নীড় পর্ব-২৫

0
1158

নীড়
রেশমী রফিক
২৫।।
অবশেষে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দেনমোহরে শারার আর তুবার বিয়ে সম্পন্ন হলো। কোনোরকম জাঁকজমক ছাড়াই। তুবা শাড়ি পরতে চায়নি প্রথমে। কান্নাকাটি করছিল খুব। ভয়ে তার আত্মা খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। আজকের এই ঘটনা বাসায় জানাজানি হলে কী তুফান আসবে, তা আর বলতে। শেফালি ওকে মেরেই ফেলবেন বোধহয়। কায়মনোবাক্যে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছিল সেই কখন থেকে। কাজি আসার আগপর্যন্ত আশপাশের কোনোকিছুই তার ধর্তব্যে ছিল না। সাইফুলের নাম শোনার পর তার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেছে। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। স্বর্ণ ওকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে কয়েকবার। লাভ হয়নি। শফিকুল চৌধুরীও একবার সতর্কবার্তা দিয়ে গেছেন। এরপর সাইফুল ওকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করিয়েছে। ঘটনা শুনে তার নিজেরও আক্কেলগুড়ুম হয়েছে। শারার আর তুবার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আছে, ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। যদিও শারার অস্বীকার করেছে বিষয়টা। তুবা কান্নার প্রবল দমকে কথা বলতে না পারলেও ডানে-বায়ে মাথা নেড়েছে। দুজনই বলেছে, তাদের মধ্যে কোনোরকম সম্পর্ক বা ঘনিষ্ঠতা নেই। তাহলে আজ দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করার বিষয়টা কীভাবে এলো? এই প্রশ্নের উত্তর তারা কেউ ঠিকঠাক দিতে পারেনি। শারার একটু-আধটু বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গুছিয়ে বলার সুযোগ পায়নি।
এদিকে পরিবেশ ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এমপির লোকজন যখন বিয়ের কথা জানল, তারা রীতিমতো ভেটো দেবার পাঁয়তারা করছিল। কিন্তু উপস্থিত লোকজন তাতে খুব একটা সায় দেয়নি। সাদা চোখে আজকের এই ঘটনার সমাধান বিয়ে ছাড়া উপযুক্ত আর কিছু হতেই পারে না। এই বিয়েটা একটা জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে এলাকায়। আর কোনো যুবা-যুবতী ছেলেমেয়ে এখানে নোংরামির উদ্দেশ্যে আসার সাহস করবে না।
শফিকুল চৌধুরী বিরক্ত হচ্ছিলেন ছেলের গোয়ার্তুমি দেখে। শারার কিছুতেই পোষ মানছিল না। সে বিয়ে করবেই না। পাঞ্জাবির প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলেছে মেঝেয়। অতঃপর তিনি কৌশলী হলেন। ছেলেকে একপ্রকার হুমকি দেয়ার পর পরিস্থিতি অনুকূলে এসেছে। যদিও হুমকি পাবার পরও শারার পাঞ্জাবি পরেনি। ঘাড় গোঁজ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল। তিনিও ওকে আর ঘাটাননি। পাঞ্জাবি পরাটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। তুবার সাইফুলকেও পাঠিয়েছিলেন তুবার সাথে কথা বলতে। বেশি সময় লাগল না এরপর। পঞ্চাশ লক্ষ টাকা কাবিন নির্ধারণ করেছেন তিনিই। এর পেছনে একটা কারণ আছে। বলা ভালো, একটা কৌশল খাটিয়েছেন। বিয়েটা আজীবনের নয়। চৌধুরী বংশের একমাত্র ছেলের বউকে অবশ্যই আর দশটা মেয়ের চাইতে আলাদা হতে হবে। সামাজিকভাবেও সমান কিংবা আরেকটু উচু হওয়া জরুরি। মেয়ের পরিবারের বংশমর্যাদা আর সামাজিক অবস্থান বিবেচনার পরও মেয়ের কিছু গুণ আর শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকাও জরুরি, যাতে শারারের সমপর্যায়ের হয়। তুবা কিংবা ওর পরিবার এর ধারেকাছে নেই। শফিকুল চৌধুরীর শ্বশুরবাড়ির সাথে তাদের আত্মীয়তা তৈরি হলেও চৌধুরী বাড়ির সাথে তারা বেমানান। স্বভাবতই কিছুদিন বাদে তালাকের প্রসঙ্গ উঠে আসবে। ওই সময়ে যেন তুবাদের পরিবার থেকে কোনোরকম আপত্তি না আসে, তারা যেন এই বিয়ের কোনো সুযোগ নিতে না পারে, বিয়েটাকে ইস্যু বানিয়ে কোনো ফাঁদ যেন তৈরি করতে না পারে, সেজন্যই মোটা অঙ্কের কাবিন করা হলো। আজকালকার সমাজে টাকাই মূল কথা। টাকা থাকলে অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলা যায় নিমেষেই। এই টাকাই তুবাদের মুখ বন্ধ করবে।
শারারকে তিনি যতই জোরজবরদস্তি করেন না কেন, ছেলে তার একমাত্র। ওর মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করার মতো বাবা তিনি নন। এই মুহূর্তে শারার হয়তো তাকে ভুল বুঝছে। সেটাই স্বাভাবিক। এই বয়সে কেউ ভেবেচিন্তে সামনে পা বাড়ায় না। শরীরের রক্ত গরম, বিধায় চট করে মাথা গরম হতে সময় লাগে না। ফলাফলে খুব বাজেভাবে ফেঁসে যাবার সম্ভাবনা থাকে। আজকের এই বিয়েটা নিয়ে তার মনে অনেক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরে একসময় ঠিকই উপলব্ধি করতে পারবে তারা বাবা কতটা সঠিক ছিলেন, মাথা কতটা ঠান্ডা রেখে, হাজার চিন্তাভাবনা মনের মধ্যে আড়াল করে এই বিয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
কেবল এতটুকু না, প্ল্যান বিও প্রস্তুত করে ফেলেছেন মনে মনে শফিকুল চৌধুরী। যদি তুবার পরিবার যদি দেনমোহর বাবদ পুরো টাকা পেয়েও সন্তুষ্ট না হয়, তখন কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটাও ছক কষে রেখেছেন। সময় মতো দাবার গুটি চেলে দেবেন। পুরো পরিবার তখন লেজ গুটিয়ে পালাবে। দিবা-সাইফুলের বিয়ের সময়েই এদের হালহকিত তার জানা হয়ে গেছে। সাইফুলের মতো ছেলেকেই এরা পাগল বানিয়ে ফেলেছে বিয়ের জন্য। শারার সেই তুলনায় দুধে-ভাত বলা চলে।
বিয়ে সম্পন্ন হবার পর শফিকুল চৌধুরী মিষ্টি আনতে পাঠালেন কাশেমকে। ভালোয়-ভালোয় আসন্ন বিপদ কেটে গেছে। এমপির লোকজনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারার পর থেকে কেবলই ঘাম বের হচ্ছিল। স্বর্ণর সাথে তাদের ঝামেলা। সেই ঝামেলাকে জোরদার করতে একজোড়া নিষ্পাপ ছেলেমেয়ের জীবনকে গুটি বানিয়ে যারা খেলতে নামার পরিকল্পনা করে, তাদের চেয়ে ভয়ঙ্কর এই দুনিয়াতে আর কেউ হয় না। কেবল শারার নয়, তুবাকে নিয়েই ভয়টা ছিল বেশি। না হোক নিজের মেয়ে, তবু কারও সন্তান। তিনি চাইলে এই মেয়েকে ফেলেই সটকে পড়তে পারতেন শারারসমেত। তারপর যা হতো, তাতে স্বর্ণ কোনোভাবে উৎরে যেতে পারলেও তুবাকে শিকার করা হতো সহজেই। কার না কার মেয়ে, জাহান্নামে যাক। তাতে তার মাথা ঘামানোর কথা নয়। কিন্তু কেন জানি মেয়েটার প্রতি এক ধরনের মমতা অনুভব করেছেন। মেয়েটাকে থরথর করে কাঁপতে দেখে তার মন বলেছে, বাবা না হয়েও ওর দায়িত্ব এই মুহূর্তে তার উপর বর্তায়। তাছাড়া, শারারের সাথে এসেছে সে। বলা ভালো, শারারই ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। অতএব, মেয়েটা অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও শারারের দায়িত্ব। তিনি এই দায়িত্বটাই নিজের কাঁধে নিয়েছেন। একারণেই মূলত বিয়ের বিষয়টা মাথায় এসেছে। নয়তো এদের দুজনকে নিয়ে এখান থেকে বের হবার পথ বন্ধ ছিল প্রায়।
স্বর্ণকেও একা ছেড়ে দেননি। মুখে যাই বলেন না কেন, তলে তলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন। ডিএমপিতে চাকুরিরত এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলেছে বিশদভাবে। এছাড়াও, স্বর্ণর বাবার কাছে খবর পৌঁছানোর কাজটা তিনিই সেরেছেন। ভদ্রলোকের সাথে ফোনে কথা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তিনি এই মুহূর্তে দেশের বাইরে। তবে তার লোকজনকে বলা হয়েছে। তারা স্বর্ণকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার মিশনে নেমে পড়েছে ইতোমধ্যে। কীভাবে কী হয়েছে, বা হচ্ছে শফিকুল চৌধুরী জানেন না। তাকে শুধু এতটুকু বলা হয়েছে, স্বর্ণর উদ্ধারকারীরা ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পালটা জবাব দেয়ার আগে শারার আর তুবাকে নিয়ে যেন তিনি বের হয়ে যান।
বিয়ে সম্পন্ন হবার পর পরই শারার-তুবাকে গাড়িতে তুলে দেয়া হয়েছে। শফিকুল চৌধুরীর গাড়ি নয়, স্বর্ণর বাবা নিজে গাড়ি পাঠিয়েছেন। তার মতে, ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলেও বিক্ষিপ্ত জনতা ওদের উপর হামলা করতে পারে। তাই সাধারণ গাড়িতে ওদের চড়া ঠিক হবে না। তিনি তার লোকজনের মাধ্যমে একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি পাঠিয়েছেন। গাড়িটা বর-কনেকে শফিকুল চৌধুরীর বাসায় পৌঁছে দেবে। গাড়ির সাথে বিশ্বস্ত ড্রাইভার থাকলেও শফিকুল চৌধুরী কাশেমকে ওদের সাথে দিয়েছেন। তাকে বলা হয়েছে, গাড়িটা ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে খানিক দূরে বিশ্বরোডের কোনো এক জায়গায় থামাবে। শফিকুল চৌধুরী এখানকার ঝামেলা চটজলদি সেরে নিজ গাড়িতে চড়ে রওনা হবেন। দুটো গাড়ি একসাথে পৌঁছুবে বাসায়। শারার-তুবা বাড়ির ভেতর ঢোকামাত্র বিশাল কুরুক্ষেত্র তৈরি হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শারারের মা লুৎফুন্নেসা সহজে হজম করবে না বিষয়টা। এই পরিস্থিতিতে তার নিজের উপস্থিত থাকাটা জরুরি। সাইফুলকে আগেই নিষেধ করেছেন, বাড়ি পৌঁছে যেন কাউকে কিছু না বলে। তিনিই সবার আগে দিবার সাথে এই প্রসঙ্গে কথা বলবেন। এরপর দিবার বাবা-মাকে ডেকে আনা হবে। কোনোরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে, সেজন্য প্রতিটা পদে তিনিই আগে কদম ফেলতে চান।
সাইফুল মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে। তবে তার আগে একটা সমস্যা হয়ে গেছে। এখানে পৌঁছুনোর পর দিবা কল করেছিল তাকে। বলল, কী একটা জরুরি কাজে বাবার বাসায় যাচ্ছে। কাজটা কী, সেভাবে কিছু বলেনি। সাইফুলও জিজ্ঞেস করেনি। ফুপা ডেকে এনেছেন, এই টেনশনে মাথা আউলে ছিল তখন। পরবর্তীতে তুবাকে এই রেস্টুরেন্টে দেখার পর পরই তার মাথা পরিস্কার হয়ে গেছে। দিবা কেন বাবার বাড়ি যাচ্ছে এই অসময়ে, তাও অনুমান করতে কষ্ট হয়নি। তখনই কোনো এক মুহূর্তে দিবাকে কল করে জানিয়েছে তুবার কথা। এখানে কী ঘটেছে, তাও অল্পসল্প বলেছে। দিবাকে নিষেধ করেছিল, জরুরি কাজটা তুবা সংক্রান্ত হলে যেন আগেভাগে শ্বশুর-শাশুড়িকে কিছু না জানায়। তুবা এই রেস্টুরেন্টে কীভাবে এলো, কেন এখানে এসে আটকা পড়েছে, এইসব প্রশ্নের উত্তর তখনও ভালোমতো জানা হয়নি তার। শফিকুল চৌধুরী তখন কাজি সাহেবের সাথে কথা বলছিলেন। সাইফুলকে কেবল তুবার উপস্থিতির কথাটাই জানিয়ে ছিলেন। সেকারণে দিবাকে আশ্বস্ত করেছিল, আগে সবটা তার আগে জানা হোক। তুবাকে নিয়েই সরাসরি শ্বশুরবাড়িতে যাবে সে। এরপর সম্পূর্ণ বিষয়টা সবার সামনে বসে ব্যাখ্যা করবে। নয়তো জনকে জন কথা চালাচালি হলে মূল বিষয়টা তিল থেকে তাল হয়ে যেতে পারে।
আদেশ-নির্দেশের নড়চড় হলে সহজে হজম করেন না ফুপা। তাকে যমের মতো ভয় পায় সাইফুল। তাই এক ফাঁকে দিবাকে কল করে বলল,
– তুমি এখনই কিছু বইলো না তোমার আব্বা-আম্মাকে। আমি আগে তুবাকে নিয়ে আসি বাসায়।
দিবা আতঙ্কিত সুরে বলল,
– কী হয়েছে, সাইফুল? আমাকে সবটা খুলে বলছ না কেন? তুবার তো কোচিংয়ে থাকার কথা ছিল। ও কীভাবে ওই রেস্টুরেন্টে গেল?
– শারারের সাথে গেছে।
– শারার? মানে কী? শারারের সাথে ওর দেখা হলো কীভাবে? আর কী ঝামেলা হয়েছে?
– দিবু, একটু ধৈর্য ধরো। আমি ফিরেই সবটা বলছি। এখন ফোনে অত কথা বলা সম্ভব না। ফুপা আছেন আশপাশে। উনি শুনলে ক্ষেপে যাবেন খুব। আমাকে পইপই করে নিষেধ করছেন যেন তোমাকে বা কাউকে কিছু না বলি।
– ফুপাজান আমাকে বলতে মানা করবেন কেন? তুবা আমার বোন। ওর কী হয়েছে, সেটা তো আমারই জানা উচিত।
– হ্যাঁ। কিন্তু ফুপা চাচ্ছেন উনি নিজে ম্যানেজ করবেন। উনি নিজেই ঘটনা বিস্তারিত বলবেন। এর আগে কেউ জানুক, এটা চাচ্ছেন না।
– আমি তাহলে বাবা-মাকে কী বলব? মা রীতিমতো কান্নাকাটি করছে ফোনে।
– তুমি গিয়ে মাকে বুঝাও। বলো যে, তুবা আমার সাথে আছে। কোচিং শেষ হবার পর আমি ওকে পিক করেছিলাম। এরপর এক জায়গায় নিয়ে গেছিলাম ঘুরতে। সেখান থেকে ফিরতে সময় লাগছে। রাস্তায় অনেক জ্যাম। ঠিক আছে? মাকে বলো, যত রাতই হোক আমি তুবাকে পৌঁছে দিব। তুমিও থাকো ওখানে। তুবাকে পৌঁছে দিয়ে আমরা একসাথে ফিরব নাহয়।
সাইফুল যতই আশ্বস্ত করুক, দিবার টেনশন যেন নামেই না। খানিকক্ষণ নিচের ঠোঁট চেপে ধরে চিন্তিত সুরে বলল,
– ঠিক আছে।
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here