পার্থক্য পর্ব-১৬

0
779

পার্থক্য

১৬ পর্ব।

#রিফাত_হোসেন।

রাতে রুমে বসে কাজ করছিলো রিফাত। সামান্য কিছুদিন হলেও রিফাতের কাছে মনে হয় বহুকাল ধরে সেই মায়াবী মুখটার দেখা পায় না। সেই মিষ্টি হাসি অনেকদিন দেখা হয় নি। অনেক অপেক্ষা করার পর আবার একটা সুযোগ এসেছে, সেই মুখটা দেখার, তাকে মনের কথা বলার। আবেগ নয়, অনুভূতি নয় নিজের ভালোবাসা দিয়ে তারিন কে কাছে টেনে নেওয়ার সুযোগ এসে গেছে। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না রিফাতের। তাই ল্যাপটপ টা রেখে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে চলে যায়। খোলা আকাশের নিচে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে রিফাত। চাঁদের আবছায়া আলোয় সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নক্ষত্রগুলো চিৎকার করে বলছে আজ শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। এ এক সাংঘাতিক ভালোবাসা। যা শুধু বুকের বা পাশে স্থায়ী অবস্থায় আছে। তবুও কেন জানি মাঝে মাঝে এখানটা শূন্য লাগে। মাঝে মাঝে তীব্র যন্ত্রণা এখানে আঘাত করে। চারদিকে কেমন অন্ধকার হয়ে আসে। হয়তো কাউকে হারানোর ভয়টা মনের ভিতর গেঁথে গেছে।
আজ বড্ড বেশি তারিনের কথা মনে পড়ছে। আর যেন তর সইছে না। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে তারিনের কাছে চলে যেই। কিন্তু কোন এক অজানা বাধার সম্মুখীন হয়ে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। রাত যত গভীর হচ্ছে শীত আরো বেড়ে যাচ্ছে। তাই রিফাত আর ছাদে না থেকে ঘরে চলে আসলো। ঘরে এসে ভাবছে তারিন কে ফোন দিবে কী দিবে না। একবার মন বলছে ফোন দিতে আবার বলছে ফোন দিবে না। যদি তারিনের বাবা ফোন রিসিভ করে। এটা ভেবে আর রিফাত ফোন দিলো না। টেবিলের উপর মোবাইলটা রেখে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। হঠাৎ করে টেবিলের উপর থাকা মোবাইলটা কেঁপে উঠলো। রিফাত বিছানা থেকে উঠে ফোন হাতে নিলো। তারপর স্কিনে তাকিয়ে দেখে একটা অচেনা নম্বর। এত রাতে অচেনা নম্বর থেকে ফোন দিয়ে হয়তো কেউ মজা করছে। এটা ভেবে রিফাত আর ফোন রিসিভ করলো না। পর পর বেশ কয়েকবার ফোন আসলো। শেষে কোন উপায় না পেয়ে রিসিভ করলো। রিফাত কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ঝাড়ি মারতে শুরু করলো। খুব সহজেই বোঝা গেল ফোনের ওপাশের মানুষটা তারিন। ঝাড়ি মারা শেষ হলে তারিন চুপ হয়ে গেল । নীরবতা ভেঙে রিফাত বলল – ‘এতক্ষন কী হচ্ছিলো ?’
– ‘আবার শুরু করে দেখাবো নাকি।’
– ‘না থাক, এইটুকুতেই পেট ভরে গেছে।’
– ‘গুড।’
– ‘আচ্ছা আপনি এইরকম কেন?’

তারিন কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘এইরকম মানে?’
– ‘এই যে একেক সময় একেক রূপ ধারণ করেন’
– ‘আমি আবার কখন কী রূপ ধারণ করলাম?’
– ‘একটু আগেই তো পুরো রেগে গিয়ে কত কিছু বললেন, কিন্তু এখন কতটা শান্ত হয়ে কথা বলছেন।’
– ‘হু, আমি এইরকম’ই।’
– ‘হুম বুঝতে পারছি, আপনি একটা “টিউবলাইট”।’
– ‘টিউবলাইট কী?’

রিফাত হাসতে হাসতে বলল – টিউবলাইট যেমন হঠাৎ করে জ্বলে উঠে। তেমনি আপনি ও হঠাৎ করে জ্বলে উঠেন।’

রিফাতের কথা শুনে তারিন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। তারপর বলল – ‘আপনাকে পুরো কাঁচা চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে।’

মুখ ফসকে রিফাত বলে ফেললো – ‘ধানিলঙ্কা’
– ‘হোয়াট?’
– ‘ না মানে, আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবেন তো। তাই বলছিলাম ধানিলঙ্কা দিয়ে খাবেন। ধানিলঙ্কা আর আস্ত একটা কাঁচা মানুষ। উফ ভাবতেই কেমন টেস্টি টেস্টি লাগছে, একদম আপনার মতো।

– ‘ইউ, আপনার সাথে আর কথাই বলবো না। আপনি একটা লুচ্চা, শয়তান, খারাপ ছেলে। আপনাকে সামনে পেলে ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতাম।’.

রিফাত কে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তারিন ফোন কেটে দিলো।

রিফাত কয়েকবার ফোন দিলো। কিন্তু প্রতিবারই তারিন ফোন কেটে দেয়।
রিফাতের কথা শুনে তারিন যতটা রেগে গেছে তার থেকে বেশি হাসি পেয়েছে। আর মনে মনে বলছে ছেলেটা একটা পাগল।

রিফাত মন খারাপ করে মোবাইল রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। তারিন মোবাইল রেখে রিফাতের কথা ভাবতে শুরু করলো। কেন তারিন বার বার রিফাতের কথা ভাবে। তা নিজেও জানে না। শুধু জানে যতক্ষন রিফাতের কথা ভাবে ততক্ষন ভালো থাকে। তারিনের ভালো থাকার ঔষধ হিসেবে রিফাত নামটা কাজ করে।

৩১.
রিফাত সকালে খাবার টেবিলে বসে আয়শা বেগম কে বলল – ‘মা আমরা গানের পোগ্রামে যেখানে গেছিলাম। সেই এলাকার চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের বিয়ে। আমরা ওই কয়দিন তাদের বাড়িতেই ছিলাম। সামনের সপ্তাহে তার বিয়ে। তাই আমাদের সবাইকে যেতে বলেছে।’
– ‘তোর বাবা বাড়িতে নেই। আর আমি চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকা পড়ে থাকবে। তাই আমি যাবো না, তোরা যা।’

হঠাৎ করে পাশ থেকে আরিয়ান বলল – ‘মা এই সুযোগ মিস করো না। হয়তো তোমার ছেলের বৌ ও পেয়ে যেতে পারো সেখানে। তোমার ছেলেতো এখন একজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে ।’

আরিয়ানের কথা শুনে রিফাত মাথায় হাত দিয়ে বসলো। আরিয়ান এইরকম কিছু বলবে রিফাত কল্পনা ও করেনি। মায়ের সামনে এইরকম পরিস্থিতিতে পড়ে রিফাত খুবই লজ্জা পেয়েছে। মায়ের দিকে তাকানোর মতো সাহস পাচ্ছে না রিফাত। আর মনে মনে বলছে আজকে আরিয়ানের খবর আছে।

আয়শা বেগম চোখ বড় বড় করে রিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর জিজ্ঞেস করলো – ‘আরিয়ান এসব কী বলছে রিফাত?’

রিফাত কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। যেভাবেই হোক মা কে কিছু জানতে দেওয়া যাবে না। তাই রিফাত একটু হাসি দিয়ে বলল – ‘আরিয়ানের কথা তুমি বিশ্বাস করো না মা। ও তো এমনি মজা করছে।’

আয়শা বেগম আবার আরিয়ান কে জিজ্ঞেস করলো – ‘তুই কী সত্যি মজা করার জন্য বলেছিস নাকি রিফাত সত্যি সত্যি কাউকে ভালোবাসে?’

আরিয়ান আমতা আমতা করে বলল – ‘আসলে মা, মুখ ফসকে উল্টো পাল্টা বের হয়ে গেছে।’
– ‘ওহ্, আচ্ছা তাহলে এবার খাওয়া শেষ কর।’
– ‘ঠিক আছে।’

সবাই খেতে শুরু করলো । রিফাত বুক ভরে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো। যেন বুক থেকে একটা বড় পাহাড় সরিয়ে দেওয়া হলো।
কোন রকমে খাওয়া শেষ করে রিফাত উপরে চলে এলো। এভাবে আরো কয়েকদিন চলে গেল। আরিফ এর বিয়ের তারিখ ও কাছাকাছি চলে এসেছে। অফিসের কাজ কিছু কমিয়ে দিয়ে পি.এ এবং ম্যানেজার কে সব বুঝিয়ে দিলো রিফাত। বিয়ের দু’দিন আগে যথা সময়ে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হলো সবাই। ট্রেনে উঠার আগে তারিন কে ফোন করে জানিয়ে দিলো।

“বলতে ভুলে গেছি, এখন আর বাবার ফোন দিয়ে কথা বলে না। নতুন ফোন কিনে দিয়েছে। আর সেদিন রাতের অচেনা নম্বর টা ছিলো তারিনের নতুন সিমের নম্বর”

তারিনের সাথে কথা বলে রিফাত ট্রেনে উঠলো। কিছুক্ষন পর ট্রেন ছেড়ে দিলো। রিফাত এক দৃষ্টিতে বাহিরে দিকে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে কখন এই ট্রেন জার্নি শেষ হবে। আজ যেন সব থেকে বিরক্তি লাগছে এই ট্রেনে বসে থাকতে। তারিন কে দেখার জন্য রিফাত পাগল হয়ে উঠেছে। অপেক্ষা করতে আর ভাল্লাগছে না। নিম গাছের পাতার মতো তিতা লাগছে আজকের ট্রেন জার্নিটা। মনে হচ্ছে এখনই দৌড়ে তারিনের কাছে চলে যাই। কাছে গিয়ে হাতটা স্পর্শ করে বলি “অদ্ভুত রকম ভালোবাসি”।
রিফাত কে অন্যমনস্ক দেখে আরিয়ান জিজ্ঞেস করলো – ‘কি রে কী ভাবছিস?’
– ‘ভাবছি, এবার আর দেরি করবো না। তারিন কে নিজের মনের কথা বলে দিবো৷’

রিফাতের কথা শুনে সবাই পাগলের মতো হাসতে শুরু করলো। যেন রিফাত একটা জোক্স বলেছে। সাধারণ একটা কথায় হাসার কী আছে ভেবে পায় না রিফাত। তবুও মনে হচ্ছে ওরা রিফাতের ভালোবাসা কে অপমান করছে। রাগে রিফাতের শরীর পুরো জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে হাতে থাকা গীটারটা দিয়ে এক বারি মেরে মাথাটা ফাটিয়ে দেই। কিন্তু অনেক ভালোবাসার গীটারটা যদি আঘাত পায়। যেটা কখনো চোখের আড়াল করে না রিফাত। অফিসে গেলেও এই গীটার সাথে করে নিয়ে যায়। সেই গীটার দিয়ে আঘাত করার সাহস পাচ্ছে না । তাই মারার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিলো।

রিফাত রাগি মুড নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল – ‘তোরা এভাবে পাগলের মতো হাসছিস কেন?’

আরিয়ান হাসি থামিয়ে বলল – ‘তোর কথা শুনে।’
– ‘আমি কী এমন বললাম যে, তোদের হাসি পেলো।’
– ‘এই যে একটু আগে বললি, তুই তারিন কে নিজের মনের কথা বলবি।’
– ‘হু, বলবো তো।’
– ‘হা হা হা, তুই এই জীবনে ও তারিন কে কিছু বলতে পারবি না।’
– ‘শালা তোরা আমার বন্ধু না শত্রু বলতো।’
– ‘আমরা আবার কী করলাম।’
– ‘কোথায় তোরা বন্ধু হয়ে আমাকে সাপোর্ট দিবি। তা না করে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস।’

একথা বলে রিফাত জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
এই বিষয়ে কেউ আর কোন কথা বলল না। অনেক অপেক্ষার পর ট্রেন স্টেশনে গিয়ে থামলো। সবাই ট্রেন থেকে নেমে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে যেতে শুরু করলো। বাজারে যেতেই আরিফ সাহেব কে দেখেতে পেলো।
সবাই তার সামমে গিয়ে দাঁড়ালো । তিনি হাসি মুখে সবার সাথে হাত মিলালো। তারপর আরিফ সাহেব বলল – ‘তাহলে চলুন এবার বাড়িতে যাওয়া যাক।’
সবাই হ্যাঁ বললেও রিফাত চুপ করেই রইলো। রিফাতের এখন মোটেও বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তারিন কে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে।
রিফাত চুপ করে আছে দেখে আরিফ সাহেব বলল – ‘কী হলো আপনি চুপ করে আছেন কেন?’
– ‘না মানে।
– ‘হু, আর মানে বলতে হবে না সব বুঝতে পেরেছি। তারিন এখন তিশাদের বাড়িতে আছে। তাই এখন বাড়িতে চলুন। বিকেলে আমি দেখা করিয়ে দেবো।

রিফাত অনেকটা খুশি হয়ে বলল – ‘আচ্ছা ঠিক আছে।

সবাই হাঁটতে শুরু করলো। বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সবাই একটু বিশ্রাম নিলো। কিছুক্ষন পর আরিফ সাহেব ঘরে এসে বলল – ‘দুপুরের খাবারের জন্য বাবা ডাকছে। সবাই নিচে আসুন।’
– ‘আচ্ছা আসছি।’

তিনি চলে যাওয়ার আগে রিফাত কে বলল – ‘রিফাত সাহেব আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’
রিফাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘কী সারপ্রাইজ?’
– ‘নিচে আসলেই দেখতে পাবেন।

রিফাত আর দেরি না করে নিচে চলে গেলো। নিচে গিয়ে রিফাত অবাক হয়ে গেল। আর মনে মনে ‘আরিফ সাহেব কে অনেক ধন্যবাদ দিলো।

চলবে……….।

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here