ল। কম্পিত হাতে ফিলোসোফির বইটা উঠিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। নীরা তাড়া দিয়ে বলল,

‘ কি রে? দেখ জলদি। এসেছে তোর চিঠি?’

নম্রতা চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল,

‘ যদি না থাকে?’

‘ যদি নয়। সত্যিই থাকবে না। সবাই তো আর তোর মতো পাগল নয় যে বই না পড়ে বইয়ের ভেতর চিঠি খুঁজে বেড়াবে। তবু দেখ। কথায় আছে, মনের শান্তিই বড় শান্তি।’

নম্রতা মলাটের নিচে চিঠির খোঁজ করল। তার নিজের লেখা চিঠি ব্যতিত ভিন্ন কোনো চিঠি পাওয়া গেল না। নীরা গুজগুজ করে বলল,

‘ বলেছিলাম পাবি না। শুধু শুধু ক্লাসটা মিস করলি। স্যার নিশ্চয় কত্তকিছু দাগিয়ে দিয়েছে। পরশু পরীক্ষায় কী লিখব আমরা?’

নম্রতা জবাব দিল না। বৃষ্টি ভেজা চুপসানো মুখ নিয়েই বাড়ি ফিরলো। অসময়ের বৃষ্টিতে ভেজায় পরের দিনই ভয়ানক জ্বরে কাহিল হলো। জ্বর আর পরীক্ষার চাপে চিঠির কথা বেমালুম ভুলে গেল নম্রতা। প্রায় এক সপ্তাহ পর, পরীক্ষা শেষে বান্ধবীদের সাথে ফুসকা খেতে বসে চট করেই মনে পড়ে গেল তার সেই নীল চিরকুটের কথা। ফুসকা ফেলে নীরাকে নিয়ে আবারও হাজির হলো গ্রন্থগারের বারান্দায়। ফুসকা ফেলে আসায় নীরা তখন মহা বিরক্ত। এই মাথা পাগল মেয়েটা তার বন্ধু হওয়ায় বিরক্তির বহরটা যেন আরও খানিকটা অতিরঞ্জিত। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের ওপর বিরক্ত হওয়া চলে না। এরা মানুষের বিরক্তি বা রাগকে যেমন পাত্তা দেয় না। ঠিক তেমনই অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে মান-প্রাণ সব হারালেও বিরক্ত হয় না। নম্রতা হলো সেই ধরনের মানুষ। তার ওপর বিরক্ত হওয়া সাজে না। নম্রতা এবারও আশাহত হলো। ফিলোসফির বইটির দিকে কিছুক্ষণ বিরক্ত ভরে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে বলল,

‘ চিঠির জবাব না এলে নাই। এই চিঠিটা এখানেই থাকুক। আমার আবেগময় সুন্দর চিঠিটা এই বইকে উৎসর্গ করলাম। চল, আজ তোকে ডাবল প্লেট ফুসকা খাওয়াব।’

নীরা বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ ফুসকা খাওয়াবি মানে? তোর মন খারাপ লাগছে না?’

‘ না, লাগছে না। আমাদের ছোট্ট জীবনটাতে ছোট্ট ছোট্ট বিষয় নিয়ে মন খারাপ করতে নেই। বাবা বলে, Life is a beautiful flower. We should feel it’s fragrance. এই যে চিঠি বিষয়ক সুন্দর ঝামেলাটা হয়ে গেল? এটাও সেই বিউটিফুল ফ্লাওয়ারেরই অংশ। আই হ্যাভ টু ফিল ইট।’

নম্রতা সর্বদা প্রাণোচ্ছল, প্রাণোবন্ত মেয়ে। তার সতেরো বছরের জীবনে কখনোই তাকে দীর্ঘসময় চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায় নি। সবসময় ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি আটকে রাখা তার স্বভাব। অল্পতে উত্তেজিত হওয়া, অল্পতে খুশি হওয়া, প্রাণ খোলে হাসা আর আড্ডা জমানোর গুণে সে সর্বদাই আকর্ষণীয়া। নম্রতার স্বাভাবিক চরিত্র অনুযায়ী ‘চিঠি’ বিষয়ক ব্যাপারটাও তার মনে খুব একটা দাগ আঁকতে পারল না। পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব, দুষ্টামো আর পাগলামো ভরা জীবনে ওই ক্ষুদ্র চিঠিটা দীর্ঘক্ষণ জায়গা দখল করে রাখতে পারল না। নম্রতা চিঠির কথাটা বেমালুম ভুলে বসল। যথারীতি ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা শেষ হয়ে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হলো। কলেজের সিনিয়র সিটিজেন হতে পেরে তারা তখন মহাখুশি। বান্ধবীরা মিলে হৈ-হৈ করে টিউশনি করা। ফুসকার দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেওয়া তখন নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠল। ঠিক এমন একটা সময়েই ঝড়টা এলো। এই মৃদু, শান্ত ঝড়েই এলোমেলো হয়ে গেলো নম্রতা। একদিন ইংরেজি টিউশনি শেষ করে শাহবাগ গ্রন্থাগারে গিয়ে বসল বান্ধবীরা। উদ্দেশ্য, নিরিবিলিতে ক্লাস নোট আর এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করা। বান্ধবীরা সবাই নোট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই নম্রতার অসচেতন চোখ দুটো ওই চির পরিচিত বইটির ওপর গিয়ে পড়ল। নিতান্ত কৌতূহল বশত উঠে গিয়ে বইটা তুলে নিলো সে। মলাটের নিচে নিজ হাতে লেখা নীল চিরকুটের খোঁজ নিতেই চমকে উঠল নম্রতা। নীল কাগজের পরিবর্তে সাধারণ সাদা কাগজে লেখা সম্বোধনহীন ছোট্ট এক চিঠি ওঠে এলো হাতে। সেখানে গুটি গুটি সুন্দর অক্ষরে লেখা,

‘ আপনি কি পাগল নাকি নিতান্তই কিশোরী একজন? পাগল বোধ হয় নন। আমার জানা মতে, পাগলেরা সাজিয়ে গুছিয়ে চিঠি লিখতে জানে না। কিন্তু কিশোরীরা জানে। যুবতীদের থেকে কিশোরীদের চিঠি লেখার গুণটা পাকা। তাদের মাথায় থাকা উদ্ভট চিন্তাগুলোও ভীষণ পাকা। যেমন আপনার এই চিঠি প্রেমের উদ্ভট ভাবনাটা! উদ্ভট বললাম বলে মন খারাপ করলেন? মন খারাপ করবেন না। এই ভাবনাটা সত্যিই উদ্ভট বৈ অন্য কিছু নয়। আজকের যুগে এসে এভাবে বন্ধুত্ব বা প্রেম করার সাহস কারো হবে বলে মনে হয় না। হয়তো মাথাতেও আনবে না। তবে মাঝে মাঝে উদ্ভট কিছু করতে খারাপ লাগে না। যেমনটা আমি করছি। আপনার এই উদ্ভট চিঠির উদ্ভট জবাব দিচ্ছি। আমার মতো মানুষ অজ্ঞাত এক কিশোরীকে চিঠি লিখছে তা আমার নিজের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না!’

চিঠিটা এক নিঃশ্বাস দু-তিনবার পরে ফেলল নম্রতা। সারা শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। প্রায় তিন সপ্তাহ পর সেই আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটা হাতে পেয়ে গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না তার। নম্রতা কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে লাফিয়ে উঠল। কয়েকজোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি তার ওপর পড়তেই চাপা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল নীরা,

‘ এই নমু? কি করছিস? সবাই দেখছে।’

নীরার কথায় চারপাশের খেয়াল হলো নম্রতার। চারদিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসল। তারপর বই হাতে কোণার এক টেবিলে চেয়ার টেনে বসল। বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে হৃদপিণ্ড। তার চিঠির জবাব এসেছে, এই সাধারণ কথাটা বিশ্বাস করতেই তার খুব বেগ পেতে হচ্ছে। নম্রতা সাদা কাগজে লেখা চিঠিটা টেবিলের উপর মেলে রাখল। কয়েক মুহূর্তে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে আনন্দিত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নোট বুকের মাঝে ভাঁজ করে রাখা নীল কাগজটা টেনে নিয়ে লিখতে বসল। কিন্তু বিস্ময় নিয়ে উপলব্ধি করল, তার হাঁত কাঁপছে। মাথাটা ফাঁকা আর গোলমেলে লাগছে। মাথার ভেতর গোছানো, সুন্দর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। নম্রতা দু’হাতে মুখ চেপে বসে রইল। মাথাটাকে একটু শান্ত করে লিখতে শুরু করল কয়েক লাইনের সম্বোধনহীন চিঠি,

‘ আপনাকে কী বলে সম্বোধন করা যায় বলুন তো? প্রথমবার ‘প্রিয়’ সম্বোধন করেছিলাম। এবার সেই ভরসাটাও পাচ্ছি না। এভাবে ‘আপনি’ ‘আপনি’ সম্বোধন করে আমায় ঘাবড়ে দেওয়ার কোনো মানে হয়? আর সাদা পাতায় কেন লিখেছেন? নীল চিরকুট কি কখনো সাদা পাতায় লেখা যায়? নীল চিরকুট সবসময় নীল কাগজেই লিখতে হয় এটাই নিয়ম। আর নিচে ইতি ওতি কিছুই তো লেখেন নি। একটা চিঠিতে এতো এতো ভুল করা মানুষটি কি-না আমায় কিশোরী মেয়ের উদ্ভট চিন্তাভাবনার কারখানা বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, এ তো ভারি অন্যায়!

ইতি
শ্যামলতা ‘

লেখা শেষে দু-বার পড়ে নিয়ে চিঠিটা মলাটের ভাঁজে রেখে দিল নম্রতা। আর সাদা কাগজে লেখা চিঠিটা খুব যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিলো। বাসায় এসে চিঠিটাকে ডায়েরির পাতায় আঠা দিয়ে লাগাল। চিঠির কোণায় দুটো লাল গোলাপের পাঁপড়ি লাগিয়ে তাতে লিখল, ‘শ্যামলতা ও সে’। তারপর থেকে শুরু হলো নতুন চিঠির অপেক্ষা। কিন্তু অপেক্ষাময় দিনগুলো যেন আর কাটে না। কলেজ শেষে রোজ একবার গ্রন্থাগারে খোঁজ নেওয়ার পরও চিঠির সন্ধান মেলে না। অপেক্ষা করতে করতে নম্রতা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ল ঠিক তখনই দ্বিতীয় চিঠিটা এলো। নম্রতাকে দু-দুটো সপ্তাহ অপেক্ষা করিয়ে সাদা কাগজের মাঝখানে গুটি গুটি অক্ষরে দুই লাইনের একটা চিঠি লিখল অপরিচিত সেই ‘সে’।

‘ সত্যিই! এ তো ভারি অন্যায়। কিন্তু আমার যে নীল রঙা কাগজ নেই। এখন উপায়? আমাকে কি তবে চিঠি খেলা থেকে বহিষ্কৃত করা হবে?’

সেই দুই লাইনের চিঠিই অসংখ্যবার পড়ল নম্রতা। প্রথম দিকটাই বিরক্ত হলেও পরমুহূর্তে বেশ লাগল। এই চিঠির জন্য অপেক্ষামান অনুভূতিই তো চাইছিল সে। এখন সেই আকাঙ্ক্ষিত অনুভূতির জন্য নিশ্চয় বিরক্ত হওয়া চলে না? নম্রতা অনেক ভেবে চিন্তে লিখল,

# চলবে….

[ নম্রতা লিখতে গিয়ে বার বার শুভ্রতা লিখে ফেলি। কি একটা অবস্থা! ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here