নীল চিরকুট পাঠ-৪৮

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৪৮.

সুন্দর, ঝকঝকে সকাল। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় বাতাসে মৃদু ঠান্ডা আমেজ। এখানে সেখানে জমে আছে কর্দমাক্ত পানি। আরফান দ্রুত পায়ে হাসপাতালের ফটকে এসে দাঁড়াল। গেইট থেকে কিছুটা দূরে, ফোন কানে দাঁড়িয়ে আছে নম্রতা। এক হাতে ছোট্ট একটি হ্যালমেট। গায়ে সাদা-কালো শাড়ি। আরফান কিছুটা এগিয়ে এসে নম্রতার মুখোমুখি দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘ বাহ! নিউ লুক।’

নম্রতা শিশুসুলভ হেসে বলল,

‘ আপনি ফ্রী?’

নম্রতার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির আভাস পেয়ে ভ্রু বাঁকাল আরফান। সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ আপনার মাথায় একজেক্টলি কি চলছে নম্রমিতা?’

‘ ফুসকা ঘুরছে। আপনি ফ্রী থাকলে দু’জন মিলে রবীন্দ্র সরোবরে যাব। আপনি বেলীফুলের মালা কিনে দিবেন। সেই মালা হাতে ফুসকা হাউজ যাব। পেট পুরে ফুসকা খাব। আপনি চাইলে আইসক্রিমও খাওয়াতে পারেন। আই ওন্ট মাইন্ড।’

নম্রতার হাসি হাসি মুখের দিকে চেয়ে হাসল আরফান। ডানহাতের কব্জিতে থাকা ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বলল,

‘ মাত্রই ক্লাস শেষ করে বেরুলাম। আগামী দুই ঘন্টা ফ্রী। আমার ডিউটি দুই ঘন্টা পর থেকে। এই দুই ঘন্টায় যতটুকু সম্ভব ঘুরে বেড়ানো যায়।’

আরফানের কথায় খুশি হয়ে গেল নম্রতা। গোলাপী রঙের হ্যালমেটটা খুব দ্রুত মাথায় চাপিয়ে বলল,

‘ গ্রেট। তাহলে চলুন!’

নম্রতাকে স্কুটিতে উঠতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল আরফান,

‘ চলুন মানে? আপনি কী স্কুটিতে যাবেন নাকি?’

নম্রতা অমায়িক হাসি দিয়ে বলল,

‘ শুধু আমি নই। আপনিও যাচ্ছেন।’

আরফান আঁতকে উঠে বলল,

‘ আমি আর স্কুটিতে? ইম্পসিবল!’

নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘ কেন! আপনার ধারণা আমি স্কুটি চালাতে পারি না?’

‘ তা নয়। আমার রিকশায় যেতে ভালো লাগে। আমরা বরং রিকশায় যাই?’

নম্রতা শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ না। আমরা স্কুটিতেই যাব। জলদি উঠুন।’

আরফান হতাশ কন্ঠে বলল,

‘ মেয়েদের স্কুটিতে উঠে রবীন্দ্র সরোবর যাব? ব্যাপারটা ভীষণ উইয়ার্ড লাগছে নম্রতা।’

‘ লাগলে লাগুক।’

‘ আপনি আমার ন্যাচার জানেন নম্রমিতা। এসব স্কুটি ফুটিতে উঠা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। প্লিজ রিকশায় চলুন।’

নম্রতা সামনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট উত্তর দিল,

‘ না।’

‘ আপনি বাচ্চাদের মত জেদ করছেন।’

নম্রতা ফিরে তাকাল। ঝট করে স্কুটি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,

‘ করলে করছি। আপনিও তো বাচ্চাদের মতোই ভয় পাচ্ছেন। আর ভয় পাচ্ছেন বলেই বাবার সাথে দেখা করতে চাইছেন না। এটা আপনার পানিশমেন্ট।’

আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হতাশ কন্ঠে বলল,

‘ এখানেও বাবা?’

নম্রতা তেড়ে এসে বলল,

‘ তো?’

‘ আপনি এখনও সেই আগের মতোই আছেন। সব কিছুতেই আগের মতোই ভয়ানক জেদ।’

নম্রতা হ্যালমেটটা খুলতে খুলতে বলল,

‘ তো? আপনি কি আমার পরিবর্তন চাইছিলেন? আপনি চান আমি পাল্টে যাই?’

আরফান হেসে বলল,

‘ একদমই না। আমিতো আরও এই ভেবে খুশি হচ্ছি যে, এতোদিন পরই হোক আর যায়হোক শেষমেষ পুরাতন শ্যামলতার সাথে দেখা তো মিলছে।’

নম্রতা সন্তুষ্টির হাসি হাসল। পরমুহূর্তেই চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,

‘ একদম গলানোর চেষ্টা করবেন না। স্কুটিতে উঠার প্ল্যান আমি ক্যান্সেল করব না। কিছুতেই না।’

‘ যদি আপনার বাবার সাথে দেখা করতে রাজি হই তবে?’

নম্রতা চকিতে তাকাল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ সত্যি?’

‘একদম।’

‘ চুক্তিপত্র জমা দিন। আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।’

আরফান হেসে একটা রিকশা ডাকল। নম্রতাকে রিকশায় উঠতে ইশারা দিয়ে একটা ফোন এটেন্ড করল। ফোন কিছুক্ষণ কথা বলার পর মুখটা কালো হয়ে গেল আরফানের। নম্রতার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে কিছু একটা বলবে তার আগেই হাসল নম্রতা। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ হঠাৎ কাজ পড়ে গিয়েছে? আচ্ছা, মন খারাপ করবেন না। আজ নাহয় আমি একাই ফুসকা খাই। এরপরের বার আপনি খাওয়াবেন। সাথে আইসক্রিম ফ্রী। মনে থাকবে?’

কথাটা বলে মিষ্টি হাসল নম্রতা। আরফান হাসল না। নম্রতার স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সে। চাপা মন খারাপ নিয়ে বলল,

‘ মনে থাকবে।’

নম্রতা আবারও হাসল। আরফানের মুখে হাসি নেই। অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ চেয়ে রইল প্রিয়তমার প্রিয় দুটো চোখে।

_

নাদিমের যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে বারোটা কি একটা বাজে। হলের চেরচানা ঘরটাতে আলো-আঁধারির খেলা। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বোজে পড়ে থাকার পর বিছানা হাতড়ে মুঠো ফোনটা উদ্ধার করল নাদিম। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা তারিখটা দেখেই ফট করে মনে পড়ে গেল, আজ তার মায়ের মৃত্যু দিন। ঠিক এই দিনটাতেই চোখের সামনে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিলেন মা। স্বেচ্ছা মৃত্যু অর্থাৎ আত্মহত্যা। গত নয় বছর ধরে ব্যাপারটা নিছক আত্মহত্যা মনে হলেও আজ এই স্নিগ্ধ দুপুরে ব্যাপারটাকে নিছক আত্মহত্যা বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষভাবে হলেও বাবাকে এই মৃত্যুর পেছনে দায়ী করে মনটাকে বিষিয়ে দিতে ভালো লাগছে। নাদিমের বাবা আদিব ছিলেন ছন্নছাড়া ধাঁচের মানুষ। জীবনের ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে বেঁচে থাকার স্বাদ আচ্ছাদনই ছিল তার মূলমন্ত্র। নাদিম ভেবে পায় না, এমন একটা মানুষকে কি করে ভালোবাসার জালে আটকে ফেলল মা? সংসার নামক ভয়ানক জালে আটকে ফেলে, কিভাবে সেই মুক্ত ডানা কাটল? নাদিম উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াল। জানালার পাল্লাটা খুলে দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। গাঢ় নীল আকাশের দিকে চেয়ে হুট করেই তার মনে হল, মা আসলে পাখা কাটতে পারেনি। বাবার মুক্ত পাখা কেটে ফেলার ক্ষমতা হয়ত মায়ের ছিল না। আর ছিল না বলেই এমন ভয়াবহ পরিণতি হলো তাদের ভালোবাসার। নাদিমের মস্তিষ্কে ‘ভালোবাসা’ নামক শব্দটা বলের মত ঢপ খেতে লাগল। ঢিপ ঢিপ শব্দ তুলে আওড়াতে লাগল, ‘ ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা’। সত্যিই কী ছিল ভালোবাসা?

_

ঘরের ছোট্ট ড্রেসিং টেবিলটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে অন্তু। শার্টের কলারটা বিভিন্নভাবে টেনেও গলার দাগ ঢাকা যাচ্ছে না। শ্যামলা গায়ে গোল হয়ে ফুলে আছে টকটকে লাল দাগ। অন্তু বিরক্ত চোখে চেয়ে রইল। দাগ ঢাকার মতো কোনো সরঞ্জাম খুঁজে না পেয়ে নিজের উপরই চটে যাচ্ছে সে। সকাল সকাল এমন অপ্রত্যাশিত ফ্যাসাদ একদমই ভালো লাগছে না। আয়নায় নিজের গলাটা খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে কিছু একটা ভাবল অন্তু। আলমারি থেকে শীতের চাদর বের করে গলায় পেঁচাল। অসন্তুষ্ট চোখে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়েই ঘরের বাইরে পা রাখল। খাওয়ার টেবিলে বসেই নীরার উপস্থিতি টের পেল অন্তু। খাওয়ার সময় অসচেতনভাবে দুই-একবার চোখাচোখিও হল তাদের। প্রতিবারই অপরাধীর মতো চোখ আড়াল করল নীরা। খাবার সার্ভ করতে করতেই গালদুটো লজ্জায় লাল হয়ে উঠল তার। ভীষণ অস্বস্তিতে হাসফাস করে উঠল মন। ইশ! কি দরকার ছিল রাতে ওমন একটা কান্ড করার? অন্তু কি ভাবছে? অন্তুর শীতল চাহনি দেখে গলা শুকিয়ে আসে নীরার। নিজের গালে ডজন খানিক চড় বসানোর অদম্য ইচ্ছে দমন করে নিজের কাজে মন দেয়। শঙ্কিত মনের অশনি সতর্কবার্তায় বারবারই আঁতকে উঠে বলে, অন্তু যদি রেগে গিয়ে বাড়িতে আসা একেবারেই বন্ধ করে দেয়?

_

গোধূলীর শেষ সময়টায় বারান্দায় বসে বই পড়ছিল নম্রতা। পাশের টেবিলে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। নম্রতার একনিষ্ঠ মনোযোগের মাঝেই পাশে এসে বসলেন নুরুল সাহেব। নম্রতা বই থেকে চোখ না তুলেই মৃদু আসল। মোলায়েম কন্ঠে বলল,

‘ গুড আফটারনুন বাবা।’

‘ আফটারনুন মা। কি পড়ছিস?’

নম্রতা এবার চোখ তুলে তাকাল। বইটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল। মৃদু হেসে বলল,

‘ তেমন কিছু নয় বাবা।’

‘ মন খারাপ?’

নম্রতা হেসে মাথা নাড়ল। জবাবে মিষ্টি হাসি উপহার দিলেন নুরুল সাহেব। পকেট থেকে নীল রঙা খাম বের করে চায়ের কাপের পাশে রাখতে রাখতে বললেন,

‘ মন খারাপ না থাকাটা সুসংবাদ। মন খারাপ থাকাটা অতিশয় সুসংবাদ। একটু পর যে মন খারাপ থাকবে না তা হবে অত্যধিক সুসংবাদ।’

নম্রতা বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে তাকাল। টেবিলের উপর থাকা খামটির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ মানে? এটা কি বাবা?’

নুরুল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। চশমাটা খুলে গ্লাস মুছতে মুছতে রহস্য করে বললেন,

‘ ডাক্তারকে বলে দিস সব বাসায় আমার মতো বাবা থাকে না। কিছু কিছু বাসায় তোর মার মতো অত্যাচারী মহিলাও থাকেন। কবুতরটা আদৌ মালিকের কাছে পড়বে নাকি শিকারীর, কে জানে?’

কথাটা বলে সকালের পত্রিকাটা হাতে তুলে নিয়ে বারান্দা ছাড়লেন নুরুল সাহেব। নম্রতা বাবার যাওয়ার পথে বোকার মতো চেয়ে থেকে খামটা তুলে নিল হাতে। খামটা উল্টেপাল্টে দেখতেই খামের অপর পৃষ্ঠায় গুটি গুটি অক্ষরে ‘আরফান আলম নিষ্প্রভ’ নামটা দেখেই চমকে উঠল সে। কিছুক্ষণ হতভম্ব চোখে চেয়ে থাকার পর নিজের হাতেই চিমটি দিল নম্রতা। ‘ আরফান চিঠি পাঠিয়েছে’ —- এই ছোট্ট বাক্যটা মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই সারা গায়ে আনন্দের ঝড় উঠে গেল। প্রচন্ড উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগল শরীর। বুকে ভর করল প্রথমবার চিঠি পাওয়ার অনুভূতি। আহ্ কি সুখ!

#চলবে….

[ পার্ট ছোট হয়েছে এই মন্তব্যটা দয়া করে করবেন না। এই বিষয়ে আমি অবগত। বড় করে লিখতে পারলে আপনাদের থেকে আমারই লাভ হতো বেশি। ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে। পারলে এক বসায় সম্পূর্ণ উপন্যাস শেষ করে দিতাম আমি। কিন্তু সময় হয়ে উঠছে না। ছোট করে হলেও রেগুলার হওয়ার চেষ্টা করছি। ধন্যবাদ সকলকে ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here