নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৬১.
চারদিকে ভীষণ অন্ধকার। কানের পাশে শো শো বাতাস। জায়গাটা কোনো ব্রিজের কাছে। নিচে টলমলে কালো জল। আকাশে ভীষণ মেঘ। অন্ধকার আকাশে আঁধার করে আসা বিষণ্নতা। থেকে থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি। নম্রতার গা ছমছম করছে৷ কানদুটো তালা লেগে যাচ্ছে নিশাচরদের ঝিমঝিম শব্দে। নম্রতা ভয়ে ভয়ে চারপাশটা দেখল, কেউ নেই। এমন একটা নিস্তব্ধ জায়গায় কেন নিয়ে এলো নিষ্প্রভ? নিষ্প্রভ কী জানে না, নম্রতা অন্ধকার ভয় পায়? নম্রতা থেকে বেশ দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে আরফান। গায়ে তার ধূসর রঙের শার্ট। অন্ধকারে চেহারা অস্পষ্ট। এই অস্পষ্ট চেহারার দিকে তাকিয়েও নম্রতা বুঝে ফেলল, আরফানের মনটা ভীষণ খারাপ। চোখ-মুখ শুকনো। নম্রতা উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ আমরা কোথায় আছি ডক্টর? জায়গাটা আমি চিনতে পারছি না। আমার ভীষণ ভয় লাগছে। ফিরে চলুন।’
আরফান নিস্পৃহ কন্ঠে বলল,
‘ এখান থেকে ফেরার উপায় নেই নম্রতা।’
নম্রতা চমকে উঠল। শরীর বেয়ে বয়ে গেল শীতল রক্তস্রোত। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
‘ উপায় নেই! কেন? এখানে এতো অন্ধকার কেন? এতো অন্ধকার আমার সহ্য হচ্ছে না ডক্টর। আমি আপনাকে দেখতে পারছি না। কাছে আসুন।’
আরফান ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
‘ সম্ভব নয়।’
নম্রতা উম্মাদের মতো বলতে লাগল,
‘ আমি অন্ধকার সহ্য করে পারছি না। আমি অন্ধকার সহ্য করতে পারছি না। এখানে খুব অন্ধকার। আলো জ্বালুন।’
‘ আমার কাছে আলো নেই নম্রতা।’
‘ এটা কোথায়? জায়গাটা আমি চিনতে পারছি না কেন?’
‘ আপনি চিনতে পারছেন। খেয়াল করে দেখুন। এটা আপনার আর আমার খুব পরিচিত জায়গা। খুব।’
আরফানের শেষ কথাটা কেমন ফিসফিসের মতো শোনাল নম্রতার কানে। হালকা বাতাসে ধাক্কা দিয়ে উড়ে গেল অনেক দূরে। নম্রতা চোখ মেলে দেখতে চেষ্টা করল। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, জায়গাটা তার পরিচিত। এইতো চির পরিচিত সেই সিঁড়ি। শাহবাগ গ্রন্থাগার। নম্রতা আশেপাশে কোনো ব্রিজ বা নদী দেখতে পেল না। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ আমরা এখানে কেন এসেছি ডক্টর?’
‘ বিদায় জানাতে।’
‘ বিদায়?’
‘ হ্যাঁ, বিদায় নম্রতা। এখান থেকে শুরু হওয়া গল্পটির বিদায় ঘন্টি বেজে গিয়েছে নম্রতা। এখানে তৈরি হওয়া শ্যামলতা এখানেই নিঃশেষ। আপনার আর আমার পথ ভিন্ন। আমাদের আর এগোনোর পথ নেই।’
নম্রতার ভেতরটা ভয়াবহ শঙ্কায় কেঁপে উঠল। ছলছল চোখে চেয়ে বলল,
‘ কি বলছেন?’
‘ আপনাকে আমি চাই না নম্রতা। আমি যাকে চাই সে আপনি নন। আপনাকে হারিয়ে যেতে হবে নম্রতা। সময়ের কাল গর্ভে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া শ্যামলতার মতোই হারিয়ে যেতে হবে আপনাকে। তবেই না আমি এগোতে পারব।’
নম্রতার চারপাশটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ হাহাকার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির মুখ অস্পষ্ট হয়ে উঠে আরও। তবুও নম্রতা দেখতে পায়, মানুষটির চোখে তীব্র বিরক্তি, ভয়াবহ বিতৃষ্ণা। তীক্ষ্ণ হয়ে বাজে একটাই কন্ঠ,
‘ আপনি হারিয়ে যান নম্রতা। আপনি হারিয়ে যান। আপনাকে আমি চাই না। হারিয়ে যান।’
নম্রতা ডুকরে কেঁদে উঠল। চিৎকার করে উঠল তার কন্ঠনালী। বুকের ভেতরটা দ্বগ্ধ হল। নিঃশ্বাস আটকে এলো। নম্রতার হঠাৎ মনে হলো, সে বাঁচতে পারছে না। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। অসাড় শরীর নেড়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। নম্রতা মারা যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎই বহুদূর থেকে ভেসে এলো অসংখ্য কন্ঠস্বর। ওগুলো কে? নাদিম, রঞ্জন? না। ওরা নয়। বাবা। হ্যাঁ, নম্রতার প্রিয় বাবা। নম্রতা বাবার কাছে ছুটতে চেষ্টা করল। ভীষণ চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, বাবা! আমার বাবা। বাবা শুনেছে। কেউ না শুনলেও তার ডাক শুনেছে বাবা। উম্মাদের মতো ছুটে আসছে। নম্রতাকে বুকে আগলে নিতে ছুটে আসছে।
‘ মা? নমু মা? কি হয়েছে আম্মু? এইতো বাবা। এমন ছটফট করছিস কেন মা?’
নম্রতা বড় বড় নিঃশ্বাস টেনে চোখ মেলে তাকাল। নন্দিতা রুদ্ধ কন্ঠে ডাকল,
‘ আপু?এই আপু? কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? বাবা? কি হচ্ছে আপুর?’
নম্রতার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ ভয়ে থরথর করে কাঁপছে শরীর। মেহরুমা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বললেন,
‘ আম্মু? কি হয়েছে আম্মু? নমুর বাবা? আমার মেয়ে এমন করছে কেন? আমার কলিজা, আম্মু? নমু মা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস সোনা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে মা?’
নুরুল সাহেব ধমকে উঠে বললেন,
‘ আহ! এখন চিৎকার চেঁচামেচি করার সময় নয় মেহরুমা। মেয়েটাকে ইজি হতে দাও। দৌঁড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। এভাবে চিৎকার করে তাকে ভরকে দিও না।’
মেহরুমা থামলেন না। গুনগুনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলেন পানি আনতে। নন্দিতা দৌঁড়ে গিয়ে বসল বোনের পাশে। ভয়ে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে তার। বোনের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে ক্রমাগত মালিশ করে চলেছে। নুরুল সাহেব নম্রতার গালে হাত দিয়ে আলতো কন্ঠে ডাকলেন,
‘ নমু মা? বাবা পাশে আছে। ভয় কী? ভয় নেই। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? কী হয়েছে? বাবাকে বল। এই দেখ বাবা পাশে। ভয় নেই তো মা।’
নম্রতার শ্বাসকষ্ট ধীরে ধীরে কমে এলো। চোখ ঘুরিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করল নিজের প্রাত্যহিক বিছানায়। পাশেই বসা বাবা আর বোন। নম্রতার শরীরটা ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ওটা স্বপ্ন ছিল? এতো বাস্তব স্বপ্ন! ঘামে জবজবে শরীর নিয়ে চট করে উঠে বসল নম্রতা। ঘরে তীক্ষ্ণ কোনো আলো নেই, ঢিম লাইট জ্বলছে। খোলা জানালার পাশে গাঢ় অন্ধকার। নম্রতার শ্বাস আটকে এলো। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগল। উম্মাদের মতে চিৎকার করতে লাগল হঠাৎ,
‘ অন্ধকার কেন? আমার অন্ধকার সহ্য হচ্ছে না। আলো জ্বালাও। আলো জ্বালাও। বাবা! বাবা! বাবা আলো জ্বালাও। আমি অন্ধকার সহ্য করতে পারছি না।’
নুরুল সাহেব মেয়েকে ঝাপটে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। নন্দিতা ছুটে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইল। নম্রতা ধীরে ধীরে শান্ত হলো। নুরুল সাহেব এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে রইলেন। দোয়া পড়ে মেয়ের গায়ে বার কয়েক ফু দিয়ে মেয়েকে পানি খাওয়ালেন। তারপর আবারও আগের মতোই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন চুপচাপ। সেই রাতে ছোট্ট নন্দিতা পর্যন্ত ঘুমোতে গেল না। বোনের একহাত ধরে চুপ করে বসে রইল। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ধুম করে জ্বর হলো নম্রতার। মেয়ের ভয়ানক জ্বরে দিশেহারা হয়ে পড়লেন মেহরুমা। মেয়েকে বাবার কাছে রেখে ওযু করে জায়নামাজে বসলেন। কলিজার মেয়েটার জন্য ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তার। বেশ তো বন্ধুর বিয়ে থেকে এলো। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার? রাত-বিরেতে ঘুরে বেড়ায়, খারাপ কিছুর নজর পড়েনি তো আবার?
_
তখন মধ্যরাত। বারোটা কি একটা বাজে। ছোঁয়ার বিয়ে থেকে ফিরে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নীরা। বিছানার এক কোণায় বসে তার দিকেই অপলক চেয়ে আছে অন্তু। ভীষণ অস্বস্তিতে কাটা হয়ে আছে নীরা। কাল রাতের ওমন ঘটনার পর লজ্জায় মাথা তুলে তাকানো যাচ্ছে না। অথচ অন্তুর চোখে যেন আজ রাজ্যের অবসর। নীরা আড়চোখে তাকাল। সাথে সাথেই চোখে চোখ পড়ল দুজনের। নীরা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্তুর দিকে পিঠ করে বিছানায় বসল। চুলগুলো হাত খোপা করে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল এক কোণায়। কাঁথা দিয়ে টুপ করে মুখ ঢেকে নিয়ে চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলল লজ্জায়। পুরো ব্যাপারটা সূক্ষ্ম চোখে নিরক্ষণ করে বেশ মজা পেয়ে গেল অন্তু। নীরার দিকে কিছুটা সরে বসে নীরার মাথার কাছাকাছি ঝুঁকে এসে হুট করেই টেনে সরিয়ে দিল কাঁথা। নীরা বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই হাসল অন্তু। চোখ টিপে বলল,
‘ হ্যালো।’
নীরা ভরকে গেল। কাঁথা নিয়ে আবার মুখ ঢাকল। অন্তু আবারও একই কাজ করতেই দুই হাতে মুখ ঢেকে অসহায় কন্ঠে বলল নীরা,
‘ উফ! আমি লজ্জা পাচ্ছি।’
নীরার কথায় হুহা করে হেসে উঠল অন্তু। জোরজবরদস্তি করে নীরার হাতদুটো সরিয়ে দিয়ে, নীরাকে অনুকরণ করে বলল,
‘ উফ! এত লজ্জা কেন পাচ্ছেন?’
নীরা হেসে ফেলল। অন্তু টুপ করে চুমু খেয়ে নিল নীরার কপালে। সেই প্রথমদিনের মতোই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল অন্তু। নীরার উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আলো নেভাল। কিন্তু সরে গেল না। জহরি চোখে চেয়ে রইল নীরার চোখে, ঠোঁটে, লতানো দেহে। নীরার গায়ে আজও পাতলা শাড়ি। মৃদু সবুজ আলোতে মোমের মতো জ্বলজ্বল করছে ফর্সা উদর। নারী দেহের আকর্ষণীয় বাঁক। অন্তুর চোখের সুপ্ত মুগ্ধতা এবার জ্বলজ্বল করে উঠল চোখে। মাথা নুইয়ে ঠোঁট রাখল ঠিক সেখানেই যেখানে একবার আকস্মিক কাঁপন ধরিয়েছিল নীরা। গলদেশের পাশটায় আকাঙ্ক্ষিত পুরুষের গাঢ় ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠল নীরা। ছোঁয়ার প্রখরতা বেড়ে ঠোঁটের কাছে পৌঁছেতেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল এক অভাবনীয় আনন্দ বার্তা। প্রতীক্ষার সম্ভাব্য অবসান!
_
আকাশের কোণে প্রত্যুষের দেখা মিলতেই জ্বর নেমে এলো নম্রতার। দুর্বল হয়ে পড়ল শরীর। ঠিক আজই, বাদ জোহরে আরফানের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার দিন। অন্য কোনো দাওয়াত হলে চোখ বন্ধ করে নাকজ করতেন নুরুল সাহেব। কিন্তু এবার তা করলেন না। মেয়ের এই নাজুক অবস্থায় আরফানের সাথে দেখা হলে ভালো লাগবে ভেবে দাওয়াত রক্ষার প্রস্তুতি নিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়েই ঘটল আরেক দূর্ঘটনা।
#চলবে…
[ বিঃদ্রঃ পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। আগামীকাল বড় পর্ব দেব ইন-শা-আল্লাহ। ]