পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব- ১

0
2881

.
উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব- ১
(নূর নাফিসা)
.
.
১.
ভোর চার টায়, জুতোজোড়া হাতে নিয়ে, রাতে গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা কাধে নিয়ে নিশব্দে হেটে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মেঘ। গেইটের বাইরে এসে ব্যাগটা গেইটের সিকে ঝুলিয়ে কেডস শো পড়ে নিলো। তারপর ব্যাগটা নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সিএনজি স্টেশনে চলে এলো। সকাল সকাল দৌড়ানোর ফলে ব্যায়ামটাও হলো আর মনটাও একদম ফ্রেশ হয়ে গেল। একটা সিএনজি রিজার্ভ করে বাস স্টেশনে চলে এলো। সেখান থেকে টিকেট কেটে, দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে বাসে উঠে রওনা দিলো সিলেটের উদ্দেশ্যে।
মেঘ মাস্টার্স কমপ্লিট করে বছর খানেক হলো বাবার সাথে ব্যাবসায়ে হাত লাগিয়েছে। অনার্সের ছাত্র থাকাকালীন ই বাবার সাথে কন্টাক্ট করা প্রতি বছর কোথাও না কোথাও মাসব্যাপী ট্রিপে যাবে। আজ বন্ধুবান্ধব ছাড়া একাই রওনা দিয়েছে। বাসায় বাবা ছাড়া কেউ জানে না। অবশ্য বাবাও জানে না যে আজ যাবে। ছোট বোন বৃষ্টি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আর দু সপ্তাহের মতো আছে তার রেজাল্ট প্রকাশিত হবে। ভাইয়াকে প্রতি বছর ট্রিপে যেতে দেখে হিংসা হয় তার। তাই সেও বলেছে এবছর মেঘের সাথে ট্রিপে যাবে। রায়হান চৌধুরী মেয়ের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়েছে, যদি বৃষ্টি জিপিএ- ৫ পেয়ে পাস করে তাহলে যেতে দিবে মেঘের সাথে। বৃষ্টি এখন রেজাল্টের অপেক্ষায়ই আছে। কিন্তু এদিকে মেঘ বৃষ্টিকে সাথে নিতে রাজি নয়। জানেই কিছুদিন পর রেজাল্ট দিবে। তাই বৃষ্টি যেন তাকে না দেখতে পায়, সেজন্য চুপিচুপি পালিয়ে বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে।
মেঘ প্রকৃতির প্রেমিক। সবসময় প্রকৃতির লীলাভূমি, সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো সুযোগ খুজেই ট্রিপে জয়েন করে। আর তা যদি হয়, অরন্য, পর্বত শৃঙ্গ, জলধারা, সৈকত তাহলে তো কথাই নেই ! তাকে আর আটকায় কে!
উঁচুনিচু, সমতল বিভিন্ন পথ পেরিয়ে পৌছেছে সিলেটের হবিগঞ্জে। ভ্রমনকারীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত কোন এক রিসোর্টে উঠেছে মেঘ। ছোটখাটো এক রুম ভাড়া করে নিয়েছে। বাথরুমে গোসল সেড়ে হালকা নাস্তা করে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। রাতে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারেনি। তাছাড়া এতোটা সময় বাসে ভ্রমণ করে শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাই শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের জগতে তলিয়ে গেল।
বিকেলের দিকে ঘুম ভেঙেছে তার। খুব ভালো একটা ঘুম হওয়াতে শরীরটা একদম ফ্রেশ লাগছে। দেহে একটা আকাশী রঙের টিশার্ট জড়িয়ে ওয়ালেট আর ফোনটা সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘুরে দেখার জন্য। রিসোর্টের রেস্টুরেন্টে না গিয়ে একটু এগিয়ে চা বাগানের পাশে মাচায় তোলা ছোটখাটো হোটেলটায় লাঞ্চ সেড়ে নিলো। তারপর উঁচুনিচু জমিতে চাষ করা চা বাগান ঘুরে বেড়ালো। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে এলে রমনীগণকে দেখা যায় চা পাতা তোলার জন্য লাইন ধরে মাঠে নেমেছে। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এলে বাড়ি ফিরে যায় তারা। রমনীদিগের লাইন ধরে হাটা, চা পাতা তোলা, উঁচুনিচু চা বাগান, সূর্যাস্তসহ বিভিন্ন রমমের দৃশ্য ক্যামেরা বন্ধী করে সূর্যাস্তের পর রিসোর্টে ফিরে এলো মেঘ। পরপর দুদিন কাটালো হবিগঞ্জে। তারপর এসে ভিড়লো সিলেটের জাফলং এ। অপরূপ সৌন্দর্য্যের মায়া মিশে আছে জাফলং। উঁচুনিচু ও অরণ্যে আচ্ছাদিত পাহাড়! গিরিপথ বেয়ে নেমে চলেছে জলধারা অর্থাৎ ঝর্ণা! ঝর্ণার পানিতে গোসল সেরে নিয়েছে মেঘ। সেখানে ঘুরাফেরার পর শ্রীমঙ্গলের একটা হোটেলে উঠলো। রাত, ভোর, দুপুর কাটিয়ে বিকেল তিন টার দিকে একটা পাহাড়ে উঠলো। বড়সড় পাহাড়টা বেশি উঁচু না হওয়ায় উপরিভাগটা সমতল। এদিকটায় চাকমাদের বসবাস। বিভিন্ন লোক মাঠে মেষ চড়াচ্ছে। পাহাড়ের উপরিভাগে উঠতেই বাচ্চাদের একসাথে জড়ো গলার আওয়াজ শুনতে পেলো মেঘ। সামনে এগিয়ে দেখলো দশবারো জন বাচ্চাকে একটা মেয়ে পড়াচ্ছে! বাচ্চারা গলা ফাটিয়ে মেয়েটিকে অনুসরণ করে পড়ে যাচ্ছে। মনমুগ্ধকর একটা দৃশ্য! খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের উপর ছোট খাটো একটা স্কুল। শিক্ষক হিসেবে আঠারো-বিশ বছরের এক মেয়ে আর শিক্ষার্থী হিসেবে পাচ-সাত বছরের বাচ্চারা। এমন একটা দৃশ্য ক্যামেরা বন্ধী না করলেই নয়! মেঘ একটু দূর থেকেই ছবি তুলে কাছে এগিয়ে গেলো। মেয়েটিকে দেখে মেঘ একটু আশ্চর্য হলো। মেয়েটির চেহারা দেখে কোনো না কোনো দিক থেকে মনে হচ্ছে সে ঢাকার মেয়ে, আবার কোনো দিক থেকে মনে হচ্ছে সে পাহাড়ি কন্যা! অর্থাৎ সম্পূর্ণ ঢাকাইয়াদের মতোও না, আবার পাহাড়িয়াদের মতোও না! মেয়েটি কয়েকবার তাকিয়েছিলো মেঘের দিকে কিন্তু কোন কথা বা জিজ্ঞাসা করে নি। মেঘও কিছু বলেনি। একটু পর বাচ্চাদের ছুটি হলে বাচ্চারা লাইন ধরে আগে চলেছে আর তার পিছন পিছন মেয়েটি যাচ্ছে। মেঘ পর্যাবেক্ষন করে দেখলো লম্বাটে মেয়েটার পড়নে সালোয়ার কামিজ। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ঘনকালো লম্বা চুল। চুলগুলো খোলা, আর মাঝামাঝিতে ছোট একটা কাটা আটকে রেখেছে। পেছন থেকে দেখতেও খোলা চুলে দারুণ দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। ইচ্ছে করছিলো ছবি তুলতে, কিন্তু এভাবে ছবি তোলাটা অন্যায় হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছেটা সংযত রেখে পকেটে হাত দিয়ে মুচকি হেসে দাড়িয়ে আছে মেঘ। আরো কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে সন্ধ্যার দিকে পথের এক চায়ের দোকানে ঢুকলো। চা বিক্রি করছে এক মহিলা। দোকানের পেছনের দিকে একটু উচুতে মাচা পাতানো কাঠের ঘর। দোকানীদেরই হবে হয়তো। চা অর্ডার করতেই ছোট ছেলেটি ছোট একটি মাটির পাত্রে চা এনে দিলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মেঘের সম্পূর্ণ শরীর শিহরিত হয়ে উঠলো। এই প্রথম তার মাঝে এমন শিহরণ জেগে উঠেছে! চায়ের দোকানের ছেলেটি এমন সাহেবি বেশের মেঘকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। সাত-আট বছরের ছেলেটিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ জিজ্ঞেস করলো,
– নাম কি তোমার?
– বিধু চাকমা।
– দোকান তোমাদের নিজেদের?
– হ
– (দোকানীকে দেখিয়ে) উনি তোমার কি হয়?
– মা।
– এই বাড়িটাও তোমাদের?
– হ। কইত্তে আইছেন?
– ঢাকা থেকে।
দোকানী ছেলেটিকে ডাকলে ছেলেটি চলে গেলো। আস্তে আস্তে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে আর দোকানে লোকদের ভির জমছে। যে ই আসছে, মেঘের দিকে একটু ঘুরেফিরে বারবার তাকাচ্ছে। মেঘ চা শেষ করে টাকা দিয়ে হোটেলে ফিরে এলো।
২.
দুতিনদিন যাবত মেঘকে বাসায় দেখছে না বৃষ্টি। মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলে মা বললো জানে না। বাবার কাছে জিজ্ঞেস করলে বাবাও একই উত্তর দিলে বৃষ্টি ক্ষেপে গেলো। কারণ মা না জানতে পারে, কিন্তু বাবা ঠিক জানে মেঘ কোথায় আছে। পরিবারের সব সদস্যকে খুব ভালো করেই জানা আছে তার।
– সত্যি করে বলো ভাইয়া কোথায়।
– জানি না তো আমি। কি করে বলি বলতো!
– আর কেউ না জানলেও তুমি ঠিক জানো। তারাতারি বলো।
– বলে যায়নি তো আমার কাছে।
– ভাইয়া আমাকে রেখে ট্রিপে গেছে না?
– সত্যি বলছি, যাওয়ার সময় আমার কাছে কিছু বলে যায়নি।
– যাওয়ার সময় বলে যায়নি ঠিক আছে, কিন্তু আগে তো ঠিকই বলেছে। কি বলেনি?
এবার কি জবাব দিবে রায়হান চৌধুরী! মেয়ের কাছে যে ধরা পড়ে গেছে! আমতা আমতা করে বললো,
– না মানে বলেছিলো এ সপ্তাহে কোথাও যাবে, তাই আমার বিজনেস যেন আ….
– হয়েছে হয়েছে, আর বলতে হবে না। সব বুঝে গেছি আমি।যেতে দিলে কেন তুমি! বলেছি না আমার রেজাল্টের পর যেতে! এজন্যই তো কয়েকবার ফোন করার পর রিসিভও করে না!
বৃষ্টি কান্না শুরু করে দিলো। মিসেস মোহিনী চৌধুরী ধমক দিয়ে বললো,
– এখানে কান্না করার কি আছে! ছেলে মানুষ ঘুরাফেরা করবেই। ওর সাথে তোর জোড়া কিসের! মেয়েদের এতো দূর ঘুরাফেরা করা ভালো না!
– তুমি চুপ করো। ছেলের পক্ষ তো টানবেই। মেয়ে বলে জন্মেছি বলে হাত পা গুছিয়ে ঘরে বসে থাকবো?
– কি আযব মেয়ে! আমি কি সেটা বলেছি! তোকে কি ঘর থেকে বের হতে দেই না! ঘুরতে যেতে দেই না! আমি শুধু বললাম, দূরদূরান্তে মেয়েদের যাওয়া ভালো না। কোন বিপদ হলে ছেলেরা যতটা মোকাবেলা করতে পারবে মেয়েরা তা পারবে না।
– তোমার জ্ঞান তোমার কাছেই রাখো। (বাবাকে) কোথায় গেছে, বলো তারাতাড়ি। না হলে আমি সব ভেঙে ফেলবো।
– সে কি বলে যায় কখনো, কোথায় যবে! ফিরে এসে না গল্প বলে কোথায় গেছে, কি কি করেছে!
– ফোন দাও এখন। ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো কোথায় গেছে!
– আচ্ছা আচ্ছা, ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবো কোথায় গেছে। তারপর আমার বৃষ্টি মা কে জানাবো, ওকে?
– জিজ্ঞেস করবো না, এখন করবে।
বৃষ্টি নিজেই বাবার ফোন হাতে নিয়ে মেঘের নম্বরে ডায়াল করলো। লাউড স্পিকারে রেখে বাবাকে বললো কথা বলতে। মেঘ রিসিভ করে বললো,
– হ্যাঁ, বাবা বলো।
– কোথায় আছিস, তুই?
– আছি বাংলাদেশের কোন এক কোণে।
বৃষ্টি হুট করে বলে উঠলো,
– ভালোয় ভালোয় বল কোথায় আছিস, না হলে এই বাড়িতে ঢুকতে পারবি না!
– বাবা তুমি এই চামচিকার সামনে কল করেছো!
– খবরদার, চামচিকা বলবি না। তুই চামচিকা, তোর চোদ্দগুষ্টি চামচিকা।
– হ্যাঁ আমার চোদ্দগুষ্টির মধ্যে তুইও আছিস। এই কদিন পর না তোর রেজাল্ট দিবে, কোথায় আল্লাহর নাম নিবি! তা না করে মানুষের সাথে ঝগড়া করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিস!
– কোথায় আছো, বলবা না!
– এইতো লাইনে এসেছিস! আমি তো আমাদের ছাদের চিলেকোঠার ঘরে আছি। কয়দিন ধরে না খেয়ে আছি। বোন আয়, কিছু খাবার দিয়ে যা।
কথাটা বলে মেঘ হা হা করে হেসে উঠলো সাথে তার বাবা মা ও। আর বৃষ্টি রেগে চিৎকার করে বললো,
– উফফ! বাবা বলে না কেন তোমার ছেলে কোথায় আছে!
এবার রায়হান চৌধুরী আবার জিজ্ঞেস করলো,
– মেঘ তুই কোথায় আছিস?
– সিলেট।
মিসেস চৌধুরী এসে ফোন নিয়ে নিলো,
– হয়েছে তো এবার জানা!
বৃষ্টি নাকমুখ ফুলিয়ে চলে গেলো। মেঘের সাথে তার বাবা-মা কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here