পদ্মপাতার জল পর্ব ০২

0
4591

#পদ্মপাতার_জল
#মুন্নি_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০২

দরজা খুলে সামনে কয়েক পা এগুতেই সিঁড়ি দিয়ে কারো উপরে উঠার শব্দ কানে এলো।মৃন্ময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।হয়তো কেউ নিচে এসেছিল।

অনিরুদ্ধ ভাই এসেছে কি না তা এখনো জানে না।তার রুমে অনেকক্ষণ জেগে ছিল।বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানা নেই।শুধু একটুখানি অনিরুদ্ধর কন্ঠ শুনতে চেয়েছিল।কিন্তু কপালে নেই!!

দুহাত সামনে হাতড়ে একটু পর সিঁড়ির প্রথম ধাপে গিয়ে বসলো।পুরনো স্মৃতি গুলো আজ হঠাৎ করে ডানা ঝাপটাচ্ছে।এ বাড়িতে আসার পর তাকে অনিরুদ্ধর স্কুলে ক্লাস থ্রীতে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়।অনিরুদ্ধ তখন সবেমাত্র ক্লাস এইটে উঠেছে।অনিরুদ্ধর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা একসাথে যাতায়াত করতো।প্রায়ই সে অনিরুদ্ধর কাছে এটা ওটা চেয়ে খেতো।

___’অনিরুদ্ধ ভাই, একটু আসতে হাঁটো না।তোমার সাথে এত দ্রুত হাঁটতে কষ্ট হয় আমার।’

অনিরুদ্ধ পেছনে ফিরে তাকালো।মৃন্ময়ী তার থেকে অনেকটা পিছিয়ে পরেছে।সে একটা ধমক দিয়ে বলল,

___’খুব তো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলিস।আর কাজের বেলা ডাব্বা।সামান্য হাঁটতেও পারিস না ঠিকমতো।’

___’আমি হাঁটছি না তো তুমি কি আমায় কোলে করে নিয়ে যাচ্ছো?হেঁটেই তো যাচ্ছি। ‘

___’চুপ,একদম চুপ।তাড়াতাড়ি আয়।’

মৃন্ময়ী দৌঁড়ে অনিরুদ্ধর কাছাকাছি এলো।একটু হেঁটেই পেটের ক্ষুধা জানান দিল।সকাল বেলা খাওয়া হয়নি তার।পেট চেপে অনিরুদ্ধকে বলল,

___’আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে অনিরুদ্ধ ভাই। ‘

অনিরুদ্ধ চমকায়।নিজেকে সামলিয়ে বলে,

___’এই তোর সমস্যা কি রে?আমায় দেখলেই তোর ক্ষুধা পায়?সকালবেলা বাড়ি থেকে খেয়ে আসতে বারণ করে কে?রোজ রোজ কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানড় করিস।’

মৃন্ময়ী মাথা নিচু করে চুপচাপ তার পাশে হাঁটে।অনিরুদ্ধ হুট করে তার হাত চেপে ধরে সামনে এগোয়।গেটের কাছে পৌঁছে হাত ছেড়ে দেয়।ব্যাগের চেইন খুলে একটা বক্স বের করে বলে,

___’এই নে,এগুলো খেয়ে নিস।আর খবরদার, বাড়ির কেউ যেনো না জানে যে রোজ আমার থেকে এটা ওটা নিয়ে খাস।’

মৃন্ময়ী খুশিতে মাথা নাড়ে।চকলেট বক্সটা হাতে নিয়ে এক দৌঁড়ে ক্লাসে যায়।

পিঠে কারো হাতের স্পর্শে বাস্তবে ফিরে মৃন্ময়ী।চোখের জল মুছে বলল,

___’খালা,তুমি ঘুমাওনি?’

রেখা একটা বড় করে হামি দেয়। বলে,

___’ঘুমাইয়াই তো ছেলাম।হঠাৎ দেহি তুই নাই।তাই আসলাম।চল,ঘুমাই যাইগা।’

মৃন্ময়ী রেখার হাত ধরে রুমে আসে।এই মানুষটা তার খুব আপনজন।ছোটবেলা থেকে তাকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখে।মৃন্ময়ী রেখা খালাকে জড়িয়ে তার বিছানাতেই ঘুমিয়ে যায়।

__________________

অনিরুদ্ধ নিজের রুমে ছটফট করছে। আজ দুই,দুইটা দিন হলো সে বাড়িতে এসেছে। অথচ একবারের জন্যেও মৃন্ময়ীর দেখা মেলেনি।তার দেশে ফেরার একমাত্র কারণই তো এই মেয়েটি।অথচ টানা ৫২ ঘন্টা কেটে গেল এক পলকের জন্য মৃন্ময়ীর দর্শন মেলেনি।

রুমের মধ্যে সমানে পায়চারি করছে সে।নিজের উপর নিজেরই প্রচন্ড বিরক্তি উঠে যাচ্ছে।বাড়ির কাউকে জিজ্ঞেস করবে তাও করতে পারছে না।কাউকে জিজ্ঞেস করার আগেই সবাই এমন ভাব নেয় যেনো মৃন্ময়ী নামের কেউ এ বাড়িতে কেনোদিন ছিলই না।

সে এই দুই রাতে মোটামুটি সাড়া বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছে।কিন্তু মৃন্ময়ীর দেখা মেলেনি।কেন জানি মনে হচ্ছে মৃন্ময়ী হয়তো রেখা খালার সাথে থাকে।খালাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে।

সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে রেখা খালাকে ডাক দিল অনিরুদ্ধ। বলল,

___’খালা,আমার রুমে কফি দিয়ে যাও তাড়াতাড়ি।’

দশ মিনিটের মাথায় দরজার নক পড়লো।অনিরুদ্ধ বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো।

___’খালা,ভেতরে আসো।’

রেখা কফির মগটা টেবিলের উপর রাখলো।অনিরুদ্ধ জড়তা কাটিয়ে বলল,

___’খালা,মৃন্ময়ীর কি অবস্থা? ওকে তো দেখলাম না একবারো।’

___’ওই ছেমড়ি তো সারাডাদিন রুমের মধ্যেই থাহে।নিচে যে রুমডাতে আমি থাহি ও তো ওহানেই থাহে।আমার লগে।চউক্ষে দেহে না তো।হেজন্যি সারাডা দিন রুমেই থাহে।মাঝে মধ্যে মেলা রাইতে ডাইনিংএ বইসা থাহে।’

___’ওহ,আচ্ছা। ও বড় হয়ে গেছে তাই না?’

__’ও মা।মাইয়া তো আমার থেইকা বড় হই গেছে।কি সুন্দরডাই না হইচে।খালি এট্টু কানা!’

কথাটা বুকের ভেতর গিয়ে লাগলো অনিরুদ্ধর। আস্তে করে বলল,

__’খালা, তুমি এখন যাও।ঘুমাবো আমি।’

রেখা বের হতেই অনিরুদ্ধ দরজা আটকে বিছানায় বসলো।বুকের ভেতর হু হু করছে।গলা বার বার ধরে আসছে।খুব করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।

_________________

আজকে রাতেও সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মৃন্ময়ী বাইরে বের হলো।এটা তার নিত্যকাজে পরিণত হয়েছে।গায়ের ওড়না টা গায়ে ভালো ভাবে জড়িয়ে বার কয়েক হাঁটলো ফাঁকা জায়গাতে।শরীর একদম বসে গেছে তার।ইদানীং বড্ড দূর্বল লাগে।

সিঁড়ির প্রথম ধাপে বসে মাথার খোপা ছেড়ে দিল।একরাশ কালো কেশ পিঠ ছাড়িয়ে সিঁড়িতে আছড়ে পরলো।হাঁটুর ভাজে হাত রেখে বসে রইলো।

কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজের বা পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করে মুচকি হেসে বলল,

___’খালা, তুমি আজকেও ঘুমাওনি?রোজ রোজ এরকম ভালো লাগে না। আমি এখানে আসলেই তুমি জোর করে রুমে নিয়ে যাও।জানো না,সারাদিন রাত রুমে থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে!’

অনিরুদ্ধ হা করে মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে আছে।সেই বারোটা থেকে সিঁড়িতে বসে আছে মৃন্ময়ীর অপেক্ষায়। এখন তিনটে বাজে প্রায়।অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো।মৃন্ময়ীর দেখা মিলল।তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গেছে। মৃন্ময়ী কে এতটা কাছে পেয়ে বুকের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে শক্ত করে জড়িয়ে বুকের মধ্যে রাখতে।

অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীর পাশে থেকে উঠে তার মুখ বরাবর একটু দূরে হাঁটু গেড়ে বসলো।মৃন্ময়ীর চোখের দিকে তাকালো।ইশ!কি সুন্দর কাকচক্ষু।পানি যেনো টলমল করছে।কেউ বুঝতেই পারবে না এই চোখ দুটো বহু বছর আগে থেকে পৃথিবীর আলো দেখতে পায় না।

মৃন্ময়ীর বাম চোখের নিচের তিলটা এখনো আছে।ফর্সা মুখে চকচক করছে।কেমন ফ্যাকাশে লাগছে তাকে।অনিরুদ্ধ বুঝতে পারলো বহু বছর তার শরীরে সূর্যের আলো পড়েনি।আর পারলো না।ঝরঝর করে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো।

কাঁপা কাঁপা হাতে ডান হাতটা মৃন্ময়ীর হাতের ভাজে রাখলো।মৃন্ময়ী মাতাল করা এক হাসি দিয়ে অনিরুদ্ধর হাতটা শক্ত করে ধরলো।অনিরুদ্ধ আবারো কেঁপে উঠলো। মৃন্ময়ী বলল,

___’আমি আজ আর ঘুমাবো না খালা।একটুপর আযান দিবে।একেবারে নামায পড়ে ঘুমাবো।তুমি ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে। সকালে তোমার অনেক কাজ করতে হবে!’

অনিরুদ্ধ চুপচাপ তার মায়াপরীকে দেখে যাচ্ছে। কতগুলো বছর পর তাকে দেখছে।তার স্পর্শ উলোটপালোট করে দিচ্ছে।

মৃন্ময়ী আবারো মুখ খুলল,

___’খালা,তুমি কথা বলছো না কেন?আর তোমার হাত এত শক্ত হলো কি করে?’

অনিরুদ্ধ চমকে উঠলো।এবার কি উত্তর দিবে?মৃন্ময়ী তার পরিচয় শুনলে তো আবারো দূরে সরে যাবে।যা সে কিছুতেই চায় না।

মৃন্ময়ীর মনে কেমন খটকা লাগলো।সে বাম হাত দিয়ে বাড়িয়ে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে ডান হাত হাতড়ে অনিরুদ্ধর মুখ খুঁজলো।একটুপর অনিরুদ্ধর সাড়া মুখে হাত বুলালো।অনিরুদ্ধ চোখ বন্ধ করে ফেলল।তার চোখ দিয়ে এখনো অশ্রু ঝরছে।

মৃন্ময়ী আঁতকে উঠল। এটা তো খালা নয়।সে এক লাফে উঠে দাঁড়ালো। ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

___’ক-কে,কে আপনি?কে?কথা বলুন।’

অনিরুদ্ধ আর পারলো না।এক ঝটকায় মৃন্ময়ীকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল।অবশেষে ঝড় থামলো।বুকের ভেতর প্রশান্তির পরশ ছুঁইয়ে যাচ্ছে।এক যুগেরো বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে সে।আজ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।

মৃন্ময়ী ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।নিজেকে ছাড়ানোর জন্য উশখুশ করতেই অনিরুদ্ধ আরো শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো।

মৃন্ময়ী ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সামনের মানুষটাকে এক চুল নড়াতে পারলো না।সে কেঁদে দিল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here