নীড় পর্ব-১৬

0
1336

নীড়
রেশমী রফিক
১৬।।
শফিকুল চৌধুরী যখন স্বর্ণপাতার থালায় পৌঁছুলেন, রেস্টুরেন্টের সামনে তখন বিশাল ঝামেলা চলছে। এলাকাবাসী এতক্ষণ কেবল রেস্টুরেন্ট ঘেরাও করে রেখেছিল। যখন এলাকার বড় ভাই বাইরে এসে তাদেরকে বললেন, এভাবে ঘেরাও করে লাভ হবে না কোনো। পুলিশ কিছু করতে পারবে না। কারণ তাদের হাত-পা আইনের কাছে বাঁধা। পরিস্থিতি কতটা বেগতিক, বুঝলেও যা কিছু করার, নিয়মের মধ্যে করতে হবে। এরপর এলাকাবাসীর ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়েছে। পুলিশ না হয় আইনের কাছে বন্দি। তারা তো নয়! দরকার পড়লে জেল খাটবে। চাঁদা তুলে স্বনামধন্য কোনো উকিল নিয়োগ করবে, তবু এই অনাচার সহ্য করবে না। এই বড়লোকের কন্যা টাকাপয়সা ঢেলে কতদূর কী করতে পারে, করুক! এলাকাবাসীর ক্ষমতাও তার দেখার দরকার আছে। জানার দরকার আছে, জীবনে অর্থই সবকিছু নয়। ইতোমধ্যে কয়েকজন সাংবাদিককে খবর দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে। তারা এলাকাবাসীর পক্ষে নিউজ কভার করবে। শারার-তুবাকে রেস্টুরেন্টের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে স্বর্ণ। পুলিশও তার পক্ষে কথা বলছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে কালক্ষেপণ করছে, যাতে সমস্ত প্রমাণাদি লোপাট করতে সুবিধা হয়। এলাকাবাসীর প্রতিনিধিকে আইনের ভয় দেখানো হচ্ছে। অথচ পুলিশ নিজে কতদূর আইন মানে, সেটাও কারও অজানা নেই। যা হোক, এতক্ষণে এলাকাবাসীর বুঝা হয়েছে পুলিশ ডেকে আনার ব্যাপারটা আসলে নাটক মাত্র।
এসআই মশিউর ফোনে সমস্ত আপডেট জানালেন ওসিকে। উপরমহল থেকে বারবার ফোনকল আসছে। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না সহজে। স্বর্ণকে তার রেস্টুরেন্টসমেত উচ্ছেদ না করে তারা রাজপথ ছাড়বে না। প্রকৃতপক্ষে এলাকাবাসীর নামে কতিপয় ছোকরা এই অভিযানে নেমেছে। এসআই মশিউর রেস্টুরেন্টের ভেতর জিজ্ঞাসাবাদ চালালেও ওসি চুপচাপ বসেছিলেন না। সাদা পোশাকে পুলিশ পাঠিয়ে এলাকার বেশ কয়েকটি বাসার মালিকের সাথে কথা বলেছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে একটা লিখিত চিঠি আদায় করা হয়েছে এই মর্মে, স্বর্ণপাতার থালা নিয়ে তাদের কারওই কোনো আপত্তি নেই। বরং কয়েকজন জানালেন, এলাকার এমন একটি রেস্টুরেন্ট চালু হবার পর সপ্তাহে অন্তত একদিন সপরিবারে সেখানে খেতে যাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে বাসায়। ছেলেমেয়েরা তো বটে, স্ত্রীও অপেক্ষায় থাকেন ছুটির দিনের। প্রতি শুক্র-শনিবার যে কোনো একদিন ওখানে খাওয়া হয়। তাছাড়া, রেস্টুরেন্টের সার্ভিস ভালো। তাদের ডেলিভারি সার্ভিস না থাকলেও অনেক সময় দেখা যায়, এলাকার মধ্যে কেউ ফোনে অর্ডার করলেও স্টাফদের কাউকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ করে, এলাকার পরিচিত মুখ যারা।
স্বর্ণর নামেও ইতিবাচক কথা শোনা গেল। রেস্টুরেন্টের মালিক হলেও তার ব্যবহার খুবই আন্তরিক। স্টাফদের সাথে নিজেও কাজ করে। রান্না তো তারই করা, এর বাইরেও প্রায়ই তাকে রেস্টুরেন্টের ডাইনে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। কখনো সদর দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে কাস্টমারের। কেউ ভেতরে এলে সাদর সম্ভাষণ জানায়। এছাড়াও, প্রতিটি টেবিলে গিয়ে হাসিমুখে কথা বলা, কিছু লাগবে কি না জানতে চাওয়া এগুলো তার অবসর সময়ের রুটিন। এক ভদ্রলোক জানালেন, গত সপ্তাহে স্বর্ণপাতার থালায় খেতে গিয়ে মালিকের সাথে কথোপকথনের সুযোগ হয়েছিল। সেসময়ই তিনি জানতে পেরেছেন স্বর্ণর পরিবার সম্পর্কে। স্বর্ণর বাবা একজন শিল্পপতি হলেও তার মধ্যে নাক-উঁচু স্বভাব নেই। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার সাথে সমানভাবে মিশেন। ভদ্রলোকের চাচা একসময় চাকুরি করেছেন স্বর্ণর বাবার অফিসে। সে সুত্র ধরেই স্বর্ণর বাবার সম্পর্কে খানিক জানাশোনা আছে। চাচা এখন আর বেঁচে নেই। ফ্যাকটরিতে কর্মরত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার অসহায় পরিবারের পাশে আত্মীয়স্বজন কমবেশি থাকলেও শক্ত ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্বর্ণর বাবা নিজে। তারই অফিসে চাকুরি দেয়া হয়েছে ভদ্রলোকের চাচাত ভাইকে। ছেলেটা তখন অনার্সে পড়ছিল। প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে ফ্যাকটরিতে যেত। সুপারভাইজার হাতে ধরিয়ে কাজ শেখাত। এখন সেই ছেলে ফ্যাকটরির ম্যানেজার পদে চাকরি করছে। এছাড়াও চাচিকে বেশ বড়সড় অঙ্কের টাকা দেয়া হয়েছিল যাতে ভরণপোষণে কোনোরকম সমস্যা না হয়। স্বর্ণর বাবার কোম্পানিতে প্রতিটি কর্মচারীকে বাধ্যতামুলক লাইফ ইন্স্যুরেন্স করতে হয়, যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হবে। প্রতি মাসের বেতন থেকে সেই কিস্তি পরিশোধ করে কোম্পানী নিজে। যদি কেউ মারা যায়, তাহলে সেই টাকা তুলে দেয়া হয় পরিবারের হাতে। আর যদি মারা যাবার আগেই চাকুরি থেকে অবসর নেয়, তখন ইন্স্যুরেন্সের টাকাটা প্রফিডেন্ট ফান্ডের সাথে বাড়তি হিসেবে পাওয়া হয়। স্বর্ণর বাবার অফিসে কর্মরত প্রতিটি মানুষ তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। স্বর্ণ নিজেও বাবার এই ধাত পেয়েছে। তাকে দেখে কেউ বলবে না এই রেস্টুরেন্টের মালিক। তেমনি কর্মচারীদের সাথে ব্যবহার খুবই আন্তরিক। তাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি তার কড়া নজর।
আরও তদন্ত করে জানা গেল, স্বর্ণপাতার থালার উপর ক্ষোভটা আসলে রাজনৈতিক স্বার্থ মেশানো। এই এলাকার এমপি হচ্ছেন সরকারি দলের। আর স্বর্ণর বাবার উঠাবসা বিরোধী দলের সাথে। বিরোধী দলের চেয়ারপারসনের ভাতিজার সাথে স্বর্ণর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। স্বভাবতই স্বর্ণর বাবার উপর রাজনৈতিক আক্রোশ থাকবে। তারই মেয়ে যখন সরকারি দলের এমপির এলাকায় রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করতে এসেছে, তাকে তো একটু হলেও যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। কিন্তু স্বর্ণ শুরু থেকে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তার অনুগত বাহিনীর সাথে এমপির ছেলেপেলেদের বারকয়েক মারামারিও হয়েছে। ব্যাপারটা তাই এখন আর সহজ পর্যায়ে নেই।
সাদা পোশাকের পুলিশি তদন্তে যখন সরকারি এমপির নাম বের হয়ে এলো, ওসি কিংকর্তব্যবিমুঢ় ভঙ্গিতে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। রাজনৈতিক বিবাদের এই পর্বটা তার অজানা ছিল এতকাল। স্বর্ণর বাবার সাথে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার আলাপ হলেও রাজনৈতিক চালটা সামনে আসেনি ভুল করেও। স্বর্ণর বাবা কখনো হামবড়া কিছু জাহির করেননি নিজেকে। খুবই সদালাপী মানুষ। দামি গাড়িতে চলাফেরা করলেও কদাচিৎ দরজা খুলে পথভিক্ষুকদের কাতারে দাঁড়াতেও তার সময় লাগে না। এক সুত্রে শোনা যাচ্ছে, সামনের নির্বাচনে বিরোধী দলের মনোনয়ন তাকে দেবার চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। এখনো দলের পক্ষ থেকে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেয়া হয়নি। তবে প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। ঘটনা হচ্ছে, আজ উপরমহল থেকে যে ফোনকল এসেছে তা স্বর্ণর বাবার পক্ষ থেকে নয়। ফোন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবের সেক্রেটারি। স্বর্ণর সাথে তার ছেলের কোনোভাবে জানাশোনা আছে। সেই পরিচিতির সুত্র ধরে সে কল করে এখানের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছিল। তারপর ছেলে তার বাবাকে বলেছে। সেক্রেটারির নির্দেশ, যতদ্রুত সম্ভব এলাকাবাসীকে হটানো হোক। এবং ভবিষ্যতেও যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সেই হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে।
ওসি এবার নিজে রেস্টুরেন্টে পা দিলেন। উত্তেজিত জনতা খানিক ঝিমিয়ে পড়েছিল, অপরপক্ষ থেকে কোনোরকম সাড়া না পেয়ে। পুলিশের গাড়ি দেখামাত্র তাদের হৈ-চৈ বেড়ে গেল। ওদিকে শফিকুল চৌধুরীও এসেছেন। তার পরিচয় সেভাবে কেউ জানল না। পুলিশের গাড়ির পেছনে তার গাড়িটা থেমেছে। তিনি সরাসরি ওসির সাথে কথা বললেন। নিজের পরিচয় দিলেন শুরুতে। এরপর ব্যাখ্যা করলেন আসার কারণ।
ওসি প্রথমে বিস্মিত হলেন। কারণ একের পর এক ক্ষমতাশালী লোক কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এই রেস্টুরেন্টকে ঘিরে। প্রথমে স্বর্ণর বাবা, এরপর স্বর্ণর বন্ধুর বাবা, এখন আবার আরেকজন! শারারকে তিনি চেনেন না। তাই নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না। তবে শফিকুল চৌধুরীকে সাথে নিয়ে গেলেন ভেতরে। এসআই মশিউর তাকে দেখে বলল,
– স্যার, চলে এসেছেন! ভালো হয়েছে খুব। এখানে তো ভেজাল আরও বেশি প্যাঁচ খেয়ে গেছে। বুঝতে পারছি না কী করব।
– কীরকম?
– এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ এসেছিলেন। তাকে আমি ঠিকমতোই কনভিন্স করেছিলাম। উনি এখান থেকে বের হবার সময় বলে গেছেন, বাইরের লোকজনদের শান্ত করবেন। কিন্তু তারা এখন উনাকেও মানছে না। উনি বিষয়টা বুঝিয়ে বলার পর আরও ক্ষেপে গেছে। ওদের দাবি, এই রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদ করতে হবে। আমি বুঝলাম না…
– আমি বুঝতে পেরেছি মশিউর। তোমাকে এখানে পাঠিয়ে আমি আরও কিছু কাজ সেরে নিয়েছি। কারণ ফোনকল এসেছে অনেক উপর থেকে। সচরাচর তারা ফোন করেন না খুচরো ঝামেলায়। কিন্তু এই রেস্টুরেন্টের বেলায় করেছেন। এবং এই ঝামেলার পেছনে কে বা কারা আছে, সেটাও ফাইন্ড আউট করা গেছে। সমস্যা কী জানো? দুই পক্ষই একই দলের।
– মানে?
– মানেটা পরে বুঝিয়ে বলছি। এখন অত কথা বলার সময় নেই। ভিকটিমরা মানে যাদের আটকে রাখা হয়েছে, তাদের কী অবস্থা?
– মেয়েটা মেন্টাল শকে আছে, স্যার। ঠিকমতো কথা বলছে না। পুলিশ দেখলেই ভয় পেয়ে শারারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
– শারার কে?
শফিকুল চৌধুরী নিজেই উত্তর দিলেন,
– আমার ছেলে। ওকে খুঁজতেই এসেছি।
এসআই মশিউর বললেন,
– শারারের সাথে কথা হয়েছে, স্যার। ও বলল, তুবা মানে ওই মেয়েটাকে নিয়ে এখানে লাঞ্চ করতে এসেছিল। গাড়িটা পেছনদিকে পার্ক করার পর পরই লোকজন ওদের অ্যাটাক করেছে। মেয়েটাকে অ্যাবিউজ করার চেষ্টা করেছিল। গাড়ি লকড ছিল বলে অতটা সুবিধা করতে পারেনি। যা গেছে, গাড়ির উপর দিয়েই। পুরা ভেঙ্গেচুরে শেষ।
– এখন এদের বক্তব্য কী? এরা ঝামেলা করছে কেন? সমস্যা রেস্টুরেন্ট নিয়ে। ওদেরকে আটকে রেখেছে কেন?
– ওদের কমপ্লেইন, মিস স্বর্ণ মানে রেস্টুরেন্টের মালিক অসামাজিক কাজকর্মের ইন্ধন দেয়। শারার আর তুবা এর সাথে জড়িত। ওদেরকে নাকি আপত্তিকর অবস্থায় পাকড়াও করেছে।
– আপত্তিকর? কীরকম?
– মানে স্যার, জামাকাপড়ের ঠিক ছিল না। আর বুঝতেই পারছেন একটা ছেলে আর একটা মেয়ে গাড়ির ভেতর… এখন তারা বলতে শুরু করেছে, শারার নাকি একেকদিন একেকটা মেয়ে নিয়ে আসে। এর সাথে মিস স্বর্ণ জড়িত। এই মেয়েগুলোকে নানান কথায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে আসা হয়। এরপর কাস্টমার মানে নানা ধরনের নানা বয়সের ছেলেরা আসা-যাওয়া করে খেতে আসার নামে। শারার আর মিস স্বর্ণ মিলে রেস্টুরেন্ট বিজনেসের আড়ালে অল্পবয়সী মেয়েদের…
শফিকুল চৌধুরী গর্জে উঠলেন,
– অসম্ভব। আমার ছেলে এমন কাজ করবে না কখনো।
– স্যার সেটা তো পাবলিক বুঝতে চাইছে না। এদের মুল ইস্যু অন্যকিছু। এরা মিস স্বর্ণর পেছনে লেগেছে। আপনার ছেলে আর ওই মেয়েটা জাস্ট ভিকটিম।
ওসি বললেন,
– ওদের মধ্য থেকে রেস্পন্সিবল কাউকে নিয়ে আসো। স্পেসিফিক করে বলো, এমপির লোকের সাথে কথা বলতে চাই আমি। আর মিস স্বর্ণ কোথায়?
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here