নীড় পর্ব-২৩

0
1133

নীড়
রেশমী রফিক
২৩।।
প্রায় ঘন্টাখানেক হলো কাশেম ঘুরঘুর করছে মৌচাক মার্কেটের ভেতর। সবগুলো শাড়ির দোকানে ইতোমধ্যে ঢুঁ মারা শেষ। এখনও শাড়ি কেনা হয়নি। শারার তাকে গু রঙের শাড়ি কিনতে বলেছে। এই রঙের শাড়ি এখনও খুঁজে পায়নি। বিভিন্ন দোকানে ঘুরছে। এটা-সেটা দেখছে। কোনোটাই মনে ধরছে না। আসলে গু রঙটা ঠিক কীরকম, সেটাই ঠাহর করে উঠতে পারছে না সে। দোকানিকে বলতেও পারছে না, ভাই, গু কালারের শাড়ি দেন। কেবল এতটুকু বলেন, হলুদের মধ্যে শাড়ি দেখান, ভারী কাজের। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে বেনারসি। যদিও তাকে বলা হয়নি, বেনারসিই কিনতে হবে। তবু, বিয়ের শাড়ি কেবল বেনারসি এই জ্ঞানটুকু সম্বল করেই এসেছে। তবে রঙটা হয় লাল। বিয়ের আসরে লাল বেনারসি শাড়ি পরে বউ। ছোটবেলা থেকে এটাই দেখে আর শুনে এসেছে। এমনকি তার নিজের বাবাও বিয়ের সময় মাকে একটা লাল বেনারসি কিনে দিয়েছিল। তখন অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। দিন আনি, দিন খাই ধরনের। নতুন বউকে রেওয়াজ অনুসারে নানান কিছু কিনে দেবার সামর্থ একদমই ছিল না। এরপরও বাবার মাথায় ছিল, বিয়ে করতে গেলে নিদেনপক্ষে একটা লাল বেনারসি শাড়ি না হলেই নয়। তাই তো বন্ধুদের কাছ থেকে ধারকর্জ করে লাল বেনারসি কিনেছিল। সেটাই হাতে করে নিয়ে গেছে বিয়ের আসরে।
কাশেমের নিজের বিয়েতে অভাব ছিল না। তার বউয়ের সমস্ত কেনাকাটা মা-বোনেরা মিলে করেছে। বাসায় আসার পর তাকে দেখিয়েছে, লাল বেনারসি। বউয়ের জন্য কেনা হয়েছে। অথচ আজকের বিয়েতে কি না গু রঙের শাড়ি পরবে বউ! তাও আবার বড় সাহেবের একমাত্র ছেলের বিয়ে! অবশ্য আজকের এই ঘটনাকে ঠিক বিয়ে বলা যায় না। বিয়ে তো কেবল মুখে কবুল বললেই হয় না। কিছু নিয়মকানুন আছে, সামাজিক আর ধার্মিক। পারিবারিক রীতি-রেওয়াজ মানতে হয়। সেদিক থেকে বলা যায়, এটা কোনো বিয়েই না। কেবল উপস্থিত জনসাধারণকে ভুংভাং বুঝিয়ে শারারকে উদ্ধার করাটাই মূল উদ্দেশ্য। তবু, গু রঙয়ের শাড়ি! কেমন যেন শোনায়।
শুধু শাড়ি কিনে আনতে বললে এত হেনস্তা হতো না। চোখ বন্ধ করে একটা লাল বেনারসি কিনে নেয়া যেত। মূল ঝামেলা করলেন বড় সাহেব। কী দরকার ছিল ছেলেকে রঙের কথা জিজ্ঞেস করার? কাশেম নিশ্চিত, শারার কখনওই চাইবে না তার বিয়েতে বউ গু রঙের শাড়ি পরুক। নিজের বউকে অপরুপ সুন্দর রুপে দেখতে কে না চায়? আজকে এই রঙের কথাটা সে বলেছে বাবার উপর রাগ করে। এটা তার মনের কথা না।
বিষয়টা যতই বুঝতে পারুক কাশেম, গু রঙটাই কিনতে হবে। শারারের মেজাজ সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবহিত সে। এই ছেলে সচরাচর ক্ষেপে না। বড়লোকের আর দশটা আদরের দুলালের মতো অহেতুক অহংবোধ তার নেই। বাবার অধীনস্থ কর্মচারীদের সাথে ভদ্রভাবে কথা বলে। আচরণেও কখনও উদ্ধত হতে দেখা যায় না। যদিও এর পেছনে শফিকুল সাহেবের কৃতিত্ব অনেকাংশে জুড়ে আছে। বাবার কঠোর শাসনে বেড়ে উঠেছে শারার। এছাড়াও তার মা যথেষ্ট ধার্মিক ঘরানার মহিলা। পূর্বে আধুনিক আর উচ্ছ্বল জীবনযাপন করলেও একটা সময় পর অন্দরমহলে থিতু হয়েছেন। সহসা দেখা দেন না চার দেয়ালের বাইরে। ধর্ম-কর্মে পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছেন। এমন বাবা-মায়ের ছেলের আচার-আচরণ সংযত হতেই হয়। তবু মাঝেমধ্যে শারারকে সমঝে চলতে হয়। একবার ক্ষেপে গেলে এই ছেলের চাইতে ভয়ঙ্কর আর প্রতিশোধপরায়ণ কেউ হয় না। স্বয়ং শফিকুল সাহেব এমন পরিস্থিতিতে ঘাটান না ছেলেকে। কিন্তু আজ যেন সমস্ত কিছু গুলে খেয়েছেন। ছেলের রাগটা হয় তার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, নয়তো কিছু একটা অশুভ চিন্তা তাকে অন্যদিকে বুঁদ করে রেখেছে।
অনেক ভেবেচিন্তে একটা শাড়ি হাতে নিল কাশেম। দোকানিকে বলেছিল, বেনারসির মধ্যে হলুদের কয়েকটা শেড দেখাতে। দোকানি স্টকে থাকা সমস্ত হলুদরঙা শাড়ি হাজির করে ফেলেছে। তার মধ্য থেকে কাঁচা হলুদ রঙের একটা শাড়ি পছন্দ হয়েছে। ঠিক কাঁচা হলুদও বলা যাবে না। কাঁচা হলুদে রঙের অ্যাক্রেলিক ডিব্বায় অল্প একটু কালো রঙ যোগ করলে যে গাঢ় রঙটা আসে, ওটাই। কাশেম জানে না, এটাই গু রঙ কি না। তবে কাছাকাছি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দামটাও বড় সাহেবের বাজেটের তুলনায় অল্প। হয়তো উন্নতমানের বেনারসি না। ইন্ডিয়ান হতে পারে। কাপড় সম্পর্কে কাশেমের অত ধারণা নেই। আপাতত রঙ মিলেছে, এতেই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।
এখন পাঞ্জাবি কেনার পালা। পাঞ্জাবির রঙ তাকে বলে দেয়া হয়নি। তবে শাড়ির পাড়ে যে মেরুন রঙ আছে, ওরকম একটা পাঞ্জাবি হলে নিশ্চিত মানাবে দু’জনকে। যতই শ্রী-হীন বিয়ে হোক, বড় সাহেবের ছেলে বলে কথা! বেমানান হলে চলবেই না কোনোভাবে। বড় সাহেব একতাড়া নোটের বান্ডিল দিয়েছেন খরচ করতে। সেখান থেকে অল্পই খরচ হলো শাড়ি আর পাঞ্জাবি কিনতে। কাশেমের মনে হলো নতুন বউয়ের জন্য আরও কিছু কেনা দরকার। একটা স্যান্ডেল কি কিনবে? সোনালী বা ম্যাটম্যাটে বেইগ রঙের? মন্দ হয় না! মেয়েটা ওই রেস্টুরেন্টে কী অবস্থায় আছে, সে দেখেনি। ভেতরের দিকে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। তবু কেন যেন কাশেমের মনে হলো স্যান্ডেল কেনা উচিত। কেডসের সাথে নিশ্চয়ই শাড়ি পরবে না সে। স্যান্ডেলের কথা মাথায় আসতেই মনে পড়ল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসই কেনা হয়নি। ব্লাউজ আর পেটিকোট। চটজলদি সেগুলোও কিনে ফেলল আনুমানিক সাইজের। কিশোরী মেয়ের সাইজ নিশ্চয়ই আজদাহা হবে না। তার উপর বড় সাহেবের ছেলের প্রেমিকা! এভাবে শারীরিক গঠন না বুঝা গেলেও অনুমান করা কঠিন কিছু না।
সমস্ত শপিং সেরে কাশেম যখন ফিরল রেস্টুরেন্টে, সন্ধ্যা গড়িয়েছে। মালিবাগ রেলক্রসিং পার হবার সময়ই চারদিকের মসজিদ থেকে একের পর এক আযান শোনা গেছে। এতক্ষণে নামাজও শেষ। কাজি সাহেব চলে এসেছেন। রেস্টুরেন্টের ডাইনে কর্নারের একটা টেবিলে বসে শফিকুল কথা বলছেন তার সাথে। বর আর কনের যাবতীয় বিস্তারিত তথ্য লেখা হচ্ছে রেজিস্টার খাতায়। এর মধ্যে আরও একটা কাজ করেছেন তিনি। ভাতিজা সাইফুলকে ফোন করে ডেকে এনেছেন। তুবার আপন বোন-জামাই সে। তুবার দিকের অভিভাবক হতে হবে তাকে। আগেভাগে কিছু বলেননি অবশ্য। কেবল জরুরি দরকার বলে ডেকেছেন। এখানে আসার পর বিস্তারিত ঘটনা জানানো হয়েছে। এই মুহূর্তে সাইফুল তার ফুপার সাথেই বসা। কনের অভিভাবক হিসেবে তার উপস্থিতি কতটা গ্রহণযোগ্য, এই নিয়ে কাজি মৃদু আপত্তি জানাচ্ছেন। কনের বাবা আর ভাই জীবিত থাকলে তারাই উত্তম অভিভাবক। আপত্তি ধোপে টিকল না। শফিকুল চৌধুরী সাইফুলকেই কনের অভিভাবক সাব্যস্ত করলেন। কাশেমকে দেখামাত্র ওকে ভেতরে গিয়ে সবকিছু দিয়ে আসতে বললেন। নির্দেশ দিলেন, অল্পসময়েই যেন বর-কনে দু’জনই তৈরি হয়ে নেয়।
দরজায় মৃদু টোকা দিতেই স্বর্ণ খুলল। তার পেছনে শারার। চোখমুখ উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। কাশেমকে দেখে উদ্বিগ্ন সুরে বলল,
– আব্বু কোথায়?
কাশেম বিনয়ের ভঙ্গিতে হাতের শপিং ব্যাগগুলো এগিয়ে দিল। বলল,
– বড় স্যার বাইরের একটা টেবিলে বইসা আছেন। কাজি আসছেন। উনার সাথে কথাবার্তা চলতেছে। সাইফুল ভাইরেও দেখলাম। মনে হয়, স্যার ডাইকা আনছে।
সাইফুলের নাম শোনামাত্র তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল তুবা। আতঙ্কের আতিশয্যে জ্ঞান হারাবার দশা তার। শারারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– না, প্লিজ। সাইফুল ভাইয়াকে এর মধ্যে ডাকবেন না। বাসায় জানতে পারলে আমাকে মেরেই ফেলবে!
স্বর্ণর বলতে ইচ্ছে করল,
– আজ তো বাসায় জানাজানি হবেই। বিয়ে হয়েই যাচ্ছে। আর বাকি রইল কী?
বলল না। এই মুহূর্তে তার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। একটা মেয়ে হয়ে সে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ে নেমেছে, যেন মহাপাপ করে ফেলেছে। এই রেস্টুরেন্ট চালু হবার পর থেকেই একের পর এক ঝামেলা লেগে আছে। অনেক কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল শেষবার। এরপর যথেষ্ট মাত্রায় সতর্ক ছিল, যাতে প্রতিপক্ষ কোনোরকম ইস্যু তৈরি করতে না পারে। শারার আর তুবার কারণেই আজকের ঝামেলা হলো। এরা গাড়ির ভেতর বসে আদতে কী করছিল, আল্লাহ জানেন। নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছে ওরা, যেটা আপাতদৃষ্টিতে বড় কিছু না হলেও সামাজিক রীতিনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে অসামাজিক কার্যকলাপের তালিকায় পড়ে। নয়তো মানুষজন এভাবে ক্ষেপে যাবে কেন? তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এরা ঘটনা ঘটিয়ে এখন ভালোমানুষ সেজে বসে আছে। শারারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যেন আস্ত বোম্ব। প্রচণ্ড রাগ নিজের ভেতর পুষে রেখেছে। সীমাহীন রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যে কোনো মুহূর্তে ফেটে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর তুবা! এই মেয়ের চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই কত বড় ধড়িবাজ। ভাবখানা যেন ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। অথচ এই বয়সে কলেজ বাঙ্ক করা শিখে গেছে। ক্লাস বাদ দিয়ে সে প্রেমিকের সাথে ঘুরতে এসেছে। প্রেমিকের পকেট খালি করে গপাগপ গিলতে না পারলে তো শান্তি হবেই না। হাভাতে কোথাকার!
স্বর্ণ সাধারণত রেস্টুরেন্টে আগত কাস্টমারদের উদ্দেশ্যে গালি দেয় না। আদতে কখনওই দেয়নি। রেস্টুরেন্টে কাস্টমার বাড়লে তারই লাভ। কিন্তু আজ সত্যি গালাগালি করতে ইচ্ছে করছে। এইসব কাস্টমারদের কাছ থেকে লাভের তুলনায় ক্ষতির আশঙ্কা বেশি মিলে। খেতে আসছে, ভালো কথা। ফস্টিনস্টি করবি, তাও মানা যায়। রেস্টুরেন্টে কেবিন টাইপের কিছু খোপ বানানো হয়েছে। অনেক সময় অতি রক্ষণশীল পরিবারও আসে। কর্তা ভদ্রলোক তখন নিরিবিলি জায়গার খোঁজ করেন, যাতে পরিবারের মেয়েরা নিকাব সরিয়ে, আরাম করে খেতে পারে। তাদের কথা ভেবেই কয়েকটা খোপ তৈরি করে সামনে পর্দা টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে। ওগুলোর কোনোটায় বসতে চাইলেও ব্যবস্থা করে দেয়া যেত শারার-তুবাকে। তারপর পর্দার আড়ালে বসে যা খুশি করত নাহয়। আর যাচ্ছেতাই বলতে কীইবা করবে? পরস্পরকে জড়িয়ে ধরবে, চুমু খাবে। এই তো? খুব বেশি হলে জামাকাপড়ের অবস্থা খানিকটা সঙ্গীন হতে পারে। বেশিদূর তো যাওয়া সম্ভব না। খোপ হলেও প্রাইভেসি কেবল ওই কাপড়ের পর্দাতেই আবদ্ধ। তা না, গাড়িতেই শুরু হয়ে যেতে হবে এদের। পারলে ওখানেই সমস্ত কাজকর্ম সেরে ফেলে আর কী!
এর মধ্যেও গড়বড় আছে। এরা আদৌ প্রেমিক-প্রেমিকা কি না, তা নিয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান। প্রেম থাকলে এরা পরস্পরের জন্য উদগ্রীব থাকত। শারার নিজে ঢাল হয়ে দাঁড়াত তুবার সামনে। তুবাও ওকে আঁকড়ে ধরত আশ্রয় হিসেবে। কিন্তু এরা দুইজন বসে আছে ঘরের দুই কোণায়। কেউ কারও দিকে একবারের জন্যও তাকায়নি। উলটো শারারকে দেখে মনে হচ্ছে, তুবাকে পারলে কাঁচাই চিবিয়ে খায়। ইতোমধ্যে ওর উপর দু’বার হামলে পড়েছিল প্রায়। একবার কষে থাপ্পড় মেরেছে। আরেকবার মুঠি পাকিয়ে মারতে গিয়েছিল। কারণ, তুবা ওই মুহূর্তে বলেছিল, তার কোনো দোষ নেই। সে ঘুমুচ্ছিল। এই ঘুম নিয়েই যত অশান্তি। যতবার শারার ঘুমের কথা শুনছে, ততবারই তেঁতে উঠছে। যেন, গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়াটা রীতিমতো অন্যায়। মারামারি শুরু হতে গিয়েও হয়নি ওদের। স্বর্ণ নিজে ঠেকিয়েছে। তাই বলে মুখ তো বন্ধ রাখা যায় না। শারারের মুখ বন্ধ নেই। তুবাকে মারতে না পারলেও তুমুল ফুলঝুরি ফুটিয়েছে কথার। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তোর ঘুম আমি চিরকালের জন্য হারাম করে দিব। আমাকে চিনিস না তুই!
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here