উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ২৩
(নূর নাফিসা)
.
.
২৪.
চাকমা সম্প্রদায়ের যাত্রাপালা অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেয়ে নাফিসার সাথে উপস্থিত হয়েছে মেঘ। খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ভালোই লেগেছে। ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন রেসেপি আর ভিন্ন অনুভূতি! খুব উপভোগ করেছে মেঘ। নাফিসাকে নিয়ে মেলায় ঘুরার সময়ই বৃষ্টির সাথে দেখা হয়েছিল তার। বৃষ্টি চলে যাওয়ার পর নাফিসাকে নিয়ে চুরির দোকানে এলো। মেঘ জোর করায় অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নাফিসাকে মেঘের সঙ্গ দিতে হচ্ছে! একমুঠো লাল চুড়ি নিয়ে নাফিসার হাতে পড়াতে গেলে নাফিসা হাত মুঠ করে রাখলো।
– আমি চুড়ি পড়বো না।
মেঘ তার হাতে জোরে চাপ দিতেই সে মুঠো ছেড়ে দিলো। আর মেঘ চুড়িগুলো পড়িয়ে দিলো।
– খুললে খবর আছে তোমার!
মেঘ দোকানীকে টাকা দিয়ে নাফিসার হাত ধরে আবার হাটতে লাগলো। জিজ্ঞেস করেছিলো আরও কিছু কিনবে কিনা, কিন্তু নাফিসার মুখ থেকে তো কোনো কথাই বের হয় না! মেঘ নিজের ইচ্ছাতেই মেলায় উঠা কিছু খাবার কিনে নিলো। নাফিসাকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছে মেঘ। প্রতিদিনের মতো আজও নাফিসাকে মেঘ দ্বারা আবদ্ধ হয়েই ঘুমাতে হয়েছে। আর যাইহোক, পুরুষ মানুষের শক্তির কাছে কি আর পারা যায়!
সকালে ঘরের সামনে উঠুনে বসে আম্মি মেঘের এনে দেওয়া মুরগীর লোম ছাড়াচ্ছিলো। নাফিসা পাশেই বসে পেয়াজ কেটে দিচ্ছে আর মেঘ ঘরে বসে বাবার সাথে ফোনে কথা বলছে। কয়েকটি জায়গা ঘুরে সে দেখেছে। বাবাকে ছবি পাঠিয়েছে। বাবা জানিয়েছে তিনি কাল সিলেট আসবে দেখতে। মেঘ বাবাকে বলে দিলো আসার সময় সাথে যেন ল্যাপটপটা নিয়ে আসে। বাবার সাথে কথা বলা শেষ হতেই নাফিসার আনন্দিত চিৎকার শুনিতে পেল মেঘ। নাফিসা “খালামনি” বলে চিৎকার করে দৌড় দিলো। মেঘ দেখলো কোন এক চাকমা মহিলা এসেছে আর নাফিসা আনন্দিত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে! পড়নে শাড়ি, যথেষ্ট স্মার্ট। বয়সে আম্মির মতোই হবে।
– আদাব, খালামনি। কেমন আছো?
– ভালো, আমার নাফিসা মনিটা কেমন আছে?
– আলহামদুলিল্লাহ, তোমাকে দেখার পর এখন খুব ভালো।
মেঘ দ্বিধায় পড়ে গেলো! নাফিসা ডাকলো খালামনি আবার বললো আদাব! এটা কেমন! কে উনি!
মহিলাটি এগিয়ে আসতেই আম্মি বললো,
– কেমন আছিস দিপা।
– এইতো ভালো। তুই কেমন আছিস?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। দিয়াকে নিয়ে এলি না কেন?
– দিয়া পৃথার বাসায় গেছে দুদিন হলো। বাসায় আর একা একা ভালো লাগছে না তাই ইচ্ছে হলো নাফিসার কাছে চলে আসি।
– খুব ভালো করেছো। খালামনি আজ থাকবে তুমি।
– আমার স্কুলে কে যাবে!
– হেড টিচার তুমি। দুএকদিন ইচ্ছে করলেই মিস দিতে পারো।
দরজার দিকে তাকিয়ে মেঘকে দেখে ডাকলেন রোকসানা।
– মেঘ এসো এদিকে। এ হচ্ছে আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড দিপা চাকমা।
– আদাব, খালামনি।
– আদাব। কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
– ভালো। চেনো নাকি আমাকে? খালামনি সম্মোধন করলে যে?
– এই মাত্র চিনলাম, নাফিসা খালামনি ডাকায় আমিও ডেকেছি।
দিপা হেসে বললো,
– ওহ আচ্ছা! রোকসানার কাছে শুনেছি আমি তোমার কথা। দেখে তো আরও বেশি ভালো লাগলো। কি নাফিসা, তোমার সমস্যা কোথায়? মেঘ তো যথেষ্ট স্মার্ট, সুসজ্জিত, মার্জিত! তোমার সাথে দারুণ মানিয়েছে!
রোকসানা জবাব দিলো,
– বুঝিয়ে যা একটু, আমি বুঝাতে বুঝাতে ক্লান্ত!
নাফিসা মেঘের দিকে তাকালো একবার পরক্ষনে বললো,
– খালামনি, ঘরে চলোতো। আগে বিশ্রাম নাও। কতোদিন দেখি না তোমায়, ঝুড়ি ভর্তি গল্প জমা আছে। চলো চলো…
নাফিসা টেনে দিপা খালামনিকে ঘরে নিয়ে গেলো। এদিকে মেঘ আম্মিকে বললো,
– আম্মি, বাবা সিলেট আসবে কাল। বাবা যতদিন থাকবে আমি রিসোর্টে উঠবো। আর সুযোগ বুঝে বাবাকে বিয়ের কথাটা বলার চেষ্টা করবো।
– হঠাৎ সিলেট কেন?
– রিসোর্টে স্থাপনের জন্য ভালো একটা প্লেস খুজছিলাম। এ দুদিন ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বাবাও দেখতে আসবেন। পছন্দ হলেই কাজ শুরু করবে।
– ওহ আচ্ছা। যা ভালো মনে করো তা ই করো।
– কিছু লাগলে বলুন, আমি বাজারের দিকে যাবো।
– না, কিছু লাগবে না।
মেঘ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো এদিকে রোকসানা রান্না বসিয়েছে। নাফিসা তো খালামনিকে পেয়ে ভীষণ খুশি! মায়ের কাজে হেল্প করছে আর খালামনির সাথে গল্প করছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে মেঘের কথা বুঝাচ্ছেন খালামনি, আর বারবার নাফিসা প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলছে। নাস্তা করে নাফিসা চা বাগানে যাওয়ার সময় খালামনিকে বারবার থেকে যেতে বলেছে।
মেঘ একটু দেড়ি করেই বাসায় ফিরেছে। রোকসানা দিপার সাথে উঠুনের একপাশে চালতা গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসে কথা বলছিলো। মেঘকে আসতে দেখে দিপা বললো,
– মেঘ, তোমার সাথে ঘুরতে যাবো। সময় হবে তোমার?
মেঘ একটু বিব্রত হলো! খালামনি তার সাথে ঘুরতে যাবে! তবুও হেসে বললো,
– কোথায় যাবেন?
– এদিকেই আশেপাশের অঞ্চল। নিয়ে যাবে না?
– অবশ্যই। কখন যাবেন বলুন?
– নাস্তা করেছো?
– না।
– আগে তুমি নাস্তা করো। তারপরই বের হবো।
রোকসানা ঘরে চলে এলো মেঘকে খাবার দিতে। আর দিপা বেঞ্চিতেই বসে আছে। রোকসানার মুখটা দেখে কেমন যেন লাগছে মেঘের কাছে। কেদেছে বোধহয়! বান্ধবীকে কাছে পেয়ে মনের সুখ দুঃখ প্রকাশ করেছে হয়তো! মেঘের খাওয়া শেষ হতেই দিপা চাকমা মেঘের সাথে বের হচ্ছিলো। রোকসানা দিপার হাত ধরে মাথা নাড়িয়ে কিছু ইশারা করছিলো। দিপা বললো,
– প্লিজ রোকসানা বাধা দিস না আমাকে। পরিবারের সদস্য হওয়া সত্তে সবটা জানা দরকার তার।
মেঘ তাদের আলাপন কিছুই বুঝতে পারেনি। দিপা রোকসানাকে উপেক্ষা করে মেঘকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। দিপা হাটতে হাটতে মেঘের সাথে কথা বলছে।
– তোমরা তো মনে হয় এক ভাই এক বোন। তাই না?
– হ্যাঁ।
– বাবা মা আছেন। তাই না?
– হ্যাঁ।
– জিজ্ঞেস করবে না আমি জানি কিভাবে?
– নিশ্চয়ই আম্মি বলেছে।
দিপা মৃদু হাসলো।
– হুম, ধরতে পেরেছো তাহলে। মাস্টার্স কমপ্লিট তোমার?
– হ্যাঁ।
– বর্তমানে কি বেকার?
– না, বাবার সাথে ব্যবসায়ে যুক্ত হয়েছি এক বছরের মতো হলো।
– ওহ! আচ্ছা। তুমি এতোদিন ধরে এখানে পড়ে আছো এতে ক্ষতি হচ্ছে না সেদিকে?
– বাবা সামলাচ্ছেন। কন্টাক্ট করা আছে বাবার সাথে, বারো মাসের একমাস আমার ছুটি থাকবে। অর্থাৎ প্রতিবছর লাং টাইম ট্যুরে যাবো। আর এখানেও সেই উদ্দেশ্যে আসা।
– ট্যুর উদ্দেশ্যে এসে বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো তাই না!
– এটা হয়তো ভাগ্যে ছিলো। তবে সম্পূর্ণটা ভাগ্যের দোষ না। আমার ইচ্ছেও ছিলো যদিও ধরনটা ভিন্ন হয়েছে।
– জানাও নি কেন বাসায়?
– সুযোগ হয়ে উঠছে না। হঠাৎ করে এমন কিছু শুনলে বাবা মা কষ্ট পাবে। কোন ইচ্ছার ত্রুটি রাখেনি তারা আমাদের দুই ভাইবোনের। আর আমাকে নিয়ে এমন কিছু তাদের কল্পনার বাইরে! ঢাকা ফিরে আমাকে সবটা খুলে বলতে হবে।
– আমি কিছু কিছু জেনেছি কিন্তু সবটা আমার ক্লিয়ার না। নাফিসার সাথে তোমার পরিচয় কিভাবে?
– এখানে বেড়াতে এসেই তাকে দেখেছি আমি। পাহাড়ে বাচ্চাদের পড়াচ্ছিলো। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু!
– বাহ! প্রথম দেখা পাহাড়ে! এ তো দেখছি পাহাড়ে মেঘের ছায়া! আর সেখান থেকে একেবারে প্রেমের সূচনা!
– হুম।
মেঘ মৃদু হাসলো। তারা কথা বলতে বলতে চা বাগানের পাশের রাস্তায় এসে পড়েছে। মেঘ রাস্তায় থেকে নাফিসাকে দেখালো। নাফিসাও একপর্যায়ে তাদের দেখতে পেয়েছে কিন্তু তারা দূরে থাকায় কথা বলতে পারেনি। তারা কথা বলতে বলতে আবার হাটতে লাগলো। দিপা চাকমা সেই পাহাড়ে যেতে চাইলে মেঘ নিয়ে এলো। এতোক্ষণে তিনি মেঘের কাছে মেঘ আর নাফিসার পরিচয়ের শুরু থেকে শেষ সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে নিয়েছেন। পাহাড়ে উঠে মেঘকে বললো,
– তুমি অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারো। ভালো লেগেছে তোমার সাথে গল্প করে। আমি তোমার সাথে কেন ঘুরতে এলাম জানো তুমি?
– জানি না, তবে অনুমান করতে পেরেছি কিছুটা। আপনি বোধহয় কিছু বলবেন আমাকে।
– হুম, কিছু না। অনেক কিছু বলবো তোমাকে। আগে বলো, নাফিসাকে সবসময় আগলে রাখতে পারবে তো তুমি?
– আপনি সম্পূর্ণ ঘটনা জেনেও হয়তো বুঝতে পারেননি নাফিসা এখনো আমার সাথে ফ্রী না। সে আমাকে মেনে নিতে রাজি না। এককথায় আমাকে বিরক্তিকর মনে করে সে। কেন এমন করে সেটা আমি জানি না। তবুও আমি বলবো, আমার জীবনের শেষ পর্যন্ত আমি তাকে মানানোর চেষ্টা করবো। চিন্তা শুধু একটাই, বাবা মা কে বুঝাতে পারবো কিনা কে জানে!
– তুমি অনেক বুদ্ধিমান। নাফিসা কেন এমন করে আমি সেটাই জানাতে এসেছি তোমাকে। আমি একটা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। আমার স্কুল চালু থাকা সত্ত্বেও আমি তোমার সাথে কথা বলার জন্যই এসেছি। নাফিসা ও তার মা দুজনেই ঢাকার বাসিন্দা।
– সেটা তাদের চেহারা দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি।
– হুম তার কারণটা এবার জানো…