পদ্মফুল #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা |৩১|

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩১|

আদিদ বিরক্ত কন্ঠে বললো,

‘কেন? দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব পড়েছে যে তোকে ঐ মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে? আর তাছাড়া আন্টিও কখনো রাজি হবে না।’

অভি বললো,

‘আমি মা’কে রাজি করিয়ে নিব। মা কবে থেকেই বলছিল আমার কোনো পছন্দ আছে কিনা, আমার যাকে পছন্দ মা নাকি তাকেই ছেলের বউ বানাবে। তাই আমার মনে হয় না মা কোনোভাবে বারণ করবে।’

‘তাহলে তো হয়েছেই, করে ফেল বিয়ে।’

অভি চিন্তিত কন্ঠে বললো,

‘কিন্তু, পদ্ম কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?’

‘সেটা আমি কী করে বলবো? গিয়ে জিজ্ঞেস কর পদ্মকে।’

অভি কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বললো,

‘তুই ফিউচার নিয়ে কিছু ভাবছিস না? না মানে এইভাবে কি আর একা থাকা যায়?’

আদিদ গম্ভীর সুরে বললো,

‘একা কোথায় দেখলি, তুই আছিস না?’

অভি নরম সুরে বললো,

‘আমি কি সারাজীবন থাকবো? তোর তো একজন জীবনসঙ্গী প্রয়োজন, যে সবসময় তোকে আগলে রাখতে পারবে। তোকে তোর মতো করে বুঝতে পারবে। আর তো….’

‘হয়েছে থাম। আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। যাকে প্রয়োজন ছিল তাকে যখন পাইনি তখন আর কাউকে লাগবে না আমার। আর আমি এইভাবেই ভালো আছি। আর ভবিষ্যতেও এইভাবেই ভালো থাকতে পারবো। আমাকে নিয়ে আর ভাবিস না। তুই তোর কাজ আর বিয়েতে ফোকাস কর।’

অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বললো,

‘আমি জানি তুই সুজানাকে কখনো ভুলতে পারবি না। প্রথম ভালোবাসা কখনো ভুলা যায় না, সেটা আমিও জানি। তবে জীবন তো আর কারোর ভালোবাসার জন্য থমকে থাকে না। জীবন জীবনের গতিতে চলতে থাকে। আর সেই গতির সাথে তাল মিলিয়ে মানুষকেও চলতে হয়। তোর বর্তমান অবস্থাটা আমি টের পাচ্ছি। যতই তুই উপর দিয়ে নিজেকে খুব স্ট্রং দেখাস না কেন, ভেতরে ভেতরে যে তুই তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিস সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। এতকিছু কে সহ্য করতে পারে, বল? কিন্তু তুই তো কাউকে কিছু বলবি না। যতই কষ্ট হোক মনের মধ্যে সব কিছু চেপে রেখে দিবি। আমাকেও কিছু বলবি না। আর তাই বলছিলাম তোর লাইফে এমন একজন মানুষ দরকার যাকে তুই কিছু মুখ ফুটে না বললেও সে সবকিছু বুঝে নিতে পারবে। এখনই বলছি না যে সবকিছু হোক। সময় নে তুই। নিজেকে প্রস্তুত কর। কিন্তু প্লীজ, থমকে যাস না।’

আদিদ চোখ বুজল। ধীর গলায় বললো,

‘আর কিছু বলবি?’

অভি বলে,

‘না, আমার আর কিছু বলার নেই। পারলে তুই ভাবে দেখিস। এখন উঠছি তাহলে।’

অভি চলে যায়। আদিদ চোখ বুজে চেয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকে। এতকিছু ভাবার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই আপাতত তার নেই।

.
.

দুপুরের রোদ কমে প্রকৃতিতে বিকেলের আনাগোনা। এই সময় রাস্তার পাশের বাগানটাতে অনেকেই হাঁটতে আসে। অনেক বাচ্চারা আসে খেলার জন্য। মাঝে মাঝে কিছু কম বয়স্ক ছেলে মেয়েদের দেখা যায়, যারা ঐখানে হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করে। আজও সেই বাগানটাতে অনেক মানুষ এসেছে। কেউ এসেছে দলবল নিয়ে বা কেউ এসেছে একা। পদ্ম’র আজকাল বিকেল কাটে ঐ মানুষগুলোকে দেখে। এই যে বাইরে এত হৈ চৈ, এত মানুষের আনাগোনা কিন্তু এই কোনোকিছুই তার মনে কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে না। পদ্ম নিজেও জানে না সে কী ভাবে। কিন্তু সেদিন সে তার ভাবনার মাঝেই অদ্ভুত এক কাজ করে বসে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই সে ফলের ঝুড়ির উপর থেকে ছু*রি টা নেয়। তারপর সেটা তার হাতের উপর বসাতেই সেখানে নার্স চলে আসে। নার্স ব্যাপারটা বোঝা মাত্রই চিৎকার দিয়ে উঠে,

‘কী করছো, পদ্ম?’

নার্সের চিৎকারে তখন পদ্ম’র হুঁশ ফেরে। নিজের হাতে ছু*রি দেখে ভয়ে সেটা ফেলে দেয়। তারপর হুট করেই কাঁদতে আরাম্ভ করে। তার কী হয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারে না। এমন অনেক কিছুই আজকাল সে করছে যেগুলোতে তার কোনো হুঁশ থাকে না।

কিছুক্ষণ পর, তার কেবিনে আদিদ এলো। এসে বললো,

‘এদিকে এসে বসুন। আপনার সেলাই’টা কা*টতে হবে।’

পদ্ম খানিকটা চমকে পেছন ফেরে তাকাল। দেখল আদিদ ব্যস্ত হয়ে সেলাই কা*টার জিনিসগুলো আলাদা করছে। পদ্ম গিয়ে বেডে বসলো। নার্স বললো,

‘শুয়ে পড়ো।’

পদ্ম শু’লো। নার্স তার পেটের উপর থেকে কাপড়’টা সরিয়ে সেলাইটা দেখল ভালোভাবে শুকিয়েছে কিনা। তারপর সে আদিদকে বললো,

‘স্যার, সবকিছু ঠিকঠিক আছে।’

আদিদ কাছে এসে দেখল। তারপর আস্তে করে সাইড থেকে ব্যান্ডেজ’টা খুলল। পদ্ম চোখ বুজে শুয়ে আছে। আগেরবার সেলাই খোলার সময় সে ব্যাথায় অনেক কান্নাকাটি করেছিল। এবারও তার ব্যাথা লাগছে। তবে তার আর এবার কান্না পাচ্ছে না। কারণ এই ব্যাথা সে আর আগের ব্যাথার মতো অনুভব করতে পারছে না। আসলে মনের ব্যাথা বেশি থাকলে সেই ব্যাথার সামনে শরীরের ব্যাথা ফিকে পড়ে যায়।

সবকিছু শেষ করে আদিদ বললো,

‘হয়ে গেছে। এখন শুধু এইখানে এই ঔষধ’টা লাগাবেন, তাহলেই হবে।’

কথা’টা বলে আদিদ ঔষধ’টা নার্সের কাছে দিয়ে বললো,

‘প্রথমবার আপনি লাগিয়ে দেখিয়ে দিন।’

নার্স পেটের ক্ষত অংশে ভালোভাবে ঔষধ’টা লাগিয়ে দিল। আদিদ তখন বললো,

‘কোনো অসুবিধা হলে বলবেন।’

বলেই সে চলে চাচ্ছিল। আবার কী ভেবে ফিরে এসে বললো,

‘আগামীকাল আপনাকে এখান থেকে রিলিজ দেওয়া হবে। কোথায় যাবেন, ভেবেছেন কিছু?’

পদ্ম ঢোক গিলল। আস্তে করে বললো,

‘না।’

আদিদ ঠান্ডা গলায় বললো,

‘অভির একটা আশ্রম আছে। চাইলে সেখানে যেতে পারেন। আর না চাইলে আমি জোর করবো না। তবে এখানেও আমি বেশিদিন কোনো পেশেন্টকে রাখতে পারবো না, নিয়ম নেই। তাই এখন ভেবে দেখুন কী করবেন।’

পদ্ম নিরব হয়ে তাকিয়ে রইল। আদিদ চলে গেল সেখান থেকে। পদ্ম’র চোখের কোণ বেয়ে তরল উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়ল। নার্স তার কাছে এসে মোলায়েম কন্ঠে বললো,

‘আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে?’

পদ্ম হাত দিয়ে চোখের কোণ মুছল। মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘না।’

‘তাহলে কোথায় যাবে?’

পদ্ম’র কান্না পাচ্ছে। এই এত বড়ো পৃথিবী, অথচ তার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। কী অদ্ভুত! পৃথিবী এত বড়ো হয়ে লাভ’টা হলো কী, যদি না তার মতো একটা ক্ষুদ্র মানুষের এই পৃথিবীতে থাকার মতো কোনো জায়গাই না থাকে।

পদ্ম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বললো,

‘জানি না।’

.

রাত আট’টার দিকে হসপিটালে পুলিশ এলো। দু’জন অফিসার আদিদের কেবিনে ঢুকলেন। তাদের দেখে আদিদ ভীষণ বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললো,

‘বসুন।’

অফিসার দু’জন বসলেন। একজন বললেন,

‘আপনি তো দেখছি কোনো খবরই রাখছেন না। আপনার মা বাবা জেলে, তাদের তো একবার দেখতেও যেতে পারেন।’

আদিদ শক্ত গলায় বললো,

‘সময় হয়ে উঠেনি।’

অফিসার হাত ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে বললো,

‘ডি এন টেস্টের কাজ কতটুকু এগুলো, খবর নিয়েছেন?’

‘এটা খুব সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার। তবে ওরা চেষ্টা করছে। বলেছে কাল পরশুর মধ্যে রিপোর্ট বের করে ফেলতে পারবে।’

অফিসার নিশ্বাস নিলেন। বললেন,

‘আপনার মা বাবা তো সবকিছু স্বীকার করে নিয়েছেন, জানেন সেটা? উনারা নিজের মুখেই বলেছেন যে উনারাই সুজানাকে মে*রেছেন আর শুধু মা*রেনই নি তাকে লুকানোর জন্য ঐ আলমারিতে রেখে দিয়েছিলেন যেন কেউ তাকে খুঁজে না পায়। আর তাছাড়া আপনার মা বাবা বিশাল এক নারী পাচার চক্রের সাথে জড়িত। শুধু পদ্ম না, উনারা আরো অনেক মেয়েকেই এইভাবে ফাঁসিয়েছেন। এখন কাল আমরা উনাদের কোর্টে তুলব। তখন আদালতই সিদ্ধান্ত নিবে উনাদের কী শাস্তি দেওয়া যায়। তাই আপনিও কাল সকাল দশ’টায় কোর্টে চলে আসবেন। আপনাকেও স্বাক্ষী হিসেবে সেখানে থাকতে হবে।’

আদিদের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘আমাকে কি থাকতেই হবে?’

‘জ্বি অবশ্যই।’

আদিদ জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে। কাট কাট গলায় বলে,

‘ঠিক আছে, আমি যাবো।’

অফিসার তারপর বললো,

‘পদ্মকে কখন রিলিজ দিবেন?’

‘কাল।’

‘তো উনি এখন যাবেন কোথায়?’

‘আমি জানি না। আপনারা উনার সাথে গিয়ে কথা বলুন।’

‘ঠিক আছে তাহলে, আমরা উনার কেবিনে যাচ্ছি।’

‘আচ্ছা।’

অফিসাররা পদ্ম’র কেবিনে গেল। তার সাথে অনেকক্ষণ কথা বললো। কাল তাকেও কোর্টে যেতে হবে। তার সাথে হওয়া সমস্ত অন্যায় কোর্টে বলতে হবে। তারপর কোর্ট উনাদের শাস্তি দিবে। কঠিন শাস্তি। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে পদ্ম চলে যাবে। কোথায় যাবে সে জানে না। আচ্ছা, ডাক্তারবাবুর বন্ধুর আশ্রমে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? অফিসাররাও তাকে সেখানেই যেতে বলছে। পদ্ম ভেবে পায় না, ভাবতে গেলেই তার বার বার মনে হয়, “আবার সে ঠকবে না তো?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here