নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব_২০

0
990

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৮

বধূর বেশভূষায় আনজুমা তার বাচ্চা আশফিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেঁদে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলছে। তাকে শান্ত্বনা দিতেও নিষেধ করেছে আরভীক। তার মেজাজ তিক্ষ্ণের চেয়েও তিক্ষ্ণতর হয়ে আছে। তাও অন্য কোনো কারণে নয়। বরঞ্চ মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার মূল ব্যক্তিই আনজুমা।
বিকালে যখন তার চেতনশক্তি ফিরে আসে তখন আরাজ সাহেবকে রুমে বসা অবস্থায় পায়। তিনি মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘কেমন আছো মা!’

‘ভালো আছি বাবা না মানে আঙ্কেল।’

‘আগের শব্দটাই বেটার ছিল। এখন থেকে বাবা ডেকে অভ্যাস করে ফেলো।’

ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো তার। প্রশ্নাত্মক নজরে আরাজ সাহেবের দিকে অবুঝ চাহনী নিক্ষেপ করে। তিনি ঠোঁট কামড়ে আলতো করে দূর ঘেঁষে বসে। আনজুমার একহাত ধরে অনুনয়ভরা গলায় বলে,

‘মা আমার কোনো মেয়ে নেই! তোমার মা আরভীক হওয়ার পরই মারা যায়। তখন তার বয়স আনুমানিক বিশ-একুশ হবে। খুব ছোটবেলায় তোমার মাকে বিয়ে করেছিলাম। যখন তার নাইন-টেনের পড়ার বয়স ছিল। কি করব বলো পছন্দের বউ আমার! ছাড় দেয়নি আগলে নিয়ে ছিলাম। শান্তির নীড় এক দমকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বুঝতে পারিনী আরভীকের জম্মের সময় কমপ্লিকেশন ছিল। তখন জানলে সন্তান নিতাম না। তবে তার প্রতি মায়াবোধ,স্নেহ পরশ্রীকাতরতা তৈরি হয়ে গিয়ে ছিল। আজীবও দ্বিতীয় ভাই পাবে বলে খুশিতে মেতে থাকতো। তোমার মা পারেনি সকলের খুশি বিসর্জন দিয়ে সন্তান ত্যাগ করতে। তাই আমিও বিনা দ্বিধায় অশ্রু ঝরিয়ে বিদায় জানিয়ে ছিলাম স্ত্রীকে ডেলিভারির দিন।’

কিছু পরম প্রণয়ী স্মৃতি মনে আসায় আরাজ সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। তিনি চোখ মুছে না। বরং অশ্রুসিক্ত চোখে আনজুমার হাতের উপর দ্বিতীয় হাত রেখে আকুতিপূর্ণ গলায় শুধায়।

‘মা আমার মেয়ে হবে! আমার ছেলেকে বিয়ে করবে। আশফিকে তার বাবার অধিকারটা দেবে।’

উৎকণ্ঠায় থমকে গেল আনজুমা। তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে দৃষ্টিকোণ চোরাবালির মত নুয়ে নিল। যেন এ এক অসম্ভব বিষয়! আরাজ সাহেব প্রথম প্রস্তাবে হতাশা পেল। দৃষ্টি মেঝের উপর রেখে আনজুমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘কোনো ভাবে সংকোচ বা জড়তা নিয়ে থেকো না মা। নিজের বাবা ভেবে সিদ্ধান্ত জানাবে।’

‘আইম সরি আঙ্কেল আমি পারব না আরভীক স্যারকে বিয়ে করতে। আমার কাছ থেকে স্বামীর হাত চার বছর আগে সরে গিয়ে ছিল। আরভীক স্যারকে স্বামী বানালে আমি তাকেও খেয়ে যাব। ছোটবেলায় মুরব্বিগণ আমাকে দেখে অপয়া,মুখপুরি বলে ক্ষ্যাত করে ছিল। সুয়াইব মানে আমার স্বামীর মৃত্যুর পর মুরব্বিগণ গ্রামে আমার নামে রটায় যে আমি নাকি স্বামীর ঠিকাদারি করতে পারি না। একদমে বিয়ের বছর না পেরুতেই খেয়ে ফেলেছি। অথচ আমি ছিলাম মরণদশায় জর্জরিত। গর্ভে ছিল দশমাসের সন্তান। হাসপাতালের বেডে কাতরে কাতরে স্বামীর অপেক্ষার প্রহর গুণছিলাম। সত্যি আমি খেয়ে ফেলেছি তাকে। তাই আমার জন্য আপনার সন্তান,আপনার কোল শূন্য,খালি হোক এক জীবনে বেঁচে থেকে এ দুদর্শাময় কথা শুনতে চাই না। আপনি দয়া করে বলুন, আশফি কি বাসায় আছে!’

গভীর মনযোগ সহকারে আরাজ সাহেব মেয়ের মনভাব শুনে ও বুঝল। আড়ালে মৃদু হেসে দেয়। আনজুমার কথার প্রেক্ষিতে গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়।

‘আরভীক তাকে নিয়ে উঠানে হাঁটতে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।’

বাক্যধারা থামিয়ে উঠে দাঁড়ায় তিনি। আনজুমাও ভদ্রতার সহিতে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। হিজাব, আবাইয়া সটান করে সালাম আদায় করে নিল। তিনিও বিনিময়ে সালামের জবাব দিয়ে বলে,

‘মা আমার কথায় ভেবে দেখিও।’

উত্তরের দিক থেকে মৌন রইল আনজুমা। সে জানে না আদৌ বিয়েতে রাজি হবে কিনা তার মন! আরভীক এর প্রেমে পড়েনি তবে ভালো লাগে তার দুষ্টুমি কথাবার্তা! কোনো খুঁত নেই তার মাঝে। কিন্তু পারবে না সে আগলে নিতে! সুয়াইবের বিস্তৃত ছোঁয়ার মাঝে আরভীকের ছোঁয়া নতুনত্বের মত প্রভাবিত করবে। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার অন্তর থেকে। আচমকা হাতে টান পড়ায় চমকে উঠে সে। চোখ তুলে ভয়ানক ভাবে কেঁপে উঠে। আরভীক তার হাত এতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেন হাত ছাড়লেই পালিয়ে যাবে! তার চোখ-মুখ রাগের কারণে রগরগে ফুলে আছে। ঢোক গিলল আনজুমা তার ভয়াবহ বর্বর রুপ দেখে। হাত ছাড়ানোর জন্য কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘দে দেখুন হা হাত ছা ছাড়েন।’

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল আরভীক এর। তার বাবার কথা অমান্য করেছে এ মেয়েটা। দুপুরবেলায় যাও আদর করে ছিল বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় যেন তার মাথা ক্রোধে ফেটেই যাবে। মেয়ের সাহস কতখানী হলো দেখে সে নিজে অবাক! না মেয়েটাকে আর ছাড় দেবে না। অনেক হলো ‘না না না’ এর খেলা! এবার সে যা বলবে তাই হবে। বিবেচনাহীন আনজুমার ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের ওষ্ঠ মিলিয়ে দিল আরভীক। হৃদয়ের ধুকপুক তেজ হয়ে গেল আনজুমার। ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আরভীক ক্রোধের ঠেলায় ওষ্ঠে স্পর্শের চেয়ে বেশি কামড়ে লাল করে দিচ্ছে। আনজুমা ছাড়া পেতে তার পিঠ,বুকে ঘু’ষি,চ’ট’কানি দিচ্ছে। যার মা’ই’র মোটেও আরভীক এর শরীরে অনুভব হচ্ছে না। হিতে বিপরীত নিয়ন্ত্রণহীন করে দিচ্ছে আনজুমার আদুরীয় মা’ই’রগুলো। আড়চোখে আনজুমার বন্ধ চোখ হতে অশ্রু ঝরতে দেখে ছেড়ে দিল। তবুও হাত ছাড়ল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল মেয়েটি। ভ্রুক্ষেপ নেই আরভীক এর। তাকে আলমারির সামনে এনে ঘেঁটেঘুটে লাল বেনারসি শাড়ি বের করে দেয়। টেনে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে সে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল। একমুর্হুতে কি হয়ে গেল ভেবেই আনজুমার মাথা ঝিম খেয়ে যাচ্ছে। দরজা ধাকিয়ে চিৎকার করে বলে,

‘এসব কি স্যার আপনি বিয়ের শাড়ি কেন দিয়েছেন! প্লিজ দরজা খুলন। আমি আশফির কাছে যাব।’

‘দিজ ইজ ইউর পানিশ্চমেন্ট মিসেস ফাওয়াজ।’

‘ওয়াট কিসের মিসেস ফাওয়াজ! আমি মিস আবান।’

‘কিছুক্ষণের জন্য! বিয়ের পর মিসেস ফাওয়াজ হয়ে যাবে।’

‘আমি আপনাকে বিয়ে করব না শুনছেন আপনি! যত যাই করুন আমি আশফিকে নিয়ে পালিয়ে যাব।’

বলতে থেকে ক্ষোভে ওয়াশরুমের বেসিনে থাকা সাবান,শ্যাম্পু দরজার দিকে ছু’ড়ে মারছে। অতিষ্ঠ হয়ে আরভীক দরজায় জোরালো এক ঘু’ষি দেয়। ভয়ের চটে কাঁপুনি ধরে যায় আনজুমার। আরভীক দাঁতে দাঁত চেপে দরজার নিকট মুখ এনে শান্ত কণ্ঠে হু’ম’কি দেয়।

‘যদি এখনি বিয়ের শাড়ি পরে বাহিরে না আসছো। মনে রেখো ভেতরে এসে আমিই পরিয়ে দেব। এর ফলে আমি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে কিছু করে বসলে। তার দায়ে থাকবে তুমি।’

‘আরে বেক্কল নাকি আমি বিয়ে করব না মানে বাংলা বুঝেন না।’

আনজুমার কথায় পাত্তা না দিয়ে ভাবলেশনহীন কণ্ঠে ‘এক’ বলে গণনা শুরু করে। আনজুমা শুকনো ভীতি মনভাবে ঢোক গিলল। মুখ খুলে নিম্নকণ্ঠে ‘প্লিজ’ বলে। তার বলার কারণে আরভীক ‘দুই’ বলে উঠে। ব্যস! আনজুমা বাক্যহীন পরণের জামা পাল্টে নেয়। পরণে পেটিকোট ও ব্লাউজ পরে শাড়ি পরতে হিমশিম খেয়ে যায়। ওয়াশরুমের ফ্লোর ভেজাভেজা হয়ে আছে। শাড়ি ভিজে থাকলে হাঁটতে,চলতে অস্বস্তি হবে। এটুকু ভেবে আমতা আমতা করে দরজায় নক করে। আরভীক দরজার মধ্যে হেলান দিয়ে ফোন টিপাটিপি করছিল। দরজায় কড়াঘাত শুনে বলে,

‘বলো রেডি!’

‘না আ আসলে আপ আপনি বাহিরে যান।’

সন্দেহের গলায় আরভীক শুধায়।

‘পালানোর জন্য।’

‘দূর বেক্কল গরুমার্কা বলদ! শাড়ি এখানে পরতে পারছি না। পেটিকোট ও ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে আছি।’

হুতুম পেঁচার মত মুখ করে ফেলে আরভীক। মনে মনে বলে, ‘এ কথা সুন্দর করেও তো বলা যেতো বাঘিনী কোনকার’। গলা ঝেরে গাম্ভীর্য ভরা গলায় ‘ওকে’ বলে সে বেরিয়ে যায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন আনজুমা। শাড়িটি নিয়ে রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে পরতে আরম্ভ করে।

৩৬.
আরাজ সাহেব তাজ্জব চাহনী নিয়ে টিভি দেখছে। একপলক টিভি তো আরেক পলক ছেলের দিকে নিবিঘ্নে চেয়ে যাচ্ছে। বাবার প্রশ্নাত্মক চাহনী দেখেও না দেখার ভান ধরে বসে রইল। আরাজ সাহেব মাথা নেড়েচেড়ে টিভির চ্যানেলে তাজা খবর শুনতে থাকে।
রিপোর্টিং করছে আরভীক এর বন্ধু সায়াজ। সে তার ধন্যমান্য গলায় তিক্ত সত্য শুনাচ্ছে সকল দর্শকদের।

‘আজকের তাজা খবর হিসেবে নিয়ে এসেছি আরো দুজন নতুন ক্রিমিনালের মৃত্যু রহস্য। ডক্টর ডেভিড নিশ্চয় নামের লোকটাকে চেনেন। তিনি অন্য কেউ নন মেন্টাল আইসোলেশনের ডক্টর। তিনি মেন্টাল পেশেন্টদের ট্রিটমেন্ট করিয়ে লাভবান হোন। তবে এমন ভালোমানুষির পিছে যে ভয়ংকর এক রুপ চুপিয়ে আছে সেটা কি জানেন আপনারা! নিশ্চয় জানেন না! তবে শুনুন আমি বলছি। ডক্টর ডেভিড মৃত্যু অপরাধী ক্লেভের স্টেপ ব্রাদার। তিনি দেশে ছিল ভাইয়ের জন্য। তার মৃত্যুর ঘটনা শুনে তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে যায়। বলাবাহুল্য প্রতিশোধের নেশায় তিনি এক মেয়েকে অপহরণ করে এক ভুয়া পুলিশের দ্বারা মেয়েটিকে অপমান ও লাঞ্চিত করে। পরবর্তীতে তার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অপনীত হয়। কিন্তু তাদের পরিকল্পনায় সফল হতে দেয়নি জনমান্য সেবক,প্রতিরক্ষক আমাদের সিআইডি অফিসার ফাহাদ আকবার।’

সায়াজ হোস্টিং করার মাঝে ফাহাদ গাড়ি নিয়ে থানায় হাজির হয়। থানায় লাশগুলো পোস্টমোটার্ম করে দাফন করা হবে। অবশ্য এসব লাশের কোনো পোস্টমোটার্ম করতে হতো না। ফর্মালিটির কারণে সিনিয়র অফিসার আজ্ঞা করেছে। ফলে বাধ্য হয়ে ফাহাদ কাজটা নিজের হাতে নিল। সায়াজ এগিয়ে এলো ফাহাদের সন্নিকটে। সকলের চুক্ষগোচরে একে অপরকে দেখে রহস্যময় হাসি দিল তারা। সায়াজ কুটির হেসে পুনরায় বলে,

‘সো স্যার আপনি কি দর্শকবৃন্দকে লাশগুলোর মৃত্যু সম্পর্কে বলতে পারবেন!’

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে ফাহাদ সায়াজের এগিয়ে দেওয়া মাইকের কাছে মুখ এনে বলে,

‘যেহেতু আপনারা জানেন অপরাধ কি তাদের সেহেতু বলছি তাদের থামতে বলায়ও থামেনি, আমার বারণ উপেক্ষা করে গু’লি চালিয়ে তিন-চারজন পুলিশকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ফলে এ কাজ গর্হিত অপরাধ হওয়ায় সোজা এনকাউন্টারের রুলস মানতে বাধ্য হয় আমি। অপধারীর শাস্তি মৃত্যু বা ক্ষমা। মৃত্যু তখন যখন সে গর্হিত অপরাধ করে আবারো অপরাধ করতে থাকে উৎকণ্ঠা অনুভব করে না। আর ক্ষমা তখন যখন অপরাধ করে শোধরে নতুন জীবনের প্রত্যাশা করে। ধন্যবাদ আমার কথার সমাপ্তি টেনে কাজে যাচ্ছি। আসসালামুয়ালাইকুম।’

সময় বিলম্ব না করে ফাহাদ থানায় ঢুকে পড়ে। সায়াজ তার মনমত রিপোর্টিংয়ে হোস্টিং শেষ করে নেয়। ক্যামেরাগুলো সাথে নিয়ে গাড়িতে বসে। তৎক্ষণাৎ কল দেয় আরভীক। বাসায় বসে আয়েশে দু’বন্ধুর কারনামা দেখছিল। একবন্ধুর কাজ শেষ হয়েছে দেখে তাকে প্রথম কল দেয়।

‘হেই ডুড কাম খাতাম।’

‘তোর স্বপ্ন এটা।’

কথাটি শুনে বোবা,গর্দভের মত মুখ হলো সায়াজের। তার বন্ধু,বন্ধু না, বন্ধু নামে মারাত্মক চিজ একটা! আরভীক পাশে থাকা বাদামের বোয়াল থেকে। একটুকরো করে বাদাম নিয়ে মুখে পুরে আর চাবিয়ে চাবিয়ে বলে,

‘বিয়ে খাইতে আর রিপোটিং করতে আয়।’

থতমত খেল সায়াজ। ফোনের লাইনে কি আসলে তার বন্ধু নাকি অন্য কোনো ছেলে বোঝার তাগিদে ফোনের স্ক্রিনে নাম দেখে নিল! বেকুব গলায় শুধায়।

‘তুই কি আরভীক!’

‘না আমি তার আত্মা বলছি।’

‘তুই মরলি কবে!’

‘এখনো মরিনী আরেকবার মদনের মত কথা বললে তোকে মেরে কেস ধামাচাপা দেব।’

‘ধুর হা’লা’র পুত! শান্তির জীবন তেজপাতা বানিয়ে ছাড়লি।’

‘জীবন তেজপাতা বানানো বউদের কাজ বিয়ের পর বুঝবি।’

‘চুপ করে বল কারে ধরেটরে বিয়ে করতে যাচ্ছিস।’

‘যারে গতরাতে উদ্ধার করছি তারে। বুঝস না বেশি দয়ালু মানুষ আমি। একদেখায় পছন্দ হয়ছে, বেচারী পাগল একটা। বাচ্চা সামলাতেও পারে না। তার চেয়ে বড় কথা আমার থেকে বাচ্চাটার বাবা হওয়ার শখও জাগছে।’

‘মিয়া তুমি চালাকি অন্য কাউরে মারিও! তোর ডুড লাগি আমি। বুঝি সব খাই কি আর সুজি!’

‘বুঝলে অবুঝের মত প্রশ্ন করস কেন মদন!’

হ্যাবলার বনে ফোন কেটে দেয় সায়াজ। ভেবে ছিল এবার বুঝি আরভীক জব্দ হলো তার হাতে। না পরিণতিতে সেই জব্দ হয়ে হ্যাবলা বনে গেল। আরভীক তার বাবার কাছে গিয়ে ঠেলেঠুলে রুমে ঢুকিয়ে দেয়। আরাজ সাহেব ছেলের আকস্মিক কাজে অবুঝের মত তাকায়। আরভীক লাজুক হেসে বলে,

‘ড্যড রেডি হয়ে নাও। তোমার বউমা এখনি বিয়ের শাড়িতে নিচে নামবে।’

ছেলের কথায় তাজ্জব বিস্ময়ে বিষম খেলো। রুমে ঢুকে আরভীক দরজা ভিড়িয়ে দেয়। আরাজ সাহেব মূর্তির মত ছেলের কথায় রেডি হতে লাগে। আরভীক ফোন বের করে অঞ্জয়কে কল লাগায়।

‘ইয়েস বস।’

‘কাজি আন।’

বিব্রতে মুখ ফুসকে কফিগুলো উগলে দেয় তার সামনে বসা পরম সুন্দরী রমণীর উপর। সেই রমণী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। অঞ্জয় কফিগুলো রমণীর শার্টে জুবুথুবু দেখে নিবিষ্ট হয়ে হাত লাগিয়ে মুছতে গেলে। রমণী মাত্রাতিরিক্ত ক্ষেপে কষে এক চড় লাগায়। বেচারা অঞ্জয় ঠোঁট কাঁপিয়ে ‘উম উম’ করে জবাব দেয়। আরভীক কপাল চুলকে সন্দেহের বাণী আওড়ায়।

‘তোর কি হয়ছে, প্যান্ট ভিজাইছস নাকি!’

বসের কথা শুনে কফির মগই হাত থেকে পড়ে গেল তার। ইজ্জত যেমন ছিল সব কুয়ায় ডুব দিছে। এমুর্হুত যা আছে তাও যদি চলে যায়। রমণী আর পটানো লাগবে না তার। আমতা আমতা করে ‘ওকে বস আনতেছি’ বলে কল রেখে দেয়।
কাজির ব্যবস্থা হয়ে গেলে সব মেইডসকে আদেশ দেয় আরভীক। বাসাটা তিনঘণ্টার মধ্যে যেন বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়।

৩৭.
আনজুমা আয়নার মাধ্যমে নিজেকে ঘুরেটুরে দেখছে। তার রুপ,যৌবনতা যেন পুনরায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। চারবছর আগে যা ক্ষয় হয়ছিল তা যেন নতুনত্ব প্রকাশ করছে। পরণের লাল শাড়ি, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, গলায় ভারী গহনা, মুখের সামান্য ফাউন্ডেশন লাগিয়ে নিজেকে অপরুপ করেছে। স্বেচ্ছায় নাকি অনিচ্ছায় তা অজানা তার! ব্যস মন চেয়েছে আরভীক এর কথায় সায় দিতে। কিঞ্চিৎ পূর্বে দুজন ফিমেইল মেইড এসে মেহেদি পরিয়ে দিয়েছে হাতে-পায়ে। আশফিকে খোঁজ ছিল সে কিন্তু তাকে নাকি আরভীক কোলে নিয়ে বসে আছে। দুজনকে দেখতে নাকি হুবুহু বাবা-ছেলের মত লাগছে। কথাটি শুনে চমকিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিল। পরক্ষণে আয়নায় নিজের সাজসজ্জিত বধূর রুপ দেখে মনেমনে আওড়ায়।

‘খুব কি বেশি ক্ষতি হতো যদি আরভীকের জায়গায় আপনি হতেন সুয়াইব। বড্ড বেশি যে ভালোবাসি আপনাকে। সে হয়তো আমার ভালোলাগা। কিন্তু আপনি আমার পরম হৃদয়ের প্রণয়রাজ।’

চোখ বুজে অপেক্ষারত রইল বিয়ের ডাকের। সে জানেও না অগোচরে কথাগুলো আরভীক শুনে নিয়েছে। সে এসেছিল খোশমনে আনজুমাকে নিতে। তবে যে কথাগুলো আনজুমা মনে বলছে ভাবল। তা স্বল্পস্বরে রুমের মধ্যেই বিরাজিত হয়েছে। যার খেয়াল ছিল না আনজুমার। আরভীক এর হৃদপিন্ডে যেন কেউ ছুড়ি বসিয়েছে। তার চোখে অতীব কষ্টের ন্যায় অশ্রু জমা হয়েছে। মুছে ফেলার জোঁ নেই। দরজা ভিড়ানো অবস্থায় প্রাণেশ্রয়ী নারীর দিকে চেয়ে রইল। কি হতো আল্লাহ্! যদি পূর্বেই তাদের মিলন করাতো। সুয়াইবের জায়গায় কেনো সে হলো না। হলে কখনো দূর হতে দিতো না তার প্রণয়োণীকে। আনজুমা হয়তো বিয়েটা মেনে নিতে না পারে, সমস্যা নেই। হাসিল করতে জানে আরভীক। ভালোবাসায় এটুকু স্বার্থপর সে হবে। তার মনদিলে সুয়াইব হলেও সে থাকুক! আরভীক না হয় সুপ্ত এক মনবাসনা তৈরি করে দেবে। যেটা শুধুই তার নাম গুঞ্জন করবে। আনজুমা যে শুধুই তার এক প্রাণের প্রণয়োণী। ভাবনার পরিচ্ছেদ দূর করে শক্তপোক্ত মুখ করে ভেতরে প্রবেশ করে। আচমকা কারো প্রবেশে বেশ ঘাবড়ে যায় আনজুমা। আরভীক এর রাগান্বিত চেহারা দেখে শঙ্কিত কণ্ঠে বলে,

‘প্লিজ আ আবার বলছি য যেতে দিন।’

আরভীক গম্ভীর মুখে এসেছে। কেননা আনজুমার প্রথমে আওড়ানো কথাগুলো তার হৃদয় ছন্নছাড়া করে দিল। তথাপি ‘যেতে দিন’ শব্দ দুটি যেন তার মাথায় রাগের অগ্নিকুণ্ড ধেবে দিয়েছে। দাঁতে দাঁত মিলিয়ে তিক্ষ্ণ শব্দ বের করে আনজুমার কথার বিপরীতে হাত শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড় করায়। তার মুখোমুখি এসে বলে,

‘যেতে দিন তাই না! এখনি তোমার যাওয়া বের করছি আমি।’

আনজুমা ভাবেনি তার কথার প্রভাবে আরভীক কপাট রেগে তৎপর হয়ে উঠবে। টেনে আনতে নিলে যখন দেখল বউয়ের কষ্ট হচ্ছে। সে কোনো ভদ্রতা,লাজলজ্জার পরোয়া না করে বউকে ঘনিষ্ঠভাবে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে। ফাহাদ,সায়াজ,অঞ্জয়,সাইবা,আরাজ সাহেব,কাজি ও এক পুরু পরিবার দাঁড়িয়ে আছে।
সকলে তাদের দৃষ্টি সংযত করে নিল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) জামাই-বউ পারস্পরিক ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা করতেই পারে। কাজির সামনে এনে দাঁড় করায় আনজুমাকে। কাজি সাহেব মেয়েকে রাজি আছে কিনা জিজ্ঞেস করে। ফুঁপানো কণ্ঠে সে ‘না’ শব্দ বের করে। যা শুনে ঢোক গিলে কাজি। আরভীক এর রাগ যেন সীমা লঙ্ঘন করে দেবে। কোনো কথ্যহীন আনজুমার হাতে কলম চেপে কাগজে সই করিয়ে নেই। সে তো বাচ্চাদের মত বিয়ে না করার জন্য কেঁদেকুটে নাজেহাল দশা বানিয়ে ফেলছে নিজের। এতে পরিপূর্ণ গা-ছাড়া ভাব নিল আরভীক। তার বন্ধুগণ দেখেও অসহায় নজরে তাদের ভাবীকে শান্ত্বনা দেয়। কেননা আরভীক কড়া ধমকে বলেছে এ মেয়ের শায়েস্তা হওয়া দরকার! তোদের কাউকে যেন একে শান্ত্বনা দিতে না দেখি। বেচারারা আরভীক এর কথার খেলাফ হতে পারবে না। কথার খেলাফ মানেই জীবন অথৈ সাগরে তলিয়ে যাওয়া।

বিয়ের সুন্দর ঘটনা মনে করে হেসে দেয় আরভীক। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ক্রন্দনরুপী বধূর কানে অথাৎ আনজুমার কানে ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে,

‘ফ্যাসফ্যাসানি বন্ধ কর। না হলে বাসর রাতে কিন্তু আমি গরম না হয়ে সরাসরি আগুন ধরিয়ে দেব। তাও কোথায় কোথায় ধরাতে পারি! নিশ্চিত তুমি বুঝদার, বুঝে গেছো।’

কথাগুলো শুনে আনজুমা ড্যাবড্যাব করে তাকায় আরভীক এর দিকে। আকস্মিক কারো ভরাটপূর্ণ গলায় ‘আনজু মা’ শুনে হৃদস্পন্দন শীতল হয়ে যায় তার। এ কণ্ঠধারীর মালিক কি সেই যে তাকে পৃথিবীর মায়া দেখিয়েছে! যাকে দেখে জীবন কি বুঝতে শিখে ছিল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here