উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ২০
(নূর নাফিসা)
.
.
২১.
মেঘ সকালে নাস্তার পর বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে , বিকেল হয়ে গেছে তবুও ফিরেনি! আজ সকালে চা বাগানে এসে নাফিসাকে বিরক্তও করেনি! দুপুরে আম্মি জিজ্ঞেস করেছিলো ” মেঘ দুপুরের খাবার খেতে বাসায় আসছে না কেন? কোথায় গেছে?” নাফিসা উত্তরে বলেছে সে জানে না। আম্মি এসে নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো কল করতে। কিন্তু কল করবে কিভাবে! মেঘের ফোন নম্বরও তো জানা নেই তার! আম্মি রেগে কিছুক্ষণ বকাঝকা করলো! এখন বিকেলে বাচ্চাদের পড়াতে এসেও বাচ্চারা মেঘের কথা জিজ্ঞেস করছে। মেঘ আজ তাদের সঙ্গীত শিখাতে আসেনি, আবার কাল বলে গিয়েছিল খরগোশ নিয়ে খেলা করবে। না এসেছে মেঘ আর না এনেছে খরগোশ! বাচ্চারা বারবার মেঘের কথা জিজ্ঞেস করতে করতে নাফিসাকে বিরক্ত বানিয়ে ফেলছে! কোনমতো পড়া শেষ করলো নাফিসা। বাচ্চারা তার পিছু পিছু বাড়িতে চলে এলো খরগোশ ছানাদের সাথে খেলার জন্য। খাচা বাইরেই রাখা ছিলো, বাচ্চারা মুঠো করে ঘাস নিয়ে খরগোশ ছানাকে খাওয়াচ্ছে। নাফিসা আসরের নামাজ পড়ে চা বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় বাচ্চাদের তাড়িয়ে দিলো নিজ বাসায় যাওয়ার জন্য। চা বাগানে আসতেই তার সঙ্গীরা জিজ্ঞেস করছে মেঘের কথা! সারাদিন মেঘের কথা শুনতে শুনতে কান তব্ধ লেগে যাচ্ছে! তারা আবারও বলে দিলো কাল বিকেলে মেঘকে সাথে নিয়ে যেন বটবৃক্ষের তলায় তাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে যায়। নাফিসা চা পাতা তুলে বাসায় আসার পথে পাহাড়ের কাছ থেকে কিছু নরম ঘাস তুলে নিয়ে এলো খরগোশ ছানার জন্য। বাসায় এসে দেখলো মেঘ এখনো আসেনি। মায়ের সাথে রান্নার কাজে হেল্প করতে লাগলো।
সন্ধ্যায় মেঘ বাসায় ফিরলো হাতে কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে। সে এসেই দেখতে পেল নাফিসা দরজার সামনে বসে খরগোশ ছানাদের মুখে ঘাস তুলে দিচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে সারাদিন ভালোই যত্ন নিয়েছে হয়তো! মেঘকে আসতে দেখে দরজার কাছ থেকে উঠে দাড়ালো নাফিসা। মেঘ ভেতরে এসে বললো,
– ভালোই তো যত্ন নিচ্ছো দেখছি! শুধু আমার বেলায় অবহেলা!
নাফিসা কিছু না বলে খরগোশ ছানার খাচা নিয়ে আম্মির রুমে চলে গেলো। মেঘ শপিং ব্যাগ গুলো খাটের একপাশে রেখে ফোন আর ঘড়ি টেবিলে রাখলো। আলমারি খুলে জামাকাপড় নিয়ে নাফিসাকে ডাকলো।
– মেঘা…
দুবার ডাক দেয়ার পর নাফিসা এলো।
– কি?
– গোসল করবো।
– তো আমি কি করবো!
– বাথরুম ফাঁকা আছে কিনা দেখে এসো।
– হ্যাঁ, ফাঁকা ই আছে। যান!
মেঘ মুচকি হেসে বললো,
– ওকে, জান। নাও ধরো এগুলো। আর চলো আমার সাথে।
– আমি আপনার জামাকাপড় নিয়ে কেন যাবো!
– তাহলে তোমার জামাকাপড় নিয়ে আসো, একসাথে গোসল করি!
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে মেঘের হাতে তার জামাকাপড় দিয়ে দিলো।
– আমার এতো গোসলের শখ হয়নি, ধরুন আপনার জামাকাপড়। আর নিজে নিয়ে যান।
– আশ্চর্য মেয়ে তুমি! এখন আমি একা একা বাথরুমে যাবো আর আম্মি যদি না জেনে সেখানে চলে যায় তাহলে ভাবতে পারছো কিছু! আমিও লজ্জা পাবো আর আম্মিও কতটা লজ্জিত হবে!
মেঘ ভুল বলেনি কথাটা! তারই বুঝতে এলোমেলো হয়েছে! তাই নাফিসা মেঘের জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে এলো। পিছু পিছু মেঘও। নাফিসা জামাকাপড় রেখে বের হতে নিলে মেঘ আটকালো। দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললো,
– চলো একসাথে গোসল করি!
নাফিসা মেঘকে ঠেলে সরিয়ে বাইরে এসে দাড়িয়ে রইলো। মেঘ গোসল করে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।
– জামাকাপড় ধুয়ে দাও। অনেক তো নিজের কাজ নিজে করেছি। এখন তো বউ আছে, এখন না হয় আমি একটু আরামে কাটাই!
মেঘ কথাটা বলে চলে এলো। নাফিসার প্রচুর রাগ হচ্ছে! না ইচ্ছে করছে এসব ধুয়ে দিতে আর না পারছে এগুলো রেখে চলে যেতে! কি সুন্দর অধিকার ফলাচ্ছে এখানে থেকে থেকে! দিনরাত তাকে জ্বালানো যেন তার পেশা হয়ে গেছে! নাফিসা রাগে ফাটছে আর জামাকাপড় ধুয়ে দিতে দিতে মেঘকে মনে মনে হাজার বার বকে যাচ্ছে! শরীরের সব রাগ যেন জামা-কাপড়ের উপর ঝেড়ে ফেলছে! জামাকাপড়ের মতো মেঘকে আছড়াতে পারলে এখন শান্তি লাগতো তার মনে!
কাপড়চোপড় ধুয়ে নাফিসা আম্মির রুমে চলে এলো। আজ সে খাবার নিয়ে যায়নি মেঘের জন্য। বাধ্য হয়ে আম্মিই গেছে খাবারের প্লেট ও বাটি নিয়ে।
– মেঘ, কোথায় ছিলে সারাদিন? দুপুরে খাওয়াও হয়নি তোমার!
– আম্মি, সিলেটেই কয়েকটা জায়গা ঘুরেছি। বাবা রিসোর্ট স্থাপন করবে সেটার জন্যই কিছু জায়গা দেখেছিলাম। আর দুপুরে খেয়ে নিয়েছি রেস্তোরায়।
– অহ! তোমার ফোন নম্বরটা দিও তো। টেনশন করছিলাম কোথায় গেছো, কিছু বলেও যাওনি!
– টেনশনের কি আছে। আমি মেঘার কাছে বলে গিয়েছিলাম ফিরতে দেড়ি হবে।
– কার কাছে?
মেঘ বিন্দু পরিমাণ লজ্জা পেয়ে বললো,
– নাফিসার কাছে।
রোকসানা নিশব্দে হেসে উঠলো। তারপর বললো,
– চমৎকার একটা নাম দিয়েছো। মেঘা, নামটা খুব সুন্দর! বাসায় কিছু জানিয়েছো বিয়ের কথা?
– না আম্মি, আমাকে সুযোগ বুঝে সেখানে গিয়ে জানাতে হবে। এখানে থেকে এমন কিছু জানালে বাবা-মা কষ্ট পাবেন! একমাত্র ছেলে আমি, আমাকে নিয়ে এমন কিছু তাদের কল্পনার বাইরে।
রোকসানা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– হুম, সেটা তো হবেই।
– আপনি চিন্তা করবেন না। বাবা-মাকে আমি শীঘ্রই জানাবো সবটা। আর নাফিসাকে ফেলে আমি যাবো না। আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন আম্মি।
রোকসানা মৃদু হেসে বললো,
– এখন, খেয়ে নাও তুমি।
মেঘ একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
– আম্মি এটা নিয়ে যান। আপনার জন্য এনেছি, দেখুন পছন্দ হয় কি-না!
– এটা কি?
– শাড়ি।
– শাড়ি এনেছো কেন শুধু শুধু! এটার কোন প্রয়োজন ছিলো না! অযথা টাকা নষ্ট!
– এটা কোনো কথা হলো! এটাও তো আমার একটা পরিবার! আমি কি পরিবারের জন্য কিছু করতে পারবো না!
– আমি সেটা বলিনি মেঘ! ঠিক আছে, দাও। এবার তুমি খেয়ে নাও, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
– হুম।
রোকসানা খাবার দিয়ে চলে গেলেন। নাফিসা আম্মির সাথে বসেই খেয়েছে। আম্মি খাওয়ার মাঝেও নানান বানী নাফিসার কানে দিলেন মেঘের সাথে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। যদিও শুনতে ভালো লাগছে না, তবুও নাফিসা তা চুপচাপ হজম করে নিলো। রাত হয় আর তার মনে ভয় বাড়তে থাকে! মেঘের কাছে যেতে ইচ্ছে করে না একটুও! কিন্তু আম্মির জন্য কিছু বলতেও পারে না! ঘুমানোর সময় হয়ে এলে নাফিসা ভয়ে ভয়ে ওই রুমে গেলো। মেঘ খাটে শুয়ে আছে মোবাইল নিয়ে! নাফিসাকে দেখতেই উঠে বসলো সে।
– মেঘা, এদিকে আসো।
নাফিসা তার কথায় কান না দিয়ে ঘরের কোনা থেকে মাদুরটা নিয়ে মাটিতে বিছিয়ে দিলো। মেঘ উঠে এসে নাফিসাকে টেনে খাটে বসালো। হাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে বললো,
– দুইটা শাড়ি এনেছি তোমার জন্য। দেখো পছন্দ হয় কিনা!
– আমি বলেছি কাউকে আমার জন্য শাড়ি আনতে?
– সবকিছু তোমাকে বলতে হবে! আর তুমি তো কিছুই বলোনা আমাকে, তাই নিজের ইচ্ছাতেই নিয়ে এলাম।
– আপনার ইচ্ছাতে এনেছেন আপনিই পড়েন। আমি শাড়ি পড়ি না।
– পড় না তো কি হয়েছে, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে পড়বে।
– পড়বো না আমি।
– আলমারিতে তুলে রাখো।
– পড়বো না যখন রাখবো কেন আলমারিতে।
– এতো কথা বলো কেন! পড়বেও এখন আলমারিতে তুলেও রাখবে। রাখো!
মেঘ ধমক দেয়ায় নাফিসা মুখ গোমড়া করে শপিং ব্যাগ গুলো সব আলমারিতে রাখলো। একসাথে সব রাখতে দেখে মেঘ বললো,
– আমার ড্রেস গুলো ব্যাগ থেকে নামিয়ে রাখো।
মেঘের কথামতো সব করছে ঠিকই কিন্তু তার কাজে জেদ স্পষ্ট! চোখে হালকা পানিও উঁকি দিচ্ছে! কেউ তার সাথে ধমক দিয়ে কথা বললে তার খুব খারাপ লাগে! আর মেঘ এটা বুঝে গেছে। কিন্তু তাকে কথা শুনাতে হলে এভাবেই বলতে হবে। এছাড়া আর উপায় খুঁজে পাচ্ছে না মেঘ! নাফিসা জামা আলমারিতে রেখে কাথা আর মশারী বের করে নিচে বিছানা ঠিক করতে লাগলো। মেঘ বললো,
– শুধু শুধু নিচে বিছানা করে লাভ নেই! আমি তোমার সাথে খাটেই ঘুমাবো।
নাফিসা কোনো প্রতিক্রিয়া না করে বিছানা ঠিক করে নিজেই নিচে শুয়ে পড়লো। মেঘ তো অবাক! আজ তাকে না বলে সে নিজেই নিচে শুয়ে পড়েছে! মেঘও কম কিসে! সেও খাট থেকে নেমে নাফিসার সাথে মাদুরে শুয়ে পড়লো! নাফিসা তাকে ধাক্কাতে লাগলো আর এক প্রকার কান্নাই শুরু করলো!
– ছাড়ুন, খাটে দিয়েছি তো আপনাকে। সেখানে ঘুমান।
– তুমি যেখানে, আমি সেখানে। সে কি জানো না!
মেঘ মুচকি হেসে গানের সুরে বললো কথাটা। এদিকে নাফিসার চোখে পানি! নাফিসা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য তার সাথে জোড়াজুড়ি করেই যাচ্ছে! মেঘ কাথাসহ মুড়ে নাফিসাকে কোলে তুলে খাটে ফেলে দিলো। নাফিসা উঠতে চেষ্টা করতেই মেঘ তাকে নিয়ে এক বালিশে এক কাথার নিচে শুয়ে পড়লো। কপালে একটা চুমু দিয়ে মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললো,
– চুপচাপ ঘুমাও। নড়াচড়া করবে না একদম। তাহলে কিন্তু মাইর লাগাবো!
নাফিসার হাত পা সব মেঘ দ্বারা আটকানো! বাধ্য হয়ে তার বুকেই মিশে থাকতে হলো। আবার সেই মিষ্টি গন্ধটা পাচ্ছে মেঘের শরীর থেকে! এ তো এক অজানা ভালো লাগা! এই গন্ধটা নাফিসাকে শান্ত হতে বাধ্য করছে!
সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো খোলা আকাশের নিচে! সে কি এখনো ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে বুঝতে পারছে না! ঘুম ভাঙলে তো আকাশমুখী ঘরের চালা দেখতে পাবে! কিন্তু আকাশ দেখছে কেন! চালা কোথায় গেছে!
ঝটপট উঠে বসলো নাফিসা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে কোন এক পাহাড়ে ঘাসের উপর শুয়ে আছে! তার গায়ে পাতলা কাথাটা আছে! মেঘ মাথার নিচে দুহাত রেখে তার পাশেই শুয়ে আছে! মেঘ শুয়ে থেকেই মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে!
– ঘুম ভেঙেছে তাহলে!
– আমি এখানে কিভাবে?
মেঘ উঠে বসে বললো,
– মেঘা, তোমার ঘুম অনেক গভীর। বাসা থেকে এপর্যন্ত নিয়ে এসেছি তবুও তোমার ঘুম ভাঙেনি! যদিও তোমাকে কোলে নিয়ে খুব সাবধানে হেটেছি যাতে ঘুম না ভাঙে! তবে ভয় একটা ছিলো, কোন লোকের সামনে পড়লে না জানি কি হতো! ভাগ্যিস এই ভোর বেলা কারো নজরে পড়িনি!
– মানে! আপনি আমাকে বাসা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন!
– হুম।
– কেন এনেছেন এখানে?
– বলেছিলাম না, তোমাকে নিয়ে সূর্যোদয় দেখবো! এজন্যই এনেছি। এমনিতে বললে তো আসতে না, তাই এই কৌশল অবলম্বন করতে হলো।
– এমন আযব মানুষও বসবাস করে দুনিয়ায়, জানা ছিলো না! যত্তসব!
নাফিসা কাথা মুড়ে হাতে নিয়ে উঠতে গেলে মেঘ তাকে এক টানে আবার বসিয়ে দিলো। তার দুপায়ের মাঝে বসিয়ে পা দিয়ে আটকে ধরলো। হাত থেকে কাথাটা নিয়ে চাদর ন্যায় দুজনকে একসাথে জড়িয়ে নিলো কাথার ভেতর। পেছনে বসে নাফিসার কাধে থুতনি রেখে কানের কাছে মুখ এনে বললো,
– এতো কষ্ট করে এতোটা পথ নিয়ে এলাম, উদ্দেশ্য সফল না হতেই এভাবে যেতে দেই কিভাবে! হুম? পূর্বাকাশে তাকাও মেঘা, আকাশ লাল হয়ে গেছে। সূর্য এখনই উদয় হবে।
দুতিন মিনিটের মধ্যেই সূর্যের দেখা পেল! নাফিসা প্রথমে ছোটার জন্য ছটফট করলেও এখন স্থির হয়ে মেঘের বাহুডোরে বন্দী হয়ে বসে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজন সূর্যের দিকে! লাল সূর্য একটু একটু করে সম্পূর্ণ দেখা দিলো তাদের! নতুন আলো ছড়িয়ে আলোকিত করে দিলো এ ভুবন! সূর্যোদয় দেখার মাঝে এতো আনন্দ, এতো ভালো লাগা আছে সেটা এই প্রথম অনুভব করলো নাফিসা! সাথে কানে ভেসে আসছে ঝর্ণার শব্দ! কাধে পড়ছে মেঘের গরম নিশ্বাস! অতি ভালো লাগায় চোখে অশ্রু ঝরছে তার! মেঘ নিজের ইচ্ছে পূরণ করতে পেরে খুবই আনন্দিত। এ তো তার বহুদিনের ইচ্ছে, প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে সূর্যোদয় দেখবে! আজ তার পূর্নতা পেল! নতুন লাল সূর্য উপরে উঠে গেলে মেঘ নতুন নেশায় মগ্ন হয়েছে! একদিকে সূর্যোদয়, অন্যদিকে পাথরের উপর আছড়ে পড়া ঝর্ণার পানির শব্দ আর পাখিদের কলোরব! এতো ভালো লাগছে কেন মুহূর্তটা! দুজনকেই শিহরিত করে তুলছে! নাফিসার কাধ থেকে চুল সরিয়ে কাধে ঠোঁট ছুয়ে দিলো মেঘ। নাফিসা চোখ বন্ধ করে ফেললো এবং সাথে সাথে মেঘের জামা খামচে ধরলো! মেঘ চুলের মাঝে মুখ লুকিয়ে বললো,
– ভালোবাসি মেঘা, খুব ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়!
আরও কয়েক মিনিট তারা এভাবে বসে থেকে একসময় নাফিসা চোখ মুছে উঠে পড়লো। কাথা রেখেই ছোট ছোট কদম ফেলে হাটতে লাগলো। এই পাহাড় তাদের বাসা থেকে দূরে না! কিন্তু এদিকে বেশি আসে না নাফিসা। বাচ্চাদের পড়ায় বলে শুধু ওই ছোট পাহাড়ে যায়। মেঘ উঠে কাথা ভাজ করে হাতে নিয়ে নিলো। দ্রুত পায়ে নাফিসার কাছে গিয়ে হাত ধরে তাকে হামহাম ঝর্ণার পাশে নিয়ে গেলো। নাফিসা কোনো কথা না বলে মেঘ যেদিকে নিয়ে গেছে সেদিকে চুপচাপ গিয়েছে তার সাথে। এখানে এসে মেঘ কাথাটা একটা ডালে ঝুলিয়ে রাখলো! টিশার্ট খুলেও কাথার সাথে রাখলো। এতো সকালে কোন লোকজন দেখা যাচ্ছে না এখানে! পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে আর ঝর্ণার পানি আছড়ে পড়ছে টিলা, পাথরের উপর! নাফিসা পাথরের উপর দাড়িয়ে শুধু দেখছে। মেঘ কি এখন এখানে গোসল করবে! প্যান্ট ফোল্ড করে মেঘ পানিতে পা রেখে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো নাফিসার দিকে।
– এসো গোসল করবো একসাথে।
নাফিসা চোখ বড় বড় মেঘের দিকে তাকালো! এতো সকালে গোসল! তাও এই ঝর্ণার পানিতে! কাপড়চোপড়ও তো আনেনি, গোসল করলে বাড়ি ফিরবে কিভাবে সেটা কি এই ছেলের মাথায় ঢুকেনি! একটা মেয়ে এতোটা পথ ভেজা কাপড়ে যাবে কিভাবে সেটা কি মাথাচাড়া দিচ্ছে না এই মানুষটার!
– কি চিন্তা করছো এতো? লোকজন নেই তো এখানে। এসো…
– না আমি এখন গোসল করবো না।
– গোসল তো তোমাকে করতেই হবে এখন আমার সাথে!
নাফিসা সেখান থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও পারলো না! মেঘ তাকে টেনে পানিতে নামিয়ে দিয়েছে!
– হচ্ছে কি এসব! বলেছিলাম না আমি গোসল করবো না!
– হুশশ!
মেঘ তাকে নিয়ে খাড়া ঝর্ণার নিচে দাড়ালো। নাফিসা তবুও ভিজতে চাইছে না! মেঘ নাফিসার ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে নিয়ে খাড়া ঝর্ণার নিচে মাথা রাখলো! কয়েক সেকেন্ড থেকে মাথা সরিয়ে নিলো। নাফিসার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো! এটা কি ছিলো সে কিছুই অনুমান করতে পারছে না! মাথা ভনভন করছে! খাড়া ঝর্ণার পানি মাথায় আছড়ে পড়া, তারউপর মুখ বন্ধ করে পানির নিচে জোর করে এতোক্ষণ আটকে রাখা! একটুর জন্য মনে হচ্ছিলো এই বুঝি দম আটকে মরে যাচ্ছে! এসব কোন মানুষের কাজ! মানুষ কতটা জঘন্য হলে এমন কাজ করতে পারে! নাফিসা এখনো ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না আর এদিকে মেঘের মুখে মুচকি হাসি। মেঘ নাফিসার কোমড় ধরে আছে, নাফিসা যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে! মেঘ তাকে তার বুকে ফেলে বললো,
– ঘনঘন শ্বাস না নিয়ে, ধীরে ধীরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ো।
মেঘের কথা মতো নাফিসা সেটাই করলো। এখন নিজের কাছে একটু হালকা মনে হচ্ছে। যখন বুঝতে পারলো নাফিসা স্বাভাবিক হয়ে গেছে তখন মেঘ তাকে নিয়ে গলা পানিতে নেমে গোসল করলো। কয়েকটি ডুব দিয়ে পানি থেকে উঠে এলো। নাফিসা ওড়না জড়িয়ে কাপছে। পুরো শরীর ভেজা, এখন বাসায় যাবে কিভাবে! রেগে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
– বলেছিলাম গোসল করবো না, এখন ভেজা কাপড়ে বাসায় ফিরবো কিভাবে?
মেঘ প্রতুত্তরে মুচকি হেসে ডাল থেকে কাথা নিয়ে চাদর ন্যায় নাফিসার গায়ে জড়িয়ে দিলো। এতে নাফিসার সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে গেছে! মেঘ বললো,
– কোন ইচ্ছা জাগলে সেটা অপূর্ণ রাখতে নেই। পরবর্তীতে আফসোস করবে। আমি সবটা ভেবেই তোমাকে পানিতে নামিয়েছি। রাস্তায় বেশি মানুষ থাকবে না, এভাবে বাসায় যেতে পারবে। চলো।
মেঘ টিশার্ট গায়ে দিয়ে নাফিসাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।
.
চলবে….