পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ ছাব্বিশ

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ ছাব্বিশ

সময় কেটে যায় ঝড়ের গতিতে। আষাঢ়, শ্রাবণ পেরিয়ে প্রকৃতিতে এখন ভাদ্রের আগমন। দর্শিনীর তখন সাত মাস চলছে। বদলেছে অনেক কিছু। তারা নিজেদের বাড়িতে উঠেছে। নিধির সাথে সম্পর্কটা তুই থেকে তুমিতে গিয়েছে। মায়ের আক্রোশ কমেছে। হরমোহন বদলায় নি। নানান ভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। দর্শিনীর বড় ভাই প্রদীপ এখনো হাঁটা চলা করতে পারছে না। সুমন অবশ্য শক্ত হাতে সংসার চালাচ্ছে। কিন্তু বদলায় নি সমাজ,প্রতিবেশী। প্রতিনিয়ত খারাপ কথা বলে ছোট করে দর্শিনীকে। লজ্জায় মূর্ছা যায় মেয়েটা। কখনো কখনো বা সিংহের ন্যায় গর্জন করে উঠে। খারাপ কথা গুলোর বিনিময়ে একরাশ ঘৃণা ছুঁড়ে মারে। আজ কোর্টে হেয়ারিং। পাকাপোক্ত ভাবে আজ কোর্টে শেষ হবে দর্শিনীর বৈবাহিক সম্পর্ক। এরপর আর কোনো পিছুটান থাকবে না তার। চারটা মাস পর সে মানুষটার মুখোমুখি দাঁড়াবে আজ। হয়তো এরপর আর কখনো মানুষটাকে দেখার ভাগ্য তার হবে না। যে মানুষটাকে একটা সময় না পেলে দমবন্ধকর অনুভূতি হতো আজ সেই মানুষটার সাথে বিচ্ছেদ ঘোষনা করা হবে। প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর,নির্মম নিয়ম গুলো নিয়ে বেঁচে থাকাটা বড্ড মুশকিল।

ভাগ্যের নির্মমতা ভেবে ছোট্ট শ্বাস ফেললো দর্শিনী। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করতেই বাহির থেকে প্রতাপ সাহার কণ্ঠ ভেসে এলো,
“মা,হলো?”

দর্শিনী ‘আসছি’ বলেই হাত ব্যাগটা উঠিয়ে নেয়। ধীর পায়ে বের হয় ঘর থেকে। আগের তুলনায় শরীর ভার হয়েছে। শরীরের রঙ এত শুভ্র হয়েছে যেন মনে হয় একটু শক্ত করে ধরলেই গলগল করে রক্ত বের হবে। গর্ভকালীন সময়টা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সময় একটি নারীর জন্য। অথচ দর্শিনী সেই সময়টাতেই লড়ে যাচ্ছে জীবনের ভয়ঙ্কর লড়াই গুলো। হয়তো তার অপ্রাপ্তির বিরাট খাতায় একমাত্র প্রাপ্তি হবে তার সন্তানটা।

প্রতাপ সাহা উঠানের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আর মেয়ে মিলে শহরের পথে পাড়ি জমাবে। যেতে অনেকটা সময় লাগবে তবে দুপুর হতে হতে পৌঁছে যাবে নিশ্চয়। প্রদীপ সুস্থ থাকলে হয়তো তাদের সাথে যেতো কিন্তু হাঁটা চলা করতে পারে না বিধায় যেতে পারছে না। আর বিশাল ব্যবসা রেখে সুমনও যেতে পারছে না, এর জন্য সে অবশ্য অনুশোচনা স্বীকার করেছে। অন্যান্য সময় হলে তৃণা যেতো কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। তৃণার বিয়ের কথা চলছে। মৃত্যুঞ্জয়দের বাড়িতে তার মা-বাবা, দাদু,কাকা কাকী সব এসেছে বিদেশ থেকে। প্রায় প্রতিবছরই নাকি তারা আসেন। এ জন্য মৃত্যুঞ্জয় যাবে না,দৃষ্টান্তও তাদের সময় দিচ্ছে তাই সেও যাবে না।

দর্শিনী তপ্ত শ্বাস ফেললো। আজকের দিনে তার অনেক গুলো ভরসার হাত প্রয়োজন ছিলো অথচ বাবা বাদে সাথে কেউ নেই। পৃথিবীতে কঠিন পরিস্থিতি গুলো মানুষকে একাই পাড় করতে হয়। আজ দর্শিনীর কঠিন পরিস্থিতি, তাই সে একাই পাড় করবে। কিন্তু বাবা নামক বটবৃক্ষটা শক্ত হয়ে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। এ মানুষটার ব্যস্ততা নেই,অজুহাত নেই। নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে আছে কেবল সে।

দর্শিনী বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়াতেই মা,বৌদিরা এসে দাঁড়ালো। কাকা কাকীরাও এসেছে। কাকা কাকীরা অবশ্য তাদের বাড়িতে দুধের মাছি। অসময়ে পাশে না পেলেও সুসময়ে দু’পা নিয়ে হাজির থাকে। যখন বাড়ি পুড়ে যাওয়ার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিলো না প্রতাপ সাহার পরিবারের তখন ভাইদের ভালোবাসাটা আমসির মতন শুঁকিয়ে ছিলো। যে-ই বাড়ি হয়ে গেলো সে ভালোবাসা ফুলে ফেপে কলাগাছ হয়ে গেছে।

দর্শিনীর ছোট কাকী দর্শিনীর হাতে একটা ছোট স্টিলের টিফিন বক্স ধরিয়ে দেয়। আদুরে ও মোলায়েম কণ্ঠে বলে,
“এটা পথে যেতে যেতে খেয়ে নিও দর্শিনী। অনেকটা পথ তো,না খেয়ে থাকা উচিৎ না। তোমার বোন একা থাকবে না, নাহয় আমিও যেতাম তোমার সাথে। অবশ্য আমি জানি,তুমি পারবে। মনে রেখো,আমরা নারী আমরাই পাড়ি।”

দর্শিনী হেসে মাথা নাড়িয়ে টিফিনবক্স টা হাতে নেয়। যে কাজটা মায়ের করার কথা ছিলো সেটা ছোট কাকী করছে। ছোট কাকীকে বরাবরই সে পছন্দ করে। কাকী থাকে শহরে। একটা স্কুলের শিক্ষিকা। ছোট কাকা মারা গেছে তাদের বিয়ের তিন বছর পরই। এরপর থেকেই কাকী তার এক বছরের মেয়েটাকে সমাজের থেকে আগলে রেখে লড়ে যাচ্ছে। এ সমাজে ডিভোর্সী,বিধবা,আর বিবাহ উপযুক্ত মেয়ে বিয়ে না হলে দাম থাকে না। কাকী খুব শক্ত মহিলা, তাই তো বৈধব্যের এত বছর পরও বেশ সুন্দর ও সাবলীল ভাবে টিকে আছে। দর্শিনীর বাবা বাদে কেউ এ মানুষটার অসহায় সময়ে পাশে দাঁড়ায় নি। এ মানুষটাকে কেউ সাথ দেয় নি। অথচ এ নারী লড়ে গেছে কোনো কিছু পড়োয়া না করে। তবে দর্শিনী পারবে না কোনো?

হঠাৎ দর্শিনীদের বাড়ির সামনে এসে বড় একটা গাড়ি থামলো। সবাই সেখানেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। মৃত্যুঞ্জয়ের গাড়ি দেখে খানিকটা অবাক হলো সবাই। গতকাল তার পুরো পরিবার এসেছে বাংলাদেশ, আজ তার তো এখানে আসার কথা না। গাড়ি থামতেই দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয় গাড়ি থেকে নেমে আসলো। দুজনেরই ফর্মাল গেটআপ। মৃত্যুঞ্জয় কালো টিশার্টের উপর সাদা কোর্ট সাথে সাদা প্যান্ট পড়েছে। দৃষ্টান্ত হালকা আকাশী রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে এসেছে। প্রতাপ সাহা কণ্ঠ সামান্য উঁচু করে বিষ্ময় নিয়ে বললেন,
“আরে বাবারা, তোমরা এখানে? আমি তো ভাবলাম আসবে না।”

“কেনো ভাবলেন, কাকা? প্রিয়দর্শিনীর এমন দিনে আমরা তাকে একা ছাড়বো ভাবলেন কীভাবে? প্রিয়দর্শিনীকে অনুভব করতে হবে তার পুরো পৃথিবী একা না, স্বল্প হলেও কিছু মানুষ তার সাথে আছে।”

মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় প্রতাপ সাহা সন্তুষ্টির হাসি দিলেন। দৃষ্টান্ত কতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে আশেপাশে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“প্রিয়’র সাথে কোনো মেয়েলোক যাবে না? পথে ওর কতরকমের প্রয়োজন হতে পারে।”

দৃষ্টান্তদের দেখে দর্শিনীর হাসি হাসি মুখ খানা মুহূর্তেই চুপসে গেলো কথা শুনে। নিধি তখন তাদের রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা ভার করে সে বললো,
“আমিই যেতাম ভাই কিন্তু এ জায়গাটাও তো সামলাতে হবে। ধৃষ্ট স্কুল থেকে ফিরে আমাকে না পেলে হৈচৈ শুরু করবে। তোমাদের দাদা বিছানায়। তারও তো সব আমার দেখাশোনা করা লাগবে। তাই পারছি না।”

দৃষ্টান্ত হাসলো। ছোট একটা অবহেলার শ্বাস ফেলে মনে মনে তাচ্ছিল্য করে বললো,’তিন নাম্বার হাত,অজুহাত’।

দর্শিনী কথা ঘুরানোর জন্য একটা ফিকে হাসি দিয়ে বললো,
“আরে সমস্যা নেই বৌদি। আমার তেমন কিছুর প্রয়োজন হবে না। চলো সবাই। দেরি হচ্ছে যে।”

“দর্শিনী,খেয়াল করে দেখে আসবে তোমার মিনসে কেমন সুখে আছে। পারলে বাচ্চাটার কথাও ভালো করে মনে করিয়ে দিবে।”

মেঝো কাকীর এমন কথায় ভ্রু কুঁচকালো দর্শিনী। এ মানুষ গুলো যে এমন সেটা তার ঢের জানা। কিন্তু দর্শিনীকে অবাক করে দিয়ে তার বড় জেঠু বলে উঠলো,
“ঐ ছেলের ঘাড় ধরে বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়াবে। যতটুকু দেয় সেটাই লাভ। আর এই বাচ্চা তাদের বংশের। সে সূত্রে কিছু হাতাতে পারলে তোমারই লাভ।”

দর্শিনী তাজ্জব বনে জেঠুর দিকে তাকিয়ে রইলো৷ ঘিনে তার শরীর রি রি করে উঠলো। কণ্ঠ হলো,কঠোর। চোখ মুখ শক্ত করে সে বললো,
“এ বাচ্চা কেবল আমার। ও আমার সন্তান হিসেবে আসছে কোনো খেলার গুটি না। আর তাছাড়া তোমাদের ওত ভাবতে হবে না ওকে নিয়ে। আমার সন্তানকে আমি তো আর তোমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি না। তাই অত চিন্তার প্রয়োজন নেই।”

দর্শিনীর কথাটা সপাটে যেন চড় লাগালো কাকা-জেঠুর-জেঠিমার গালে। তারাও কম যায় না। মেঝো কাকী মুখ ভেঙচিয়ে বলেই উঠলো,
“এত চেটাং চেটাং কথা কম বলো মেয়ে। মুখে চোখে তোমার কোনো শোক তাপ নেই। ঘর ভাঙতে চলছে এমন মেয়ে কীভাবে এত বড় বড় কথা বলে আমার বোধগম্য হয় না। একে তো প্রেমের বিয়ে তাও টিকিয়ে রাখতে পারলে না।”

“তোমারও তো কাকী প্রেমের বিয়ে। কাকা বিদেশ বছরের পর বছর না থাকলে তোমার বিয়েটাও টিকতো না। স্বামী তার স্ত্রীর জ্বালায় দেশে আসতে চায় না, এর চেয়ে লজ্জা আছে?”

দর্শিনীর কথায় ফোঁস ফোঁস করে উঠলো কাকী। দু চারটা কথা শুনিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেলো। আজ হঠাৎ করেই যেন দর্শিনী প্রতিবাদী হয়ে উঠলো। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে, টিকে থাকতে হলে প্রতিবাদের বিকল্প নেই।

দর্শিনী তপ্ত শ্বাস ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ব্যতিব্যস্ত পায়ে হাজির হয় নিপা। গাড়ির কাছে গিয়ে বেশ অকপটে বলে,
“আমি যাবো তোমার সাথে, প্রিয়। চলো।”

সবাই যেন বিষ্মিত হয়ে গেলো। নিধি বললে নাহয় মানা যেতো কিন্তু নিপার কথা যেন হজম হলো না কারো। এ জন্য হয়তো বলে মানুষের ভালো খারাপ দুইটা দিকই আছে। কেবল ভালোটাতেও মত্ত হয়ে কারো পূজারী হওয়া উচিৎ না আবার কেবল খারাপটাকে দেখেও কাউকে বিচার করা উচিৎ না।

সময় চলে যাচ্ছিলো বিধায় কেউ আর কথা বাড়ালো না। যে যার মতন গাড়িতে গিয়ে উঠলো। দর্শিনীদের গাড়ি বাড়ির সামনে থেকে পাড় হতেই একজন মনে মনে বললো,
“ওর এ যাওয়াই যে শেষ যাওয়া হয় ভগবান।”

_

বিপ্রতীপের মনে চাপা উত্তেজনা। হাত পাও সামান্য কাঁপছে। তাদের পুরো পরিবার গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কোটের দিকে। এই দু’মাস মায়ার পরীক্ষা ছিলো বিধায় সংসারে ঝামেলা একটু কম হয়েছে। তবে সেদিন যখন সবাই জানলো মায়া বিহঙ্গিনীকে যেতে দেখেছে এরপর থেকে মায়ার প্রতি তাদের আরেকটা রাগের সৃষ্টি হয়েছে। বিহঙ্গিনীরও পড়াশোনার চাপ একটু বেশি ছিলো বিধায় নিজের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ শেষ করতে পারে নি। তবে খুব শীগ্রই সে রহস্যের জাল খুলবে।

বিপ্রতীপের মনে সেই বিয়ের দিনের মতন উত্তেজনা। সেদিন তার মন রোমাঞ্চিত হয়েছিলো ভালোবাসার মানুষটাকে একবারে নিজের করে পাওয়ার আশায়। কিন্তু আজ, আজ সে মানুষটাকে একবার দেখার আশায় এত রোমাঞ্চনা।

আচ্ছা,দর্শিনীকে এখন দেখতে কেমন লাগে? নিশ্চয় বিষাদ কাতর মেয়েটা বিরহে একবারে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গিয়েছে! আচ্ছা, আজ যদি দর্শিনী তার কাছে অনুরোধ করে আরেকটাবার থেকে যেতে সে কী করবে? মেয়েটা নিশ্চয় প্রচুর কাঁদবে আজ। কে বলেছিলো সেধে ডিভোর্স পেপার দিতে? এবার বুঝুক মজা।

এমন হাজার জল্পনা-কল্পনা করে বিপ্রতীপ এগিয়ে যাচ্ছে কোটের দিকে। সাথে মা-বাবা,বিহু,মায়াও আছে। দর্শিনীরাও এগিয়ে আসছে তাদের কাছে। কি হবে দুজন চির পরিচিত প্রিয় থেকে অপ্রিয় হওয়া মানুষরা মুখোমুখি হলে! নিশ্চয় নতুন কিছু অপেক্ষা করছে ওদের জীবনে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here