পদ্মফুল #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা |২৯|

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২৯|

রুবি হোসেন পদ্ম’র কেবিনে গিয়ে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলেন। আর উনাকে দেখা মাত্রই পদ্ম ভয়ে জড়ো হয়ে বসল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন,

‘আমাদের ভুল হয়েছে মা, আমাদের তুমি ক্ষমা করে দাও। আমরা জানি আমরা তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি। তুমি আমাদের উপর খুব রেগে আছো, তাই হয়তো ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা করবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমরা সত্যিই খুব অনুতপ্ত। ক্ষমা করে দিও আমাদের। আমাদের ভুলের শাস্তি স্বরূপ আমাদের এখন জেলে যেতে হবে। হয়তো বাকি জীবন’টা ঐ কারাগারের মাঝেই কাটাতে হবে। আমার ছেলেটা একা মা, তুমি ওকে দেখো। ওকে বুঝিও। আর বলো, পারলে যেন ও আমাদের ক্ষমা করে দেয়।’

রুবি হোসেন শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক মুখ মুছলেন। অফিসার বললেন,

‘হয়েছে, এবার চলুন।’

রুবি হোসেন কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,

‘একটু অফিসার…’

এই বলে তিনি পদ্ম’র কাছে গেলেন। পদ্ম বিছানার এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে। রুবি হোসেন তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। ধরা গলায় বললেন,

‘পারলে ক্ষমা করে দিও। নয়তো এই পাপের বোঝা আমাদের সারাজীবন বয়ে চলতে হবে।’

পদ্ম কিছু বলে না। চুপচাপ শক্ত হয়ে বসে আছে। রুবি হোসেন সেই ফাঁকেই তার কোমর থেকে ছুরি’টা বের করে পদ্ম’র পে*ট বরাবর ঢু*কিয়ে দিল। প্রথমে পদ্ম কিছু বুঝলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ তার মনে হলো তার পেটে কেন যেন খুব তীব্র ব্যথা করছে। রুবি হোসেন ততক্ষণে তাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে হেসে বলতে লাগলেন,

‘নিন অফিসার, এবার আপনি আমায় এরেস্ট করুন। এবার আমার মনে হচ্ছে আমি সত্যিই একটা অন্যায় করেছি।’

অফিসার হতভম্ব হয়ে পদ্ম’র পে*টের উপর আটকে থাকা ছুরি’টার দিকে তাকিয়ে আছেন। পদ্ম বাকরুদ্ধ। সেখানের নার্স চেঁচিয়ে উঠল,

‘এটা কী করলেন আপনি?’

রুবি হোসেন হাসছেন। আকবর সাহেবও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। উনার স্ত্রী যে এতটা ভয়ানক সেটা তিনি আগে জানতেন না। অফিসার উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বাকি পুলিশদের ডেকে রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবকে থানায় নিয়ে যেতে বললেন। তারপর তিনি হাতে একটা রুমাল নিয়ে পদ্ম’র পেট থেকে ছুরি’টা বের করতেই সেখান থেকে র*ক্তের বন্যা ছুটল। এতক্ষণ পদ্ম বসে থাকলেও, এবার সে হেলে পড়ল। নিস্তেজ হয়ে জ্ঞান হারাল সে।

.

এত সব খবর মিনিটেই পুরো হসপিটালে ছড়িয়ে পড়েছে। অভি আর আদিদ দুজনেই ছুটে আসে। পদ্ম’র কেবিনে এসে দেখে নার্স তার র*ক্ত বন্ধ করার চেষ্টায় ব্যস্ত। আদিদ-কে দেখে অফিসার বললেন,

‘আপনার মা এটা কী করলেন? এমনিতেই তো উনার অন্যায়ের কোনো শেষ ছিল না এখন আবার উনি একজন মানুষকে আমার চোখের সামনে মা*রতে পর্যন্ত চেয়েছিলেন, উনার মধ্যে কি নূন্যতম মনুষ্যত্ব নেই? কী ভয়ানক মহিলা, ভাবা যায়! আমার চোখের সামনে এত কিছু করেছে…আপনার মায়ের নামে আমি নিজে কেইস লিখবো। আমিও দেখে নিব, উনি কীভাবে বাঁচেন।’

আদিদ জবাবে কিছু বললো না। সে পদ্ম’র কাছে ছুটে গেল। পেটের কাছে র*ক্ত’টা ভালোভাবে পরিষ্কার করে দেখল খুব বেশি একটা ক্ষত না হলেও একটা সেলাই লাগবে। সে নার্স’কে সব জিনিসপত্র আনতে বললো। তারপর অফিসার আর অভিকে বললো,

‘আপনারা দয়া করে বাইরে যান। আমি দেখছি ওকে।’

অফিসার ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,

‘দেখবেন, ম*রে টরে গেলে কিন্তু আপনার মা’কে ফাঁ*সির হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’

আদিদ চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো, সে কেন ম*রে যাচ্ছে না? আর কিসের জন্য বাঁচবে সে? এতকিছুর পরও বুঝি কারো বাঁচতে ইচ্ছে করে…?

.
.

কিছু সময় পর,

আদিদ কেবিন থেকে বেরিয়ে বললো,

‘পদ্ম এখন ঠিক আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।’

অফিসার বললো,

‘ঠিক আছে। আমরা থানায় যাচ্ছি তাহলে। আপনার মা বাবার কাছ থেকে তো এবার সবকিছুর স্বীকারোক্তি নিতে হবে। আর আপনার যদি এই ব্যাপারে কিছু বলার থাকে তবে থানায় এসে বলবেন।’

অফিসার কথাটা বলে চলে যেতে থাকে। আদিদ একবার ডাকে উনাকে। তিনি পেছন ফিরলে আদিদ শক্ত গলায় বলে,

‘অপ*রাধীদের যেন কঠিন শাস্তি হয়।’

অফিসার মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যান। অভি বুঝতে পারছে আদিদের বুকের ভেতরটা কেমন করছে। সে আদিদের কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিদ বলে,

‘দোস্ত, এখান থেকে চলে যা। আমি একটু একা থাকতে চাই। প্লীজ, আমাকে আর বিরক্ত করিস না।’

অভি তার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। আদিদ তার কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। অভি জানে আদিদ এখন কেবিনে গিয়ে ফ্লোরে শুয়ে অঝোরে কাঁদবে কিছুক্ষণ। তারপর সে নিজেকে নিজে বোঝাবে। নিজেকে তো বুঝিয়ে সুঝিয়ে যেই ভাবেই হোক বাঁচিয়ে তো রাখতে হবেই, তাই না। আর যদি আজ আত্ম*হ*ত্যা সহজ হতো তবে…তবে আদিদ হয়তো বেঁচে যেত।

কিন্ত আদিদ হয়তো আর কেবিনে যেতে পারবে না, কারণ তার আগেই একটা নার্স এসে বললো, দু’শত বারো নাম্বার কেবিনের পেশেন্টের শরীর নাকি হঠাৎ করে খারাপ করেছে। হলোও তাই, কথাটা শোনা মাত্রই আদিদ আর কেবিনে ঢুকল না, সে তার অসুস্থ মন নিয়েই ছুটল তার অসুস্থ পেশেন্টকে সুস্থ করার জন্য।

অভি হসপিটালে থেকে যায়। সে সেখানের বাকি মেয়েদের কাছ থেকে তাদের বাড়ির ঠিকানা নেয়। সবার বাড়ির লোক আসে। এক ভয়ংকর কান্নায় মেতে উঠে সবাই। হসপিটালে যেন একটা হৈ চৈ লেগে গিয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে মিডিয়ার লোকেরাও চলে এসেছে। তারা আজ জম্পেশ এক ব্রেকিং নিউজ বানাতে পারবে। এসেই তারা পদ্ম সহ বাকি মেয়েদের খুঁজতে থাকে। অভি তাদের কাউকেই ভেতরে যেতে দেয়নি। ইনফ্যাক্ট আদিদের কেবিনেও তাদের ঢুকতে দেয় না। যা বলার সে বলেছে। কারণ সে জানে এই লোকগুলোকে ভেতরে পাঠালে এরা আবার এটা ওটা বলে আদিদের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে দেবে। তাই অভি তাদের এটা ওটা বলে কোনোরকমে বিদায় করে।

সব ঝামেলা মেটার পর সে আদিদের কেবিনের কাছে যায়। দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখে সেটা লক করা। অভি নক করে, বারবার দরজা খুলতে বলে কিন্তু আদিদ কোনো জবাব দেয় না। সে কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে এবার পদ্ম’র কেবিনের দিকে যায়।

ধীর পায়ে পদ্ম’র কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। নার্স তখন বলেছিল পদ্ম’র জ্ঞান ফিরেছে তবে তার মাঝে নাকি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সে এখনও চোখ বুজে পড়ে আছে। হয়তো ঘুমাচ্ছে। অভি তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে দেখলে মায়া হয়। এইটুকু বয়সে কত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে। চেহারাতে এখনও তার ফুটে আছে প্রচন্ড ভয়ের ছাপ। কেমন ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্থ হয়ে আছে মুখটা। যেন মনে হচ্ছে, কেউ পদ্ম বিলের তাজা পদ্ম ফুলটাকে উপড়ে ফেলেছে।

অভি কী ভেবে পদ্ম’র মাথায় হাত রাখে। তারপর সেই হাতটা গালে রাখবে ভেবে কাছে নিতেই সে আবার হাতটা সরিয়ে নেয়। কেমন যেন লাগে তার কাছে। সে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আদিদের কেবিনের কাছে গিয়ে আবার সে দরজা ধাক্কাতে আরম্ভ করে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here