নীল চিরকুট
লেখনীতে – নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৪৪.
সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি অন্তুকে পাশে পেলো না নীরা। নীরা তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়ল। আজও ঘুম ভাঙতে দেরী হয়ে গিয়েছে তার। কোনোরকম চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিল নীরা। জাহানারা রান্নায় ব্যস্ত। চোখমুখ থমথমে,গম্ভীর। নীরা ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরের ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল। মিহি কন্ঠে বলল,
‘ আর কিছু রান্না করবেন মা? আমি করে দিই?’
জাহানারা উত্তর দিলেন না। থমথমে মুখে কড়াইয়ে খুন্তি চালাতে লাগলেন। নীরা জাহানারার উত্তরের আশায় কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে রইল। যখন বুঝল, জাহানারা উত্তর দেবেন না তখন নিজ উদ্যোগেই পাশে রাখা গামলায় সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াতে হাত বাড়াল। জাহানারা এবারও কিছু বললেন না। দুটো ডিমের খোঁসা ছাড়ানো শেষ হতেই আক্রোশ নিয়ে বলে উঠলেন জাহানারা,
‘ রাতে ভাত খাওনি কেন? টেবিলের উপর খাবার বেড়ে রেখেছিলাম দেখোনি? আমি একা মানুষ কতদিকে তাকাব? সবাইকে তো আর তুলে তুলে খাইয়ে দেওয়া সম্ভব না। এটা তোমার বাপের বাড়ি না। শশুর বাড়ি অতো আরাম চাইলে তো চলবে না। নিজের খাবার নিজের হাত দিয়েই তুলে খেতে হবে। অতো আদিখ্যেতা আমি করতে পারি না।’
নীরা ডিমের খোঁসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
‘ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মা।’
জাহানারা বিরক্ত চোখে তাকালেন। তরকারির কড়াইটা নামিয়ে রেখে বললেন,
‘ না খেয়ে ঘুমাবে কেন? নিজের খাওয়ার কথাও মনে থাকে না? খাবার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এখন এসিস্ট্যান্ট রাখতে হবে আমায়? মানুষ ছেলে বিয়ে করায় শেষ বয়সে আরাম করার জন্য। আর আমার কপাল দেখো।’
এটুকু বলে থামলেন জাহানারা। চুলোয় নতুন কড়াই চড়াতে চড়াতে গজগজ করতে লাগলেন,
‘ শশুরবাড়ি এসে একদিনেই শুকিয়ে চিমসে লেগে যাচ্ছ। না খেয়ে থেকে বুঝাতে চাও আমরা তোমাকে খাবার-দাবার দিই না?’
নীরা উত্তর দিল না। মাথা নুইয়ে নিজের কাজে মন দিল। জাহানারা নীরার হাতের গামলাটা এক ঝটকায় টেনে নিয়ে বললেন,
‘ ভাত-তরকারি হয়েছে নিজ হাতে বেড়ে খেয়ে নাও। নাকি বেড়ে হাতে তুলে দেওয়া লাগবে?’
নীরা মিহি কন্ঠে বলল,
‘ কাজ টুকু শেষ প্রায়। শেষ করে পরে খাই?’
জাহানারা ধমকে উঠলেন।
‘ সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠে কাজ দেখাও? অতটুকু সাহায্য তোমার না করলেও চলবে। হাত দুটো এখনও অচল হয়ে যায়নি। যতদিন বেঁচে আছি খাটিয়ে মারো। ছেলের বউ বলে কথা। শশুর-শাশুড়ীকে বেতের আগায় না রাখলে চলবে নাকি?’
নীরা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে খেতে গেলো। নীরাকে তাড়াহুড়ো করে খেতে দেখে আবারও ধমকা-ধমকি করলেন জাহানারা। নীরা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নিজ উদ্যোগেই থাল-বাসন পরিষ্কার করতে নেমে গেল। অন্তু যখন বাড়ি ফিরল তখন দশটা কী সাড়ে দশটা বাজে। আনিমুল সাহেব খাবার টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছেন। অয়ন ডালে ভিজিয়ে পরোটা খাচ্ছে। অন্তু একটা চেয়ার টেনে বসেই অয়নকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ অয়ু্? তোর ভাবিকে গিয়ে রেডি হতে বল। সাড়ে এগারোটায় ক্লাস আছে। আমার সাথে ভার্সিটি যাবে।’
অয়ন বাবার ফোনে মগ্ন ছিল। ভাইয়ের কথায় বিরক্ত চোখে তাকাল।
‘ এটুকু তো তুমিই বলতে পারো। নীরা আপু থুক্কু ভাবি তো রান্না ঘরেই আছে।’
অন্তু চোখ লাল করে বলল,
‘ তুই যাবি? নাকি ঠাটিয়ে চড় লাগাব?’
অয়ন মুখ ভার করে উঠে দাঁড়াল। আধ খাওয়া পরোটাটা হাতে তুলে নিয়ে বলল,
‘ নীরা আপুর বিয়েটাও আমার সাথেই দিয়ে দিতে। সব কাজ তো আমাকে দিয়েই করাও।’
কথাটা বলে বাবার দিকে তাকাতেই আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল অয়ন। বাবার রক্তচক্ষু দেখে মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল তার। একটা শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে জায়গাটা থেকে সরে দাঁড়াল। জাহানারা স্বামীকে চা দিচ্ছিলেন। অন্তুর কথাটা কানে যেতেই বললেন,
‘ নীরার ভার্সিটি যাওয়ার কী দরকার? বিয়ে যখন হয়েই গিয়েছে তখন পড়াশোনা নিয়ে এতো লাফালাফি করার কোনো প্রয়োজন নেই। তোর বউয়ের পড়াশোনা বহুত হয়েছে আর লাগবে না।’
অন্তু শান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকাল। মুখের খাবারটুকু গিলে নিয়ে বলল,
‘ আমারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে আম্মা। বিয়ের পর আমি পড়তে পারলে নীরা কেন পারবে না? পড়াশোনা কমপ্লিট করা ওর ইচ্ছে। আর ওর পড়াশোনা কমপ্লিট করানো আমার দায়িত্ব। বিয়ের সময় পড়াশোনা করাব না বলে কোনো শর্ত তো দিইনি আম্মা।’
জাহানারা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন,
‘ দিসনি তো কি হয়েছে? এখন দিবি। তিনজনের পড়াশোনার খরচ টানার সামর্থ আছে নাকি তোর আব্বার? সংসারের বাদ বাকি খরচও কি কম? সংসারে একজন এক্সট্রা মানুষ পালাও বহুত খরচার বিষয়। খাওয়া-দাওয়া, জামা-কাপড়। এখন আবার পড়াশোনা?’
অন্তু বুঝল, যুক্তিগুলো একান্তই আব্বার। যুক্তিগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আম্মার মগজে। অন্তু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তোমাকে চিন্তা করতে হবে না আম্মা। বিয়ে করার আগেই তো বলেছিলাম, আমার স্ত্রীর খাওয়া-পরা, পড়ালেখা সবকিছুর দায়িত্ব আমার। ওর জন্য আপনাদের একটা টাকাও খরচ করতে হবে না।’
জাহানারা চোখ কপালে তুলে বললেন,
‘ তোর দায়িত্ব? তুই কোথায় পাবি অত টাকা? বাচ্চা একটা ছেলে। চাকরী বাকরিও করিস না।’
‘ আমি ব্যবস্থা করে নিব।’
আমিনুল সাহেব খবরের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। তাচ্ছিল্য নিয়ে বললেন,
‘ তোমার ছেলে এখন বউয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে গিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে বাসের কন্ট্রাক্টরের চাকরি নেবে নাকি জিগ্যেস করো তো জাহানারা।’
অন্তু খাওয়া ছেড়ে আনিমুল সাহেবের দিকে তাকাল। পরমুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নিয়ে হাত ধুয়ে উঠে গেল। মাথায় হাজারও দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার। কিভাবে কী ম্যানেজ করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। গত দুইদিন রাত-দিন খুঁজেও কোনো টিউশনি পাওয়া যায়নি। আপাতত একটা দুইটা টিউশনি পেলেও চলে যেত অন্তুর। আপাতত নীরার প্রয়োজনটুকু তো মিটতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রুমে গিয়ে শার্ট খুলল অন্তু। আলমারি থেকে আরেকটা শার্ট বের করে পরতে নিতেই চোখ আটকে গেল আয়নায়। কুঞ্চিত কপালটা আরও খানিকটা কুঁচকে গেল। অন্তুর কাঁধের বামপাশে থাকা ট্যাটুটা বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করে ধরা দিচ্ছে আয়নায়। প্রায় তিন বছর আগে কাঁধের কাছে ‘এন’ লিখে ট্যাটু করিয়েছিল অন্তু। অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে শার্টের কলার টেনে ঢেকে ফেলল কাঁধ। নীরার জন্য এমন অনেক পাগলামোই করেছে অন্তু। তখন বড্ড ছেলেমানুষ ছিল সে। বয়স আর কত হবে তখন? বিশ অথবা একুশ? অন্তু এখনও ছেলেমানুষই আছে। বয়সের হিসেবে দুই-তিন বছর বৃদ্ধি পেয়েছে এই যা। কিন্তু এই দুই-তিন বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে নীরার অবহেলার ধরন। সেই সাথে পরিবর্তন হয়েছে অন্তুও। দীর্ঘ এই অবহেলার জ্বালা মেটাতে যখন আগাগোড়া পরিবর্তন হতে চাইল অন্তু। সামলে নিতে চাইল জীবন। প্রাণভরে একটু শ্বাস নিতে চাইল ঠিক তখনই রি-সাইকেলের মতো আবারও জীবনের সাথে ল্যাপ্টে গেল নীরা। অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইকের চাবিটা তুলে নিল হাতে। নীরা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। অন্তু হয়তো খেয়ালই করল না তাকে। বাইরে গিয়ে অয়নকে দিয়ে নীরাকে ডাকতে পাঠাল অন্তু। নীরা ঢিপঢিপ করে বাজতে থাকা হৃদপিণ্ড নিয়ে অন্তুর বাইকে গিয়ে বসল। অন্তুর কাঁধে হাত রাখতেই ভিন্ন এক অস্বস্তিতে কাটা হয়ে রইল মন। ধানমন্ডি থেকে শাহাবাগ পুরোটা রাস্তা নিশ্চুপ কাটল তাদের। ভার্সিটির সামনে এসে নীরা বাইক থেকে নামতেই একটা পাঁচশ টাকার নোট এগিয়ে দিল অন্তু। নীরা অবাক চোখে তাকাল। সংকুচিত মনে নোটটা হাতে নিয়ে অন্তুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। অন্তু বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে সামনের দিকে তাকিয়েই বলল,
‘ হাত খরচের টাকা।’
কথাটুকু বলে মুহূর্তেই বাইক নিয়ে ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে গেল অন্তু। নীরা ফ্যালফ্যাল চোখে অন্তুর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। হাত-পা শিরশির করে উঠল অদ্ভুত, অচেনা এক অনুভূতিতে।
শরতের মাঝামাঝি। আবহাওয়ায় হালকা শুষ্ক ভাব। ভ্যাপসা গরম, জ্যাম আর ধুলোবালির সাথে নিরন্তর যুদ্ধ করে বাস যখন রাজেন্দ্রপুর এসে থামল, তখন ঘড়িতে বারোটা বাজে। মাথার উপর দগদগ করে জ্বলছে সূর্য। নাদিমের মাথা ভর্তি চুল তখন ধুলোয় ধূসর। পরনের গোলাপি শার্ট, কালো প্যান্টে ধুলোবালির পাতলা আস্তরণ। নাদিম বাস থেকে নেমে ডানহাতের কব্জিতে পরা ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ির স্বচ্ছ কাচটি ঘোলা হয়ে এসেছে মিহি ধুলোয়। প্যান্টের গায়ে ঘড়িটা ঘষে কাচ পরিষ্কার করল নাদিম। চোখ ছোট ছোট করে আশেপাশে তাকাল। পকেট থেকে কাগজের ছোট্ট টুকরোটা বের করে ঠিকানা দেখল। দ্বিতীয় গন্তব্য, বাংলাবাজার। অটোরিকশায় বাংলাবাজার পৌঁছানোর পর যেন দিশেহারা হয়ে পড়ল নাদিম। খা খা দুপুরে দোকানপাটের অধিকাংশই ফাঁকা, নিস্তব্ধ । নাদিম বেশ কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়েও কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজে পেল না। দোকানের সবাই প্রায় নতুন কর্মচারী, স্থানীয় বাসিন্দাদের খুব একটা চেনে না। নাদিম ক্লান্ত হয়ে একটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। এক কাপ চা খেয়ে মধ্যবয়স্ক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই চা ওয়ালা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
‘ মকবুল ওয়াহেদ চৌধুরী আবার ক্যাডা? এই নামে তো কাউরে চিনি না ভাইসাব।’
নাদিমের ভ্রু জোড়া বিরক্তিতে ত্রিভুজাকার রূপ ধারণ করল। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ আপনারে দেইখা তো স্থানীয় মানুষই মনে হইতাছে চাচা। কয় বছর আছেন এই এলাকায়?’
দোকানদার দ্রুত হাতে চা ছাঁকতে ছাঁকতে বলল,
‘ জন্মের পর থাইকাই তো এইখানেই আছি ভাইসাব।’
‘ তাহলে তো মকবুল ওয়াহেদ চৌধুরীকে চেনার কথা। শুনেছি উনার বড়সড় একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টেরি আছে এলাকায়। গাজীপুরে নাকি রিসোর্ট টিসোর্টও আছে। তারওপর স্থানীয় মানুষ। চিনেন না ক্যান?’
দোকানদার নাদিমের মুখের দিকে খানিক ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ আনমনা বসে থেকে বলল,
‘ আপনে কী মুকুল ভাইয়ের কতা জিগাইতেছেন নাকি ভাইসাব?’
নাদিমের পুরু ভ্রু আরও খানিকটা কুঁচকে গেল। মুকুল ভাই? এই মুকুল ভাইয়ের কাহিনিটা কী? বড় মামার ভাষ্যমতে মিষ্টিকে মকবুল ওয়াহেদ চৌধুরী নামক এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কাগজে লেখা ঠিকানাটাও তার। এর মাঝে মুকুল ভাই নামক ব্যক্তির এন্ট্রি কিভাবে হলো বুঝা যাচ্ছে না। নাদিমকে চুপ থাকতে দেখে দোকানদার নিজ উদ্যোগেই বলল,
‘ স্থানীয় বাসিন্দা গো মধ্যে মুকুল ভাইই বিরাট ধনী মানুষ। গারমেন্স কারখানা আছে। হুনছি বড়লোকী হোটেলও নাহি আছে দুই একটা। ভাইজানের বাড়ি বাজার থাইকা দশ মিনিটের রাস্তা। রিকশা লইয়া চইলা যান। মকুল ভাইয়ের বাড়ি বেবাকেই চিনে। মকুল ভাইয়ের বাড়ি যামু কইলেই দিয়া আইব।’
নাদিম জবাব দিল না। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে কিছু একটা ভাবল। আরও এক কাপ চা খেয়ে মুকুল ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
রিকশাওয়ালা যখন নাদিমকে মকুল ভাইয়ের বিশাল বাড়িটির সামনে পৌঁছে দিল, তখন ঘড়িতে পৌনে দুইটা বাজে। মাথার উপর ঝা ঝা করছে স্বর্ণালী রোদ। ঘেমে-নেয়ে একাকার নাদিমকে গেইট থেকে অন্দরমহল পর্যন্ত পৌঁছাতে বহু কসরত করতে হলো। তাকে যে বসার ঘরে বসতে দেওয়া হলো তার সাজসজ্জা আলিশান। ছিমছাম সবুজ গালিচা বিছানো মেঝে। ঝকঝকে, দামী আসবাব। সেই আলিশান, বিলাসিতায় মোড়া বসার ঘরে বসে থেকে জীবনে প্রথম বারের মতো নাদিম উপলব্ধি করল, মিষ্টি নামক মেয়েটির জন্য তার চিন্তা হচ্ছে। সাত-আট বছর আগে যে মেয়েকে টাকার বিনিময়ে কিনে আনা হয়েছে, তার সাথে কী রকম আচরণ করা হতে পারে ভেবেই তার গা শিউরে উঠছে । বার বার জানতে ইচ্ছে করছে, মেয়েটা কি আদৌ বেঁচে আছে? নাদিমের সূক্ষ্ম চিন্তার মাঝেই সুপ্ত মানবের আবির্ভাব ঘটল। মনের গহীন থেকে তাচ্ছিল্যের কন্ঠে বলে উঠল,
‘ তুমি একজন মেরুদণ্ডহীন মানুষ নাদিম। তোমার মাঝে কোনো প্রতিশোধস্পৃহা নেই। এই মেয়েটির জন্য এতো চিন্তা তোমায় মানায় না। কেন করছ এতো হাহাকার?’
নাদিম চমকে উঠে বলল,
‘ হাহাকার করছি?’
‘ অবশ্যই করছ।’
‘ বোনের জন্য হাহাকার করা খারাপ তো কিছু নয়। মিষ্টি আমার ছোট বোন।’
সুপ্ত মানব আক্রোশ নিয়ে বলল,
‘ বাজে কথা। মিষ্টি কখনোই তোমার বোন নয়। সে তোমার দুর্দশার কারণ। তোমার মায়ের দুঃখের কারণ। কেন ভুলে যাচ্ছ বারবার? ফিরে যাও। ছেড়ে দাও তার পিছু। অতীত ঘেঁটে কী লাভ? ভালো আছো, ভালো থাকো।’
নাদিম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ তোমার সত্যিই মনে হয় মিষ্টিই সকল দুর্দশার কারণ? কারো পক্ষে কারো দুর্দশার কারণ হওয়া কী আদৌ সম্ভব? ইট’স অল এবাউট ডেসটিনি। মানুষের পক্ষে হয়ত ভাগ্যের বাইরে গিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়।’
‘ তুমি বলতে চাইছ, তোমাকে ঠকানো হয়নি?’
‘ হয়েছে। কিন্তু তার জন্য মিষ্টি দায়ী হতে পারে না। সেও ঠকেছে। তাকেও ঠকানো হয়েছে। হয়ত, আমার থেকেও বেশি।’
নাদিমের কথার প্রত্যুত্তর এলো না। তার আগেই বিশাল লম্বা,স্বাস্থ্যবান এক ভদ্রলোক নাদিমের সামনে সোফায় এসে বসল। লোকটি লম্বায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। থলথলে শরীরে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি। পরনে ধবধবে সাদা লুঙ্গি। পান খেয়ে ঠোঁটদুটো টকটকে লাল। তীর্যক নাকের নিচে মাঝারি আকারের তিল। নাদিম সরাসরি ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। লোকটি ভ্রু কুঁচকে নাদিমকে দেখে নিয়ে বললেন,
‘ তুমি কে? আমার সাথে দেখা করতে চাওয়ার কারণ কী? কম কথায় উত্তর দাও। বেশি কথা আমার পছন্দ নয়।’
নাদিম ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে নিয়ে সরাসরিই প্রশ্ন করল,
‘ আপনার নাম মকবুল ওয়াহেদ চৌধুরী?’
লোকটি তীর্যক দৃষ্টি মেলে বললেন,
‘ হ্যাঁ। কেন?’
‘ প্রায় সাত-আট বছর আগে ময়মনসিংহের একটা এতিমখানা থেকে আট বছরের একটা বাচ্চাকে কিনে এনেছিলেন আপনি। মেয়েটির নাম ছিল মিষ্টি। চিনেন তাকে?’
মকবুল সাহেবের মুখ মুহূর্তেই থমথমে রূপ ধারণ করল। চোয়াল শক্ত করে নাদিমের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ তুমি কে?’
নাদিম হেসে বলল,
‘ আপনি বোধহয় উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন। অযথা ঘাবড়াবেন না। আমি আহামরি কেউ নই। আমার নাম নাদিম হোসেন। সম্পর্কে মিষ্টির ভাই। আমি মিষ্টির সাথে দেখা করতে চাই। ওর সাথে দেখা করা কি সম্ভব?’
মকবুল সাহেব আগের মতোই নিশ্চুপ বসে আছেন। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও ধারাল।
‘ যা বিক্রি করে দিয়েছ তার প্রতি হঠাৎ এতো উৎকন্ঠা? বিক্রিত জিনিস মাত্রই বিক্রিত জানো না? মিষ্টি মানুষ হোক বা বস্তু আমি তাকে নগদ টাকা দিয়ে কিনেছি। অযথা ঝামেলা না বাড়িয়ে নিজের চরকায় তেল দাও।’
নাদিম মকবুল সাহেবের দিকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ আপনার কথায় একটু ভুল আছে মকবুল সাহেব। মিষ্টিকে আমি বিক্রি করিনি। বিক্রি করেছে অন্যকেউ। মিষ্টির এই মালিকানা বদলের রহস্য আমার অজানা। তবে আমি মিষ্টিকে ফিরিয়ে নিতে আসিনি। আমি শুধু ওর সাথে দেখা করব। দুই একটা কথা বলব। তারপর চলে যাব।’
নাদিমের কন্ঠে কিছু একটা ছিল। মকবুল সাহেব খানিক শান্ত হলেন। নাদিমকে অবাক করে দিয়ে একজন কাজের লোককে ডেকে পাঠালেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ তোমার আপা মণিকে ডেকে আনো তো শামছুল।’
চাকর শ্রেণীর লোকটি মাথা হেলিয়ে সরে যেতেই মকবুল সাহেব চোখ-মুখ শক্ত করে তাকালেন। শাসানোর মতো করে আঙ্গুল উঁচালেন। হিংস্র চোখে চেয়ে বললেন,
‘ এইবারই শেষ। এই এলাকায় ফিরে আসার সাহস করবে না আর। এরপর তোমাকে এই এলাকায় দেখলে কেটে ফেলে দেব।’
নাদিমের মাঝে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। রক্ত কণিকাগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠল। হৃদপিণ্ডটা ঢিপঢিপ করছে। তবে মিষ্টি বেঁচে আছে? বেশ কিছুক্ষণ পর সিঁড়ি বেয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো ষোল-সতেরো বছরের এক যুবতী। গায়ের রঙ মিষ্টি শ্যামলা। মুখের গড়নে আদিবের অবয়ব স্পষ্ট। মিষ্টির অবনত মুখটির দিকে চেয়ে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা করে উঠল তার। হাত-পায়ের শিরায় টান পড়ল। মেয়েটি ঠিক বাবার মতো দেখতে হয়েছে। নাদিমের চেহারায় বাবার ছাপ অল্প, মায়ের ছাপ বেশি। নাদিমের থিতিয়ে থাকা রাগটা ফুঁসে উঠতে চাইল। পুরো পৃথিবী ছারখার করে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছেই ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠল মন। কিন্তু মিষ্টি নামের মেয়েটা যখন বড় বড় চোখ মেলে নাদিমের দিকে তাকাল। ঠিক তখনই শান্ত হয়ে এলো নাদিমের মস্তিষ্ক। টলমলে নিষ্পাপ সেই চাহনীর সামনে নাদিমের সকল বিতৃষ্ণা যেন থিতিয়ে গেল। ফনা তোলা রাগটা মাথা নুইয়ে শান্ত হয়ে পড়ে রইল বুকের এক কোণায়। দুই জোড়া চোখ চুপচাপ চেয়ে রইল প্রায় অনেকক্ষণ। মকবুল সাহেব মিষ্টিকে সোফায় বসতে বললেন। মিষ্টি বাধ্য মেয়ের মতো সোফায় গিয়ে বসল। মুখোমুখি সোফায় বসে থাকা যুবতী মেয়েটির সারা গায়ে সদ্য যৌবনের চঞ্চলতা। আনত মুখটিতে এক রাজ্য মায়া। সেই মায়াবী মুখটির দিকে চেয়ে নাদিমের হঠাৎই মনে হলো, মিষ্টি শব্দটা বোধহয় কোন এককালে এই মেয়েটির জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন বিধাতা। মিষ্টি নামটি রেখেছিলেন বাবা। নাদিমের তখন সাত বছর বয়স। এমনই একটি গোধূলি বিকেলে মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে বাচ্চা মেয়েটির নাম রেখে ফেললেন মিষ্টি। মলি- মিষ্টি। মা খুব চোটপাট করেছিলেন সেদিন। ছোট্ট মিষ্টিকে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন মাটিতে। বাবা বারান্দায় বসে গম্ভীর মুখে পুরো ব্যাপারটা দেখলেন অথচ উঠে এলেন না। উচ্যবাচ্য করলেন না। বাবার চেহারা এখন আর মনে নেই নাদিমের। কিন্তু সেই তারস্বরের কান্নাটা মাঝে মাঝেই কানে ভাসে। এখনও কত জীবন্ত সেই কান্না। নাদিমের ভাবনার মাঝেই বসার ঘর থেকে উঠে গেলেন মকবুল সাহেব। নাদিম ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবারও মিষ্টির দিকে তাকাল। মিষ্টি উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। বড় বড় চোখদুটোতে চিকচিক করছে কৌতূহল। সত্যিই কি কৌতূহল? নাকি টলমলে জল? নাদিম হাতের ইশারায় মিষ্টিকে ডাকল। বলল,
‘ এদিকে এসো।’
মিষ্টি ইতস্তত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নাদিমের পাশে বসল। নাদিম গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কোন ক্লাসে পড়?’
মিষ্টি জবাব দিল না। নাদিমের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থেকে বলল,
‘ তুমি আমার ভাইয়া?’
নাদিমের বুকের কোথাও একটা চাপা যন্ত্রণা খেলে গেল। বলতে ইচ্ছে হলো, না। আমি তোমার কেউ নই। কেউ না। কিন্তু বলা হলো না। মিষ্টির বলা ভাইয়া শব্দটা হৃদপিণ্ডের সাথে সমান তালে লাফাতে লাগল পুরো বুকেজুড়ে। নাদিমের উত্তর না পেয়ে মিষ্টি নিজে থেকেই কথা বলল। তার মিহি কন্ঠে খেলে গেল রাজ্যের অস্বস্তি,
‘ আমার ভাইয়ার গালে তিল ছিল। তোমারও আছে। এই দেখো আমারও আছে। তুমি আমার ভাইয়া না?’
নাদিম চোখ উঠিয়ে মিষ্টির বাম গালে তাকাল। একই জায়গায় আদিবেরও তিল ছিল। নাদিম ডানহাতে ঘাড় চুলকে এদিক ওদিক তাকাল। কি বলবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। তারপর মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ তোমার আমাকে মনে আছে?’
মিষ্টি মাথা নাড়ে। তারপর খুব অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ তুমি আমায় পছন্দ করো না, না? কেন পছন্দ করো না? কি করেছি আমি?’
নাদিমের ভেতরটা টলমল করে উঠল। এই বিশ্রী পৃথিবীর সব অশ্লীল, কপটতাকে ঠেলে দিয়ে ছোট্ট একটি বোন বিশাল অভিমানের ঝুঁড়ি নিয়ে ভাইয়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল। নাদিমের মনে হলো, সেই প্রশ্নটা নাদিমের ভেতরটাকে চোখের পলকে তীব্র এক ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত করে দিল। নরম কন্ঠে বলল,
‘ কে বলল আমি তোমায় পছন্দ করি না?’
‘ সবাই বলত। আমি জানি।’
কথাটা বলে থামল মিষ্টি। ভীত হাতে নাদিমের বাহুতে হাত রাখল। অপলক চোখে নাদিমের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
‘ মায়ের চেহেরা আমার মনে নেই। তুমি কী মায়ের মতো দেখতে? মাকে খুব মনে পড়ে আমার। মামা বলেছিল, আমি নাকি মাকে মেরে ফেলেছি। আমার জন্যই মরে গিয়েছে মা। মামার কথা কী সত্য ভাইয়া? তুমি যা বলবে আমি বিশ্বাস করব। মামার কথা আমার বিশ্বাস হয় না। মামা আমার সাথে…. ‘
এটুকু বলে থেমে গেল মিষ্টি। মাথা নিচু করে বসে রইল চুপচাপ। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল টপাটপ বৃষ্টি। তার ছোট্ট আদুরে মুখ দেখে মনে হলো, অভিমানিনী এক কিশোরী গাল ফুলিয়ে একের পর এক নালিশ করছে। জীবন সম্পর্কে হাজারও নালিশ ভাইয়ের জন্য জমা রেখেছিল সে। ভাইয়ের প্রতি তার অগাধ ভরসা। ভাইয়েরা সব পারে! নাদিমের চোখের কোণে চিকচিক করে উঠল এক ফোটা অশ্রুবিন্দু। এই প্রথম মিষ্টি নামক মেয়েটির জন্য বড় মায়া হলো তার। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
‘ মামা মিথ্যে বলেছেন। উনার কথা বিশ্বাস করো না। মা তোমাকে ভালোবাসত। আমায় বলেছে।’
মিষ্টির মুখটা উজ্জল হয়ে উঠল।
‘ তুমিও আমায় ভালোবাসো?’
নাদিম এক পলক মিষ্টির দিকে তাকাল। চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ। বাসি।’
‘ আব্বুও বলেছিল যে তুমি আমায় ভালোবাসো। মামা মিথ্যে বলেছে।’
নাদিম সন্দিহান চোখে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ আব্বু?’
#চলবে….
[ বিঃদ্র-১ঃ অনেক বড় হয়ে গিয়েছে অলরেডি। সময়ও নেই। তাই অন্যান্য চরিত্রগুলো উঠে আসেনি এই পর্বে। সেজন্য দুঃখিত।
বিঃদ্র-২ঃ আমি হয়ত নীরা চরিত্রকে খুব ভালো বর্ণনা করতে পারিনি। তাই অনেকে নীরাকে প্রতিবাদী চরিত্র বলে ভুল করছেন। নীরার ধৈর্যশক্তি বা সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অত্যাধিক হলেও সে প্রতিবাদী নয়। সব সময় পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতেই সে অভ্যস্ত। জীবনে ভিন্নতা আনার প্রয়াস তার মাঝে নেই বললেই চলে। সে জন্যই তার আফসোস, কেন সে ইরার মতো প্রতিবাদী হলো না? তাহলে হয়তো তার জীবনটা এমন বিষাক্ত হতো না। প্রতিবাদীরা পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তনের চেষ্টা করে বেশি। নীরা চরিত্র তেমন কোনো লক্ষ্মণ নেই।
বিঃদ্র-৩ঃ রি-চেইক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে ধরিয়ে দিবেন প্লিজ।]