নীল চিরকুট পাঠ-৭১

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৭১.

ভরা বর্ষা। আকাশটা ছেয়ে আছে কালো মেঘে। পাহাড়ি গা’জুড়ে ভয়াবহ ঝুম বৃষ্টি। সরু আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলোর পাশ বেয়ে ছুটে যাচ্ছে ফুলে-ফেঁপে থাকা ঝিরি। আষাঢ়ে কান্নায় ধুয়েমুছে আরও খানিকটা পবিত্র হয়ে উঠেছে রূপসী পাহাড়ের অঙ্গ। সেই সরু,পিচ্ছিল লাল মাটির রাস্তা দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে মধ্যবয়স্ক এক উপজাতি। মাথায় তার কালো ছাতা। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ছাতাটা বুঝি ঠেকে গিয়েছে কালো,অন্ধকার মেঘরাজ্যে। পা জোড়া খালি, জুতো নেই। হাঁটু সমান লুঙ্গি আর ঢিলেঢালা ফতুয়ার অধিকাংশই ভেজা। পিঠে মাঝারি আকারের ঝুড়ি। লোকটি নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছেন। ভীষণ পরিচিত পাহাড়ি জঙ্গলা ভেঙে উঠে যাচ্ছেন পাহাড়ের চূড়ায় থাকা ছোট্ট, ছিমছাম বাড়িটির দিকে। বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়িটি চোখে পড়ছে না। কালো মেঘ আর পাহাড়ি গাছে ঢেকে আছে তার অস্তিত্ব। লোকটি চূড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে নামল। বৃষ্টি বাড়ছে। বাইরের চটানে রাখা বালতি থেকে পা ধুয়ে ভেতরে ঢুকল বাহাদুর। দরজা খোলা। ভেতর থেকে অদ্ভুত সুরেলা শব্দ আসছে। বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে অসাধারণ শোনাচ্ছে কানে। ঝুড়িটা বাইরের ঘরে রাখতেই ভেতর থেকে কোমল কন্ঠ শুনতে পেল বাহাদুর। বাবু গাইছে। আজও নিশ্চয় সেই অদ্ভুত যন্ত্রটা নিয়ে বসেছে বাবু? বাহাদুর ভেতরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

‘ আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে
মনে পড়লো তোমায়
অশ্রু ভরা দুটি চোখ
তুমি ব্যথার কাজল মেখে
লুকিয়েছিলে ঐ মুখ

বেদনাকে সাথী করে
পাখা মেলে দিয়েছো তুমি
কত দূরে যাবে বলো
কত দূরে যাবে বলো
তোমার পথের সাথী হবো আমি…’

গানটা থেমে গেল হঠাৎ। জানালার পাশে বসে থাকা নাদিম ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,

‘ কী অবস্থা বাহাদুর? ভিজে গিয়েছ দেখছি। বৃষ্টি সারলেই আসতে পারতে।’

বাহাদুর মুখ কাঁচুমাচু করে নিজের দিকে তাকাল। তার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে ভয়াবহ অপরাধ করে ফেলেছে। নাদিম গিটারে সুর তুললো। টুংটাং শব্দ তুলে বলল,

‘ বেশি করে চিনি দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে ফেলো তো বাহাদুর। ফটাফট বানাবে। পারবে না?’

বাহাদুর মাথা নাড়ল। তারপর কী ভেবে বলল,

‘ ঘরত দুধ নেই বাবু।’

‘ দুধ না থাকলে রং চা বানাবে। চিনিটা একটু বেশি দিবে। দুধ থাকতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’

বাহাদুর মাথা নাড়ল। ফিরে যেতে নিয়েও থেমে গেল হঠাৎ। নাদিম গিটার থেকে হাত সরিয়ে তার দিকে চাইল। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ কিছু বলতে চাও বাহাদুর?’

বাহাদুর মাথা নাড়ল। নাদিম গিটারটা পাশে রেখে সোজা হয়ে বসল,

‘ বলে ফেলো।’

‘ ত নামে চিঠি ইজজি।’

নাদিম জবাব না দিয়ে চেয়ে রইল। বাহাদুর নাদিমের বছর বাঁধা ভৃত্য। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাজারঘাট সবই করে সে পুরোদমে। শক্তসমর্থ শরীরে পরিশ্রম করার অসাধারণ স্পৃহা। কিন্তু সমস্যা হলো, বাহাদুর খুব একটা বাংলা বলতে পারে না। নাদিমের ধারণা, বাহাদুর বাংলাটা ইচ্ছে করেই বলে না। বাংলা বুঝা সত্যেও বাংলা বলতে না-পারাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নাদিম কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিষ্পৃহ কন্ঠে বলল,

‘ আমার নামে চিঠি? আমাকে কে চিঠি পাঠাবে বাহাদুর? তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। চিঠিটা অবশ্যই আমার নামে নয়।’

বাহাদুর কিছু বলার আগেই গিটার তুলে নিল নাদিম। গিটারের দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ বাংলায় কথা বলো বাহাদুর। তোমার অধিকাংশ শব্দ আমি বুঝি না।’

বাহাদুর এবার বাংলায় কথা বলল। ভাঙা বাংলা আর তার নিজস্ব ভাষায় যতটুকু বলল তাতে, চিঠিতে নাদিমের নামই লেখা আছে। সিভিল সার্জন অফিসে এসেছিল। বড় বাবু শহর থেকে কেউ একজনকে দিয়ে থানচি পাঠিয়েছে। বাহাদুর সেই চিঠি নিতেই শহরে গিয়েছিল আজ। নাদিমের কপাল কুঁচকে এলো। উদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে বলল,

‘ চিঠিটা কোথায়?’

বাহাদুর ফতুয়ার পকেট থেকে পলিথিন কাগজে মোড়ানো একটা খাম বের করল। খামটা নাদিমের দিকে এগিয়ে দিতেই চোখ দিয়ে টেবিলের উপর রাখতে ইশারা করল নাদিম। বাহাদুর চিঠিটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল,

‘ হি হেবে? হি রানিম, বাবু?’

নাদিম চিঠিটির দিকে চেয়ে থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

‘ কিছু রান্না করতে হবে না। দুটো ডিম ভেজে ফেলো তাতেই হবে।’

‘ ঘরত বডা নাই, বাবু।’

নাদিম বিরক্ত চোখে চাইল,

‘ ডিম না থাকলে যা আছে তাই রান্না করো। আমার মেজাজ ভালো নেই। আমাকে বিরক্ত করবে না।’

সহজ-সরল বাহাদুর ভীতমুখে মাথা নাড়ল। বাহাদুর চলে যেতেই চিঠিটা হাতে নিল নাদিম। দীর্ঘক্ষণ চিঠির দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল সে। খামের গায়ে প্রেরকের নাম ঠিকানা নেই। তবে এসেছে ঢাকা থেকে। নাদিম খামটা উল্টেপাল্টে দেখল। চিঠিটা যে পাঠিয়েছে সে নিশ্চয় খুব বুদ্ধিমান। নয়তো নাদিমকে খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। নাদিম নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা যেমন করেনি। তেমনই কারো ধরা-ছোঁয়ার মাঝেও নিজেকে রাখেনি। ঢাকা শহরটা একঘেয়ে, অসহ্য লাগছিল বলেই হঠাৎ এক গন্তব্যহীন রাতের ট্রেনে উঠে পড়েছিল নাদিম। সেই ট্রেনে করেই এসে পৌঁছাল রাজশাহী। প্রথম দুই-তিনমাস রাজশাহীর আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াল নাদিম। তারপর ঢাকা থেকে কাগজপত্র জোগাড় করে মাস্টার্সটা শেষ করল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহীর হাওয়া অসহ্য ঠেকতেই পিছুটানহীন নাদিম পাড়ি জমাল চট্টগ্রামের পথে। চট্রগ্রামের সিভিল সার্জন অফিসে হেল্থ প্রোগ্রাম প্রজেক্টে অস্থায়ী সাইকোলিক্যাল কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত সে। দুই বছরের ধরা বাঁধা চাকরি। এরপর আবারও অন্য কোনো শহরে গা ভাসানোর তাড়া। নাদিমের মতো উড়ো পাখির জন্য এ এক অসাধারণ কাজ। নাদিম কৌতূহল নিয়ে খাম খুলল। খামের ভেতর থেকে নীল চিরকুট লেখা খামটা বেরিয়ে আসতেই চট করে বুঝে ফেলল, এটা অবশ্যই আরফানের কাজ। নম্রতা অত বুদ্ধিমতী নয়। কিন্তু আরফান হঠাৎ তাকে চিঠি পাঠাবে কেন? হাজারও প্রশ্ন নিয়ে নীল খামটা ছিঁড়ে ভেতরের ছবিটা বের করতেই কপালের কুঞ্চন গাঢ় হলো তার। সাথে থাকা চিরকুটটা বার কয়েক পড়ে টেবিলের উপর রেখে দিল। গিটারটা হাতে নিয়ে এক মনে সুর তুললো তাতে। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে গেয়ে উঠল তার কন্ঠ,

‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে
মনে পড়লো তোমায়
অশ্রু ভরা দুটি চোখ
তুমি ব্যথার কাজল মেখে
লুকিয়েছিলে ঐ মুখ…’

গান বেশিদূর এগোল না। গিটারের শব্দও থেমে গেল হঠাৎ। নাদিম হঠাৎ উপলব্ধি করল, এই সুন্দর পাহাড়ী বৃষ্টি, মুক্ত জীবন তার ভালো লাগছে না। বুক ভার লাগছে। হাত-পা মৃদু কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। নাদিম গিটার নামিয়ে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ভরাট কন্ঠে বাহাদুরকে ডাকল। বাহাদুর ভীত চোখে দরজার কাছে উঁকি দিতেই হাতের ইশারায় ভেতরে ডাকল নাদিম। চেয়ার টেনে বসতে বলে বলল,

‘ তোমার ছেলে মেয়ে ক’জন বাহাদুর?’

অবাঞ্ছিত প্রশ্ন। নাদিম জানে বহাদুরের দুই মেয়ে এক ছেলে। জানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার মানে হয় না। তবুও কেন জিজ্ঞেস করল জানা নেই। শুধু জানে, কথা বলতে হবে। এইযে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। কিছু একটা পেয়ে যাওয়ার আনন্দে হাত-পা কাঁপছে। এই কম্পন থামাতে হবে। বাহাদুর বিরস কন্ঠে বলল,

‘ মর দিবি জি আর দিবি পো।’

নাদিম বুক ভরে শ্বাস নিল। মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ তোমাদের ভাষায় বন্ধুদের কী বলে বাহাদুর?’

‘ সোমাজসি, বাবু।’

নাদিম হাসল। জানালার বাইরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বিরবিরিয়ে বলল,

‘ সোমাজসি! বাহ! সুন্দর তো।’.

একটু থেমে আবারও বলল,

‘ আমাকে ঢাকা যেতে হবে বাহাদুর। কালকেই যেতে হবে। তুমি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করো।’

বাহাদুর অবাক হয়ে বলল,

‘বারে বেজ ঝড় দেড়। পদট পুট উটটি। গাড়ি ন পেব।’ [ বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে রাস্তা কাদা। গাড়ি পাওয়া যাবে না।]

নাদিম আনমনা কন্ঠে বলল,

‘ তবুও যেতে হবে। যেতেই হবে বাহাদুর।’

বাহাদুর কী বুঝে বলল,

‘ আচ্চা বাবু।’

নাদিম হঠাৎ সুর তুলল। ভীষণ করুণ কন্ঠে গাইল,

‘ আমার ধূলাবালি জমা বই
আমার বন্ধুরা সব কই
আমার ভাল্লাগেনা এই মিথ্যে শহর
রাতের আড়ালে রই।’

বাহাদুরের হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। নাদিমের কন্ঠে ভেসে আসা কাতরতা যেন আকাশের কান্না হয়ে বৃষ্টির শব্দে কন্ঠ মেলাল। নাদিম গান থামিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করল,

‘ ভালোবাসাকে তোমরা কী বল বাহাদুর?’

‘ হোজপানা।’

নাদিম উঠে বসল। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা জ্যাকেটটা পরতে পরতে মৃদু হাসল। বাহাদুরকে অবাক করে দিয়ে বলল,

‘ তর তেই হোজপানা বাহাদুর।’ [ তোমার জন্য ভালোবাসা বাহাদুর। ]

বাহাদুরের সহজ-সরল গাল লজ্জায় রাঙা হলো। পরমুহূর্তেই বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ কোতায় যাচ্চেন বাবু?’

‘ ঢাকা যাচ্ছি বাহাদুর। এখনই যেতে হবে। আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।’

‘বারে বেজ ঝড় দেড়, বাবু।’

নাদিম অমায়িক হেসে বলল,

‘ ঝড়ে কিছু ক্ষতি হবে না বাহাদুর। ঝড়ের ভয়ে এখানে বসে থাকলেই বরং ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে আমার। উত্তেজনায় ঘুম হবে না। নিঃশ্বাস নিতে পারব না।’

বাহাদুর আকাশসম বিস্ময় নিয়ে দেখল, একা এক সুদর্শন যুবক রাতের অন্ধকারে ভয়াবহ ঝড়ের মুখে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেল। পিঠে তার ঝুলন্ত গিটার আর কালো ব্যাগ। বুক ভরা সাহস। গন্তব্য বহুদূর। এতো সাহস কোথায় পায় সে? কোথায় পায় এতো তেজ!

_

অস্ট্রেলিয়ায় হাড় কাঁপানো শীত। আবহাওয়ার তাপমাত্রা -৪ এর কাছাকাছি। পথঘাট শুভ্র বরফে আচ্ছন্ন। ছোঁয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে তার খয়েরী রঙের হুডি। হাতে-পায়ে মোজা তবুও তিরতির করে কাঁপছে শরীর। সাইমের গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বরফে ডুবে থাকা ছোঁয়ার টয়েটোর পাশেই পার্ক করা হলো গাড়ি। খুব ভোরে গাড়ির হিটার অন করে, বোতল থেকে পানি ঢেলে, ওয়াইপার চালিয়ে সামনের বরফ পরিষ্কার করেছিল ছোঁয়া। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। আবারও বরফ কুঁচিতে ভরে গিয়েছে গাড়ির গ্লাস। সাইম গাড়ি থেকে নেমেই হাত নাড়ল। ছোঁয়া উত্তরে মুচকি হাসল। ঘরে ঢুকে গায়ের মোটা জ্যাকেট আর হাত মোজা খুলতে খুলতে সোফায় বসল সাইম। একটা খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ উড ইউ লাইক টু ইট গ্রিলড চিকেন, চিপস এবং গারলিক সস নাউ?’

ছোঁয়া হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে হাসি হাসি চোখে চাইল। প্যাকেটটা পাশে রেখে বলল,

‘ আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি সাইম। উড ইউ লাইক টু গো উইদ মি?’

সাইম অবাক চোখে তাকাল,

‘ বাংলাদেশ মানে? হঠাৎ বাংলাদেশে কেন? নো প্ল্যানস্, নো রিজনস্, হোয়াই ডিড ইউ মেইক দিস ডিসিশন? আমার ছুটি নেই ছোঁয়া। ইভেন তোমারও ছুটি থাকার কথা নয়।’

ছোঁয়া ভ্রু কুঁচকে চাইল। সাইমের সামনের টেবিলটাতে বসে পড়ে তার কলার ধরে কাছে টেনে আনল আচমকা। সাইম বিস্ময়ে হতবাক চোখে চেয়ে রইল। সাইমের বিস্ময় আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েই মুখ খুলল ছোঁয়া,

‘ এইযে লায়ক শাকিব খান? সারাদিন অস্ট্রেলিয়ান গরুদের মতো প্ল্যানিং, রিজনস্ ক্যান খুঁজো? তুমি বাঙালী না? বাঙালীদের কোনো পরিকল্পনা ফরিকল্পনা থাকে না। তাদের কর্মকান্ড হবে হুটহাট, এটাই নিয়ম।’

সাইম বিস্ময়ে কথা খুঁজে পেল না। কয়েক সেকেন্ড চোখ বড় বড় করে চেয়ে থেকে বলল,

‘ এভাবে কথা বলছ কেন তুমি? আর ইউ ওকে?’

‘ অবশ্যই ঠিক আছে? ক্যান? আমারে দেইখা রোগী রোগী মনে হইতাছে তোমার? তুমি কইতে চাও আমি রোগী?’

সাইম স্তব্ধ। সাইমের হতভম্ব চোখের দিকে চেয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল ছোঁয়া। সাইমের বিস্ময় এবার আকাশ ছুঁলো। ছোঁয়া সাধারণত শব্দ করে হাসে না। এমন উদ্ভট কথা তো কখনোই বলে না। ছোঁয়া কথা বলে মেপে মেপে। মার্জিত ভঙ্গিতে। আজ হঠাৎ কী হলো তার? সাইম উদ্বিগ্ন চোখে ডানহাতটা বাড়িয়ে ছোঁয়ার কপালের উপর রাখল। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ তোমার কী জ্বর হয়েছে? তুমি ঠিক আছো?’

ছোঁয়া সাইমের হাতটা সরিয়ে নিজের হাতে নিল। ঠোঁটভরা হাসি নিয়ে বলল,

‘ আমি ঠিক আছি। আই ওয়াজ ইঞ্জয়েনিং দিজ ল্যাঙ্গুয়েজ সাইম। আমার ফ্রেন্ডদের চিনো? ওরা এভাবে কথা বলত। ওরা আমার মতো ভিতু নয়। আমার মতো গোছালোও নয়। তবুও তারা পার্ফেক্ট? একবার নাদিম কী করেছিল জানো? হঠাৎ স্যারের সামনে পরীক্ষার খাতা ছিঁড়ে ফেলে বলে ফেলল, ধূর বাল! সময় শেষ হওয়ার আগেই খাতা টানাটানি। পরীক্ষায় দিতাম না। ফেইল দিলে ফেইল। এইসব ছাতার পাশ মার্ক আমার লাগতো না। বালের পরীক্ষা!’

এটুকু বলে আবারও খিলখিল করে হেসে ফেলল ছোঁয়া। তারপর হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনা হয়ে গেল। সাইম কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে বসে রইল। ছোঁয়া উঠে গিয়ে সাইমের পাশ ঘেঁষে বসল। হয়তো এই প্রথম বারের মতো ভীষণ অনুভূতি নিয়ে বাহু চেপে ধরে কাঁধে মাথা রাখল। বিরবির করে বলল,

‘ আমি বাংলাদেশে যাব সাইম। আমাকে যেতেই হবে। ওরা আমার অপেক্ষায় আছে। আই উইল ম্যানেজ আনাদার জব। বাট আই কান্ট গেইট আনাদার অপরচুনিটি। আমার জীবনের সব থেকে কনফিডেন্ট ডিসিশন এটা। এই ডিসিশন নিয়ে আমার কোনো কনফিউশান নেই। একটুও না…’

সাইম অবাক চোখে চেয়ে রইল। ছোঁয়ার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস দেখেই হয়ত ছোট্ট একটা চুমু খেল ডানহাতের পিঠে। মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ ওকে। গো এন্ড ইঞ্জয়।’

_

বাইরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। নম্রতা রান্নার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ তার ঝাল ঝাল খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। শাশুড়ী মা ঘুমাচ্ছে। কাজের মেয়েটাও ভাত ঘুমে। নম্রতার প্রেগনেন্সির পর থেকে হুটহাট বাড়ি চলে আসে আরফান। আজও এলো। নিজের ঘরে নম্রতার খোঁজ না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরে এসে উঁকি দিল। বউকে কোমরে ওড়না বেঁধে রান্না করতে দেখে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সে। হালকা একটু কেশে বলল,

‘ হ্যালো মিসেস নিম পাতা। কী চলছে?’

হঠাৎ আরফানের ডাকে চমকে তাকাল নম্রতা। ভীত মুখে বলল,

‘ দেখুন! আপনি এখন মানা করবেন না। মানা করলেও আমি শুনব না। রান্না প্রায় হয়ে গিয়েছে। সারাদিন বসে থাকতে ভালো লাগে না।’

আরফান হাসল। কেবিনেটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে বলল,

‘ মানা কেন করব? যা মন চাই তাই করবেন। শুধু ভারী কিছু না করলেই হলো। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকলে এমনিই শরীর খারাপ করবে। মুড সুয়িংও করবে বেশি বেশি। তার থেকে একটু আধটু কাজ করুন। তবে কাজ করার সময় আশেপাশে কাউকে রাখবেন। একা একা পন্ডিতি করতে যাবেন না।’

নম্রতা মুখ কালো করে চুলোর আঁচ কমাল। আড়চোখে আরফানকে দেখে নিয়ে বলল,

‘ আম্মু ফোন দিয়েছিল। বলেছে এক দুই মাসের মধ্যে আমায় নিয়ে যাবে। ডেলিভারি হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানে….’

নম্রতার কথা শেষ না হতেই বাঁধ সাধল আরফান,

‘ অসম্ভব। আমি অনুমতি দেব না।’

‘ অনুমতি দিবেন না মানে? আমি বাবা-মার সাথে দেখা করতে যাব না?’

‘ দেখা করবেন না, তা তো বলিনি। তবে ওখানে গিয়েও থাকতে পারবেন না। এ বাড়িতে আমার সামনেই থাকতে হবে। এ ব্যাপারে আর একটা কথাও নয়।’

নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘ আমি যাবই। কেন শুনব আপনার কথা? আমার উপহার কই? দুই সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে অথচ উপহারের খোঁজ নেই। নিশ্চয় ভুলে বসে আছেন?’

আরফান কেবিনেট থেকে নেমে ফ্রিজ খুলল। পানির বোতল বের করতে করতে বলল,

‘ ভুলিনি। আর চারদিন পর পাবেন। আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকির সকাল বেলায়।’

নম্রতা চোখ বড় বড় করে বলল,

‘ এক উপহারে তিন অকেশন পাড় করে দিতে চাইছেন? এতো কিপ্টা আপনি? এইজন্য ডাক্তার বিয়ে করতে চাইনি। আম্মু ঠিকই বলেছিল। ডাক্তাররা এতো কিপ্টা!’

আরফান হাসল। পানির বোতলটা পাশে রেখে নম্রতার পেছনে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। খাবারের ঢাকনা খুলতে খুলতে ফিসফিস করে বলল,

‘ বিয়ের রাতের উপহার বিয়ের দিন ছাড়া তো দেওয়া যায় না নম্রতা। আর আফসোস করেই বা কী হবে? ডাক্তার বিয়ে করে জুনিয়র ডাক্তারের ঘন্টীও তো বাজিয়ে ফেলেছেন। এখন এসব আফসোস টাফসোস বাদ দিয়ে কাজ করুন। স্বামীকে খাইয়ে দিয়ে স্বামীসেবা করুন। খাবারটা লোভনীয় দেখাচ্ছে।’

নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘ যে পুরুষ একটা চিরকুট লিখতে তিন সপ্তাহ লাগায় তাকে আমি খাইয়ে দিই না।’

আরফান হাসছে। হাসিমুখেই বলল,

‘ দিবেন না মানে? দিতে বাধ্য। আমি জোর করে পেতে জানি, মহারাণী নিম পাতা।’

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here