পার্থক্য
১১ পর্ব।
#রিফাত_হোসেন।
১৭.
রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে রিফাত। কিছুই ভাল লাগছে না। বার বার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। অনেকক্ষন ধরে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে এই আশায় যে তারিন ফোন দিবে। কিন্তু অনেক সময় শেষ হওয়ার পরেও তারিনের কোন ফোন নেই । রিফাত একরাশ হতাশা নিয়ে টেবিলের উপর ফোনটা রেখে চোখ বন্ধ করলো। কিন্তু ঘুম’ও রিফাতের উপর রেগে আছে। পাশ থেকে আরিয়ান জিজ্ঞেস করলো – ‘এবার বল কাল সারারাত কোথায় ছিলি আর ওই মেয়েটা কে কীভাবে চিনিস।
– ‘কাল বললে হবে না।’
– ‘না এখন বল।’
– ‘ওকে।’
তারপর রিফাত কাল রাত থেকে যা হয়েছে সব ঘটনা বলল আরিয়ান কে। তারিনের সাথে কীভাবে পরিচয়, কীভাবে এখানে এসেছে।
আরিয়ান সব শুনে ‘থ’ হয়ে গেলো।
মেয়েটা কে প্রথমে দেখে বোঝা যায় নি এতটা কষ্ট মনে চেপে রেখেছে। পরে অবশ্য কিছুটা অনুমান করতে পেরেছে। কিন্তু সেটা যে এতটা ভয়ংকর হবে তা আরিয়ান বা অন্য ফ্রেন্ডদের ভাবনার বাহিরে ছিলো।
তবে একটা বিষয় হলো রিফাত যে অবশেষে কারোর প্রেমে পড়েছে। এটা ভেবেই আরিয়ানের মনে শান্তি লাগছে।
আরিয়ান রিফাত কে বলল – ‘কিন্তু মেয়েটা কী আর কোন ছেলেকে মন থেকে বিশ্বাস করবে?’
রিফাত চিন্তিত হয়ে বলল – ‘সেটা তো আমিও ভাবছি।’
– ‘তবে আমি বেশ কয়েকবার খেয়াল করেছি, মেয়েটা তোর দিকে তাকিয়ে থাকে।’
– ‘হু’
– ‘হয়ত তোকে বিশ্বাস করতে চায়, কিন্তু ফেলে আসা ভয়ংকর স্মৃতি ওকে তাড়া করে বেড়ায়। নতুন করে বাঁচতে বাধা দেয়। কাউকে মন থেকে বিশ্বাস করতে বাধা দেয়।’
রিফাত তারিনের কথা ভাবতে ভাবতে বলল – ‘হু, কিন্তু আমি কীভাবে ওর বিশ্বাস অর্জন করতে পারবো?’
– ‘দেখ যেহেতু ও তোকে অপছন্দ করে না। তাই ওনাকে বেশি করে সময় দিতে হবে। ওনাকে বোঝাতে হবে হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনি পৃথিবীর সব ছেলে এক নয়। একেক জন একেক রকম। দু’একজন খারাপ বলে পৃথিবীর সবাই খারাপ, তা নয়।’
রিফাত আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল – ‘হু‚ তুই একদম ঠিক বলেছিস।’
– ‘এবার ঘুমিয়ে পড়।’
– ‘সেই কখন থেকে বসে আছি, তারিনের ফোনের অপেক্ষায়।’
– ‘তোর কাছে ওনার নম্বর নেই?’
– ‘না, ওর ফোন আশিক ভেঙে দিছে। তাই আমার নম্বর নিয়ে গেছে।’
– ‘ওহ, তাহলে আর কী অপেক্ষা কর।’
রিফাত আবার ফোন হাতে নিয়ে তারিনের সাথে কাঁটানো মুহূর্তগুলো ভাবতে লাগলো।
১৮.
রাতের খাবার খেয়ে তারিন আর তিশা শুয়ে আছে। তারিন আশিকের সাথে থাকার সময়ের ভালবাসার মুহূর্তগুলো তিশার সামনে উপস্থাপন করছে। সেই সাথে আশিকের কাছ থেকে দূরে চলে আসার কষ্টটা। তারিন আশিক কে নিয়ে কথা বলছে আর চোখের জল ফেলছে। তিশা তারিনের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে তারিন কে জড়িয়ে ধরলো। তারিন তিশার বুকে থাকা অবস্থায় কাঁদতে লাগলো। এত্তো এত্তো কষ্ট তারিনের মনে জমা হয়ে আছে। যা গুলিস্তানে বিক্রি করলেও একটা ফ্রিজ কেনার টাকা হয়ে যাবে। যাতে কষ্টগুলো ফ্রিজে দীর্ঘদিন ধরে রেখে দিতে পারে। কিন্তু তারিনের ঘরে আগে থেকেই একটা নতুন ফ্রিজ থাকায় কষ্টগুলো বিক্রি করার চিন্তা বাদ দিয়ে তিশার বুকে ঢেলে দিচ্ছে। তিশা চেয়ারম্যানের ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তাই তারিনের দেওয়া কষ্ট বুকে জায়গা পায়নি। কষ্টগুলো বুকে জায়গা না পেয়ে মাথায় চলে গেছে। তিশা মাথায় থাকা কষ্টগুলো কে বিশ্রাম করতে বলে ভাবতে লাগলো কীভাবে মাথায় থেকেও কষ্টগুলো তাড়িয়ে দেওয়া যায়। তারিন অনবরত কষ্টগুলো তিশার মাথায় দিয়েই যাচ্ছে। সিয়ামের ছবি চালু হলে যেভাবে মেয়েদের জন্য পুরো অডিটোরিয়াম হাউজফুল হয়ে যায়। ঠিক সেভাবেই তারিনের দেওয়া কষ্ট দিয়ে তিশার মাথা ও হাউজফুল হয়ে গেছে ৷ তাই তিশা ঠিক করলো সবার আগে তারিনের কষ্ট থামাতে হবে। আর কষ্ট থামানোর যন্ত্র হিসেবে পেলো রিফাত কে।
তিশা তারিন কে বলল – ‘বলছিলাম কী, আমার মাথা হাউজফুল হয়ে গেছে। এবার কষ্ট থামানোর যন্ত্র ব্যবহার কর।’
তারিন তিশার বুক থেকে মুখ সরিয়ে এক হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল – ‘এসব কী বলছিস তুই?’
তিশা তারিনের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করলো।
তারিন জিজ্ঞেস করলো – ‘এভাবে হাসছিস কেন?’
তিশা আবার হেসে বলল – ‘তোকে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে।’
তারিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘মানে।’
– ‘কাঁদার সময় তোকে একদম বাচ্চাদের মতো লাগে৷ আর অনেক কিউট লাগে। তোর এই কিউট চেহারা দেখে আমিই প্রেমে পড়ে গেছি আর রিফাত ভাইয়া তো মনে হয় তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।’
তারিন একটু রাগ দেখিয়ে বলল – ‘এই ছেমড়ি একদম বাজে কথা বলবি না।’
তারিনের কথা শুনে তিশা হেসে দিলো। এক্কেবারে রাক্ষসী রানী মনি মল্লিকার মতো। তাই দেখে তারিন বলল – ‘তোর হাসি দেখে মনে হচ্ছে, রাক্ষসী রানী মনি মল্লিকা তোর উপর ভর করেছে।’
তিশা হাসি থামিয়ে বলল – ‘ছিঃ তুই সাত ভাই চম্পা নাটক দেখছ।আমি তো স্টার জলসা, জী-বাংলায় এইসব আজাইরা চ্যানেল এর দিকে তাকিয়ে ও দেখি না।’
তারিন বলল – ‘তাহলে তুই জানলি কীভাবে “রাক্ষসী রানী মনি মল্লিকা” সাত ভাই চম্পা নাটক করে।’
তিশা আমতা আমতা করে বলল – ‘ইয়ে মানে’
– ‘হয়েছে তোকে আর মানে মানে করতে হবে না। পাবলিক যা বোঝার বুঝতে পারেছে।’
– ‘তোর কাছে রিফাত ভাইয়ার নম্বর আছে তাই না।’
– ‘হ্যাঁ’
– ‘তাহলে একটা ফোন দে।’
– ‘ওনাকে ফোন কেন দিবো। তাছাড়া এখন ফোন দিলে যদি অন্য কিছু ভাবে।’
– ‘কী আবার ভাববে, হয়ত ওনি তোর ফোনের অপেক্ষায় আছে।’
তারিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘ওনি আমার ফোনের অপেক্ষায় কেন থাকিবে।’
– ‘সারারাত একটা ছেলের সাথে থেকেও বুঝলি না ছেলেটা তোকে ভালবাসে। আমি তো বিকেলেই বুঝে গেছি।
এ’কথা বলেই তিশা থেমে গেল। তারিন মনে মনে ভাবতে লাগলো ছেলেটা কী সত্যিই আমাকে ভালবাসে। না এটাও কোন ছলনা। আশিক ও তো আমাকে খুব ভালবাসতো। কিন্তু পরে সেই আশিক ঠকালো। এই লোকটা ও কী আশিকের মতো মানুষ রূপে কোন পশু। নাকি সে সত্যিই আমাকে ভালবাসে। যদি সত্যিই আমাকে ভালবেসে থাকে তাহলে কেন আমি মন থেকে ওনাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তারিন এইসব কথা ভাবছিল তখন তিশা তারিনকে ধাক্কা দিয়ে বলল – ‘কী রে কোন রাজ্যে চলে গেলি আবার?’
– ‘কোন রাজ্যে যাবো?’
– ‘নাকি রিফাত ভাইয়ার কথা ভাবছিস।’
তারিন একটু রাগ দেখিয়ে বলল – ‘তোর কী বাজে কথা ছাড়া কোন কাজ নেই?’
তারিনের কথা শুনে তিশা হাসতে শুরু করলো।
– ‘একদম হাসবি না।’
তিশা হাসি থামিয়ে বলল – ‘আচ্ছা, আর হাসবো না। তাহলে রিফাত ভাইয়াকে ফোন দে।’
– ‘আমার ফোন তো নেই।’
– ‘আমার টা দিয়ে দে।’
তারিন টেবিল থেকে রিফাতের দেওয়া নম্বরের কাগজটা হাতে নিলো। তারপর তিশার মোবাইল দিয়ে ফোন করলো।
১৯.
হঠাৎ করে রিফাতের হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। রিফাত তাড়াতাড়ি করে ফোন স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা অচেনা নম্বর। রিফাত মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো যেন ফোনের ওপাশের মানুষটা তারিন হয়। ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে কিন্তু রিফাত ধরার সাহস পাচ্ছে না।
কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করতে যাবে তখনই কেটে গেল৷ হতাশ হয়ে বসে রইলো রিফাত। একটু পরেই আবার ফোন বেজে উঠলো। এবার রিফাত সাহস করে ফোন রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠে “হ্যালো” বলল। কন্ঠটা শুনে রিফাতের বুকের হার্টবিড উঠানামা করতে শুরু করলো। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই চুপ করেই রয়েছে।
এদিকে রিফাত চুপ করে আছে দেখে তারিনের খুব রাগ হলো, তাই ফোনটা কেটে দিলো।
তারিন ফোন কেটে দেওয়ার পর রিফাত মনে মনে নিজেকে গালি দিতে শুরু করলো।
তিশা অবাক হয়ে তারিন কে জিজ্ঞেস করলো – ‘কী হলো কেটে দিলি কেন?’
– ‘কোন কথা বলছে না তো কী করবো।’
– ‘আচ্ছা আমাকে দে ফোনটা।’
– ‘তুই আবার কী করবি?’
– ‘আগে দে, তারপর দেখ কী করি।’
তারিন তিশার হাতে ফোন দিলো। তারপর তিশা আবার রিফাতে নম্বরে ফোন দিলো।
এবার রিফাত আর দেরি না করে ফোন রিসিভ করলো। তারপর বলল – ‘স্যারি, আসলে কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না তাই চুপ করে ছিলাম।’
তারিন একটু হাসি দিয়ে বলল – ‘তারিন ঠিকই বলে আপনি হাই লেবেলের লুচ্চা৷’
এইরকম একটা কথা শোনার জন্য রিফাত মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। রিফাত আবারও চুপ হয়ে গেল।
তিশা বলল – ‘দুলাভাই ভয় পাবেন না। আমি আপনার একমাত্র শালিকা।
রিফাত এবার বুঝতে পারলো ফোনের ওপাশে কে কথা বলছে।
– ‘হু’ চিনতে পেরেছি। কিন্তু আপনি আমাকে লুচ্চা বললেন কেন?’
– ‘তারিন যখন ফোন দিলো, তখন তো চুপ করে ছিলেন। আর আমি ফোন দিতেই মুখে আওয়াজ চলে এসেছে।’
রিফাত আমতা আমতা করে বলল – ‘আসলে প্রথমে বুঝতে পারিনি, ফোনের ওপাশের সুন্দরী মেয়েটা তারিন ছিল।’
তিশা একটু অভিমান নিয়ে বলল – ‘আমি বুঝি সুন্দর না।’
– ‘আপনিও সুন্দর তবে, তারিনের থেকে নয়।’
– ‘বৌ পেয়ে শালিকে ভুলে গেছেন তাই না। এই নিন কথা বলুন।
এ’কথা বলেই তিশা তারিনের হাতে ফোন দিয়ে দিলো। তারিন এতক্ষন চুপ করেই ছিলো। আর মনে মনে বলছে শুধু কথা বলা শেষ হোক তারপর তিশা কে দেখে নেবে।
তারিন ফোন হাতে নিয়ে বলল – ‘তিশা যা বলেছে তাতে কিছু মনে করবেন না প্লিজ।’
– ‘ওনি তো খারাপ কিছু বলেনি।’
তারিন অবাক হয়ে বলল – ‘মানে’
– ‘আপনি যদি চান হয়ে যাবে।
– ‘কী হয়ে যাবে।’
– ‘ইয়ে মানে, আমার আর আপনার।’
– ‘ওই মিয়া আপনার সাহস তো কম না। তখন তো আস্তে করে নাকে ঘুসি মারছি। এবার কিন্তু এক ঘুসি তে নাক ফাটিয়ে দিবো।’
– ‘হুহ, আমি কী বসে থাকবো না।’
– ‘কী করবেন আপনি।’
– ‘ওই যে আপনার ডায়লগ টা আমিও ছাড়বো।’
– ‘কোন ডায়লগ।’
– ‘আমাগো বাড়ির সামনে গেলে এক্কেবারে ভাজি কইরা খাইয়া ফালামু।’
এ’কথা বলার পর দু’জনে একসাথে হেসে উঠলো।
রিফাত হাসি থামিয়ে বলল – ‘আবার ঘন্টা বেজে গেছে।’
– ‘কীসের ঘন্টা?’
– ‘প্রেমের ঘন্টা।’
– ‘আপনি খুব খারাপ একটা মানুষ। ইচ্ছে করছে এখনি আপনার নাকটা ফাটিয়ে দিতে।’
– ‘তাহলে আসুন। নাক ফাটিয়ে দিয়ে যান।’
– ‘থাক, কিছু বললাম না।’
– ‘কেন ভয় পেলেন নাকি।’
– ‘না ভয় পাইনি। আর বাবা- মা আপনাকে দেখতে চেয়েছে।’
রিফাত অনেকটা খুশি হয়ে বলল – ‘বাহ, মেয়ের আগে বাবা-মা রাজি হয়ে গেছে।’
– ‘কীসের রাজি।’
– ‘আমার আর আপনার বিয়ের।’
– ‘জ্বী, না।’
– ‘তাহলে ( হতাশ হয়ে)
– ‘যিনি আমাকে এত্তবড় একটা বিপদের হাত থেকে বাঁচালো। তাকে একটা ধন্যবাদ দিবে না।’
– ‘ওহ তাই বলুন। আমি আরও কত কিছু ভাবলাম।’
– ‘আপনার মতো লুচ্চা ছেলে এর থেকে আর কী ভাবতে পারে।’
– ‘আমি মোটেও লুচ্চা নই।’
– ‘হু, জানা আছে সব।
এইরকম আরও কিছু কথা বলে ফোন কেটে দিলো।
চলবে…………?
বিঃদ্রঃ অনেক ব্যস্ততার মাঝে গল্প লিখেছি। তাই হয়ত কিছু বানান ভুল হয়েছে।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন প্লিজ।