নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৫২.
ঘড়ি থেকে চোখ তুলে তাকাতেই নম্রতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল আরফান। রুষ্ট চোখজোড়া নম্রতার উপর নিবদ্ধ রেখে কোনোরূপ বনিতা ছাড়াই বলল,
‘ আবারও লেইট!’
নম্রতা উত্তর দিল না। মুখ ফুলিয়ে পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকাল। চোখে-মুখে চাপা ক্রোধ নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। নম্রতার স্থিরতায় পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির উপর কোনোরূপ প্রভাব পড়ল বলে মনে হলো না। সে স্বভাবসুলভ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
‘ তুমি তো দেখতে ভীষণ মিষ্টি, মিস.ছোঁড়াছুড়ি! বাহ্! তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।’
নিদ্রার সম্বোধনে ঈর্ষান্বিত মনটা ফুঁস করে জ্বলে উঠল এবার। ছোঁড়াছুড়ি? কিসের ছোঁড়াছুড়ি? এই মেয়ে তাকে আরফানের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলার কথা বলছে না তো? সুপ্ত ক্রোধ চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠতেই গাড়ির কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করলেন একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা। পরনে কালো পেড়ে সাদা শাড়ি। ঘাড়ের কাছে ঘন চুলের বিশাল খোপা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। টান টান ত্বকে রূপবতী মেয়েটির চেহারার ছাঁচ। নম্রতা পুরো ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল। আরফান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দুই পা এগিয়ে নম্রতার পাশে এসে দাঁড়াল। নম্রতা দ্বিধান্বিত চোখে একবার গাড়িতে থাকা ভদ্রমহিলা তো আরেকবার আরফানের দিকে তাকাল। আরফান হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ আপনার যন্ত্রণায় আমার পুরো পরিবার রাস্তায় নেমে এসেছে নম্রমিতা। এই মুহূর্তে পাত্রী দেখা পর্ব চলছে। ইউ আর দ্যা মেইন ক্যারেক্টার ইন দিস এপিসোড। অল দ্যা বেস্ট পত্রপ্রেমিকা!’
আরফান এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে নম্রতার দিকে তাকাল। নম্রতা বোকা বোকা চোখে চেয়ে থেকে বলল,
‘ মানে?’
আরফান উত্তর দিল না। নম্রতা হতবিহ্বল চোখে আবারও গাড়িতে থাকা ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল। ভদ্রমহিলা ধীরে-সুস্থে গাড়ি থেকে নামলেন। তাঁর উজ্জল মুখশ্রীতে তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্ববোধের ছটা দেখে কিছুটা ভরকে গেল নম্রতা। অসহায় চোখে আরফানের দিকে তাকাল। আরফানকে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল। ভদ্রমহিলার গম্ভীর চেহারা দেখে মনে মনে শত তারা গুণতে লাগল নম্রতা। বুকের ভেতর থাকা হৃদপিন্ডটা খনিকের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল ভয়ে। মুহূর্তের মধ্যেই ভদ্রমহিলাটিকে ভীষণ রাগী বলে আখ্যায়িত করে ফেলল নম্রতা। পরমুহূর্তেই নম্রতার ভাবনাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন ভদ্রমহিলা। নম্রতার ডানগালে আলতো হাত ছুঁইয়ে বললেন,
‘ তুমিই তবে শ্যামলতা?’
নম্রতা মাথা নাড়ল। ভদ্রমহিলা হেসে বললেন,
‘ কিন্তু এই মোমের মতো মেয়েটিকে তো শ্যামলতা নামে মানাচ্ছে না মা। এই মিষ্টি মেয়েটির নাম হওয়া উচিত ছিল, শুভ্রলতা। আমি তোমাকে শুভ্রলতা বলে ডাকলে কী তুমি রাগ করবে মা?’
ভদ্রমহিলার অসম্ভব সুন্দর কন্ঠস্বরে মস্তিষ্কে শীতল হাওয়া বয়ে গেল যেন। নম্রতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মৃদু হাসল। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করল, এই ভদ্রমহিলাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। ভীষণ তৃপ্তি দিচ্ছে তার কথা বলার ভঙ্গিমা। নম্রতাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন ভদ্রমহিলা,
‘ তুমি নিশ্চয় আমায় চিনতে পারছ না? আমি হলাম নিষ্প্রভের মা।’
ভদ্রমহিলার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পেছন থেকেই বলে উঠল নিদ্রা,
‘ আর আমি হলাম নিদ্রা। নিষ্প্রভ ভাইয়ার ছোট হলেও তোমার থেকে এক বছরের বড়। সুতরাং, বিয়ের পর আমি তোমাকে ভাবি বলে ডাকব না। নাম ধরে ডাকব। আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকলে কী তুমি রাগ করবে ছোড়াছুড়ি?’
নম্রতা যেন হোঁচট খেল এবার। ছোঁড়াছুড়ি? আবারও ছোঁড়াছুড়ি? এতো সুন্দর একটা মেয়ে বারবার এমন কুৎসিত নামে কেন ডাকছে তাকে? ভাই ডাকে নিম পাতা, মা ডাকে শুভ্রলতা। পাতা-লতা শেষ করে ফুল-পাখিও তো ডাকতে পারত নিদ্রা। নম্রতা একটুও রাগ করত না। কিন্তু হুট করেই ছোঁড়াছুড়িতে চলে যাওয়ার লজিকটা কিছুতেই ধরতে পারছে না নম্রতা। নম্রতা অসহায় চোখে তাকাল। আরফানের মা নম্রতার ডানহাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল,
‘ তুমি নাকি রাগ করে কথা টথা বলছ না? বেশ করেছ। এই বদমাইশের সাথে কথা বলা উচিতও না। আজ ওর রাতের খাবার বন্ধ। ওর রিপ্লেজমেন্টে খাবার টেবিলের দায়িত্ব হবে তোমার। কি? যাবে না? ‘
নম্রতা বিস্ময় নিয়ে আরফানের দিকে তাকাল। আরফান মৃদু হাসল। চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল। নম্রতা বিস্ময়ভাব নিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল। ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,
‘ রাতে বাইরে থাকাটা বাবা-মা এলাউ করবে না আন্টি।’
ভদ্রমহিলা কিছু একটা ভেবে বললেন,
‘ কোনো সমস্যা না থাকলে তুমি কি তোমার বাবার নাম্বারটা দিবে মা? আমি তোমাদের সপরিবারে নিমন্ত্রণ দিতে চাই। এই মিষ্টি মেয়ের বাবা-মার সাথে পরিচয়টা না হলেই নয়। নিস্প্রভ বলছিল, তোমরাও নাকি ধানমন্ডিতেই থাকো? রোড নাম্বার আলাদা হলেও এলাকা কিন্তু একই। সে হিসেবে আমরা সবাই প্রতিবেশী হয়ে গেলাম না?’
নম্রতা কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল ভদ্রমহিলার মুখে। কাউকে এতো দ্রুতও বুঝি আপন করে নেওয়া যায়? কন্ঠস্বরের স্বাভাবিক, ছোট্ট বাক্যগুলিতে বুঝি এতোটাও মায়া ঢালা যায়?
_
ভার্সিটি থেকে ফিরেই রান্না বসিয়েছে নীরা। সন্ধ্যার নাস্তা আর রাতের খাবার তৈরি করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে খেয়ালই ছিল না তার। টেবিলে খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে সিংকে হাঁড়ি-পাতিল পরিষ্কার করছিল নীরা। খোঁপা ছেড়ে বেরিয়ে আসা এলোমেলো চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কপালে। চেহারায় ক্লান্তি। নাকে-মুখে তৈলাক্ত ঘামের আভা। এমন সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন জাহানারা। অন্তুর খাবারটা আলাদা করে ঢেকে রাখতে রাখতে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। শাশুড়ীর দৃষ্টিকে খেয়াল করে ভেজা হাতের পিঠ দিয়ে চুল ঠিক করে ওড়নার আঁচল টানল নীরা। আমতা আমতা করে বলল,
‘ কিছু বলবেন মা?’
জাহানারা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। নীরার প্রতি আজকাল একটু-আধটু সন্তুষ্ট সে। সেদিন নীরার করা সরল অভিযোগের পর বাইরে রাত কাটানো বন্ধ হয়েছে অন্তুর। সারাদিন যেখানেই থাকুক না কেন? রাত বারোটার আগে ঠিকঠাক বাড়ি ফিরছে সে। রাতের খাবারটা নিয়ম করে বাড়িতেই খাচ্ছে। ছেলের এতটুকু নিয়মমাফিক জীবন দেখেই এক টুকরো স্বস্তি পেয়েছে জাহানারা। ছেলের বউয়ের প্রতি প্রকাশ্য তিক্ততা খানিক কমে এসেছে। জাহানারা কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলল,
‘ সব সময় এমন সালোয়ার কামিজ পরে থাকো কেন? এটা তোমার বাপের বাড়ি না। বাড়ির বউদের রঙ-বেরঙের শাড়িতেই ভালো মানায়। অন্তু বাসায় থাকলে এসব সালোয়ার কামিজ রেখে শাড়ি পরে থাকবে। ওর সামনে শাড়ি পরে ঘুরঘুর করবে। দাদী-নানীরা বলত, “কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ট্যাশ ট্যাশ।” এখন এতো উড়তে দিলে অন্য পাখির খাঁচায় যেতে কতক্ষণ? নিজের সংসার ধরে রাখতে হলে এমন থম মেরে বসে থাকলে চলবে না। সময় থাকতে লাঘাম ধরো। প্রেমের বিয়ে বলে গা ভর্তি তেল নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। পুরুষ মানুষের মন আর গাছের পাকা আম কোনটারই বিশ্বাস নেই বউ। কখন, কোথায় ঝড়ে পড়বে তা তারা নিজেরাই জানে না।’
কথাগুলো বলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল জাহানারা। নীরা সাবান মাখা হাতে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। শাশুড়ী মা কী কোনোভাবে তার আর অন্তুর ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছেন? সত্যিই কি এবার লাঘাম ধরা উচিত নীরার? অন্তুর পক্ষে কি সত্যিই অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হওয়া সম্ভব? বুকের ভেতর থেকে বিরক্ত এক সত্তা ধমকে উঠে বলল, ‘কেন সম্ভব নয়? অন্তুকে দেখেছিস কখনও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে? বিয়ের পর একবারও অন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছে সে? তাকায়নি। তবে?’ নীরা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কাজে হাত দিল। সত্যিই যদি এমন কিছু হয় তবে কিভাবে লাঘাম টানবে নীরা? কী করবে সে?
_
গভীর রাত। আকাশ ভর্তি তারার মেলা। হালকা ঝিরঝিরে বাতাসে উড়ছে পাতলা ওড়না, কপালে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুল। সামনের রাস্তা থেকে ভেসে আসছে যানবাহনের মৃদু হর্ণ। ছাঁদের এক কোণায় থাকা দোলনায় বসে আছে নম্রতা। ডানহাতে ধোঁয়া উঠা কফি কাপ। বামহাতে কানে ধরে থাকা ফোন।
‘ আপনি এখন কোথায় আছেন? কি করছেন?’
ওপাশ থেকে ক্লান্ত কন্ঠে উত্তর দিল আরফান,
‘ আমি হসপিটালে আছি। এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ড ঘোরাফেরা করছি। আই এম অন ডিউটি ম্যাডাম। রাউন্ডে আছি।’
নম্রতা আঁতকে উঠে বলল,
‘ এতো রাতেও ডিউটি? ঘুম টুম নেই আপনার?’
আরফান হাসল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কারো সাথে কয়েকটি কথা বলে নিয়ে বলল,
‘ ঘুম তো আপনার কাছে।’
‘ ফাজলামো করবেন না, আমি সিরিয়াস। এই মুহূর্তে ডাক্তারের ওয়াইফদের জন্য প্রচন্ড মায়া হচ্ছে আমার।বেচারীদের নিশ্চয় রাতে একা একা ঘুমোতে হয়? মাঝরাতে ভয় পেলে কাঁথা দিয়ে মুখ চেপে মটকা মেরে শুয়ে থাকতে হয়? সাংঘাতিক! নাহ্, এসব ডাক্তার ফাক্তারকে বিয়ে করা যাবে না। প্ল্যান ক্যান্সেল।’
আরফান নিঃশব্দে হাসল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাতের কাজ শেষ করল। তারপর মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ আপনি এখনও ঘুমোননি কেন? অলমোস্ট একটা বাজে। এতোরাতে কি করছেন?’
‘ ছাঁদে বসে কফি খাচ্ছি আর আকাশ দেখছি। আজকের আকাশটা অনেক সুন্দর ডক্টর।’
আরফান অবাক হয়ে বলল,
‘ ছাঁদে? অনেক বছর আগে কেউ একজন আমায় বলেছিল, সে একা একা ছাঁদে যেতে ভয় পায়। তাই বরের জন্য অপেক্ষা করছে। সাহসী বর তাকে ছাঁদে নিয়ে গিয়ে জ্যোৎস্না বিলাসে সঙ্গ দিবে। তো, তার কী বর জুটে গিয়েছে আজকাল?’
‘ বর না জুটলেও সাহসটা ঠিকই জুটে গিয়েছে তার। অনেক বছর আগের বাচ্চা মেয়ে এখন বিশাল বড়। ভূতে টূতে ভয় পায় না।’
‘ তাই নাকি? তাহলে তো মায়ের গল্পটা আপনাকে বলাই যায়। মা বলতো, আমাদের আশেপাশে নাকি সবসময়ই জ্বীন-পরীরা ঘোরাঘুরি করে। একসাথে, পাশাপাশি বসেও থাকে। আপনার পাশেও নিশ্চয় আছে? ফাঁকা ছাঁদে আপনি আর আলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন কিছু জ্বীন, ব্যাপারটা দারুণ না?’
নম্রতা ভয়ে ভয়ে পাশে তাকাল। অদ্ভুত একটা ভয়ে কেঁপে উঠল তার বুক। কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলল,
‘ দেখুন, একদম উল্টাপাল্টা গল্প ফাঁদবেন না। ডিউটিরত অবস্থায় ফোনে কথা বলছেন। তারওপর উল্টাপাল্টা গল্প বানিয়ে মাসুম যুবতীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আপনার নামে তো মামলা করা উচিত ডক্টর। আন্টির মতো….’
#চলবে…
[ টাস্ক ছিল তিনদিন টানা গল্প দিব। মাঝে একদিন বাদ পড়েছিল বলে আজ একদিনে দুটো পার্ট দিয়ে টাস্ক কমপ্লিট করলাম। তবুও, ঠিক টাইমে কমপ্লিট না করতে পারায় দুঃখিত।]