নীড় পর্ব-২৪

0
1090

নীড়
রেশমী রফিক
২৪।।
মোট কথা, পরিস্থিতি অনেকটাই বেগতিক। শারার তুমি থেকে তুই-তে নেমে এসেছে। তুবার দিকে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে। এর মানে দাঁড়ায়, তুবার জীবন সে নরক বানিয়ে ছাড়বে। সমস্ত রাগ এই মেয়ের উপর ঢালছে সে। কেন? মেয়েটা কী করেছে গাড়ির ভেতর? তবে কি তুবাই সবকিছুর মূলে? সে নিজেই কি শারারকে প্রলুব্ধ করেছিল? স্বর্ণ বুঝতে পারছে না এদের হালচাল। তুবার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না, শারারকে সে দোষী ভাবে। উলটো শারারের কাছে আশ্রয় খুঁজছে। কিন্তু শারার ধর্তব্যে নেই। আশ্রয় দেবার বদলে সে দ্বিগুণ ক্রোধে ফুঁসছে। তবে কি তুবা এখন ভান করছে? যদি করে থাকে, তাহলে মানতে হবে অভিনয়ে সে ভালোই পারদর্শী। কান্নাকাটি করে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। নাকের পানি, চোখের পানি এক করেছে।
এদের এক কাঠি উপরে আছেন শফিকুল চৌধুরী, ওরফে শারারের বাবা। এই ভদ্রলোক এখানে এসে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে দিয়েছেন। এমপির সাথে দেখা করলেন, আরও কার-কার সাথে ফোনে কথা বললেন। শেষমেশ নিজ বুদ্ধিতে কাজি ডেকে এনেছেন। সাবালক ছেলেকে জোরজবরদস্তি বিয়ে দেবেন। তাও আবার সেই মেয়ের সাথে, যাকে তার ছেলে ভালোবাসে না।
শারার চোখ কটমট করে তাকাল। তুবা খানিকটা এগিয়ে এসেছিল। ওর অগ্নিদৃষ্টি দেখে আবার স্বর্ণর পেছনে লুকিয়ে গেল। শারার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। হয়তো আরও একদফা হুমকি-ধমক চলত। স্বর্ণর ইশারায় আর কথা বাড়াল না। কাশেমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– সাইফুলকে ডেকে আনতে পারবেন?
কাশেম ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
– স্যারের লগে বইসা আছে কাজি সাবের ধারে। অহন ডাকলে আবার যদি কিছু কয় স্যার। মিজাজ বেশি সুবিধার মনে অইল না।
– আচ্ছা, থাক। সাইফুলের এমনিতেও বেশিদূর দৌড়ানোর ক্ষমতা নাই। আপনি একটা কাজ করেন প্লিজ। আমাকে এখান থেকে বের হবার ব্যবস্থা করেন। আমি এই বিয়ে করব না। বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। ওর সাথে আমার কোনো রিলেশন নাই। আমি জাস্ট ওকে নিয়ে এসেছিলাম, আমার মনে হয়েছিল, স্বর্ণর এই রেস্টুরেন্টে বসে একসাথে খাওয়া-দাওয়া করা যাবে। দ্যাটস ইট! সেখানে এত কিছু হয়ে গেল। আর এখন বিয়ে! ইম্পসিবল।
– আমি ত বুঝবার পারতাছি। তয় স্যারে না বুঝলে কী করতেন? স্যারের সম্মানের বিষয় চলে আসছে।
– আব্বুকে আসতে বলছিল কে এখানে? আমি যে এখানে আছি, সেই খবর পেল কীভাবে? আমি তো বলিনি।
কাশেম চুপ করে রইল। শারারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার বিষয়টা খুব গোপনীয়। শফিকুল চৌধুরী বরাবরই হুঁশিয়ার করেছেন, যাতে এই ব্যাপারটা ছেলে কিছুতেই জানতে না পারে। আজকালের ছেলেমেয়েরা স্বাধীন চিত্তের। বাবা-মায়ের শকুনি দৃষ্টির বেড়াজাল তাদের পছন্দ না। উলটো হিতে-বিপরীত হবার ঘটনা ইদানীংকালে শোনা যায় অহরহ। শফিকুল চৌধুরী ছেলেকে বন্দিত্বের অনুভূতি দিতে চান না, আবার তাকে পুরোপুরি ছেড়ে দেয়াটাও তার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি কোনোকালে। ছেলে বড় হয়েছে, কিন্তু বুঝদার হয়নি। বরং এই সময়েই ভুলপথে পা বাড়ানোর প্রবণতা বেশি থাকে।
শারার উত্তরের আশা করল না। আবার জিজ্ঞেস করল,
– আপনি ব্যবস্থা করতে পারবেন?
কাশেম দুই হাত কচলাতে শুরু করল মাথা নিচু করে। যার মানে দাঁড়ায়, পারবে না। শারার হতাশ ভঙ্গিতে স্বর্ণর দিকে তাকাল। স্বর্ণ দু হাত তুলে না-বোধক ভঙ্গিতে বলল,
– আমি পারলে কি এতক্ষণ তুমি এখানে বসে থাকতা? না আমি এত ঝামেলায় পড়তাম? তোমার চিন্তা কীসের? পয়সাওয়ালা বাপ আছে। উনি তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন। সাথে বউ পাচ্ছ ফ্রি। তোমার তো আনন্দে লারেলাপ্পা হবার কথা। তা না করে এমন ভাব করতেছ যেন ফাঁসি দিচ্ছে! এইসব হাবভাব আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। বিয়ে করতেছ, করো। বিয়ের পর তোমার বাপকে বলবা এইসব ভেজাল দূর করে এরপর যেন ছেলে আর ছেলের বৌ নিয়ে উনি বাড়ি যায়। নয়তো এমন ব্যবস্থা করব, বাসর ঘরে বউয়ের সাথে ফুর্তি করার চান্স পাবা না। তার আগেই আসল শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়া লাগবে, বউ ছাড়াই। স্পেশাল মামু আসবে পালকি নিয়ে।
– মানে কী?
– মানে আমি যদি এই ঝামেলায় ফেঁসে যাই, তাহলে তোমাকেও ফাঁসিয়ে দিব। মাইন্ড ইট।
– আমাকে? আমাকে কেন ফাঁসাবে তুমি? আমি অলরেডি ফেঁসেই আছি। এই তুবা হারামী…
তুবা বড়-বড় চোখ মেলে কথোপকথন শুনছিল। এবার গুটিয়ে গেল অনেকটা। স্বর্ণ গলা চড়াল,
– তুবা একলাই হারামী না। তুমি নিজেও। ভাব করতেছ যেন নাদান বাচ্চা। গাড়ির ভেতর বসে কুকর্ম করার বেলায় তো নাদানি দেখাও নাই।
– আমি কিচ্ছু করি নাই।
– তুমি না করলে তুবা করছে! কেউ একজন অবশ্যই কিছু করছে। নাইলে পাবলিক এভাবে চেতবে কেন? তোমরা দুইজনই ভালোমানুষ সাজতেছ এখন। এতই ফস্টিনস্টি করার শখ, হোটেলে যাও নাই কেন? আমার এখানে তো বিছানা-বালিশ নাই। চেয়ার-টেবিলে নিশ্চয়ই সুবিধা হতো না ভালো। নাকি বাপের টাকা খরচ করতে কলিজা চড়চড় করতেছিল? এইজন্য অল্পের উপর দিয়ে চালানোর প্ল্যান করছিলা! তো গাড়িতেই কাজকর্ম সেরে ফেলতা। আমার এইখানে কী? আমার রেস্টুরেন্টে মানুষ খেতে আসে। তোমাদের মতো নোংরামি করতে না।
শারারের মুখ দেখে মনে হলো, পারলে এখনই ফেটে পড়ে। স্বর্ণকে দু-চারটা কথা না শোনালেই নয়। এই মেয়ে আগেই ভেজাল করে বসে আছে এলাকাবাসীর সাথে। আর এখন ওর দোষ দিচ্ছে! কীসব খারাপ কথা বলল। এর জবাব দিতেই হবে। নয়তো এই মেয়ে ধরেই বসবে তার কথাগুলো সত্যি। কিন্তু সেই মুহূর্তে তুবার দিকে চোখ পড়ল শারারের। ওর ভীত চাহনি শারারের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিল। স্বর্ণর পেছনে গিয়ে দাঁড়ানোটা মন মানতে পারছে না। এই মেয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? স্বর্ণর সাথে হাত মিলিয়েছে বুঝি! ঠিক তখন কাশেম তাড়া দিল,
– ভাইজান, আপনে তাত্তাড়ি তৈরি হয়া নেন। স্যার দশ মিনিট টাইম দিছে। ছোট ভাবিসাবরেও বলেন তৈরি হয়ে নিতে। অত সাজগোজের টাইম নাই। কেবল শাড়িডা পরলেই অইব।
কাশেমের কথা শুনে হাতের শপিং ব্যাগটা তুবার দিকে ছুঁড়ে মারল শারার। তারপর হনহন করে বের হয়ে এলো ঘর থেকে। সেই কোন দুপুরে এই ঘরটায় এসে ঢুকেছিল। এতক্ষণ বাদে বের হলো। কী একটা অদম্য রাগ তাকে বের করে নিল আচানক। স্বর্ণ বাধা দিতে যাচ্ছিল। সুযোগ পেল না। তবে শারারের বেশিদূর যাওয়া হলো না। সাইফুলকে কাজির সাথে বসিয়ে শফিকুল চৌধুরী এগিয়ে আসছিলেন। ছেলেকে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে হেঁটে আসতে দেখে গম্ভীর সুরে বললেন,
– কোথায় যাচ্ছ তুমি? এখনও রেডি হওনি যে! কাজি চলে এসেছে। বিয়ে পড়ানো হলেই ফিরব। তোমাদের রেখে আবার অফিসে যেতে হবে। সারারাত তো এখানে থাকা পসিবল না। আজকে সারাটাদিন গেছে তোমার এইসব হাঙ্গামা ম্যানেজ করতে। রাতও কি এখানে কাটাতে চাও? কাশেম কি তোমাকে শপিংগুলো দেয়নি? কাশেএএএম!
কাশেম দৌড়ে এলো। হাতজোড় করে বলল,
– স্যার আমি ব্যাগগুলান দিয়াসছি।
শারার শান্ত সুরে বলল,
– আব্বু, আমি বিয়েটা করব না। এই সিচুয়েশনে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। তুবার সাথে আমার এমন কোনো রিলেশন…
– শারার, আমার হাতে সময় কম। আমার ডেলিগেটরা এসে বসে আছে। যত দ্রুত সম্ভব, অফিসে যাওয়া জরুরি। কিন্তু আমি সব ফেলে এখানে পড়ে আছি তামাশা দেখতে।
– তোমাকে তামাশা দেখতে কে বলেছে? আমি তো তোমাকে ডেকে আনিনি। তুমি নিজেই এসেছ। আর কেন তুমি এই বিয়ের ব্যবস্থা করছ?
– তুমি কি চাচ্ছ আমি চলে যাই? আমি একবার গেলে কিন্তু আর আসব না। এরাও তোমাকে ছেড়ে দেবে না। সো, ভেবেচিন্তে বলো।
– আব্বু প্লিজ। আমি বিয়েটা করব না।
– তোমাকে আমি কোনো মাল্টিপল চয়েজ কোয়েশ্চেন দেইনি, শারার। তোমাকে বলা হয়েছে, জলদি রেডি হতে। কাজি ওয়েট করছেন। উনাকেও ফিরতে হবে। বেশিক্ষণ আটকে রাখা যাবে না।
– আব্বু। আমার কথা শোনো।
– তুমি আর একটা কথা বলবে। আমি সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠব। একবারও পেছন ফিরে তাকাব না।
শারার আরও কিছুক্ষণ গাঁইগুই করতে চাইছিল। জানে, তার বাবা একবার কোনোকিছুতে মনস্থির করলে তাকে টলানোর সাধ্য কারও নেই। তবু শেষ চেষ্টা করতে চেয়েছিল। কিন্তু শফিকুল চৌধুরীর লোহার মতো শক্ত মুখখানা দেখে তার গলা শুঁকিয়ে গেল। আর কোনো কথা না বলে সে আবছাভাবে মাথা ঝাঁকাল। (চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here