নীল চিরকুট পাঠ-৪৩

নীল চিরকুট
লেখনীতে – নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৪৩.

শেষ বিকেল। গোধূলি হানা দিয়েছে দরজায়। এক টুকরো সোনালি রোদ এসে পড়েছে থালা-বাসন দেওয়ার সিংকে। জলের কল খোলা। চুড়ির টুটাং শব্দ তুলে থালা-বাসন ধুচ্ছে নীরা। ছোট ছোট দুষ্ট চুলগুলো অবহেলা ভরে পড়ে আছে কপালে। নীরা ভেজা হাতে ঘোমটা টানল মাথায়। কন্ঠনালী শুকিয়ে এসেছে। বুক আর পেটে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে প্রায় ঘন্টাখানেক হলো। এতোগুলো মানুষের রান্নার জোগার আর খাওয়ার যোগান দিতে গিয়ে সকাল থেকে কিছু মুখে তোলার সুযোগ হয়নি তার। জাহানারা দুই একবার খাওয়ার কথা বললেও এতো মেহমান আর খালা-ফুপু শাশুড়ীর ভিড়ে খেতে বসার সাহস হয়নি নীরার। এমনিতেই খুঁতের পর খুঁত বলে বেড়াচ্ছে। এখন খেতে বসলে নিশ্চয় আরও কিছু কথা শুনাবে তাকে? বুক-পিঠে চাপ দিয়ে ধরতেই থালা-বাসন ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল নীরা। চোখদুটো বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। হচ্ছে না। নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতেই চাপ দিয়ে ধরছে বুকে। নীরা অসহায় চোখে এদিক-ওদিক তাকাল। ডানহাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে আবারও হাত দিল কাজে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর, রান্নাঘরের কাজটুকু শেষ করে বসার ঘরের কাছাকাছি আসতেই থমকে গেল পা। কানে এলো অন্তুর খালা-ফুপুর মধ্যকার নিচু স্বরে চলা রুচিহীন আলোচনা,

‘ বড় ভাবি? অন্তুর বউ নাকি অন্তুর থেকে বয়সে বড়? এটা কোনো কথা? আমাদের বংশের ছেলেদের এই একটা সমস্যা। চোখে পট্টি বেঁধে মেয়ে পছন্দ করে। বাপ-মায়ের সাথে যুদ্ধ করে বিয়েটা যখন করলিই তখন কচি মেয়ে দেখে বিয়ে কর। তা-না দামড়া মেয়ে পছন্দ করে বসে আছে। মেয়ের চরি. .’

নীরা আর দাঁড়াল না। শব্দহীন পায়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বিছানার এক কোণায় ফ্লোরে গিয়ে বসল। চোখ দুটো টলমল করে উঠল নিঃশব্দ, বোবা কান্নায়। বুকে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ গুজল। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল শরীর। জীবনে প্রথমবারের মতো মনের কোণায় উদয় হলো আত্মহত্যার কথা। মরে গেলে কী মুক্তি পাবে নীরা? একটু স্বস্তি পাবে? ক্ষণিকের জন্য কী কেউ তাকে বুকে আগলে ধরে কাঁদবে? একটু বোঝার চেষ্টা করবে? নীরার কান্নার মাঝেই ফোন বাজল। বিছানার উপর পড়ে থাকা ফোনটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে ফোন তুলল। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে নরম স্বরে কথা বলে উঠল রঞ্জন,

‘ নীরু বলছিস?’

নীরা অস্ফুট স্বরে বলল,

‘ হু।’

‘ আধা ঘন্টা পর আমার ফ্লাইট দোস্ত। তোর সাথে দেখা হলো না। যেতে চেয়েছিলাম তোর শশুরবাড়ি, কিন্তু হলো না। তোর ফুপু শাশুড়ী নাকি খুব কনজারভেটিভ? আমি গেলে যদি আবার কথা টথা উঠে, তাই যাইনি।’

এটুকু বলে থামল রঞ্জন। তারপর খুব আদুরে কন্ঠে বলল,

‘ তুই ভালো আছিস নীরা?’

এই ছোট্ট প্রশ্নটা শুনেই হুহু করে কেঁদে উঠল নীরা। মুখ চেপে কান্না চাপার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো এবার। কতদিন পর কেউ একজন সত্যিকার অর্থে জানতে চাইল, তুই ভালো আছিস নীরা? এই ছোট্ট প্রশ্নটা কতদিন শুনে না নীরা। নীরার কান্নার শব্দে আৎকে উঠল রঞ্জন। ব্যস্ত হয়ে বলল,

‘ নীরু? কাঁদছিস কেন দোস্ত?’

নীরা উত্তর দিল না। নীরার কান্নার শব্দেই যা বোঝার বুঝল রঞ্জন। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমাদের জীবনটা অবজেকশন আর এলিগেশনে ভর্তি নীরা। এই অবজেকশন কারো কম, কারো বেশি, পার্থক্যটা এখানেই। তোরা বলিস না? আল্লাহ যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। যাচাই করে। তারপর হুট করেই বিশাল এক সারপ্রাইজ দিয়ে সব দুঃখ-কষ্ট ভালোবাসায় মুড়িয়ে দেয়। সেই হিসেবে তুই আল্লাহর অনেক প্রিয় একজন সৃষ্টি। এই সৃষ্টিটাকে আল্লাহ অনেক বেশি ভালোবাসেন বলেই তোর দুঃখগুলোর দিকে তাঁর এতো মনোযোগ। আল্লাহ হয়ত তোকে স্ট্রং হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন। তোকে এমন কান্নাকাটি মানায় না দোস্ত। হেরে যাওয়াও মানায় না। শক্ত হয়ে দুঃখের ঝড়টা পাড় করে যা। দেখবি হঠাৎ একদিন বিশাল এক সারপ্রাইজ আসবে তোর জীবনজুড়ে। অপেক্ষা কর। সৃষ্টিকর্তা কাউকে ফেরান না। তিনি নিজের উপর কোনো অভিযোগ রাখেন না। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা কর। জীবনের শেষ দিনটিতেও যদি সারপ্রাইজটা না মেলে তাহলে এটলিস্ট সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবি, আমি অপেক্ষা করেছিলাম। আমার পাওনাটা তুমি দাওনি। তুমি অভিযুক্ত।’

নীরার কান্না থেমে গিয়েছিল। রঞ্জনের কথা থামতেই নাক টানল নীরা। রঞ্জনের কথা তার মনে ধরেছে। বন্ধু মহলের ঝকঝকে বিকেল আর মায়ের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আত্মহননের চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলেছে। মনের সুপ্ত এক অংশ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, এই পৃথিবীতে গুটিকতক মানুষ তাকে বাস্তবিকই ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। নীরা বসে যাওয়া ফ্যাঁসফ্যাঁসে স্বরে বলল,

‘ তুই চলে যাচ্ছিস। তুই চলে গেলে আমাদের এভাবে বুঝবে কে, বল তো?’

রঞ্জন হেসে ফেলল।

‘ সবাই তো রইল বোকা। আর আমিই বা যাচ্ছি কোথায়? খুব জলদি ফিরব।’

রঞ্জনের কথার মাঝেই ফোন টেনে নিল কেউ। অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘ এই নীরু ভতী, দুপুরে খাইছিস তুই? রঞ্জন আজ ট্রিট দিছে, তুই তো ফক্কা খাইলি মামা। আইচ্ছা কান্দিস না। তোর জামাইয়ের কাছে খাওয়ন দিয়া দিতাছি। তাও নজর লাগাবি না। ভতী মানুষের নজর লাগে বেশি। চোখ ভরলেও হেগো পেট ভরে না। হলে বাথরুমের কমোড ভাইঙা গেছে। রাইতে-বিরাতে পেটে খিঁচ পড়লে সমস্যা। নজর লাগাবি তো তুই শ্যাষ!’

নাদিমের কথায় হেসে ফেলল নীরা। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করল, এই ছোট্ট ছোট্ট হাসি নিয়ে বেঁচে থাকাও খুব কষ্টকর নয়। এদের এই ছোট্ট ছোট্ট যত্নটুকু পাওয়ার লোভে পড়েও এই বিষাক্ত জীবনটা বয়ে বেড়ানো যায়।

_

লম্বা টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নম্রতা। চারদিকে ধূসর সন্ধ্যার হাতছানি। একটু পরেই ঝুপ করে নেমে আসবে নিশুতি অন্ধকার রাত। সামনের রাস্তায় জ্বলে উঠেছে ল্যাম্পপোস্ট। নিরন্তর ছুটে চলেছে বিভিন্ন আকৃতির যান। নম্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ফোনের দিকে তাকাল। গত দুই ঘন্টায় দুই থেকে তিনবার আরফানকে ফোন দিয়েছে নম্রতা। আরফান রেগে থাকলেও ফোন তুলেছে। শান্ত কন্ঠে কথাও বলেছে। আরফানের রাগ অদ্ভুত। রাগ প্রকাশের ধরনও ভিন্ন। রেগে গিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া তার স্বভাব নয়। উচ্চবাচ্যও করে না। শান্ত,শীতল কন্ঠেই প্রকাশ পায় তার ভয়ানক, হৃদয় কাঁপানো রাগ। নম্রতা আবারও ফোন লাগাল। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে ভয়। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ ভেসে এলো,

‘ বলুন।’

নম্রতা কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলল,

‘ কি করছেন?’

নম্রতা প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারল, বিরাট ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে। এমন উদ্ভট প্রশ্ন করা উচিত হয়নি। গত দুই ঘন্টায় সে বার দুয়েক এই একই প্রশ্ন করেছে। তৃতীয়বারে প্রশ্নটা বড় খাপছাড়া আর অদ্ভুত শুনাচ্ছে কানে। আরফান শীতল কন্ঠে বলল,

‘ ডিউটিতে আছি।’

‘ ব্যস্ত?’

আরফানের সহজ স্বীকারোক্তি,

‘ হ্যাঁ।’

নম্রতা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,

‘ আপনি কী খুব রেগে আছেন?’

‘ না।’

‘ তাহলে এভাবে কথা বলছেন কেন?’

‘ কিভাবে কথা বলছি?’

‘ আপনার কন্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে আপনি ভয়ানক রেগে আছেন। রাগ করে থাকবেন না প্লিজ।’

‘ আচ্ছা।’

নম্রতার মন খারাপ হয়ে গেল। এর থেকে চিল্লাচিল্লি, ধমকা-ধমকি করাটাই কি ভালো ছিল না? অন্তু-নাদিমের মতো রাগে হিতাহিত ভুলে দুই-চারটা চার থাপ্পড় লাগালেও রক্ষা। কিন্তু এভাবে সব শর্ত মেনে নিয়ে রেগে বসে থাকলে কিভাবে রাগ ভাঙাবে নম্রতা? নম্রতা বেশ রয়ে সয়ে বলল,

‘ আমাকে কাল আপনার বাসায় ঘুরতে নিয়ে যাবেন ডক্টর?’

আরফানের দায়সারা জবাব,

‘ ইচ্ছে হলে যাবেন। আমি ব্যস্ত।’

নম্রতা ফোন কেটে দিল। আরফানের এহেন ব্যবহারে কান্না পেয়ে যাচ্ছে তার। ইট দিয়ে আঘাত করে নিজের এবং আরফানের দুই জনেরই মাথা ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। নম্রতার ভাবনার মাঝেই লাফাতে লাফাতে পাশে এসে দাঁড়াল নন্দিতা। ভীষণ বিজ্ঞ কন্ঠে বলল,

‘ আচ্ছা আপু? তোমাদের সাইকোলজি বইয়ে এমন কোনো মানসিক রোগের নাম লেখা নেই? যে রোগ হলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিয়ে করে ফেলতে হয়?’

নম্রতা চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করল। ডানহাতটা কোমরে রেখে চোখ লাল করে তাকাল। নন্দিতা সরল কন্ঠে বলল,

‘ এভাবে তাকাচ্ছ কেন? নেই? থাকলে ভালো হতো।’

নম্রতা কটমট করে বলল,

‘ দেখ নিদু। আমার মেজাজ এখন প্রচন্ড খারাপ। তোর এসব আউল ফাউল প্যাঁচাল বন্ধ করে দ্রুত কেটে পড়।’

নন্দিতার শ্যামলা মুখটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে উচ্ছল কন্ঠে বলল,

‘ কেন? কেন? ডাক্তার ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হয়েছে তোমার? কেমন ঝগড়া? কঠিন নাকি তরল?’

নম্রতা প্রত্যুত্তর করার আগেই পেছন থেকে সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল কেউ,

‘ এই ডাক্তার ভাইয়াটা কে?’

মায়ের আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে পেছনে ফিরে তাকাল নম্রতা। মায়ের কটমটে দৃষ্টি খেয়াল করে অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ আমি চিনি না আম্মু। তোমার পীর বাবার কসম।’

নম্রতার মা সরু চোখে তাকালেন। নম্রতার কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস না করে বললেন,

‘ এই তুই প্রেম করিস? এতোবড় সাহস। আমি এক্ষুনি তোর বাবাকে বলছি। মেয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে প্রেম করে বেড়াচ্ছে আর বাবা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে, এটা কেমন কথা? আমার বাড়িতে এসব প্রেম ফ্রেম চলবে না।’

নম্রতা চোখ ছোট ছোট করে কটমট দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকাল। নন্দিতা দাঁত বের করে হেসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে মায়ের পেছনে ছুটল। যেতে যেতেই মাকে সাঁই দিয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ। একদম প্রেম ফ্রেম চলবে না। এজন্যই বলছি আমায় চট করে বিয়ে দিয়ে দাও। পরে প্রেম টেম করে ফেললে তো আমাকে দোষ দিবা।’

নম্রতা বারান্দা থেকে মায়ের প্রতিক্রিয়া বুঝতে না পারলেও নন্দিতার কথায় হেসে ফেলল। মেয়েটা দূর্দান্ত ফাজিল হয়েছে।

_

অন্তু যখন বাসায় ফিরল তখন রাত দশটা কি এগারোটা বাজে। মেহমানদের প্রস্থানে বাড়ি এখন ফাঁকা। অন্তু বাড়িতে ঢুকেই আশেপাশে তাকাল। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল,

‘ আম্মা-আব্বা কই?’

অয়ন তখনও দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। ভাইয়ের প্রশ্নে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসল। টিভির চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বলল,

‘ ঘুমোচ্ছে। টেবিলে তোমার খাবার দেওয়া আছে।’

অন্তু দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে একবার টিভির দিকে তাকাল। ডিসকোভারি চ্যানেল চলছে। সাদা চামড়ার এক ইংরেজ যুবক বিশাল এক সাপ কোলে নিয়ে বসে আছে। অন্তু আগ্রহ পেলো না। নিজের ঘরে গিয়ে লাইট জ্বালাল। বিছানার এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে তার বউ, নীরা। অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাতে থাকা খাবারের ব্যাগটা টি- টেবিলে রেখে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আরও একবার নীরার দিকে তাকাল অন্তু। কয়েক সেকেন্ড কপাল কুঁচকে চেয়ে থেকে নীরার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হালকা নিচু হয়ে ডানহাতটা রাখল নীরার কপালে। জ্বর নেই। চোখের কোণায় কান্নার চিন্হ। অন্তু সরে দাঁড়াল। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। অয়নকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ সবাই খেয়েছে?’

টিভিতে মগ্ন থাকা অয়ন ছোট্ট করে জবাব দিল,

‘ হু।’

‘ তোর ভাবি খেয়েছে?’

অয়ন নজর ফিরিয়ে তাকাল। ভাবি মানুষটা তাদের পরিবারে নতুন। ভাবি শব্দটার সাথে অভ্যস্ত হতে খানিক সময় লাগবে তার। চট করে ভাবি সম্বোধনে কেমন গুলিয়ে যায় সব। অয়ন একটু ভেবে বলল,

‘ নীরা আপুর কথা বলছ? আমি দেখিনি। খেয়েছে হয়ত।’

অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের খাবারটা টেনে নিয়ে বলল,

‘ ওকে ডেকে তুলে খেতে বল। টেবিলের উপর খাবারের প্যাকেট রেখে এসেছি। তোর রঞ্জনদা পাঠিয়েছে।’

অয়ন বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ তুমি ডাকলেই তো পারো।’

‘ কেন? তুই ডাকলে কী মুখে ফোসকা পড়বে? যাবি? নাকি টিভি তুলে আছাড় মারব?’

অয়ন ঝট করে উঠে দাঁড়াল। অন্তুর ভরসা নেই। কিছুদিন আগেও আস্ত এক টেলিভিশন ভেঙেছে সে। আবারও ঘটনার পূনরাবৃত্তি করা তার জন্য মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। অয়ন দ্রুত পায়ে অন্তুর রুমের দিকে ছুটল। নীরা চোখ বোজে শুয়ে ছিল। অয়নের প্রথম ডাকেই চোখ মেলে তাকাল। দূর্বল হাসি দিয়ে বলল,

‘ কিছু বলবে?’

অয়ন বিছানার উপর বসল। নীরার ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে বলল,

‘ তুমি রাতে খেয়েছ নীরা আপু?’

পরমুহূর্তেই শুধরে নিয়ে সরল কন্ঠে বলল,

‘ আপু না, ভাবি। এখন তো ভাবি হও আমার। মনে থাকে না।’

শেষ কথাটা বলে ঠোঁট উল্টে হাসল অয়ন। মাথা ঘুরিয়ে টি-টেবিলের দিকে ইশারা করে বলল,

‘ ওখানে তোমার খাবার রাখা। রঞ্জনদা পাঠিয়েছে। খেয়ে তারপর ঘুমাও।’

এটুকু বলেই নীরার ফোনে গেইম খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অয়ন। খেলার মাঝপথে আবারও একবার তাড়া দিতেই উঠে বসল নীরা। কিন্তু খুব বেশি খেতে পারল না। অল্প একটু মুখে দিতেই বুকে-পিঠে চাপ দিয়ে ধরল। নীরাকে মুখ কুঁচকে ফেলতে দেখে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল অয়ন,

‘ খেতে ভালো নয়?’

নীরা অল্প হাসল। ঠিক সেই সময় খাওয়া শেষ করে ঘরে এলো অন্তু। ঘরে ঢুকতেই চোখাচোখি হলো। সারাদিনে এই প্রথম মানুষটিকে দেখতে পেয়ে মনটা স্নিগ্ধ হয়ে গেল নীরার। অন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই চোখ ফিরিয়ে নিল। বিছানার কাছাকাছি এসে অয়নের মাথায় চাটি মেরে বলল,

‘ এটা তোর গেইম খেলার জায়গা?যা ভাগ।’

অয়ন মুখ কালো করে বেরিয়ে গেল। পুরোটা সময় খাওয়া থামিয়ে তৃষ্ণার্ত চোখে অন্তুর দিকেই চেয়ে রইল নীরা। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, অন্তুর ছোটখাটো কথাও চুম্বকের মতো টানছে তাকে। অন্তুর অঙ্গভঙ্গি, কুঁচকানো কপাল সবই যেন কালো জাদুর মতো হঠাৎই তীব্রভাবে মুগ্ধ করছে তাকে। অন্তু জগ থেকে পানি ঢেলে পানি খেলো। টি-টেবিল থেকে গ্লাসভর্তি পানি নিয়ে নীরার পাশে বেড সাইড টেবিলে রাখল। তারপর স্বাভাবিকভাবেই নিজের জায়গায় গিয়ে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ল। একহাত বুকের উপর রেখে অপর হাত কপালে আড়াআড়িভাবে রেখে চোখ বোজল। নীরা অন্তুর দিকে চেয়ে হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অন্তু কী আজও তার সাথে কথা বলবে না? এক বিছানায় এতোটা কাছাকাছি থেকেও কী বেপরোয়া অন্তুর অভিমান গলবে না? বহু প্রত্যাশিত ঘুমের একটুও অনিয়ম করবে না?

#চলবে….

[ রি-চেইক করিনি। পরের পর্বে আরফান-নম্রতা বেশি থাকবে চিন্তার কিছু নেই।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here