পদ্মফুল #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা |১৭|

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৭|

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’

‘আমিও ভালো আছি।’

জবাব দিয়ে পদ্ম থামল। তারপর কিছুটা সময় নিয়ে আরাফাত আবার বললো,

‘আমি জানি আপনার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, আর সত্যি বলতে আমারও খানিক অস্বস্তি হচ্ছে। এর আগে কখনও এইভাবে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা হয়নি তো, তাই। পদ্ম, আমি আপনার সম্পর্কে সব কিছুই জানি। আন্টি আমাকে সব বলেছেন। আপনার সব কিছু জেনে শুনেই আমার পরিবার এই সম্বন্ধে রাজি হয়েছে। এখন বাকি’টা আপনার উপর ডিপেন্ড করছে, আপনি যা চাইবেন তাই হবে।’

পদ্ম ভাবছে, জবাবে এখন সে কী বলবে। অনেকক্ষণ ভেবে চিন্তে সে জবাব দিল,

‘আসলে, আমি এখন এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আর তাছাড়া আমি এই বাড়ির আশ্রিতা। সেই জন্য একটা অস্বস্তি আমার মধ্যে বরাবরই আছে। তবে আপনারা সবকিছু জেনে শুনেই কথা বলছেন, এটা জেনে আমি কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। আসলে, আমার সাথে এখন অবধি যা যা হয়েছে তার জন্য আমি ঠিক এখন আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মনে হয়, সবাই যেন আমার সাথে অন্যায় করছে। কে আমার ভালো চায় আর কে আমার খারাপ চায় সেটাও আমি বুঝে উঠতে পারছি না। আমি জানি, জীবন এইভাবে যাবে না, আমি সারাজীবন এখানে থাকতে পারবো না। আমার একটা পরিচয় প্রয়োজন, একটা পরিবার প্রয়োজন আর তার জন্য আমাকে বিয়ে করতে হবে। আজকে না করলেও কোনো একদিন তো করতে হবে। আর আপনার সম্পর্কেও বড়ো মা আমাকে বলেছেন। উনিও আমার উপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছেন না; আমাকে ভাবার জন্য সময় দিয়েছেন। জানেন তো, উনারা আমার জন্য অনেক করছেন; উনাদের ঋণ হয়তো আমি কখনো চোকাতে পারবো না। কিন্তু হয়তো, এই বিয়েটা করে উনাদের কিছুটা হলেও খুশি করতে পারবো। আর তাছাড়া আমি নিজেও এই বাড়িতে আর থাকতে চাই না। পারলে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতাম। (একটু থেমে) আচ্ছা, আপনারা আমাকে কেন পছন্দ করলেন বলুন তো? আমার তো মনে হয়, আমাকে পছন্দ করার মতো তো আমার মাঝে কিছু নেই। তাহলে?’

আরাফাত হাসল। বললো,

‘কে বলেছে, কিছু নেই? জানেন তো, আপনার মাঝে এক অদ্ভুত জিনিস আছে আর সেটা হলো আপনার এই সরলতা। আর এই জিনিসটা কিন্তু আর কারোর মাঝে নেই। আপনি খুব সৎ, আপনার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। আসলে, আমি চাই এমন একজন-কে যে কখনো আমাকে ঠকাবে না, যে আমার পরিবারকে ভালোবাসতে পারবে। যার ভালোবাসার মাঝে কোনো প্রকার স্বার্থ থাকবে না। আর আমার মনে হয়, আপনি ঐরকম একটা মেয়ে যে আমার পরিবারকে ভালোবেসে আগলে রাখতে পারবেন। নিজের কাঁধে আমার পরিবারের দায়িত্ব তুলে নিতে পারবেন। আমার আর কিছু চাই না, চাই শুধু ভালো একটা মানুষ। আর আপনিই সেই ভালো মানুষ। যাকে আমি হয়তো চোখ বুজে বিনা দ্বিধায় ভরসা করতে পারবো। কি, পারবো না?’

পদ্ম বোধ হয় লজ্জা পেয়েছে। সে মাথা নিচু করে তার হাতের আঙ্গুল দেখছে। আরাফাত বললো,

‘আপনার যত খুশি সময় নিতে পারেন। আপনি যত বেশি সময় নিবেন ততটা গভীর ভাবে আমাকে চিনতে পারবেন। তখন আর আপনার মনের ভেতর কোনো দুটানা থাকবে না। তাই যথেষ্ট সময় নিন, সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিন, কেমন?’

পদ্ম নরম সুরে বললো,

‘আচ্ছা।’

‘ঠিক আছে তাহলে, আজ রাখছি। আবার পরে কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ।’

‘আল্লাহ হাফেজ।’

ফোনটা বিছানায় রেখে পদ্ম বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। মানুষ’টার ব্যবহার তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আর মানুষের ব্যবহার’ই তো বলে দেয় মানুষ’টা আসলে কেমন। উনার ব্যবহার ভালো, তার মানে উনিও ভালো। কিন্তু…কিন্তু সত্যিই কি শুধু মাত্র মুখের কথা দিয়ে একটা মানুষকে বিচার করা যায়? ব্যবহার তো ঐ আকবর সাহেবেরও ভালো ছিল। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে মানুষ’টা তো নিকৃষ্ট। তবে এটাও ঠিক, পৃথিবীর সবাই তো আর খারাপ না, এখনও অনেক ভালো মানুষ আছেন। হয়তো আরাফাতও তাদের মধ্যে একজন।

পদ্ম সবকিছু খুব পজিটিভলি নিল। আর কত খারাপ ভাববে সে? যত খারাপ ভাবছে তার সাথে ততই খারাপ হচ্ছে। এখন থেকে সবকিছু সে ভালো ভাববে আর খারাপ কিছু ভাববে না। চিন্তা ভাবনা ভালো হলেই জীবনে ভালো কিছু হবে, নয়তো না।
.
.
দুপুরের খাওয়া শেষ করে পদ্ম নিজের রুমে চলে এলো। রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব তখনও খাচ্ছিলেন। পদ্ম রুমে এসে কী যেন একটা খুঁজছে। শেলফে রাখা বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখছে সে। না নেই। সুজানার একটা ছবি ছিল, সেটা এখন পাচ্ছে না সে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সঞ্চয়িতা” বইয়ের মাঝে ছবিটা পেয়েছিল সে। কিন্তু এখন আর সেখানে ছবিটা নেই। সে অনেক খুঁজেও পায়নি সেটা। হতাশ হয়ে বিছানায় বসলো সে। ছবিটা উধাও কী করে হয়ে গেল? এই বইয়ের মাঝেই তো ছিল, কোথায় গেল এখন? কেউ কি এখান থেকে নিয়ে গিয়েছে? কিন্তু কে’ই বা নিবে? তার রুমে তো তেমন কেউ আসে না, বড়ো মা আর আকবর সাহেব..আকবর সাহেবের কথা মনে পড়তেই পদ্ম’র মনটা যেন হঠাৎ কেমন করে উঠল। সুজানা নিখোঁজ, আজকে এতদিন। এত ভালো ভালো গোয়েন্দারাও তাকে খুঁজে বের করতে পারলো না, ব্যাপারটা খুব সন্দেহজনক। মেয়েটা যাবে তো যাবে কোথায়? আর হুট করে উধাও ই বা কী করে হয়ে গেল? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণ আছে। আর সে গায়েব হওয়ার আগে ডাক্তারবাবুকে কিছু বলতে চাইছিল। সেটাই বা কী?

পদ্ম’র মাথায় অনেক ধরনের চিন্তা আসছে। যদিও এসব নিয়ে ভেবে সে লাভের লাভ কিছুই করতে পারবে না। তাও আজ হঠাৎ মেয়ে’টার কথা তার মনে পড়ল, আকবর সাহেবের মুখে তার নাম শুনে। নিচে তাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। হয়তো তারা ভেবেছিল, পদ্ম সুজানাকে চেনে না। তাই আকবর সাহেব পদ্ম’র সামনেই বলছিল,

‘বুঝলে তো রুবি, এই সুজানা চলে যাওয়ার পর থেকেই আমাদের ছেলের জীবন বদলে গিয়েছে। মেয়েটা আমাদের ছেলের জীবনের একটা বোঝা ছিল। সবসময় দেখতে না ওর পেছন পেছন কেমন ঘুরত, খালি সুবিধা ভোগ করার জন্য। কী যে লোভী ছিল মেয়েটা! আর দেখোই না এই যে আমাদের পদ্ম, কত ভালো একটা মেয়ে। বিন্দু মাত্র লোভ নেই ওর মাঝে। কত সুন্দর আমাদের সাথে মিশেছে, যেন আমাদের নিজের মেয়ে। ওর জায়গায় যদি এখন ঐ সুজানা থাকতো তাহলে এতক্ষণে রাক্ষসীর মতো আমাদের সম্পত্তি সব খেয়ে নিত।’

তখন আকবর সাহেবের কথার সাথে রুবি হোসেনও খুব সুন্দর করে তার মেলাচ্ছিলেন। পদ্ম ভীষণ অবাক হয় তাদের কথা বার্তাগুলো শুনে। সুজানা, মেয়েটা নিশ্চয়ই এতটা খারাপ ছিল না যেভাবে উনারা বলছেন। ডাক্তারবাবু তো মেয়েটাকে ভালোবাসতো; নিশ্চয়ই সবকিছু দেখে শুনেই ভালোবেসেছে? তাহলে উনারা এইভাবে কেন বলছেন? আর হয়তো তাই সুজানা হারিয়ে যাওয়াতে উনারা এত খুশি হয়েছেন। একটুও কি খারাপ লাগেনি উনাদের? এইভাবে একটা মেয়ে উধাও হয়ে গেল, আর তাতে উনাদের বিন্দু মাত্র খারাপ লাগল না? আশ্চর্য!

পদ্ম এখনও বসে বসে বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছে। তখনই তার রুমে আকবর সাহেব এলেন। উনাকে দেখা মাত্রই পদ্ম রেগে যান। কাঠ কাঠ গলায় বলে,

‘কী চাই আপনার?’

আকবর সাহেবের চোখ মুখ যেন হঠাৎ শুকিয়ে উঠল। ধরা গলায় বললেন,

‘আমাকে ক্ষমা করবে, মা?’

পদ্ম এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো,

‘আবার কেন নাটক করছেন আপনি? আপনাকে না আমি বারণ করেছি, আমার সামনে এসব নাটক দেখাতে। আপনি কি চান আমি বড়ো মা’কে গিয়ে সবকিছু বলি?’

‘আমি নাটক করছি না মা। আমার ভুল হয়েছে। আমার তোমার সাথে ঐভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। আমি জানি তোমার খারাপ লেগেছে। বিশ্বাস করো, এতদিন শয়তান আমাকে ধোঁকা দিচ্ছিল। এখন আমি বুঝেছি, আমি যা করেছি তা তো পাপ। তুমি আমার মেয়ের মতো, আর তোমার দিকে আমি ঐরকম দৃষ্টিতে…ছি ছি ভাবতে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে এখন। আজ সকাল থেকেই আমার খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, খুব বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি আমি; তাই ক্ষমা চেতে এসেছি তোমার কাছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি আর এমন হবে না দেখো। প্লীজ আমায় ক্ষমা করে দাও।’

পদ্ম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। এই লোকটা এইভাবে হুট করে কিভাবে বদলে গেল? বদলে যাওয়া কি এতই সহজ? আদৌ কি উনি উনার ভুল বুঝতে পেরেছেন, নাকি এটা আবার উনার নতুন কোনো নাটক?

পদ্ম বললো,

‘আমি জানি না আদৌ আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন কিনা? কিন্তু, যেহেতু আপনি ক্ষমা চাচ্ছেন তাই আমি বলবো ক্ষমা করার আমি কেউ না। আজকে ক্ষমা করলে দেখা যাবে কাল আপনি আবার একই কাজ করবেন তখন আবার এসে ক্ষমা চাইবেন। অন্যায় করেছেন আর সেটা যেহেতু আপনি বুঝতে পেরেছেন তাই বলবো, শুধরে যান। বড়ো মা এসব শুনলে কষ্ট পাবেন তাই আমি উনাকে কিছু বলিনি। আপনি যদি শুধরে যান তাহলে আমি এই ব্যাপারে উনাকে কিছু বলবোও না। আপনাকে হেনস্থা করার কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই। আপনি আমার বাবার বয়সী, আপনাকে আমি বাবার চোখে দেখি। তাই আশা করবো, আজ থেকে আপনিও আমাকে আপনার মেয়ের চোখেই দেখবেন।’

আকবর সাহেব মাথা হেলিয়ে মোলায়েম গলায় বললেন,

‘তুমি খুব ভালো মা, খুব ভালো। দেখো, আজ থেকে আমি একদম বদলে যাবো। একজন ভালো বাবা হয়ে দেখাবো।’

আকবর সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পদ্ম এখনও ভেবেই চলছে, হলো’টা কী উনার। সত্যিই কি উনি আজ থেকে ভালো মানুষ হয়ে যাবেন? যদি এমনটা হয় তাহলে তো ভালো। অন্তত তাকে তো আর এইভাবে আর ভয়ে ভয়ে বাঁচতে হবে না…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here