পার্থক্য
১৮ পর্ব।
#রিফাত_হোসেন।
রাতে খাওয়া শেষ করে ছাদে চলে গেল রিফাত। তারিনের নম্বরে একটা ফোন দিলো। সাথে সাথেই রিসিভ করে ফেললো। যেন রিফাতের ফোনের অপেক্ষায় ছিলো তারিন। ফোন রিসিভ করে বলল – এত দেরি হলো কেন ফোন দিতে?’
– ‘মাত্র খাওয়া শেষ করে ছাদে এলাম।’
– ‘ওহ।
– ‘ আপনি মনে হচ্ছে আমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন।’
– ‘হুহ, আমার তো আর কোন কাজ নাই, আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।’
– ‘আমার তো তাই মনে হচ্ছে, ফোন দেওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করে ফেললেন। তাই বললাম।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ফোন কেটে দিচ্ছি, আপনি আবার ফোন দিন। আর আমি অনেকক্ষন পরে রিসিভ করবো।’
– ‘থাক আর কষ্ট করতে হবে না।’
– ‘গুড’
– ‘আচ্ছা আপনি তখন হঠাৎ করে ওইরকম রূপ ধারণ করেছিলেন কেন?’
– ‘আমি আবার কখন কোনরকম রূপ ধারণ করলাম?’
– ‘বিকেলে প্যান্ডেলের ওখানে।’
– ‘অবশ্যই কারণ আছে।
– ‘কী কারণ?’
– ‘সেটা আপনাকে কেন বলবো।’
– ‘আমাকে বলুন আর নাই বলুন। আপনাকে তখন পুরো গুন্ডী মেয়েদের মতো লাগছিলো।’
রিফাতের কথা শুনে তারিন রেগে গিয়ে বলল – ‘আপনার এত সাহস যে আমাকে গুন্ডী বলেন। আপনার সাথে আর কথা-ই বলবো না।’
রিফাত কিছু বলার আগেই তারিন ফোন কেটে দিলো। রিফাত ভালো করেই জানে আজকে আর ফোন দিয়ে কোন লাভ হবে না। তাই আর ফোন দিলো না। আজ কেন জানি রিফাতের চোখে ঘুম নেই। শত চেষ্টা করার পরেও তারিন কে ভালোবাসার কথা বলতে পারেনি রিফাত। মাথায় নানান রকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কীভাবে তারিন কে ভালোবাসার কথা জানাবে। তারিন কীভাবে নেবে রিফাতের ভালোবাসা। ও কী রিফাত কে ভালোবাসবে। নাকি ওর মনে এখনও আশিক আছে। এতদিনের নির্ঘুম রাতের স্মৃতি গুলো একটু একটু করে জমিয়ে রেখেছে রিফাত। প্রতিটি রাত না ঘুমিয়ে ফোনে কথা বলা, ছাদে বসে গীটারের সুর তুলে গান গেয়ে শুনিয়েছে তারিন কে। সব স্মৃতি রিফাত বুকে আকড়ে ধরে রেখেছে এতদিন। এই সব স্মৃতি একদিন তারিনের সামনে উপস্থাপন করবে রিফাত। তাহলে হয়তো তারিন বুঝতে পারবে রিফাত ওকে কতটা ভালোবাসে।
৩২.
ফোন হাতে নিয়ে গম্ভীরমুখে বসে আছে তারিন। একবার নিজেকে গালি দিচ্ছে আরেকবার রিফাত কে গালি দিচ্ছে। তখন যদি রাগ দেখিয়ে ফোন না কেটে দিতো, তাহলে অনেকক্ষন কথা বলতে পারতো। আর রিফাত কে গালি দিচ্ছে এটা ভেবে একবার কেটে দিয়েছে বলে কী আর ফোন দেওয়া যায় না। এত ভাব দেখানোর কী আছে। আগে তো রাগ করে ফোন কেটে দিলে কতবার করে ফোন দিয়ে রাগ ভাঙ্গাতো। তাহলে এখন কেন চুপ করে আছে রিফাত। তারিনের কাছে বার বার মনে হচ্ছে এই বুঝি ফোনের রিংটোন টা বেজে উঠলো। কিন্তু না প্রায় ১ঘন্টা ধরে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। তবুও রিফাতের কোন সারা নেই। কী হয় আরেকবার ফোন দিলে। নাকি মরে গেছে।
মরার কথা বলতেই তারিনের বুকটা কেঁপে উঠলো। নিজের মাথায় একটা টোকা দিয়ে বলল – ‘এইসব কী আবোল তাবোল বলছি আমি। হয়তো রিফাত ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আর ফোন দিচ্ছে না। ‘
রিফাতের প্রতি একটা মায়া জন্মে দেছে তারিনের। এই কয়দিন কথা বলতে বলতে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। যেন ওর সাথে এখন কথা না বললে ভালো লাগে না। সব সময় শুধু রিফাতের কথাই মনে পড়ে। যেন তারিনের প্রতিটি নিশ্বাসে মিশে গেছে রিফাত। কেন এতটা মায়ায় জড়িয়ে পড়লো তারিন। কেন সব সময় শুধু রিফাতের কথা মনে পড়ে। এর নাম কী ভালোবাসা। কিন্তু তারিন তো রিফাত কে ভালোবাসতে চাইনি। ইনফ্যাক্ট ও আর কাউকে ভালোবাসতে চায়নি। তাহলে কেন রিফাতের প্রতি এত আকর্ষন। কেন এত মায়া। কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়।
তারিন নিজের মনে মনে বলে উঠলো – ‘আমার একটা ভুলের জন্য বাবা-মা অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমি আবার সেই ভুল করে তাদের কষ্ট দিতে পারবো না। রিফাতের মায়ায় জড়ানো চলবে না আমার।
তারিন সিদ্ধান্ত নিলো, এখন থেকে রিফাত কে এড়িয়ে চলবে। কিছুতেই রিফাতের মায়ায় জড়াবে না। মেয়ে খুব ভয় পেয়ে ছিলো বলে বাবা-মা নিজেদের কষ্টটা চেপে রেখেছিলো। কিন্তু তারিন ভালো করেই জানে আফজাল সাহেব এবং আমেনা বেগম কতটা কষ্ট পেয়েছিলেন।
তারিন রিফাতের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
৩৩.
সকালে ঘুম থেকে উঠে রিফাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১০ টা বেজে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। তারপর ফোন হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেল। কারণ আজকের সকালটা প্রতিদিনের মতো নয়। প্রতিদিন ফজরের নামাজের সময় তারিন রিফাত কে ফোন দিয়ে জাগিয়ে তোলে। তারপর নামাজ পড়ে দু’জনে কিছুক্ষন কথা বলে বাকি কাজ করতে যায়। কিন্তু আজকে এতটা সময় পাড় হয়ে গেছে তবুও তারিন একবার ও ফোন দেয়নি। হঠাৎ করে রিফাতের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। রিফাতের মাথায় নানান রকম উদ্ভট চিন্তা আসতে লাগলো। আবার এটা ভেবে নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে যে বিয়ে বাড়িতে কোন কাজ করছে হয়তো। তাই ফোন দিতে পারেনি।
রিফাত নিজেকে যতই শান্তনা দিক তবুও বুকের ভিতর কেমন চিনচিন ব্যাথা করছে। এতদিনের অভ্যেস হঠাৎ করে চেঞ্জ হয়ে গেলে মনে নানান রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাওয়াটা স্বাভাবিক।
এরমধ্যে রাফি রুমে এসেছে। রিফাত রাফিকে জিজ্ঞেস করলো – ‘সবাই কোথায় রে।’
– ‘সবাই নিচে কাজ করছে।’
– ‘আমাকে ডাকলি না কেন?’ ১০ টা বেজে গেছে।’
– ‘তুই নিজেই তো বললি আরো কিছুক্ষন ঘুমাবি।’
রাফির কথা শুনে রিফাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘আমি আবার কখন বললাম যে আরেকটু ঘুমাবো।’
– ‘আরিয়ান যখন তোকে ডাকছিলো, তখন তুই বললি আরেকটু ঘুমাবি। তাই তো আমরা আর না ডেকে নিচে চলে গেছি।’
– ‘এখানে আমার কিছু করার নেই। এটা বিরোধী দলের কাজ।’
– ‘কিহ্,।
– ‘সেটা তুই বুঝবি না।’
– ‘প্রেমে পড়ে তুই পুরো পাগল হয়ে গেছিস। এখন এইসব বাদ দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়। সবাই খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে।’
– ‘আচ্ছা’
রাফি চলে গেল। রিফাত ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। আরিফ সাহেবের বাবা-মা কে সালাম দিয়ে চেয়ারে বসে গেল। খাওয়ার মাঝে হঠাৎ চেয়ারম্যান সাহেব রিফাত কে বলল – ‘তোমার বাবা-মা কেমন আছে?’
– ‘হ্যাঁ, তারা ভালো আছে।
– ‘আরিফ এর কাছে শুনলাম তোমার বাবা নাকি দেশের বাহিরে আছেন এখন।’
– ‘জ্বী আঙ্কেল। তিনি কিছুদিন আগে বাহিরে গেছেন।
– ‘ওহ, আচ্ছা।
কেউ আর কোন কথা বললো না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রিফাত উপরে চলে এলো। ঘরে এসে অনেকবার করে তারিন কে ফোন দিয়েছে। কিন্তু তারিন ফোন তোলেনি। রিফাত অনেকটা অস্থির হয়ে গেছে। বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে তারিনের কী হলো যে এতবার করে ফোন দেওয়ার পরেও রিসিভ করছে না। রিফাত আর দেরি না করে তিশার নম্বরে ফোন দিলো।
তিশা তখন বসে বসে গল্প করছিলো। ফোনের রিংটোন বেজে উঠার পর ফোন স্কিনের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে গেল। কারণ এখন তারিনের ফোন আছে। তাই তিশার নম্বরে ফোন দেওয়ার কোন দরকার নেই রিফাতের। তাহলে হঠাৎ এই নম্বরে কেন ফোন দিলো। তবুও কোন জরুরি কথা আছে, এটা ভেবে ফোনটা রিসিভ করলো তিশা। রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো – ‘তিশা আপনি কী জানেন তারিন কোথায়?’
রিফাতের এইরকম অস্থির কন্ঠে কথা বলার কারণ বুঝতে পারলো না তিশা। তিশা শান্ত কন্ঠে বলল – ‘আগে আপনি একটু শান্ত হন। তারপর আমাকে বলুন কী হয়েছে।’
– ‘আসলে তারিন কে বার বার করে ফোন দিচ্ছি, কিন্তু তারিন ফোন রিসিভ করছে না।’
– ‘এতে এত চিন্তা করার কী আছে। হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত আছে। তাই রিসিভ করতে পারছে না।’
– ‘আচ্ছা ও কী এখন আপনাদের বাড়িতে আছে?’
– ‘না এখনো আসনি। তবে কিছুক্ষন পর এসে যাবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
রিফাত আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিলো। পকেটে ফোন ঢুকিয়ে নিচে চলে গেল। সবাই বসে বসে গল্প করছে। দুপুর হয়ে গেছে আর কিছুক্ষন পর এই বাড়ি থেকে সবাই তিশাদের বাড়িতে যাবে। আজ কোন কিছুতেই রিফাতের ভালো লাগছে না। কোন কাজে মন বসছে না। আরিয়ান রিফাত কে জিজ্ঞেস করলো – ‘কি রে চুপ করে আছিস কেন?’
– ‘এমনি।’
– ‘আমার কাছে লুকাচ্ছিস।
রিফাত আরিয়ান কে সব কিছু বলল। রিফাতের কথা শুনে আরিয়ান হাসতে লাগলো। রিফাত জিজ্ঞেস করলো – ‘এভাবে হাসছিস কেন?’
– ‘এই কারণে তোর মন খারাপ।’
– ‘আমার মন খারাপের জন্য এটা কী যথেষ্ট নয়?’
– ‘না নয়।
– ‘তাহলে?’
– ‘আরে বোকা, আরেকটু পরেই তো আমরা তিশাদের বাড়িতে যাবো। সেখানে অবশ্যই তারিন থাকবে।’
রিফাত একটু ভেবে বলল – ‘তুই একদম ঠিক কথা বলেছিস। এই সহজ কথাটা আগে আমার মাথায় আসেনি।
যেহেতু কাছাকাছি বাড়ি, তাই বিকেলের দিকে সবাই তিশাদের বাড়িতে গেল।’
সবাই তিশা কে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও। রিফাতের চোখ শুধু একজন কেই খুঁজছিলো। আশেপাশে অনেক জায়গায় দেখলো। কিন্তু তারিন কে কোথাও দেখতে পেল না। খাবার খাওয়ার জন্য সবাই ডাকছে। রিফাত যেতে চাইছিলো না, কিন্তু আরিয়ান জোর করে রিফাত কে সেখানে নিয়ে যায়। আর সেখানে গিয়ে রিফাত তারিন কে দেখতে পায়। রিফাতের শরীরে যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেল। তারিনের সাথে কথা বলার জন্য সামনে যাবে আর তখনই তারিন রিফাত কে এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
চলবে…….?
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।