# নীল চিরকুট
# লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
০৫.
নম্রতা হাসলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,
‘ বলদ ছিলাম না। তবে এভাবে ধরা খেয়ে যাব চিন্তাও করিনি কখনো।’
অন্তু শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে কলার ঠিক করলো। ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ তারপর কী হলো? এই বাঁশেই প্রেমিক পুরুষের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার হয়ে গেল তোর?’
নম্রতা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল,
‘ আরে ধূর! তখন উদ্ধার হলে কী আজ এই অবস্থা হয় আমার? চরম বাঁশ খাওয়ার পর কিছুদিন চুপচাপ ছিলাম। তবে, আমাদের প্রেমটা মূলত সেখান থেকেই শুরু। প্রেম নয় হয়তো বন্ধুত্বের শুরু। তখন থেকেই ধীরে ধীরে পাল্টে যায় আমাদের চিঠির ধরন।’
‘ বাপরে! তো এতো প্রেম হঠাৎ উবে গেলো কীভাবে?’
নাদিম অবাক কন্ঠে বলল,
‘ তুই সত্যি সত্যিই এই চিঠি-পত্রের সাথে প্রেম করে ফেললি? মানে, সত্যিই? ওই ব্যাটা যদি বুইড়া, টাকপড়া বা গাঞ্জা খোর হতো তো? ব্যাটার নাম কী?’
নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ জানি না।’
নীরা ব্যতিত বাকী সবাই চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ জানিস না মানে? তুই ওই ছেলের নামটা পর্যন্ত জানিস না? তোকে আমরা এতোটা বলদও ভাবি নি। তোর মতো বুদ্ধিমতি মেয়ে এমন বলদামো কেমনে করল?’
নম্রতা নিরাশ চোখে নিজের পায়ের দিকে তাকালো। ক্লান্ত গলায় বলল,
‘ কখনো জিগ্যেস করা হয় নি। দু’জনের কেউ-ই প্রয়োজনবোধ করি নি। তবে কথায় কথায় একবার বলেছিল, তাদের পরিবারের সবার নামের প্রথম অক্ষর নাকি ‘এন’ দিয়ে শুরু। অদ্ভুতভাবে, একদম দাদার বাবা থেকে ‘এন’ রীতি চলে আসছে তাদের। সে হিসেবে ওর নাম ‘এন’ লেটার দিয়েই হওয়ার কথা।’
ছোঁয়া বোকা বোকা গলায় বলল,
‘ “এন” দিয়ে তো বাংলাদেশেই অসংখ্য নাম আছে। কিভাবে বুঝবি কোনটা ওই লোকের নাম? আমাদের নাদিমের নামও তো ‘এন’ দিয়ে। এই নাদিম? তুই কিছু করিস নি তো?’
নাদিম অত্যন্ত বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ধমকে উঠে বলল,
‘ তোরে আল্লায় মুখস্থ করার গুণ ছাড়া আর কিছু দেয় নি। তোর আই কিউ মাইনস জিরোর থেকেও কম। বালের কথা বলে অলওয়েজ।’
ছোঁয়া ফুঁসে ওঠে কিছু বলবে তার আগেই উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো রঞ্জন,
‘ ছেলে কই পড়তো জানিস? প্লিজ এবার এটা বলিস না যে, ওই ব্যাটা কই পড়াশোনা করত সেটাও জানিস না তুই।’
নম্রতা অপরাধী চোখে তাকিয়ে থেকে চোখ নামাল। রঞ্জন আৎকে উঠে বলল,
‘ তারমানে তুই সত্যিই জানিস না?’
নাদিম হাত উল্টে হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ ওই পোলায় যে পড়াশোনা করত তারই বা কী গ্যারেন্টি আছে? আমার তো মনে হচ্ছে ওইটা কোনো পোলাই না। মাইয়া মানুষ ফাইজলামো করছে।’
নম্রতা ব্যস্ত গলায় বলল,
‘ একদমই না। কোনো মেয়ে শুধু মজার ছলে গোটা আড়াই বছর নিয়ম করে চিঠি চালান করবে না। তাছাড়া, চিঠিতে থাকা আমাদের অনুভূতিগুলো সত্য ছিল। তোদের বোঝাতে পারছি না। তোরা ঠিক বুঝবি না। কিন্তু আমি বুঝি, আপাতত সেই সময়টাতে সে আমাকে ভালোবাসতো। কখনো কখনো আমার থেকেও বেশি ভালোবাসতো। আর ও তখন স্টুডেন্টই ছিল। ঢাকারই কোনো ভার্সিটিতে পড়তো তখন।
অন্তু ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ তুই কী করে জানলি? আন্দাজই?’
নম্রতা অন্তুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আন্দাজই তো নয়। বিশ্বাসে। নম্রতার বিশ্বাস চিঠিতে লেখা একটা কথাও সে মিথ্যে লিখে নি। সে মিথ্যে বলতে জানে না।
তখন বর্ষার মাঝামাঝি। নম্রতাদের চিঠি দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি তখন সপ্তাহে গড়িয়েছে। কখনো বা সপ্তাহে দুটো। শ্যামলতা ও সে- এর মাঝে তখন প্রেম না চললেও চলছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। সম্বোধনের আপনি লেখা জায়গাটাতে তখন তুমিময় রাজত্ব। নম্রতার মাত্রই প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে বাইরে যাওয়া বারণ। নম্রতারা তখন তাদের ধানমন্ডির নতুন বাড়িটিতে থাকে। শাহবাগ থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব খুব বেশি না হলেও এই বিশ্রী বর্ষাকালে অযথা জল-কাদা এক করার কোনো কারণ নেই। অন্তত মায়ের চোখে তো নেই-ই। সেই সময়টুকু ঘরে বসে পরীক্ষার শীট মুখস্থ করে, গলা ছেড়ে গান গেয়ে, পুরোনো চিঠিগুলো পড়ে আর নিরন্তর ঝড়ে পড়া বৃষ্টিকন্যাদের নৃত্য দেখেই কেটে যায় নম্রতার। প্রি-টেস্ট পরীক্ষার পর এক সপ্তাহ জ্বর আরেক সপ্তাহ মায়ের কড়া ইন্সট্রাকশনের কারণে শাহবাগে যাওয়া হয়ে উঠলো না নম্রতার। তাদের উত্তাল চিঠি আদান-প্রদানে ভাটা পড়ল। প্রায় দুসপ্তাহ পর কলেজ আর টিউশনিতে যাওয়ার অনুমতি পেয়েই শাহবাগে ছুটে গেল নম্রতা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেদিন ছিলো শনিবার। গ্রন্থাগারে ছুটির দিন। নম্রতার আর চিঠি পাওয়া হলো না। মন খারাপ নম্রতা মাঝরাতে ওঠে চিঠি লিখতে বসলো,
‘ শুনো,
আজ আমার মনটা খুব খারাপ। এত্তো কাঁদতে ইচ্ছে
করছে কী বলব! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কী জানো? আমার মন খারাপের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। ভীষণ অগোছালো চিন্তা আজ মাথা জুড়ে। মানুষের বোধহয় বেঁচে থাকার জন্য সত্যিই একটা ভালোবাসার মানুষ প্রয়োজন, তাই না? যে মানুষটি শুধু আমার হবে। যাকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করবে না। পৃথিবীর যেকোনো কোণায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে থেকেও জানব আমার একজন মানুষ আছে। আমারই থাকবে। আমার কিশোরী মনটা যখন ভয়ানক মেঘে ঢেকে যাবে তখন আমি জানবো ওই মেঘগুলোর আড়ালে আমার নিজস্ব এক সূর্য আছে। নিজস্ব এক পুরুষ আছে। তাহলে আর কষ্ট করে পড়াশোনা করা লাগতো না। প্রি-টেস্ট পরীক্ষাটা যা খারাপ হয়েছে। টেস্ট দিতে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। এই দুঃখ-কষ্টময় জীবন দিয়ে কী হবে বলো তো? বাবা-মা তো বিয়ের কথাও ভাবছে না। ধূর! কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
[ বিঃদ্রঃ এতোদিন পর চিঠি পেলে। এই দিনগুলোতে মনে পড়েছিল আমায়?]
ইতি
শ্যামলতা ‘
এবারের চিঠির জবাবটা দু’দিনের মাথাতেই হাতে পেয়ে গেল নম্রতা। প্রথম দফায় বিস্মিত হলেও পরমুহূর্তেই খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠলো। মনে মনে ভেবে নিলো, সেই মানুষটি হয়তো তাকেই ভাবছিল। তার চিঠির জন্যই ছটফট করছিলো নয়তো এতো তাড়াতাড়ি চিঠি পাওয়ার ভাগ্য কী নম্রতার হতো? নম্রতা চিঠি নিয়ে ফিরে গেল বাসায়। পুরোটা সময় অদ্ভুত এক উত্তেজনা চেপে থাকল বুকজুড়ে । না-জানি কী আছে চিঠিতে! কী লিখেছে ওই অদ্ভুত লোকটি? নম্রতা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে দরজা দিয়ে চিঠি খুললো। সাথে সাথেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো গুটি গুটি অক্ষরে লেখা আনন্দময় শব্দগুচ্ছ গুলো। চিঠির অদ্ভুত সুন্দর শব্দগুলো মিলেমিশে তৈরি হয়ে গেল কাল্পনিক এক পুরুষালি মুখমন্ডল। গম্ভীর মুখভঙ্গিতে ধীরে ধীরে কথা বলছে সে। কথার মাঝে হাসছে। সেইসাথে হাসছে তার সুন্দর দুটো চোখ।
‘ শ্যামলতা,
তুমি এতো পড়াচোর কেন, বল তো? তোমার লাস্ট চিঠিটা পড়ে কত্ত হেসেছি কোনো ধারণা আছে তোমার? প্রথম দফায় ভাবলাম বাচ্চা মেয়েটার এতো কষ্ট দূর করতে একটা নিজস্ব পুরুষ মানুষ কিনে দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু শেষটা পড়ে তো আমি হতভম্ব। ম্যাডাম যে পরীক্ষার ভয়ে পুরুষ মানুষ চাইছে সে তো আমার কল্পনারও বাইরে ছিল।তবে, আমি কিন্তু পড়াশোনা ফাঁকি একদম পছন্দ করি না। আমি নিজেও ভীষণ পড়াকু তাই চাই আশেপাশের মানুষগুলোও ভীষণ পড়াকু হোক। আমার ইচ্ছে কী জানো? আমার ইচ্ছে আমাদের ভার্সিটিরই টিচার হিসেবে জয়েন দেওয়া। আমার বাবার ইচ্ছেটাও ছিল তাই। কিন্তু টাকা-পয়সার অভাবে বাবার ইচ্ছেটা আর পূরণ হয়ে উঠে নি। ভাইয়াও বাবার স্বপ্নটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় নি। তাই টিচিং প্রফেশনের দিকে না ঝুঁকে নিজের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। এখন আমি আর নিদ্রাই বাবার একমাত্র ভরসা। নিদ্রা কিন্তু তোমার মতোই পড়াচোর। পড়াশোনা নাকি তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। আমাকে বলে, আমি নাকি রসকষহীন রোবট মানব। যার ভেতর শুধু একটাই সফটওয়্যার। পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। কিন্তু তোমার কাছে এসে ব্যাপারটা ভিন্ন। আমার পৃথিবীতে হাতেগুণা মানুষদের মাঝে তুমি একজন যে আমার বাইরেটা নয় ভেতরটা জানে। মস্তিষ্কের বাইরেও আমার যে একটা মন আছে তা তোমার সাথে কথা না হলে হয়তো ঠিকঠাক প্রকাশ পেতো না শ্যামলতা। এই যে তুমি পড়াশোনায় টালবাহানা করো। আমার কী মনে হয় জানো? মনে হয়, তোমার সাথে এমনটাই মানায়। তোমাকে ঠিক এমনটাই হওয়া উচিত। তোমার প্রাণোবন্ততার সাথে তো এমনটাই সাজে। তাই বলে, পড়াশোনায় অবহেলা কিন্তু ঠিক নয়। মেয়েদের তো আরো নয়। তোমার না দেশ ঘুরে-বেড়ানোর শখ? পড়াশোনা না করলে সেই দেশ ঘোরাটা কী আদৌ হয়ে উঠবে? তোমার সেই নিজস্ব পুরুষ মানুষ যে তোমায় সেই স্বাধীনতাটুকু দিবেই দিবে। তারই বা কী গ্যারেন্টি আছে? তাছাড়া নিজেকে শিক্ষিত, মার্জিত, আত্মবিশ্বাসী আর স্বাবলম্বী ভাবতেও তো অন্যরকম অনুভূতি হওয়ার কথা। আমার তো হয়। তোমার স্বাবলম্বী হতে ইচ্ছে করে না? কোনো এক ঘরের কোণায় সংসারের যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে থাকা শ্যামলতাকে ভাবলেই তো দমবন্ধ লাগে। তোমার লাগে না?
বিঃদ্রঃ তোমায় মনে পড়েছে কি-না জানি না। তবে বেশ কিছুদিন যাবৎ হঠাৎ-ই আমার ঘরে বেলীফুলের সুবাস আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ আবার আসছে। বেলীফুলরা হয়তো জেনে গিয়েছে, আজ আমার খুশি হওয়ার দিন! ‘
সেই দমবন্ধ করা শেষ লাইনগুলো পড়ে বিস্ময়ে, আনন্দে কেঁদে ফেললো নম্রতা। আর সেদিন থেকেই পড়াশোনার প্রতি আলাদা দৃষ্টি তৈরি হলো তার। মাথায় খেলে গেল একটাই কথা। সত্যিই তো? পড়াশোনা করে স্বাবলম্বী না হলে কী করে চলবে তার? তার এতো এতো স্বপ্নগুলোকে পাখা দিতে ঠিকঠাক পড়াশোনা করা তো চাই-ই চাই। তাছাড়া তার ‘সে’ যে পড়তে ভালোবাসে। সে- এর ভালোবাসার জিনিসে নম্রতার এতো উদাসীনাতা মানায়? কক্ষনো না।
‘ বাপরে! এদিক বিবেচনা করলে ওই ব্যাটাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া যেতেই পারে। এক চিঠিতেই তোকে ঢাবির স্টুডেন্ট বানিয়ে ছেঁড়ে দিলো? এটা একটা কাজের কাজ হয়েছে। ব্যাটা হিপনোটিজম ভালো পারে। গুড!’
অন্তুর কথায় ঘোট কাটলো নম্রতার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসার চেষ্টা করলো। রঞ্জন হাতে থাকা কাগজের টুকরো দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল,
‘ ব্যাটা বলল, সে ভার্সিটির টিচার হতে চায় আর তুই মেনে নিলি? মিথ্যাও তো বলতে পারে। পারে না?’
নাদিম চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘ পোলায় সত্যি বললেও এতো অল্প ইনফরমেশনে কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পাবলিকে পড়তো নাকি প্রাইভেটে পড়তো সেটাও তো জানিস না বাল। ঢাকাতেই তো কত্তোগুলো ইউনিভার্সিটি।’
নম্রতা অবাক হয়ে বলল,
‘ মানে কী? তোরা কী ওকে খোঁজার পরিকল্পনা করছিস নাকি?’
নাদিম স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ তো? খুঁজব না? ব্যাটায় আমাগো দোস্তরে ছ্যাকা দিয়া ব্যাকা বানিয়ে দিয়ে গেল আর আমরা চুপ থাকব? আপাতত দশ-বারোটা ঘুষিতে তার প্রাপ্য। নমু? তুই তাকে খুঁজার চেষ্টা করিস নি কখনও?’
‘ কিভাবে খুঁজবো, কোথায় খুঁজবো বুঝতেই পারি নি। নামটাও তো জানি না।’
‘ আচ্ছা। ওসব বাদ। বাকি গল্পটুকু বল। প্রেমের শুরুটা?’
নম্রতা কিছু বলবে তার আগেই উঠে দাঁড়ালো ছোঁয়া। তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ মাম্মা আমাকে নয়টার মধ্যে বাসায় থাকতে বলেছিল। এখন অলরেডি নয়টা বিশ বাজে। আই হ্যাভ টু গো।’
নাদিম খেঁকিয়ে বলে উঠল,
‘ তো যা না। তোরে এনে বসে থাকতে কইছে ক্যাডায়? সবসময় আজাইরা আলাপ বা..’
ছোঁয়া তেজ দেখিয়ে বলল,
‘ খবরদার বাকিটা উচ্চারণ করবি না। আর ক্যাডায় মানে কী? ভাষার কী ছিঁড়ি! তোর গার্লফ্রেন্ড তোকে সহ্য করে কিভাবে বুঝি না আমি। থার্ডক্লাস কথাবার্তা।’
নাদিম গোঁ নিয়ে বলল,
‘ আল্লায় দিলে মুখটা আমার পার্সোনাল। আমার মুখ দিয়া আমার যেমনে মন চায় তেমনে কতা কমু। তোর বাপের কী? শালা ইংরেজ কোথাকার!’
ছোঁয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। রঞ্জন শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে ওঠে দাঁড়াল। নম্রতাদের বন্ধু মহলে রঞ্জন সব থেকে সুদর্শন পুরুষ। গৌড়বর্ণ, সুঠাম দেহ। মাথা ভর্তি কোকরানো চুল। খাড়া নাকের নিচে পাতলা কালচে ঠোঁট। মুখভর্তি ছোট ছোট দাড়ির মেলা। সনাতন ধর্মাবলম্বী রঞ্জনের সবচেয়ে সুন্দর দেখতে ওর চোখ। রঞ্জন ছাড়া গলায় বলল,
‘ চল তোরে রিক্সা করে দিই। একা যেতে পারবি? নাকি আমরা কেউ যাব সাথে?’
ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ পারব। তুই সাথে গেলেই বরং অস্বস্তি ফিল করব। মেয়েদের চোখে তো তুই মানুষ না। মিষ্টির দোকান। হা করে তাকিয়ে থাকে। বিরক্তিকর।’
রঞ্জন হাসল। আবারও বসে পড়ে বলল,
‘ তাহলে একাই যা। এখান থেকেই রিক্সা নে। অন্তু দেখ তো রিক্সা আছে নাকি আশেপাশে।’
ছোঁয়া রাস্তার দিকে পা বাড়িয়েও আবার ফিরে এলো। ব্যস্ত গলায় বলল,
‘ আরে! তোদের তো একটা ইম্পোর্টেন্ট কথা বলায় হয় নি। মাম্মা তাদের বুটিক হাউজ থেকে ট্যুরের প্ল্যান করেছে। দে আর গুয়িং টু কক্সবাজার। তোরা কী যেতে চাস? হোটেল রেন্ট আর যাতায়াত খরচ ফ্রি।’
নাদিম ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ সারাদিন মাম্মা মাম্মা করছ কেন বাল? বাঙালী না তুই? খাঁটি বাঙালিদের কখনো ম্যা ম্যা করতে শুনছিস? খুব তো ভাষা নিয়ে হাদিস মারো। আবার ম্যা ম্যা করো। আমার সামনে ম্যা ম্যা করতে এলে চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। বাঙালী মাইয়া তুই। মায়েরে আম্মা ডাকবি। অলটারনেটিভ হিসেবে মা ডাকবি। ম্যা ম্যা আবার কী? আর আমরা কোনো ম্যা ম্যা-এর সাথে পিকনিকে যাব না। ভাগ তুই।’
ছোঁয়া ফুঁসে উঠল। রঞ্জন শান্ত গলায় বলল,
‘ না-রে ছোঁয়া। আন্টি-আংকেলের সাথে পিকনিকে জয়েন করাটা কেমন দেখায় না? ওদের সাথে থাকলে ইঞ্জয়ও করতে পারব না ঠিকঠাক। গার্ডিয়ানরা সুযোগ পেলেই তো ওয়ান, টু-এর বাচ্চাদের মতো ট্রিট করে। কী লাভ শুধু শুধু সময় নষ্ট করে?’
‘ কিন্তু আব্বু আর মাম্মা কেউই তো যাচ্ছে না আমাদের সাথে। আমি শুধু আমাদের কথা বলছি। আমরা ছয়জন।’
অন্তুর চোখদুটো উত্তেজনায় ধ্বক করে উঠল। উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ মানে? উনারে যাবে না কেন?’
‘ মাম্মাদের প্ল্যানটা লাস্ট মোমেন্টে এসে ওয়াক করে নি। হোটেল, গাড়ি সব বুক করা হয়ে গিয়েছে। আগামী কালেরই প্ল্যান। কিন্তু আজ হঠাৎ একটা কাজ পড়ে গিয়েছে। বুকিং ক্যান্সেলও করা যাচ্ছে না। আর করলেও মাম্মা আমার এবং আমার বন্ধুদের জন্য অফারটা ছেড়ে দিচ্ছেন। তোরা রাজি?’
নাদিম, অন্তু, রঞ্জন চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ অবিয়েসলি!’
নীরা বিরস মুখে বলল,
‘ বাসায় শুনলে কেলাবে। সম্ভব না। তোরা যা।’
নম্রতা সায় দিয়ে বলল,
‘ আমার বাসাতেও মানবে না বোধহয়। কতদিনের ট্রিপ?’
‘ তিনদিন।’
অন্তু মুখ ভার করে বলল,
‘ এটা কোনো কথা? গেলে ছয়জনই যাব। নয়তো একজনও না।’
রঞ্জন কুটিল হেসে বলল,
‘ সব্বাই যাচ্ছি। কাল সকাল সাতটাই দেখা হচ্ছে। এখন সবাই হলে গিয়ে ঘুমা।’
নীরা আৎকে উঠে বলল,
‘ আম্মু আমায় মেরে ফেলবে। তোরা যা প্লিজ। আমি যাব না।’
নম্রতা বিরবির করে বলল,
‘ আমারও মন ভালো নেই। আর আব্বু বোধহয় মানবে না।’
নাদিম গিটার হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ ধুরু! বাসায় জানলে তো কাহিনী ঘটবে। জানাবি না। ব্যস!’
নীরা-নম্রতা চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ কী বলছিস?’
রঞ্জন তুড়ি বাজিয়ে বলল,
‘ সুন্দর আইডিয়া। তোদের বাপ-মা তো আর হলে এসে খোঁজ নিবে না। ফোনই করবে। আর ফোন তো তোদের কাছেই থাকবে। তিনদিনেরই ব্যাপার। বাকিটা আমরা সামলে নিব। রিল্যাক্স।’
নীরা ভীত চোখে তাকাল। নাদিম নীরার মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘ ভয় পাস না ভতী। ডর বাদুইরা কোথাকার। আমরা তো আছিই। সামলায় নিমু। কিন্তু তোগো ছাড়া যাইতাম না।’
নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হলো। ওদের দুই জনের জন্য সবার আনন্দ নষ্ট করার কোনো মানে নেই। তাছাড়া এই ইট-পাথরের শহর থেকে দূরে গিয়ে কষ্টের ভার যদি একটু লাঘব হয়, তাহলে ক্ষতি কী? আলোচনা শেষে রঞ্জু আর নাদিম নম্রতা-নীরাকে হলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রওনা হলো। অন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে বিধায় ছোঁয়াকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো অন্তুর ঘাঁড়ে। বন্ধুদের চেষ্টায় ক্ষণিকের জন্য অপরিচিত ‘সে’- কে ভুলে গেল নম্রতা। কিছুক্ষণের জন্য বুকভরে শ্বাস নিলো। নতুন করে ভাবার চেষ্টা করল। কিন্তু নিয়তি কী আদৌ তাই চায়?
# চলবে….