নীল চিরকুট পাঠ-৫৯

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৫৯.

পূর্বাকাশ যখন সিঁদুর রঙে রাঙা হল, ভোরের বাতাস আলোড়িত করে বেজে উঠল প্রার্থনায় নিমজ্জিত হওয়ার আহ্বান। ঠিক তখনই দুই চোখ বোজল নম্রতা। ঘুমগুলো এসে ধরা দিল ধীর পায়ে। অশ্রুসিক্ত ফোলা চোখদুটো দু’দন্ড শান্তি কুড়ালো এবার। ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেল সকল বিষাদ।

চওড়া বারান্দায় চেয়ার বিছিয়ে বসে আছেন নুরুল সাহেব। চোখের সামনে মেলে রাখা খবরের কাগজ। চোখ-মুখ গম্ভীর। পাশের ক্যাসেটে বাজছে স্মৃতিবিজরিত গান।

‘একটাই কথা আছে বাংলাতে
মুখ আর বুক বলে একসাথে
সে হল বন্ধু, বন্ধু আমার
বন্ধু আমার, বন্ধু আমার।
কে গরীব, কে আমীর সে মানে না
জাতের বিচার করা সে জানে না
সে হল বন্ধু.বন্ধু আমার
বন্ধু আমার।’

বাপ্পী লাহিড়ী ও মুন্না আজিজের কন্ঠে গাওয়া মাস্টারপিস। তরুন বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বসে এই গানটাই বেতারে শোনা হয়েছে অসংখ্যবার। আসাদ, মাসুদ, ইব্রাহিম আরও কতজন ছিল তখন। এখন নেই। কে, কোথায় আছে সে খবর নেওয়ার সময়, সুযোগটাও নেই। নুরুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে খবর কাগজের পাতা উল্টালেন। ততক্ষণে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নম্রতা। এলোমেলো চুলে হাত খোপা। গায়ে রাতের টি-শার্ট আর টাউজার। নম্রতা বিধ্বস্ত মুখেই মৃদু হাসল। টলমলে পায়ে চেয়ারের কাছে এসে বলল,

‘ শুভ সকাল বাবা।’

নুরুল সাহেব গানের সাউন্ড কমিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। খবরের কাগজটা ভাঁজ করে পাশে রাখতে রাখতে বললেন,

‘ শুভ সকাল, মা।’

নম্রতা চেয়ারে বসে হাসল,

‘ হাও ইজ দ্য মর্নিং? রিমেম্বারিং দ্য ওল্ড ডেইজ?’

নুরুল সাহেব হাসলেন। চোখ থেকে চশমা খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভীষণ আনমনা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টটির গায়ে।

‘ বন্ধু পাওয়া প্রাপ্তি, বন্ধু হারিয়ে ফেলা ব্যর্থতা। জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজের ব্যর্থতাগুলো গুণার চেষ্টা করছিলাম।’

নুরুল সাহেব আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঠোঁটে হাসি টেনে মেয়ের দিকে তাকাতেই কপাল কুঁচকালেন। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,

‘ কিন্তু তোর এই অবস্থা কেন? চোখ-মুখ ফোলা লাগছে। ঠিক আছিস মা?’

নম্রতা হাসার চেষ্টা করল। চেষ্টা সফল হল না। নিজের চেয়ারটা বাবার পাশাপাশি রেখে বলল,

‘ তোমায় একটু জড়িয়ে ধরব বাবা? আমার ঘুম হচ্ছে না।’

নুরুল সাহেবের উদ্বেগ বাড়ল। মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে আলতো হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়। মেয়েকে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। চুলে বিলি কাটতে কাটতে শুধু বললেন,

‘ বাবা তোকে খুব ভালোবাসে মা। জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে বাবা তোকে ভালোবাসবে।’

নম্রতা চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিল। বাবাকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,

‘ ইউ আর দ্য বেস্ট ফাদার ইন দ্য ইউনিভার্স। লাভ ইউ মোর। মোর এন্ড মোর।’

_

সকাল এগারোটা। সিএনজি-তে বসে একদৃষ্টে ফোনের দিকে চেয়ে আছে নম্রতা। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে দেখছে, আরফানের ফোন বন্ধ। আরফান তাকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেনি। রাতে ওভাবে ফোন কাটার পর একটা বারও তার নম্রতার কথা মনে পড়েনি? একবারও নয়? নম্রতা নিজে থেকেই ফোন দিল, ফোন বন্ধ। নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিএনজির সিটে গা এলিয়ে দেয়। এই বিদঘুটে, বিষন্ন দুপুরটার প্রতি জন্মায় রাজ্যের ক্ষোভ। ভার্সিটির গেইটের কাছে সিএনজি থামতেই ছোঁয়াকে দেখতে পায় নম্রতা। গোলাপি কুর্তি আর সাদা সালোয়ার গায়ে গাড়ি থেকে নামছে ছোঁয়া। নম্রতা তাকে দেখেই বিরক্ত চোখে তাকাল। অযথা রাগ দেখিয়ে বলল,

‘ তোর না কাল বিয়ে? বিয়ে রেখে ভার্সিটিতে এসেছিস কোন দুঃখে?’

ছোঁয়া নম্রতার রাগটা ধরতে পারল না। নম্রতার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সরল কন্ঠে বলল,

‘ বিয়ে তো কাল। আজ তো কোনো কাজ নেই আমার। শুধু শুধু বাড়ি বসে থাকব কেন?’

নম্রতা দাঁড়িয়ে গেল। চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ ঠিক বলেছিস। তোর তো কোনো কাজ নেই। আমার ধারণামতে, বিয়ের দিনও তোর কোনো কাজটাজ থাকবে না। দুই মিনিটের কবুল বলা ছাড়া বউদের তেমন কাজ থাকেও না। বাসর রাতেও কোনো কাজ নেই তোর। বর বাসর করবে, সেখানে অযথা তোর কী কাজ? আমরা কাল গ্রুপ স্টাডির প্ল্যান করছি। ফ্রী-ই যেহেতু আছিস, ওয়ান্না জয়েন আস?’

ছোঁয়া চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘ জয়েন করতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু মাম্মা বোধহয় এলাউ করবে না।’

নম্রতা রাগ নিয়ে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ নাদিমের বলা ইউনিভার্সাল ট্রুথ কি জানিস?’

ছোঁয়া জিজ্ঞেসা নিয়ে তাকাল। নম্রতা আকাশসম বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ তুই আসলেই একটা বলদ।’

নম্রতা-ছোঁয়ার কথার মাঝেই রিকশা থেকে ডেকে উঠল একটি মেয়ে। নম্রতা প্রথম দফায় চিনতে না পারলেও সম্বোধন শুনে চট করে চিনে ফেলল। ঠোঁটে হাসি টানার চেষ্টা করে বলল,

‘ আপনি এখানে?কেমন আছেন আপু?’

নিদ্রা হেসে বলল,

‘ আমি এই ভার্সিটিরই প্রাক্তন ছাত্রী। কিছু কাগজপত্র তুলতে এসেছিলাম। টিচার্স নিয়োগে এপ্লাই করব এবার। কিন্তু তোমার এই অবস্থা কেন? আর ইউ ওকে? ভীষণ সিক দেখাচ্ছে তোমায়।’

নম্রতা হেসে বলল,

‘ তেমন কিছু না। রাতে ঘুম হয়নি তো তাই এমন দেখাচ্ছে।’

‘ ঘুম হবে না কেন? ভাইয়া ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও তার প্রিয়তমার এই অবস্থা! মানা যাচ্ছে না। তাকে বলোনি?’

নম্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ নিষ্প্রভের ফোন অফ। তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।’

নিদ্রা কপাল কুঁচকে তাকাল। তার সুন্দর ঠোঁট জোড়া বাচ্চাদের মতো উল্টে ফেলে বলল,

‘ ভাইয়ার তো দুটো নাম্বার। তুমি সেকেন্ডটাতে ট্রাই করো। ভাইয়া তো একসাথে দুটো নাম্বারই বন্ধ রাখে না।’

নম্রতা অবাক হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ নিষ্প্রভের সেকেন্ড কোনো নাম্বার তো আমার কাছে নেই।’

নিদ্রা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। নম্রতাকে তৎক্ষনাৎ আরফানের নাম্বার দিয়ে বিদায় নিল। নম্রতা অনুভূতিশূন্য চোখে ছোঁয়ার দিকে তাকাল। ছোঁয়া ভীষণ অবাক হয়ে বলল,

‘ মেয়েটা কি ম্যান্টালি সিক? তোকে ছোঁড়াছুড়ি বলে ডাকছিল কেন? এটা কেন নাম হলো? আশ্চর্য!’

নম্রতা উত্তর দিল না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। মনে মনে শুধু একটা প্রার্থনায় করতে লাগল, আরফানের এই নাম্বারটাও যেন বন্ধ থাকে। আরফানের এই নাম্বারটা খোলা থাকলে, নম্রতার অবুঝ মনটা তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের সাথে পেরে উঠবে না। মস্তিষ্কের হাজারও যৌক্তিক প্রশ্নের জবাবে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো রাস্তা থাকবে না। ভীষণ অস্থিরতা নিয়ে গোটা একটা ক্লাস করল নম্রতা। আরফানের নাম্বারে ফোন দেওয়ার মানসিক শক্তি জুগাতে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল শরীর। যদি ফোনটা লেগে যায়? হাজারও দ্বিধা-দ্বন্দের অবসান ঘটিয়ে কল করল নম্রতা। তার হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দিয়ে, সকল প্রার্থনা মিথ্যে করে দিয়ে প্রথমবারেই ফোন রিসিভ করল আরফান। নম্রতা বোবা হয়ে বসে রইল। তবে কি নম্রতার জন্যই সীম অফ রেখেছিল আরফান? যদি তা না হয় তাহলে এই নাম্বারটা কেন দেয়নি তাকে? সকালে একটাবারও কেন মনে পড়েনি তাকে?

‘ নম্রতা? আপনাকে একটু পর ফোন দিই? আমি এখন পেশেন্টের সামনে। ব্যস্ত আছি।’

হঠাৎ আরফানের কন্ঠে ভাবনায় ছেদ ঘটল নম্রতার। চমকে উঠে বলল,

‘ হু?’

‘ আমি আপনাকে একটু পর ফোন দিচ্ছি নম্রতা।’

নম্রতা নিজেকে খুব দ্রুত ধাতস্থ করে নিয়ে বলল,

‘ সকালে একটা বার আমাকে কল দেওয়ার প্রয়োজন কি আপনার ছিল না?’

আরফান মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ সরি! খেয়াল ছিল না।’

নম্রতা যার পর নাই অবাক হলো। মেজাজ বিগড়ে গেল। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

‘ খেয়াল ছিল না? আমার এক্সজিসটেন্স কী তবে খেয়াল হওয়া পর্যন্ত ডক্টর?’

‘ ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে কেন ঝামেলা করছেন নম্রতা? আমি আপনাকে পরে কল দিই?’

‘ ঝামেলা? ঝামেলা কোথায় করলাম? আই ওয়াজ জাস্ট আস্কিং। ফোন বন্ধ কেন আপনার?’

‘ ফোন বন্ধ থাকলে কল এলো কিভাবে?’

‘ সীমটা বন্ধ রেখেছেন।’

‘ ওহ! কাল রাতে অফ করেছিলাম। অন করতে মনে নেই। আমি পরে ফোন দিচ্ছি।’

‘ কাল রাতে কোনো ইম্পোর্টেন্ট কল এটেন্ট করেছেন?’

আরফান বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ আমার সামনে পেশেন্ট বসা নম্রতা। আমি ব্যস্ত আছি।’

নম্রতা জবাব দিল না। ডানচোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গালে। বিড়বিড় কন্ঠে বলল,

‘ আপনার জীবনে আমার অস্তিত্ব ব্যস্ততা আর খেয়াল হওয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ ডক্টর। আমি এতোটা ঠুনকো কখনও বুঝতেই পারিনি!’

আরফান বুঝতে না পেরে বলল,

‘ কি বললেন বুঝতে পারিনি। এখন রাখি, প্লিজ?’

নম্রতা রেখে দিল। দুই চোখে ভর করল রাজ্যের বৃষ্টি। বুকের বাম পাশে থাকা ছোট্ট মনটা ব্যথা করে উঠল নিষ্ঠুরভাবে। চার বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা। প্রতিটি রাতের একাকিত্ব যন্ত্রণা, কান্নাগুলো যেন আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠল চোখে। যার খেয়ালে সে মগ্ন থেকেছে এতটা কাল। এতটা বছর। এতোগুলো রাত-দিন! সেই তার কাছে নম্রতার অস্তিত্ব আজ খেয়ালের উপর টিকে আছে। ভালোবাসার মানুষের কথাও বুঝি খেয়াল থাকে না? খেয়াল করে নিতে হয়? কি আশ্চর্য! তবে কি নম্রতা ভালোবাসতে পারেনি? তার কেন খেয়াল করতে হয় না?

_

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেই ছটফট করতে লাগল নীরা। বার বার উদগ্রীব চোখে তাকাতে লাগল দরজায়। শাশুড়ী মাকে রান্নায় সাহায্য করতে গিয়েও বাঁধাল গন্ডগোল। পিঁয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেটে বলি করল। জাহানারা মেজাজ খারাপ করে তাকালেন। ধমকে উঠে বললেন,

‘ একটা কাজ ঠিকঠাক করতে পারো না? কাজ করার সময় মন থাকে কই? বরকে দেখাতে চাও, তোমার শাশুড়ী তোমাকে অত্যাচার কে মেরে ফেলছে? হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? পানি ঢালো হাতে। অয়ন? এই হারামজাদা। সারাদিন টিভিতে কি দেখিস তুই? তোরে আর তোর টিভি দুইটাকেই এক কোপে দুই ভাগ করে ফেলব হারামির বাচ্চা। ভাবির হাত কেটেছে, স্যাভলন আন। কাজ করতে এসে যত অকাম। জীবনটা শ্যাষ করে ফেলল আমার। এখনও দাঁড়ায় আছ কেন তুমি?যেতে বলি নাই?’

জাহানারার ধমকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে নীরা। অয়ন হাতে পট্টি বেঁধে দেওয়ার পর রান্নার কোনো কাজে হাত দিতে দেননি জাহানারা। সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি ধমকা-ধমকি করেই পাড় করেছেন সময়। নীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকা শুনেছে আর শাশুড়ী মায়ের ছেলের জন্য অপেক্ষা করেছে। কাল রাতের পর অন্তুকে ধারেকাছে পায়নি নীরা। ছেলেটা সারাদিন বাইরে বাইরে কী করে কে জানে? নীরার এই চঞ্চলা অপেক্ষার অবসান ঘটল রাত এগারোটায়। অন্তু বাড়ি ফিরেই খেতে বসল। অয়ন আর নীরা ব্যতীত সবাই তখন যার যার ঘরে। অন্তু খেতে বসেই প্রথম নীরার দিকে তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘ খাওয়া হয়েছে ম্যাডাম?’

নীরা মৃদু হেসে বলল,

‘ পরে খাব।’

অয়ন সোফায় শুয়ে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিল। ভাই-ভাবীর কথার এক পর্যায়ে গলা উঁচিয়ে বলল,

‘ নীরাপু থুক্কু ভাবী আজ হাত কেটে ফেলেছে ভাইয়া।’

অন্তু কপাল কুঁচকে তাকাল। মাথা হেলিয়ে উঁকি দিয়ে বলল,

‘ কোন হাত? দেখি?’

নীরা ডানহাতটা একটু উঁচু করে নিজের চোখের সামনে ধরল। তারপর বলল,

‘ অত কাটেনি। একটু।’

অন্তু কিছু বলল না। নীরা অয়নের দিকে চেয়ে বলল,

‘ এই তুই এখনও ঘুমোতে যাস না কেন? বাবা যদি দেখে এখনও টিভি চলছে, খুন করে ফেলবে একদম। যা ঘুমোতে যা।’

অয়ন আগের মতোই লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ে বলল,

‘ ম্যাচ শেষ না হলে ঘুম আসবে না। ভাইয়া? আজকের ম্যাচটা কিন্তু জটিল হচ্ছে।’

নীরা অন্তুর পাতে খাবার দিয়ে নিজের ঘরে গেল। ছাদে শুকোতে দেওয়া জামা-কাপড়গুলো অগোছালোভাবে পড়ে আছে বিছানায়। নীরা বিছানায় বসে এক এক করে কাপড়গুলো গুছাতে নিতেই ঘরে এলো অন্তু। মুখভর্তি হাসি নিয়ে ফোনে কথা বলছে সে। এক হাতে তার খাবারের প্লেট। অন্যহাতে ফোন। অন্তু ফোনে কথা বলতে বলতেই বিছানায় এসে বসল। কথার ধরন দেখে বুঝা গেল নাদিমের সাথে কথা বলছে সে। অন্তুর হাসি বিস্তৃত হলো। বিচিত্র ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁট কামড়ে বলল,

‘ ওই মেয়ে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। তেজ ব্যাপক। তোর দ্বারা সম্ভব হবে না।’

কথা বলতে বলতেই খাবার মেখে নীরার সামনে ধরল অন্তু। নীরার মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি এবার বিস্ময়ে রূপ নিল। অন্তু তখন নাদিমের বিপক্ষে কথার ঝুলি সাজাতে ব্যস্ত। নীরার বিস্মিত চাহনি তার চোখে পড়ল না। নীরা মুখ বাড়িয়ে খাবার মুখে নিল। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়েই একের পর এক লোকমা এগিয়ে দিল অন্তু। নাদিমের সাথে হাস্যোজ্জল আলাপন করতে করতে নীরার চোখের বিস্ময়, মোহ ঠাহর করতে পারল না সে। হঠাৎই শব্দ করে হাসল অন্তু। ফোনের ওপাশে বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ চাপা মারিস না। আমি অবশ্যই পারতাম। কিন্তু তারে দিয়ে আমি করুমটা কি? ওই মেয়ের জায়গায় তোর বোন হলে নাহয় একটা কথা ছিল। আহা! আমাদের প্রেমকাহিনীটা তুই পুরো হতে দিলি না।’

নাদিম অশ্লীল কিছু গালি দিয়ে বলল,

‘ তুই তো শালা বিরাট চরিত্রহীন। ঘরে বউ রাইখা বাইরে নজর দেস।’

অন্তু হাসে। নীরার দিকে শেষ লোকমা এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ বউ রাইখা নজর দিলাম কই? নজর তো আমার আগে থেকেই ছিল। এক বউ দিয়ে আসলে চলছে না। তোর বোনকে মাস্ট দরকার।’

নীরা মুগ্ধ চোখে অন্তুর হাসি দেখছে। এই ছেলের এই হাসির জন্যই শেষমেশ প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছিল নীরা। এত এত গালি শোনার পরও অন্তু নির্বিকার হেসে বলত, আর কত বকবি দোস্ত? রেস্ট নে। সামনের মাসে প্রপোজ করলে বাকি গালি দিস। এখন গালি শোনার মুড নাই। নীরা তখনও মুগ্ধ চোখে দেখত। সেই চোরা দৃষ্টি এখন প্রকাশ্য। সেই নিষিদ্ধ মোহ এখন বাধাহীন, পবিত্র। অন্তুর সুন্দর, স্বচ্ছ হাসির দিকে চেয়ে থেকেই হঠাৎ ভীষণ অগোছালো হয়ে পড়ল নীরা। হঠাৎই উঠে গিয়ে অন্তুর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপরই বর্ণনাতীত এক কাজ করে বসল সে। ডানহাতটা অন্তুর কাঁধে রেখে অন্তুর মোহাচ্ছন্ন ঠোঁট জোড়াতে ঠোঁট রাখল পরম আবেশে। অন্তু হঠাৎই কিছু বুঝে উঠতে পারল না। পুরো ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই হতভম্ব হয়ে গেল সে। নীরার অকল্পনীয় কাজে কাঠ হয়ে বসে রইল। হাত থেকে গড়িয়ে পড়ল ভাতের প্লেট, ফোন। প্লেট পড়ার শব্দ হতেই ছিটকে সরে দাঁড়াল নীরা। কাঁপা হাতে প্লেটটা তুলে নিয়েই দ্রুত পায়ে ঘর ত্যাগ করল। একটাবারও অন্তুর চোখে চাওয়ার সাহস করে উঠতে পারল না। অন্তু হতভম্ব চোখে নীরার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। ঠিক এই মুহূর্তে কি ঘটে গেল, কিভাবে ঘটে গেল কিচ্ছু বুঝতে পারছে না অন্তু। ফোনের ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠল নাদিম,

‘ তুই কি মইরা গেছিস দোস্ত? টিকেট কাইট্টা গেছে তোর? কথা কস না ক্যারে?’

অন্তু কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বিরবির করে বলল,

‘ আমার বোধহয় আট্যাক ফ্যাটাক হয়ে যাচ্ছে দোস্ত। শরীর কাঁপছে। কি হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’

#চলবে….

[ রি-চেইক করা হয়নি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here