নীল চিরকুট পাঠ-৪৭

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৪৭.

বিছানার এক কোণায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে নীরা। সময়টা প্রায় মধ্যরাত। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। জানালার পর্দা উড়িয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে স্তব্ধ, নিশ্চুপ ঘরে। ঘরের ভেতর উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। নীরার পাশেই লম্বালম্বিভাবে শুয়ে আছে অন্তু। কপালের উপর ডানহাতটা তুলে দিয়ে মাঝে মাঝেই ভীষণ উশখুশ করছে সে। নীরা জানে অন্তু ঘুমোয়নি। আলোতে তার ঘুম হয় না, সে-ও নীরার জানা। তবুও আগের মতোই শক্ত হয়ে শুয়ে রইল নীরা। নিজ মুখে না বললে কিছুতেই আলো নেভাবে না সে। মুখে কুলুপ এঁটে পত্নী সেবা পাওয়ার ইচ্ছে থাকলে, আজ সেই আশার গুড়ে বালি দেবে নীরা। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর হঠাৎই ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাস টের পেল নীরা। নিঃশ্বাসের স্পর্শ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতেই চমকে উঠল নীরা। দমবন্ধ হয়ে এলো। উত্তেজনায় হাত-পায়ে কাঁপন ধরল। অন্তু তার এতো কাছে? নীরা কম্পিত বুক নিয়ে সোজা হয়ে শুল। সাথে সাথেই নিজের মুখের ঠিক উপরেই আবিষ্কার করল প্রিয় একটি মুখ। ঝলমলে আলোয় কাঙ্ক্ষিত মানুষটির শক্ত চোয়াল, প্রশস্ত কাঁধে নজর আটকে গেল নীরার। একদৃষ্টে চেয়ে রইল অন্তুর মুখে। অন্তু নীরার দিকে এক পলক চেয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে নীরার পাশে থাকা সুইচবোর্ড হাতড়ে আলো নেভাল। সবুজ রঙা ঢিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে সরে আসতে নিতেই চট করে টি-শার্টের কলার খামচে ধরল নীরা। নীরার আচমকা আক্রমণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল অন্তু। নীরার উপর পড়ে যেতে নিয়েও কোনোরকমে সামলে নিল সে। নীরার মাথার পাশে বামহাতের ঠেস দিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকাল। নীরার বামহাতের মুঠোতে থাকা কলারের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাল। নীরার মুখের দিকে চেয়ে হতভম্ব কন্ঠে প্রশ্ন করল,

‘ কী?’

নীরার হাতের মুঠো আরও খানিকটা শক্ত হল। অন্তু বাধ্য হয়েই আরও একটু ঝুঁকে এলো কাছে।

‘ রাতে বাড়ি না ফেরার কারণ কী?’

অন্তু উত্তর না দিয়ে কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করল। নীরা হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে রেখে অন্তুর মুখের দিকে চেয়ে রইল। অন্তু কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতেই দু-একবার নীরার দিকে তাকাল৷ নীরার মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার কোনো লক্ষ্মণ না দেখে মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল,

‘ কী চাই?’

নীরা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

‘ আইডিয়া চাই।’

অন্তুর কপাল কুঁচকে গেল। ভ্রু বাঁকিয়ে নীরার দিকে চেয়ে থেকে আবারও কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করল। নীরা মুঠো শক্ত রেখেই বলল,

‘ আইডিয়া না দিলে ছাড়ব না।’

অন্তু বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ কিসের আইডিয়া?’

‘ শাশুড়ী মা বলেছে, নিজের বরকে ঘরে আটকে রাখার দায়িত্ব আমার। সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করানোর পরও যদি ছেলে রাত-বিরেতে বন্ধুর বাসায় পড়ে থাকে তাহলে চলবে কেন? শাশুড়ী মায়ের কথায় পয়েন্ট আছে। কিন্তু বরকে কিভাবে আটকাব বুঝে উঠতে পারছি না৷ ছেলেদের সম্পর্কে ছেলেদের ধারণা থাকে সবচেয়ে বেশি। তাই আইডিয়া চাচ্ছি, কিভাবে আটকাব আমার বরকে?’

কথাটা বলে সরল চোখে চাইল নীরা। অন্তুর হতভম্ব দৃষ্টি লক্ষ্য করে কৈফিয়ত দেওয়ার মত করে বলল,

‘ বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে আইডিয়া চাইছি। বাকিরা তো নেই কাছে। থাকলে নিশ্চয় চুপ করে থাকত না।’

অন্তু বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল। নীরা যে এমন কিছু বলতে পারে ধারণায় ছিল না তার। নীরার কথার পিঠে কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইল অন্তু। ভ্রু,কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভাবতে লাগল। অন্তুর নিশ্চলতার সুযোগে আরও একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল নীরা। আচমকায় কাছে টেনে চুমু খেল অন্তুর গলায়। অন্তুর সারা শরীর ক্ষণিকের জন্য কেঁপে কেঁপে উঠল। চকিতে নীরার দিকে তাকাল। মেয়েটা কী পাগল হয়ে গিয়েছে আজ? নীরা আবারও একই কাজ করল। তৃতীয়বারের পাগলামো যেন অসহনীয় ঠেকল অন্তুর। গলার এক পাশে গাঢ় দাগ বসিয়েই সম্বিৎ ফিরে পেল নীরা। চমকে উঠে অন্তুকে ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুল। কাঁথায় চোখ-মুখ ঢেকে নিজের লজ্জা আর অস্বস্তি ঢাকার বৃথা চেষ্টা করল। এতোক্ষণ পর ছাড়া পেয়ে নীরার পাশেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল অন্তু। গলার জ্বালা ধরা জায়গাটুকু হাত দিয়ে আলতো স্পর্শ করে আড়চোখে নীরার দিকে তাকাল। আশ্চর্য! কি চায় এই মেয়ে?

_

পার্কের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে নাদিম। দুই আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। মাথায় এক দঙ্গল চুল। চোখে-মুখে নিষ্পৃহ ভাব। কোলের উপর রাখা গিটারটায় সুর তোলার প্রচেষ্টা নেই। নাদিম সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে মুখ কুঁচকাল। বিস্বাদ। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে পকেট থেকে ফোন বের করে ভ্রু বাঁকাল। নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবল। তারপর ধীর হাতে ডায়াল করল পরিচিত এক নাম্বারে। কল ঢোকার সাথে সাথেই ঝট করে রিসিভ করে ফেলল অপর পাশের ব্যক্তি। নাদিম গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ হ্যালো?’

ওপাশ থেকে জবাব পেল না নাদিম। কারো ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ এসে ধাক্কা খেতে লাগল ফোনের স্পিকারে। সেই সাথে অল্প একটু নাক টানার শব্দ। নাদিম বিরক্ত হল। বন্ধুর খাতিরে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বিরক্তি দমন করল সে। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ হ্যালো, মৌশি? ক্যান ইউ হেয়ার মি?’

ওপাশ থেকে মৃদু জবাব,

‘ হ্যালো স্যার।’

‘ কেমন আছ মৌশি?’

মৌশি কান্না আটকে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘ আপনি কেমন আছেন স্যার?’

নাদিম হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। এই বয়সের মেয়েদের অল্পতে কেঁদে কেটে পৃথিবী ভাসিয়ে ফেলার স্বভাবটা বড় বিরক্তিকর।

‘ আমি ভালো আছি।’

কথাটুকু বলে থামল নাদিম। ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ তোমার কী এখন কোনো টিউটর প্রয়োজন মৌশি? প্রয়োজন হলে আমায় জানিও। আমি একটা ভালো টিউশনি খুঁজছি।’

নাদিমের কথায় অবাক হল মৌশি। নাদিম তার কাছে হেল্প চাইছে? সত্যিই চাইছে? কথাটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না মৌশির। মৌশি অবাক হয়ে বলল,

‘ আপনার প্রয়োজন স্যার?’

নাদিম উত্তর দিল না। মৌশি খুশি হয়ে বলল,

‘ আপনি আমাকে যেকোনো সাবজেক্ট পড়াতে পারেন স্যার। কখন আসবেন বলুন। সকাল, দুপুর, রাত এনিটাইম।’

‘ টিউশনিটা আমার জন্য নয় মৌশি, আমার বন্ধুর জন্য। দারুণ ট্যালেন্টেড একটা ছেলে। অসাধারণ পড়ায়। যদি তোমার টিচারের প্রয়োজন থাকে তবেই হ্যাঁ বলো। অন্যথায় নয়।’

মৌশির মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

‘ আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড?’

নাদিম ভ্রু কুঁচকাল,

‘ হ্যাঁ। কেন?’

মৌশি উত্তর না দিয়ে বলল,

‘ আমি উনার কাছে পড়ব।’

নাদিম মৃদু হাসল। মৌশি যে চট করেই রাজি হয়ে যাবে এমনটাই ধারণা করেছিল নাদিম। অন্তুর মাধ্যমে নাদিমের সাথে কানেক্টেড থাকার শেষ চেষ্টাটা যে মৌশি কিছুতেই হাতছাড়া করবে না তা-ও নাদিমের জানা। নাদিম ফোন কেটে গিটারে সুর তুলল। চেহারায় বাবার তেমন ছাপ না থাকলেও নাদিমের ব্যক্তিত্ব আর চাল-চলনে বাবার প্রকাশ স্পষ্ট। বাবার মতোই ছন্নছাড়া জীবনবোধ। নারীমহলে দীর্ঘশ্বাসের কারণ। কথাবার্তায় স্পষ্ট, ভয়হীন তেজ। নাদিমের মনে হঠাৎই প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা? চরিত্রের দিক দিয়েও কি তারা একই? একই কি তাদের পরিণতিও?

#চলবে…

[ রি-চেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here