পার্থক্য পর্ব-১০

0
1042

পার্থক্য

১০ পর্ব।

#রিফাত_হোসেন।

তারিনের কথাতে সবাই মত দিলো। মাঝি ভাইকে বলল নৌকা ঘাটের দিকে নিয়ে যেতে। আস্তে আস্তে নৌকা ঘাটে চলে এলো। এবার বিদায় নেওয়ার সময়। সবাই একদিকে যাবে কিন্তু তারিনের বাড়ি অন্য দিকে। তিশাকে বলল তারিন কে বাড়ি পৌঁছে দিবে। তাই সবাই মিলে তারিনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। রিফাত একবার আড়চোখে তারিনের দিকে তাকালো। তারিনের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলো কিছুক্ষন আগের তারিন আর এখনকার তারিনের মাঝে অনেকটা পার্থক্য। তারিন চুপ করে এক মনে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ তিশা বলে উঠলো – ‘দুলাভাই শুধু দেখলে হবে। দু’একটা গান ও তো শোনাতে পারেন।

সবাই অবাক হয়ে তিশার দিকে তাকিয়ে রইলো। সবার থেকে বেশি অবাক হয়েছে রিফাত আর তারিন। তিশা কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেলো। সবাই এমন ভাবে তাকিয়ে আছে তিশার দিকে, যেন তিশা চিড়িয়াখানার বাঘ। তিশা ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত কে দুলাভাই বলে না জানি কত বড় অপরাধ করে ফেলেছে।

তিশা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল – ‘সবাই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

তারিন রাগে কটকট করতে করতে বলল – ‘তুই একটু আগে কী বললি?’

তিশা এমন একটা ভাব নিয়ে বলল যেন কিছুই হয়নি – ‘কী বলেছি একটু আগে?’
– ‘তুই ওনাকে দুলাভাই কেন বললি।’
– ‘আসলে, মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছে।
– ‘তোর মাথাটা সত্যিই গেছে। ভাল ডাক্তার দেখিয়ে নিস।’
– ‘আচ্ছা’
– ‘এখন কোন গান করতে হবে না, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।’

পাশ থেকে রিফাত বলে উঠলো – ‘এটাই তো রোমান্টিক মুহূর্ত।’

তারিন রাগি মুড নিয়ে বললো – ‘আপনি কী বৌ নিয়ে বেড়াতে আসেছেন নাকি, যে রোমান্টিক মুহূর্ত খুঁজছেন।’

রিফাত নিচু কন্ঠে বলল – ‘সেই অপেক্ষাই তো আছি।’
– ‘কী বললেন?’
– ‘কই কী বললাম?’

আরিফ সাহেব বলল – ‘আচ্ছা তোমরা এখন ঝগড়া বাদ দেও। এখনও অন্ধকার হয়নি। পাশেই চায়ের দোকান। এই নদীর পাড়ে বসে কুয়াশার আড়ালে চা খেতে খেতে গান শুনলে কেমন হয়। কী সুন্দর বাতাস। এটাই গান গাওয়ার জন্য পারফেক্ট সময়।

– ‘হ্যাঁ তুমি একদম ঠিক বলেছো। তারিন প্লিজ আর না করিস না।’

তারিন আর না করলো না। কারণ তারিনের ও ইচ্ছে করছিল রিফাতের কন্ঠে একটা গান শুনবে। তাই সাথে সাথে তারিন রাজি হয়ে গেল।

আরিফ সাহেব বলল – ‘সবাই এখানে বসো। আমি চা নিয়ে আসছি।’

আরিফ সাহেব চা আনতে চলে গেল। সবাই নদীর পাড়ে বসে পড়লো। রিফাত মাঝখানে আর ডানপাশে তারিন বা’পাশে তিশা বসে আছে। রিফাত আর আরিয়ান গিটারে সুর তুলছে। তারিন একমনে রিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে ছেলেটা খুব সুন্দর গান গায়। দেখতেও অনেকটা ভাল। খুর স্মার্ট আর ভদ্র। আরিফ সাহেব দোকানে গিয়ে চা দিতে বলে এসেছে। কিছুক্ষণ পর দোকানদার চা নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে চা খেতে শুরু করলো। রিফাত চা না খেয়ে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারিনের গোলাপি রঙের ঠোঁট দু’টো চায়ের কাপে ছোঁয়ার সাথে সাথে রিফাতের শরীর শিহরণ দিয়ে উঠলো। হার্টবিড উঠানামা করতে শুরু করলো রিফাতের। চায়ের কাপ দেখে রিফাতের খুব হিংসে হলো।
তারিন আড়চোখে রিফাতের দিকে তাকালো। তারপর বলল – ‘আমার দিকে হা করে না তাকিয়ে থেকে গানটা শুরু করুন।’

তারিনের কথা শুনে সবাই একসাথে হেসে দিলো। রিফাত লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।
হাসি থামিয়ে তিশা বলল – ‘এবার গান টা শুরু করুন তো ভাইয়া।’
– ‘আচ্ছা।

রিফাত গীটার হাতে নিয়ে বাজাতে শুরু করলো।
“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই”
কোথায় হারিয়ে গেল…

হঠাৎ তারিন বলে উঠলো – ‘ওই থামেন থামেন।’
সবাই অবাক হয়ে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিফাত জিজ্ঞেস করলো – ‘কী হলো থামতে বললেন কেন?’
– ‘কী সব আবোল তাবোল গান শুরু করছেন।’
– ‘মানে?’
– ‘সবাই মিলে চা খাচ্ছি, আর আপনি বলছেন কফি হাউজের কথা।’
– ‘কিন্তু গানে তো কফি হাউজের কথাই বলা আছে।’
– ‘সে যাই হোক, আপনি চা দিয়ে গান শুরু করুন।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

“চায়ের দোকানে সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই”
“কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই”
………….।
“নিখিলেশ প্যারিসে, মঈদুল ঢাকাতে নেই তারা আজ কোন খবরে”
“গ্র‍্যান্ডের গীটারিস্ট গোয়ানীস ডিসুজা, ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে”
“কাকে যেন ভালবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে পাগলা গারদে আছে রমা রায়”
“অমলাটা ধুঁকছে দুরন্ত ক্যান্সারে, জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়”
“চায়ের দোকানে সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই।”
“কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালী বিকেলগুলো সেই , আজ আর নেই”

রিফাত গান গাইছে আর তারিন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ আর তারিন মনে মনে ভাবছে আশিকের কথা। ঠিক এভাবেই একদিন আশিক গান গাইছিল আর তারিন আশিকের কাধে মাথা রেখে বসেছিল। নৌকা দিয়ে নদীতে ঘুরতে যেতো। আশিক তারিনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতো।
এই কথাগুলো মনে পড়তে কষ্টে তারিনের বুক ফেটে যাচ্ছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, কেন করলে আমার সাথে এইরকম? কী অপরাধ ছিল আমার? নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালবাসতাম তোমাকে। তোমার অসুস্থতার কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি করে তোমার ওখানে চলে গিয়েছিলাম। জানো তো আশিক, তুমি যখন একটু একটু করে আমার কাছে আসছিলে। তখনও ভেবেছিলাম তুমি হয়ত আমার সাথে মজা করছো। কিন্তু আমার ভাবনা কে ভুল করে দিয়ে তুমি যখন ছুরি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলে। তখন আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে আমি তোমাকে আঘাত করেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর তোমাকে আঘাত করার পর আমার ভিতরে যে কতটা কষ্ট হয়েছিল বলে বোঝাতে পারবো না। ক্রমশ বুকের ব্যাথা বেড়ে যাচ্ছিলো। তবুও নিজেকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে ফেলে চলে এসেছি
প্লিজ আমাকে মাফ করে দিও।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে তারিনের চোখের কোণে জল এসে গেছে। জল লুকানোর জন্য রিফাতের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো৷ মাথা নিচু করে বসে আছে তারিন। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে।

১৬.

রিফাতের গান শেষ হয়ে গেছে। সবাই মিলে রিফাতের প্রসংশা করছে। কিন্তু রিফাত তাতে সন্তুষ্ট নয়। সে যে একজনের মুখে প্রসংশা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। রিফাত তারিনের দিকে তাকিয়ে দেখে মাথা নিচু করে বসে আছে তারিন। একবার তারিন বলে ডাকলো। কিন্তু তারিন কোন সারা দিচ্ছে না। তারিন মনে মনে ভয় পাচ্ছে, যদি চোখের জল সবাই দেখে ফেলে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে রিফাতের দিকে তাকালো। রিফাত জিজ্ঞেস করলো – ‘কী হয়েছে চুপ করে আছেন যে?’

তারিন শান্ত কন্ঠে বলল – ‘কিছুনা’

সবার কাছ থেকে চোখের জল আড়াল করতে পারলেও রিফাতের কাছে তা পারেনি। রিফাত স্পষ্ট বুঝতে পারছে তারিন কান্না করেছে।
তারিনের কান্না করার কারণ রিফাত বুঝতে পারলো না। তাই জিজ্ঞেস করলো – ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’

রিফাতের কথা শুনে সবাই চমকে গেলো। হঠাৎ তারিনের চোখ থেকে একফোঁটা পানি বেয়ে পড়লো। তারিন বসা থেকে উঠে গিয়ে অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রিফাত কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু তারিনের কান্না সহ্য করতে পারছে না তাই রিফাত ও বসা থেকে উঠে তারিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারিনের মাথাটা উপরে তুলে নিজের হাতে চোখের জল মুছিয়ে দিলো। সবাই খুব অবাক হয়ে দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিফাত কী করছে নিজেও বুঝতে পারছে না। মনে হয় একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। তারিন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। রিফাতকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। রিফাত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে তারিনের এইরকম অবস্থা দেখে তিশার চোখেও জল চলে এসেছে।
কিছুক্ষন নীরব থাকার পর তারিন বুঝতে পারলো রিফাত কে জড়িয়ে ধরে আছে। তাই রিফাত কে ছেড়ে দিয়ে তিশার কাছে চলে এলো। তারপর বলল – ‘আমাকে এবার বাড়িতে যেতে হবে।

তারিনের মনে অবস্থা বুঝতে পেরে তিশা বলল – ‘আচ্ছা চল।

তিশা আরিফ সাহেব কে বলল – ‘তোমরা সবাই বাড়িতে চলে যাও। আমি আজ তারিনদের বাড়িতে থাকবো।
আরিফ সাহেব বলল – ‘ঠিক আছে সাবধানে যেও।’
– ‘হু’
– ‘রিফাত চলুন আমরা বাড়িতে যাই।’
– ‘হুম চলুন।

রিফাত এখনও তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারিন একবার রিফাতের দিকে তাকিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো।

রিফাত ও চলে আসলো।

চলবে…………?

অনেক ব্যস্ততার মাঝে লিখেছি, ভুল হলে ক্ষমা করে দিবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here