নীল চিরকুট পাঠ-৬৩

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৬৩.

নম্রতা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। আরফান আগের মতোই কাঁধে মুখ গুজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কোনো ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। নম্রতা এবার ঘুরে দাঁড়াল। চিঠিটা এক হাতের মুঠোয় রেখে দুইহাতে আরফানের গলা জড়িয়ে ধরলো। ততক্ষণে কুয়াশা কেটে গিয়েছে। কয়েক ফালি রোদ এসে পড়ছে নম্রতার অগোছালো চুলে, মেটে রঙের টাইলসে মোড়ানো মেঝেতে। টাইলসগুলো রোদের কিরণে চকচক করছে। ডাকপাখি তারস্বরে ‘চিঠি সংবাদ’ ঘোষণা করছে। আরফান নম্রতার থেকে থেকে কেঁপে উঠা শরীরটা নিজ বাহুতে আবদ্ধ করল। কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ এভাবে কান্নাকাটি করলে আপনার ব্যারেস্টার বাবা আমার নামে মামলা ঠুকে দিবে না, নম্রতা? তিনি নিশ্চয় ভাববে, আমি আপনাকে ভয়াবহ অত্যাচার করছি। কান্নাকাটি বন্ধ করুন। আপনার ভয়ঙ্কর পিতামহাশয় এখনও আমার বাড়িতেই অবস্থান করছেন। যেকোনো সময় তাঁর আগমন ঘটে যেতে পারে।’

নম্রতা কান্নারত অবস্থাতেই গরম চোখে তাকাল। নাক টেনে টেনে বলল,

‘ কী বললেন?’

আরফান হাসল। নম্রতাকে টেনে সোজা দাঁড় করিয়ে ভ্রু কুঁচকে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। সেকেন্ড কয়েক পর গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ বাহ! কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে ফেললেও আপনাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। ভয়ানক সুন্দর। কেউ এতো সুন্দর করে কাঁদতে পারে জানা ছিল না। এখন থেকে আপনাকে আরও বেশি বেশি কাঁদাতে হবে। সেজন্য দুঃখিত নম্রতা।’

‘ ধুর! ওসব কিছু নয়। সব মেয়েদেরই কান্নারত অবস্থায় সুন্দর লাগে। উপন্যাসে পড়েননি?’

‘ উপন্যাসে পড়েছি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। এখন তো আরও না। মেয়েদের কান্নারত অবস্থায় সুন্দর লাগে, কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়।’

নম্রতা অসন্তোষ চোখে চাইল। চোখ মুছতে মুছতে বলল,

‘ তবে সত্য কী?’

‘ সত্যটা হলো, আমরা আমাদের প্রিয় মানুষকে যেকোনো অবস্থায় সুন্দর দেখি। তাকে ঘিরে আমরা মুগ্ধ হতে পছন্দ করি বলেই সুন্দর দেখি। আপনাকে কান্নারত অবস্থায় আজ প্রথম দেখছি তেমন কিন্তু না। আমাদের সাক্ষাতের প্রথম দিনও আপনি ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলেন। কিন্তু সেদিন আপনাকে বিন্দুমাত্রও সুন্দর বলে মনে হয়নি। মুগ্ধতা কাজ করেনি। বাংলাদেশের বাকিসব মেয়েদের মতোই লেগেছে, এভারেজ। মনে মনে অভদ্র, আনকালচারড বলে বিরক্তও হয়েছি। কিন্তু দেখুন, সেই আপনাকেই এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী বলতে দ্বিধা হচ্ছে না। এর থেকে সুন্দর কেউ হতে পারে, আমার মন বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করতে চাইও না। সব মেয়েদেরই কান্নারত অবস্থায় সুন্দর লাগলে নিশ্চয় সেদিনও আপনাকে ভুবনমোহিনী রূপবতী লাগত? লাগেনি তো। সব আসলে দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভর করছে। এছাড়া কিছু না।’

নম্রতার কান্না থেমে গেল। সে সব কথাগুলো সাইডে রেখে দুটো শব্দকে কেন্দ্র করেই আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠল,

‘ আপনি আমাকে অভদ্র, আনকালচারড ভেবেছিলেন? আমি অভদ্র?’

আরফান কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করল। পরক্ষণেই হেসে ক্ষ্যাপাটে নম্রতাকে কাছে টেনে, দুই বাহুর চাপে বুকের সাথে পিষ্ট করে বলল,

‘ সেই অভদ্র মেয়েটা ভবিষ্যতে এসে আপনি হবেন, সেটা তো জানতাম না নম্রতা। তেমনটা জানলে কখনোই অভদ্র ভাবতাম না। পৃথিবীর সবচেয়ে ভদ্র মেয়ে ভেবে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতাম। ওমন ভয়ানক খামচিগুলো আরও দশ-বারোটা খেয়ে নিতাম অবলীলায়।’

কথাগুলো বলে কৌতুক হাসল আরফান। নম্রতা ফুঁসে উঠে বলল,

‘ আপনি ফাজলামো করছেন?’

আরফান নিঃশব্দে হাসল। নম্রতার কপালে টুপ করে একটি চুমু খেয়ে নিয়ে বলল,

‘ আচ্ছা আর ফাজলামো করব না। এবার আদর করব। কোনো এক বিদ্বান ব্যক্তি বলেছিলেন, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই টুপ করে চুমু খেয়ে ফেলতে হয়। এই মুহূর্তে আপনিই সবচেয়ে রূপবতী নারী। আমার উচিত আপনাকে টুপ করে চুমু খেয়ে ফেলা। আসুন, চুমু খাব।’

নম্রতা হতভম্ব চোখে চাইল। আরফানের ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি। নম্রতাকে আরেক দফা বিস্মিত করে দিয়ে বাস্তবিকই ঠোঁটের কোণে গভীর এক চুমু বসিয়ে দিল আরফান।

‘ ভীষণ ব্যক্তিগত সময়ে চলে আসায় আমি একদমই দুঃখিত বোধ করছি না।’

এমন এক আকস্মিক কন্ঠে ঘনিষ্ঠতায় ভাঁটা দিয়ে পাশ ফিরে তাকাল তারা। নিদ্রা বাইরে রাখা টেবিলে ঠেস দিয়ে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে উচ্ছল চঞ্চলতা। হাতদুটো খেলা করছে খোলা চুলে। প্রতিমার মতো সুন্দর মুখটিতে নরম রোদের আলো। এমন ব্যক্তিগত মুহূর্তে নিদ্রার উপস্থিতিতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল নম্রতা। লজ্জায় ছটফট করে উঠল চোখের দৃষ্টি। আরফানের মাঝে কোনোরকম অপ্রস্তুতভাব দেখা গেল না। সে খুব স্বাভাবিকভাবেই নম্রতাকে ছেঁড়ে দাঁড়াল। হেসে বলল,

‘ কিন্তু তোমার দুঃখিত হওয়া উচিত ছিল, নিদু।’

নিদ্রা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘ তা কেন হবে? দুঃখিত তো উল্টো তোমাদের হাওয়া উচিত। শুধুমাত্র তোমাদের জন্য সকাল সকাল খুবই লজ্জাজনক এক দৃশ্য দেখে ফেলেছি আমি। আমার এখন ভীষণ লজ্জা লজ্জা লাগছে।’

নিদ্রার চোখে-মুখে লজ্জার লেশমাত্র খুঁজে পেল না নম্রতা। মোমের মতো ফর্সা মুখে ঠোঁট ভর্তি হাসি নিয়ে নিরন্তর বলে চলল নিদ্রা,

‘ আমি তো ছুড়োছুড়িকে খুঁজতে এসেছিলাম। আমরা ভেবেছি সে হারিয়ে গিয়েছে। যেমনটা স্নিগ্ধা আপুর ক্ষেত্রে হয়েছিল। হঠাৎ, হাওয়া!’

আরফান জবাব দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে মৃদু হাসল। এই বোনটির সাথে কথায় পেরে উঠা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে আজকাল। নাস্তার টেবিলে বসে নম্রতাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন আরফানের মা,

‘ তোমার আর নিষ্প্রভের বিয়ের কথা চলছে শুভ্রলতা। তোমার কী আমার ছেলেকে পছন্দ হয়?’

নম্রতা চোখ তুলে তাকাল। ফট করেই বলে ফেলল,

‘ ভীষণ পছন্দ হয়।’

মেয়ের নির্লজ্জতায় হতবাক হয়ে গেলেন মেহরুমা। স্বামীর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। যার অর্থ, ‘দেখেছ? মেয়েদের মাথায় তুলে কী রকম নির্লজ্জ বানিয়েছ, দেখেছ?’ নুরুল সাহেব স্ত্রীর দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। আরফানের ঠোঁটে তখন লজ্জামাখা মৃদু হাসি। মা আরফানের দিকে চেয়ে কৌতুক কন্ঠে বললেন,

‘ কী রে? মেয়েটাকে পছন্দ হয়? আমার আর নিদ্রার তো খুব পছন্দ। বিয়ে করবি তাকে?’

আরফান মাথা নিচু করে হেসে ফেলল। জবাব দিল না। মেহরুমা মনে মনে হায় হায় করে উঠলেন, ‘ পুরুষ মানুষ হয়েও ছেলেটা কী লাজুক, ভদ্র! আর তার মেয়েটা? ইয়া মাবুদ, কী হবে এই মেয়ের!’

_

ধানমন্ডির ছোট্ট একটা কফি শপে, গম্ভীর মুখে কফি কাপে চুমুক দিচ্ছে আরফান। চারদিকে পড়ন্ত বিকেলের হলদে আলো। আরফান বিরক্ত চোখে ঘড়ি দেখল, পাঁচটা চব্বিশ। ছেলেটা এখনও আসছে না। মুহিব সামনের চেয়ারটাতেই মন খারাপ করে বসে আছে। কফি ঠান্ডা হচ্ছে, চুমুক দিতে ইচ্ছে করছে না। সেই ছোট্ট একটা কাহিনিকে কেন্দ্র করে এতো বছর পর তার খুব মন খারাপ লাগছে। ছাত্র জীবনে আরফানের পেছনে ছায়ার মতোই লেগে থেকেছে সে। বিপদে আপদে ছোট ভাইয়ের মতো সাহায্য পেয়েছে । সেই বড় ভাইয়ের বিশ্বাসটা ধরে রাখতে না পেরে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো, আরফান তার সাথে রাগারাগি করেনি। চোখ গরম করে তাকায়নি। তার চাহনীতে ছিল তীব্র বিতৃষ্ণা। সময়টা ঘুরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি থাকলে অবশ্যই ব্যাপারটা ঘুরিয়ে দিত মুহিব। অতীতে গিয়ে চট করে নিজের ভুলটা শুধরে নেওয়া যেত। মুহিবের ভাবনার মাঝেই ভেতরে এলো সাতাশ আটাশ বছরের বেঁটে খাটো এক যুবক। চারকোনা মুখটিতে স্বাভাবিকের তুলনায় বড় দুটো চোখ। মুহিব তাকে ইশারা করতেই কাছাকাছি এসে চেয়ার টেনে বসল। আরফানকে দেখে খানিক চমকাল কী?

‘ আরে আরফান ভাই? আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?’

আরফান শীতল চোখে তাকাল। কফি কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,

‘ ওয়া আলাইকুম আসসালাম। তোমার নাম সাব্বির না?’

সাব্বির খানিক অপ্রস্তুত ভাব নিয়ে বলল,

‘ জি ভাই।’

মুহিব অধৈর্য কন্ঠে বলল,

‘ দ্যাখ সাব্বির! ডিরেক্ট কথায় আসি। প্রায় পাঁচ বছর আগে তোরে একটা চিঠি দিছিলাম লাইব্রেরিতে রাখার জন্য। চিঠিটা গেল কই?’

সাব্বিরের মুখটা খানিক ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মৃদু কেশে হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ চিঠি! আরে, অতোদিন আগের কথা আজ হঠাৎ? আমি তো…’

আরফান তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,

‘ দেখো সাব্বির, আমরা কিন্তু জানি তুমি চিঠিটা বইয়ে রাখোনি। রাখোনি এই ব্যাপারে সিওর হয়েই তোমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, তোমার মুখ থেকে সরাসরি সবটা শোনার জন্য। বলো সাব্বির, কাজটা কেন করলে?’

পুরো কথাটা আন্দাজে বললেও সাব্বিরের চেহারার রং উড়ে গেল যেন। আরফান বুঝে ফেলল, ছুঁড়ি একদম সঠিক জায়গায় লেগেছে। সাব্বির জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিল। পরমুহূর্তেই আরফানের শান্ত দৃষ্টিতে এলোমেলো হয়ে গেল সব। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ সরি ভাই। আমি আসলে ইচ্ছে করে কিছু করিনি। মুহিব যেদিন চিঠিটা দিল সেদিন গ্রন্থাগারে গিয়েছিলাম আমি। তবে বই পড়ার জন্য নয়, গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করার জন্য। আমাদের মনোমালিন্য চলছিল প্রায় সপ্তাহখানিক। আমাদের ব্রেকাপটা সেদিনই হয়ে গেল। মন-মেজাজ খারাপ থাকায় চিঠির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। এক চোটে মনে পড়ল মুহিবের ফোন পাওয়ার পর। তখন অলরেডি তিনদিন কেটে গিয়েছে। চিঠিটা কোথায় রেখেছি তারও কোনো হদিশ নেই। বেশ খুঁজে টুজে বের করে পরেরদিন যখন গ্রন্থাগারে গেলাম তখন দেখি গ্রন্থাগার বন্ধ। মুহিবকে আগের দিনই বলে দিয়েছিলাম, চিঠিটা ঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে। তাই আর ব্যাপারটাকে তত গুরুত্ব দিইনি। বাসায় ফিরে চিঠিটা ফেলে রেখেছিলাম ড্রয়ারের এক কোণায়। এতগুলো বছরে একবারও চিঠিটার কথা মনে পড়েনি আমার। মনে পড়ার মতো কিছু ছিলও না।’

আরফান শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ চিঠির কথা তুমি ভুলে গেলে তোমার ড্রয়ার থেকে চিঠিটা সেই মেয়ের কাছে পৌঁছাল কীভাবে? তুমি নিজেই দিয়েছ নিশ্চয়। কাজটা ঠিক করোনি।’

সাব্বির চমকে উঠল। ব্যস্ত হয়ে বলল,

‘ না ভাই। আমি নিজে দিই নাই, বিশ্বাস করেন। আপনাকে যে ফোন দিয়েছিল ওর নাম পুতি। আমার খালাতো বোন। আমার বোন আর পুতি হঠাৎ কিভাবে যেন চিঠিটা হাতে পেয়ে যায়। চিঠিটা এখনও ড্রয়ারে আছে তাই তো মনে ছিল না আমার। ওরা যে আপনার সাথে ফোনে ফাজলামো করছে সেটাও জানতে পেরেছিলাম দুই তিনদিন পর। ছোট মানুষ। ফ্যান্টাসী বেশি। আর আপনার গলার আওয়াজও সুন্দর, তাই….’

কথাটা বলে মাথা নিচু করে ফেলল সাব্বির। মিনমিন করে বলল,

‘ সরি ভাই।’

মুহিব রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

‘ ছোট মানে কী? ফিডার খায়? কোন ক্লাসে পড়ে তোর বোন?’

‘ এবার টেনে উঠল দুজনই।’

আরফান হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল। দশম শ্রেণীর বাচ্চা মেয়ে তার সাথে ফাজলামো করেছে? কী আশ্চর্য! এই মেয়েগুলো তো তার থেকে জন্ম-কর্মেরও ছোট। আরফান কোনো কথা খুঁজে পেল না। বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সাব্বিরের মুখে। লাস্ট দুদিন বেশকিছু আপত্তিকর কথা বলেছিল মেয়েটি। এসব বাচ্চা মেয়ের মুখে এসব কথাও সম্ভব? মুহিব একাধারে গালিগালাজ করে চলেছে। আরফানের মাথায় দপদপ করছে রাগ। আরফান শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ তোমার বোনটা সামনে থাকলে গাল বরাবর একটা চড় বসাতাম সাব্বির। বোনকে শালীনতা শেখাও। কারো অনুভূতিকে অপমান করার মতো বিশ্রী অপরাধ আর কিছু হতে পারে না।’

_

রাতে অন্তু বাড়ি ফিরেই গলা উঁচিয়ে ডাকল,

‘ নীরা? এক কাপ চা।’

নীরা রান্নাঘরে ছিল। তখন প্রায় এগারোটা বাজে। শাশুড়ী মা রান্নাঘর গোছানোর দায়িত্বটা নীরার কাছে গছিয়ে দিয়ে ঘুমোতে যাচ্ছেন মাত্র। নীরা চুপচাপ চুলোয় চা বসাল। জাহানারা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বিস্ময় নিয়ে নিজের ঘরের দিকে তাকাল নীরা। এই সময়ে চা? রাতের খাবারের আগে চা খায় কেউ? নীরা বিস্ময়াভাব নিয়েই ঘরে গেল। চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো অন্তু। তোয়ালেতে চোখ-মুখ মুছে নীরার সামনে দাঁড়াতেই নীরার মনে হলো, অন্তুর স্বাস্থ্য কিছু বেড়েছে। চোখে-মুখে সুস্বাস্থ্যের লক্ষ্মণটা দৃঢ় হয়েছে। নীরা শুনেছিল, বিয়ের পর মেয়েদের স্বাস্থ্য হয়। রূপবতী হয়। তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন হলো কেন? অন্তু টেবিলের ওপর থেকে একটা নোট খাতা এনে নীরার হাতে দিল। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,

‘ পড়াশোনা একেবারে বাদ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে নাকি মাথায়? পড়াশোনা করতে তো দেখি না। ফাইনালে লাড্ডু পেলে নমু আর নাদিম আমারে গালি দিতে দিতেই মেরে ফেলবে। ওদের বধ্যমূল ধারণা, আমি তোকে ভয়াবহ অত্যাচার করি। গিয়ে ফ্রেশ হ, তারপর নোট নিয়ে পড়তে বস। পরীক্ষার হলে হাসবেন্ড হিসেবে কোনো বেনিফিট আশা করিস না। আমি তোকে কিচ্ছু দেখাব না। লাস্ট পরীক্ষায় তুই আমার সাথে যে বাটপারি করছিস, আমি কিন্তু ভুলি নাই। রিভেঞ্জ।’

নীরা হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল। পরীক্ষায় সে নিজে লিখে শেষ করতে না পারলে নীরার কী দোষ? নীরা তো দেখিয়েছিলই। দেখাতে পাঁচ মিনিট দেরী হয়েছিল এই যা! পাঁচ মিনিটে কী এমন হয়? নীরা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ খাবার দিই আগে। রাতের খাবার?’

অন্তু বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমার খাবার আমি নিয়ে খেতে পারব। আম্মা জেগে না থাকলেই হলো। তুই খেয়েছিস?’

নীরা চোখ তুলে তাকাল। অন্তু বুঝে ফেলল, নীরা খায়নি। এই মহিলার বরের প্রতি প্রচুর প্রেম। একা একা খেতে বসলে তার গলায় আটকায়, পাকস্থলীতে আটকায়, হজমেও আটকায়। অন্তু নীরাকে ধমকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে নিজেই গেল রান্নাঘরে। যাওয়ার আগে হুমকি দিয়ে বলল,

‘ খবরদার ফ্রেশ হয়ে শাড়ি টাড়ি পরবি না। আমার মাইন্ড ডিস্ট্রেক্ট হয়ে গেলে কিন্তু এই জীবনে আর পড়া টড়া তোর হবে না।’

নীরা স্তব্ধ চোখে চেয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। জীবনে পানি ঢেলে না খাওয়া ছেলে নিজেই আজ প্লেট পরিষ্কার করল। রান্নাঘরের জিনিসপত্র যতটুকু পারা যায় গুছানোর চেষ্টা করে খাবার নিয়ে রওনা দিল ঘরে। নীরা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। গায়ে তার গোলাপী রঙের পাতলা শাড়ি। অন্তু কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল। এই মেয়ের সমস্যা কী? ইচ্ছে করে এমন ব্যবহার করে নাকি তার সাথে? যা নিষেধ করবে তাই পরে পরে সামনে এসে যাবে বারবার, বেয়াদব। অন্তু খাবার নিয়ে বিছানায় বসল। নীরাকে বসতে ইশারা করে বলল,

‘ এখানে বোস এবং মাঝারি আওয়াজে পড়। আমার কান পর্যন্ত যাওয়া জরুরি। পড়ে মনে থাকছে না। শুনলে মনে থাকবে। স্পষ্ট, সুন্দর করে পড়বি। এখন হা কর।’

নীরা ‘হ’ করল। খাবার কিছুটা চিবিয়ে নিয়ে মোটামুটি জোরে পড়ার চেষ্টা করল। অন্তু নিজেও খেল এবং মনোযোগ দিয়ে শুনল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল অন্তু। তারপর ফিরে এসে সটান নীরার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল সে। নীরা বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়ছিল। অন্তুর এহেন কাজে কিছুটা চমকে তাকাল। নীরার হাতের নোটটা ছিনিয়ে নিয়ে টেবিলের উপর ছুঁড়ে মেরে বলল,

‘ বহু পড়ছিস। আর পড়া লাগবে না। শাড়ি পরতে মানা করেছিলাম, পরেছিস। মনকে বলেছিলাম ডিস্ট্রেক্ট হোস না, হয়ে গিয়েছে। কেউ কথা শুনেনি। কেউ কথা রাখেনি। এখন কিচ্ছু করার নেই।’

নীরা হেসে ফেলল। অবচেতন মনেই ডানহাতটা রাখল অন্তুর চুলে। নীরার শাড়ির আঁচল হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে হঠাৎই বলল অন্তু,

‘ এই নীরু? শিপনকে চিনিস?ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ছেলেটা। দূর্দান্ত বিতর্ক করত যে? মনে আছে?’

নীরা একটু ভেবে বলল,

‘ হ্যাঁ। হ্যাংলা-পাতলা ফর্সা মতোন না? আমাদের এক জুনিয়রের সাথে বোধহয় প্রেম ছিল ওর। নমু বলেছিল একবার।’

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ। ওইটাই। প্রেম ছিল কী? বিয়ে করে ফেলেছে ওরা। পালিয়ে বিয়ে। আমাদের বিয়ের চার পাঁচ মাস আগেই বিয়ে করেছে। শপিনের সাথে দেখা হয়েছিল আজ। এতো ভালো একটা স্টুডেন্ট। অলওয়েজ টপ করতো। অনার্স, মাস্টার্সটা কমপ্লিট করলেই লেকচারার হয়ে যেতে পারত। মাত্র দুটো বছরের অপেক্ষা। এর মধ্যেই একটা স্ক্যান্ডেল করল। বিয়ে তো করেছেই, বউ নাকি প্রেগন্যান্ট। ছয় মাস চলে। টিউশনিও নাই। খরচ জোগাতে হিমশিম খেয়ে গার্মেন্টেসে চাকরি নিয়েছে এবার। পরীক্ষাও খারাপ করেছে। দুটোতে ব্যাক লক। ক্যারিয়ারটা একদম শ্যাষ। ব্যাপারটা শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল।’

নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ এখনই পালিয়ে বিয়ের প্রয়োজন কী ছিল? ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছে বেচারা।’

‘ মেয়ের নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল অলমোস্ট। শপিনকে নিয়ে ভীষণ পসিসিভ সে। পাগলামো করছিল, মরে টরে যাবে। আমার কথা হলো, বিয়ে করেছে ঠিক আছে। কিন্তু এখনই বাচ্চা নেওয়ার কী দরকার ছিল? ক্যারিয়ারটা শেষ করল।’

‘ অতোকিছু কী খেয়াল থাকে?’

অন্তু অসন্তোষ কন্ঠে বলল,

‘ থাকবে না কেন? এখন বাচ্চার ভবিষ্যতেরই বা কী হবে? এক্সিডেন্টলি হলেও তৎক্ষনাৎ একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। একটা নতুন জীবন…’

নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, উত্তর দিল না। অন্তুর অনবরত বলে যাওয়া কথাগুলো শুনে চলল এক মনে।

_

তারপরের দিনগুলো খুব দ্রুত কাটল তাদের। ভার্সিটিতে শুরু হলো সেমিস্টার ফাইনাল। পরীক্ষার হলগুলো একই থাকলেও প্রত্যেকবারের মতো একে অপরকে ফোন দিয়ে অযথা চিন্তা ঝাড়া হলো না। লাইব্রেরিতে বসে নোট বানানো হলো না। হৈ-হুল্লোড় হলো না। আড্ডার সময় হলো না। পরীক্ষার হলে একটু আধটু দেখা। একটু আধটু দৃষ্টিবিনিময় হতে লাগল শুধু। পরীক্ষা শেষে ক্যান্টিনে বা টিএসসিতে বসা হলো না। ঘন্টার পর ঘন্টা গান, আড্ডা দেওয়া হলো না। সবাই ব্যস্ত তখন নিজ নিজ জীবন গতিতে। অতো আড্ডার সময় কই? নীরার সংসারে বিস্তর কাজ, দু’দন্ড বসার সময় কই? অন্তুর টিউশনি, চাকরির পড়া। নম্রতার বিয়ে নিয়ে তোড়জোড়। আরফানকে সময় দেওয়ার তাড়া। নাদিম নিজের মতো ছন্নছাড়া, উদাসীন। সাইম ততদিনে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমিয়েছে। ছোঁয়ার জন্য রেখে গিয়েছে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার ব্যস্ততা। দেশ থেকে পত্রপাঠ বিদায় নেওয়ার আগে একটা প্রিপারেশন আছে না? এতো এতো ব্যস্ততার মাঝে বন্ধুত্বের বিকেলগুলো হয়ে উঠল নিঃসঙ্গ, রঙহীন, ফিকে। ক্যান্টিন, লাইব্রেরির চেয়ারগুলো পড়ে রইল ফাঁকা, উদাসীন।কেটে গেল একের পর এক দিন। হারিয়ে গেল উচ্ছলতা। মলিন হলো হাসি। কমে গেল দুঃখ-সুখ ভাগাভাগির গল্প। পরীক্ষাটাও ফুরিয়ে গেল। শেষ হয়ে গেল ভার্সিটি জীবনের দীর্ঘ চার বছর। ফুরিয়ে এলো কী তবে দীর্ঘ বন্ধুত্বের গল্প?

#চলবে…

সকল পর্বের লিংক-

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=221556623104091&id=100057492638003

[ রি-চেইক করা হয়নি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here