নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৫৬ [বর্ধিতাংশ]
ঘড়িতে কয়টা বাজে জানা নেই নীরার। বারান্দায় আজ জ্যোৎস্নাদের মেলা। ঝিরঝিরে বাতাসে মৃদুমন্দ ঠান্ডাভাব। বারান্দার এক কোণায় টুলের উপর বসে আছে নীরা। উদাসী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তারা ভর্তি আকাশে। শাড়ির আঁচলটা গড়িয়ে আছে মেঝেতে। হাত খোপা করা চুলগুলো আজ উন্মুক্ত। গালের উপর শুষ্ক জলের ধারা। বেশ কিছুক্ষণ অনুভূতিশূন্যভাবে বসে থেকে দুই হাতে মুখ ঢাকল নীরা। বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। নিজের জীবনটাকে আরও একবার বোঝা বলে বোধ হলো তার। বেঁচে থাকাটা বড়ই নিষ্প্রয়োজন, অযথা বলে মনে হতে লাগল। প্রিয়দের জীবনে নিজের জন্য বিন্দুমাত্র মিষ্টতা খুঁজতে খুঁজতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ল ঠিক তখনই অন্যকারো উপস্থিতি টের পেল নীরা। মুখ থেকে দুহাত সরাতেই বারান্দার দরজায় অন্তুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। নীরাকে অবাক করে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো অন্তু৷ মেঝেতে হাঁটু গেড়ে নীরার মুখোমুখি বসল। নীরার হাতদুটো আলতো করে নিজের হাতে তুলে নিয়ে চোখে চোখ রাখল। নীরার বিস্মিত, স্তম্ভিত চোখদুটো থেকে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোটা টসটসে জল। অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নীরার ডানহাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেল তার হাতে। নরম কন্ঠে বলল,
‘ আম্মা এত রেগে আছেন কেন? কি হয়েছিল সন্ধ্যায়?’
স্তম্ভিত নীরা জবাব দিতে পারল না। স্থির চেয়ে রইল অন্তুর চোখে-মুখে। পুরো ব্যাপারটা নীরার কাছে অবিশ্বাস্য, স্বপ্ন বলে বোধ হচ্ছে। অন্তু একটা হাত নীরার গালের উপর রাখল।
‘ নিশ্চয় কিছু ঘটেছিল। না বললে জানব কি করে? ইরার সাথে কিছু হয়েছে?’
এবারও জবাব দিল না নীরা। তার শরীর কাঁপছে। এই স্বপ্নটা সত্যিই যদি স্বপ্ন হয় সেই ভয়ে শরীর কাঁপিয়ে কান্না পাচ্ছে। অন্তু আগের মতোই নরম স্বরে ডাকল,
‘ নীরু?’
অন্তুর এই ছোট্ট ডাকেই ডুকরে কেঁদে উঠল নীরা। চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে বসে ভয়ে ভয়ে মাথা রাখল অন্তুর বুকে। অন্তু বাঁধা দিল না। মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। এই এতোবছর পর নিজের খোলস ভেঙে বেরিয়ে এলো নীরা। অন্তুর একটু আদর, একটু প্রশ্রয় পেয়ে বুকের সব কষ্টগুলো এই প্রথমবারের মতো প্রকাশ করল সে। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ আমার আর সহ্য হচ্ছে না। এই সংসার, এই জীবন আর ভালো লাগছে না। যতই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি ততই সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছি। নিজেকে এতো উটকো কেন লাগছে আমার? কারো জীবনে বিন্দুমাত্র মিষ্টতা নেই আমার জন্য। সারাদিন চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করি, কখন অন্তু ফিরবে। কখন আমার সাথে একটু হেসে কথা বলবে। কিন্তু অন্তু তো কখনও আমার কাছে ফিরে না। আমি এই অন্তুকে প্রচন্ড ভয় পাই। তার দিকে তাকাতে ভয় পাই। তাকে ছুঁতে ভয় পাই।’
এটুকু বলে থামল নীরা। ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমি ক্লান্ত অন্তু। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। একটুও না।’
অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নীরার চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ সরি। প্রেমিক হিসেবে সরি। হাজবেন্ড হিসেবে সরি। বন্ধু হিসেবে আই এম এক্সট্রিমলি সরি দোস্ত।’
নীরা মাথা তুলে তাকাল। চোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইল। অন্তু নীরার আঁচলটা ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
‘ কি হয়েছিল সন্ধ্যায়?’
নীরাকে স্থির তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখের ইশারায় বলতে বলল অন্তু। বহুদিন বাদে অন্তুর চোখদুটো যেন চির পরিচিত হয়ে উঠল নীরার চোখে। ইরা আসার পর একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করে বলে ফেলল নীরা৷ অন্তুর কপালে মৃদু কুঞ্চন দেখা দিল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু একটা ভাবল। নীরাকে ভীত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসার চেষ্টা করল অন্তু। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। নীরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ ইট’স ওকে। আমি আম্মাকে সামলে নিব। আম্মা উপরে শক্ত হলেও ভেতরে খুব নরম। ইরার ওভাবে কথাগুলো বলা উচিত হয়নি। আম্মা কষ্ট পেয়েছেন। আম্মাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি নীরা। অতটা ভালো এখনও কাউকে বেসে উঠতে পারিনি।’
এটুকু বলে থামল অন্তু। মুখ কাঁচুমাচু করে অন্যদিকে তাকাল। তারপর ফট করেই বলে ফেলল,
‘ তাই বলে বউকে যে খুব কম ভালোবাসি তেমনটাও নয়।’
কথা শেষ করেই বারান্দা থেকে ভেতরের ঘরে গেল অন্তু। নীরা স্তব্ধ চোখে দেখল, নতুন অন্তুর নতুন সূর্যোদয়।
_
পার্পেল রঙের গাউন গায়ে স্থির বসে আছে ছোঁয়া। কাজের মেয়েটি চুল বাঁধছে। সিঁথি হক তীক্ষ্ণ চোখে লিপস্টিক পর্যবেক্ষণ করছেন। পার্পেল রঙের জামার সাথে লাল, খয়েরী নাকি পার্পেল রঙের লিপস্টিক লাগানো যেতে পারে তা নিয়ে মারাত্মক দু’টোনায় পড়েছেন। ছোঁয়া মনে মনে নিজেকে উত্তেজিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। উত্তেজিত হওয়ার বদলে ক্রমেই ঝিম ধরে আসছে মন। এক সপ্তাহ পরই বিয়ের তারিখ ঠিক করেছেন বাবা-মা। সাইম ব্যস্ত মানুষ অতো ছুটি সে পাবে না। তাছাড়া, বিয়ের পর হানিমুন বলেও একটা ব্যাপার আছে। সাইমের পছন্দ অনুযায়ী দূর্দান্ত কিছু হানিমুন সুইটসও ঠিক করে ফেলেছেন বড় খালামণি আর সিঁথি হক। ছোঁয়াকেও পছন্দের কথা জিগ্যেস করেছিল সাইম। কিন্তু সিদ্ধান্ত না নিতে নিতে অনভ্যস্ত ছোঁয়া তার পছন্দের কথা জানাতে পারেনি। কোনো পছন্দের জায়গা সে ভেবেই পায়নি। অবশেষে, সবটা মায়ের উপর ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থেকেছে সে। আজ আবারও সাইমের সাথে দেখা হবে ছোঁয়ার। এর আগেও বার দুয়েক দেখা হয়েছিল তাদের। সাইম সুদর্শন, ওয়েল মেইনটেনেন্ট ছেলে। ভার্সিটি প্রফেসর হওয়ায় কথাবার্তায় সবসময়ই প্রফেসর প্রফেসর ভাব। তাদের যেদিন প্রথম দেখা হলো সেদিন সাইমের প্রথম প্রশ্ন ছিল,
‘ টাইম ট্রাভেল সম্পর্কে একজেক্ট ধারণা কী আপনার?’
ছোঁয়া কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল এমন প্রশ্নে। কেউ যে হবু বউয়ের সাথে দেখা করতে এসে এমন উদ্ভট প্রশ্ন করতে পারে তা যেন ধারণাতেই ছিল না ছোঁয়ার৷ ছোঁয়াকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মৃদু হেসে কফি কাপে চুমুক দিয়েছিল সাইম। গম্ভীর কন্ঠে বলেছিল,
‘ আপনার বড় খালামণি বলেছিলেন, আপনি নাকি প্রচন্ড পড়াকু মেয়ে? বড় খালামণির কথাটা সম্পূর্ণ সত্য বলে মনে হচ্ছে না।’
তারপরের সময়টুকু দক্ষ শিক্ষকের মতো টাইম ট্রাভেল সম্পর্কে বুঝিয়েছে সাইম। ছোঁয়া বুঝেছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বাড়ি ফিরে আপাদমস্তক ক্লাস শেষ করে ফিরে আসার মতো অনুভূতি হয়েছে ছোঁয়ার। অথচ সে ভেবেছিল, ডেইট নামক বিষয়টা ভীষণ উত্তেজনাপূর্ণ হয়!
সিঁথি হক রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই ফোন হাতে নিল ছোঁয়া। নম্রতা-নীরাকে ফোনে না পেয়ে নাদিমকে ফোন লাগাল। তিনবারের মাথায় ফোন উঠাল নাদিম। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বিসমিল্লাহতেই দুই-তিনটা বিশ্রী গালি উপহার দিয়ে বসল সে। ছোঁয়া সেসব তোয়াক্কা না করে বলল,
‘ তুই কখনও ডেইটে গিয়েছিস?’
ছোঁয়ার প্রশ্নে যেন আকাশ থেকে পড়ল নাদিম। কয়েক সেকেন্ড চোখ বড় বড় করে চেয়ে থেকে ধমকে উঠে বলল,
‘ ক্যান? ডেইট ফেইটে গেলেও তোরে কইতে হইব ক্যান? বাই এনি চান্স, তুই কি ডেইটের ক্লাসিফিকেশন শোনার লাইগা ফোন দিছিস আমারে? শোন ছোঁয়াইয়া, তুই হইলি ইংরেজ বলদ। বলদদের ডেইটে কোনো ক্লাসিফিকেশন নাই। এদের একমাত্র ডেইট হলো গলা মিলিয়ে হাম্বা হাম্বা করা। তুই তোর অস্ট্রেলিয়ান গরুকে নিয়ে হাম্বা হাম্বা শুরু করে দে। হাম্বা হাম্বা করতে করতে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভেঙে ফেল। তোদের এই হাম্বা প্রতিযোগিতার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করব আমি। পুরস্কারের নাম হবে, ‘হাম্বা ডেটিং পুরস্কার’ নামটা সুন্দর না?’
#চলবে….
[ বিঃদ্রঃ রি-চেইক করা হয়নি।]