পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব-৩৩

0
727

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৩৩
(নূর নাফিসা)
.
.
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে মেঘ ঢাকায় ফেরা নিয়ে আম্মির সাথে কথা বললো। আম্মি নাফিসাকে নিয়ে যেতে বললো কিন্তু নিজে যাওয়ার জন্য রাজি হলো না! মেঘ অনেক চেষ্টা করলো, বাবা মায়ের সাথে কথাও বলিয়েছে কিন্তু যেতে রাজি হননি। নাফিসা বাচ্চাদের পড়িয়ে বাসায় ফিরলে নাফিসাকে আম্মি রাজি করালো। আম্মিকে ছেড়ে যেতে সে রাজি না। কিন্তু মেঘ ও আম্মির জোড়াজুড়িতে যেতে সে বাধ্য! মেঘ তাকে বললো, কিছুদিন কাটিয়ে আবার তাকে নিয়ে সিলেট ফিরবে। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাতেই গোছগাছ করে রেখেছে।
সকালে নাস্তা করে আম্মির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়নি মেঘ। সিলেটের কিছু জায়গা ঘুরেছে যেগুলো তার ঘুরা হয়নি। বারোটার দিকে লাঞ্চ শেষ করে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করেছিলো ট্রেনে যাবে নাকি বাসে যাবে। নাফিসা সিদ্ধান্ত মেঘের উপর ছেড়ে দেওয়ায় ট্রেনে যাওয়ার জন্যই প্রস্তুত হয়েছে। একটা কেবিন বুক করেছে মেঘ।
সেই ছোটকালে এই ট্রেন যাত্রায়ই ঢাকা থেকে সিলেট এসেছিলো নাফিসা। আজ বহুবছর পর আবার ঢাকার উদ্দেশ্যেই পাড়ি জমিয়েছে সেই ট্রেন যাত্রায়। মেঘ স্টেশন থেকে ফাস্টফুড জাতীয় কিছু খাবার কিনে নাফিসাকে নিয়ে ট্রেনে উঠলো। দুজনেই মুখোমুখি দুই সিটে জানালার পাশে বসেছে। এদিকে কোনো মানুষ দেখছে না নাফিসা তাই জিজ্ঞেস করলো,
– ট্রেনে তো ভীড় জমার কথা, কিন্তু এদিকে কেউ আসছে না কেন?
মেঘ মৃদু হেসে বললো,
– কেন, ভীড় ঠেলে যাওয়ার ইচ্ছা? পুরো কেবিন বুক করেছি আমি। আর এমনিতেও তেমন ভীড় হবে না। তবে ঈদুল আজহার জন্য কিছুদিন পর ভীড় হবে।
– ওহ্! কেবিন না নিলেও পারতে। দুই সিট হলেই হতো। শুধু শুধু টাকা নষ্ট।
– তোমার জন্যই তো নিয়েছি। আমি সিট ছাড়াও ভ্রমণ করতে পারবো কিন্তু তোমার ব্যাপার আলাদা।
নাফিসা আর কিছু বললো না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। ট্রেনের বেল বেজে গেছে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে স্টেশন ছেড়ে গেছে সাথে ট্রেনের গতিও বেড়ে গেছে অনেক। মেঘ বললো,
– মেঘা, শাড়ি পড়ে থাকতে কি অসুবিধা হচ্ছে?
– উহুম।
– অসুবিধা হলে চেঞ্জ করে নিতো পারো।
– চেঞ্জ করবো এখানে!
– সমস্যা কি, কেউ আসবে না এদিকে। আমি থাকায় প্রব্লেম হলে বলো, বাইরে যাই।
– না, আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
মেঘ উঠে কেবিনের দরজা আটকে দিয়ে আবার আগের জায়গায় বসলো। নাফিসা তার দিকে তাকিয়ে আবার বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। দূরের দৃশ্য গুলো দেখা গেলেও কাছের দৃশ্য গুলো প্রচন্ড গতিবেগের কারণে তেমন দেখা যাচ্ছে না। নাফিসা তাকিয়ে আছে বাইরে আর মেঘ তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে। মেঘ লক্ষ্য করলো নাফিসার মুখটা কেমন মলিন দেখাচ্ছে। চুল খোপা করে রেখেছে তবুও ছোট ছোট চুলগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে! শাড়ির আঁচল বেধে রেখেছে তবুও বাতাসে ঢেউ খেলছে আঁচলে! আজ প্রথম শশুর বাড়ি যাচ্ছে বিধায় মেঘের এনে দেওয়া লাল শাড়িটাই পড়েছে নাফিসা। চোখে হালকা কাজল টানা দিয়েছে, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়েছে কানে ছোট ছোট দুল আর হাতে লাল চুড়ি। এতোটুকু সাজই মেঘকে মুগ্ধ করতে যথেষ্ট! না সাজলেও তাকে ভালো লাগে। মেঘ মনের অজান্তেই প্রকাশ করলো,
” উড়ছে কালো চুল আর হেলছে কানের দুল,
মন্দ হতোনা, যদি থাকতো খোপায় ফুল!
করেছো ওষ্ঠ রাঙা, দিয়েছো কাজল টানা,
তবুও কেন হয়ে আছো তুমি আনমনা?
বেধে রেখেছো লালাচল,
তবুও ঢেউ খেলছে দেখো না হয়ে অচল।
এ কোন রূপে সেজেছো তুমি পাহাড়ি কন্যা?
যার ফলে প্রবাহিত হচ্ছে আজ, মেঘের হৃদয়ে বন্যা!”
নাফিসা বাইরের দৃষ্টি সরিয়ে মেঘের দিকে নিক্ষেপ করলো। এতো সুন্দর করে লোকটা কথা বলে কিভাবে বুঝে উঠতে পারে না সে! বারবার প্রেমে পড়তে বাধ্য করে তাকে! হবেই না কেন, যে কেউ প্রেমে পড়তে বাধ্য! মেঘ কথা শেষ করে মুচকি হাসলে নাফিসাও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। মেঘ তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। নাফিসা বুঝতে পেরেছে মেঘ তার পাশে আনার জন্য হাত বাড়িয়েছে। তাই বললো,
– আমি জানালার পাশে বসবো।
– এসো।
নাফিসা মেঘের হাত ধরে উঠতেই মেঘ জানালার পাশ থেকে না সরে নাফিসাকে টেনে তার কোলে বসিয়ে দিলো।
– হচ্ছে কি!
– এখনো তো কিছুই হলো না, মিসেস!
– ছি, ট্রেনে আছি!
– তো! কে দেখছে আমাদের!
– আমি উঠবো।
– উঠো, নিষেধ করেছে কে!
– না ছাড়লে কিভাবে!
– আমি কি জানি!
– বসতে অসুবিধা হচ্ছে আমার।
মেঘ জানালার দিকে মুখ করে নাফিসাকে ঠিক করে তার পায়ের উপর বসালো।
– এবার সুবিধা হচ্ছে?
নাফিসা আর কিছু বললো না। সুবিধা তো হয়েছে ঠিকই কিন্তু কোলে বসায় অসস্তি লাগছে তবুও কিছু করার নেই, মেঘ উঠতে দিবে না। তাই সে চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ নাফিসার কাধে থুতনি রেখে বললো,
– মন খারাপ?
– উহুম।
– আম্মির জন্য খারাপ লাগছে না?
নাফিসা ছলছল চোখে মেঘ পানে তাকালো! এতো সহজে বুঝে যায় কেন সবকিছু!
– আমরা সিলেট ফিরবো তো আবার। শুধু শুধু মন খারাপ করছো কেন!
মেঘ নাফিসার খোপা খুলে দিলো। নাফিসাকে নিজের সাথে আরও চেপে ধরে চুলের ঘ্রাণ নিতে লাগলো।
– মেঘা, কি আছে এখানে? সর্বদা এ সুবাস মাতাল করে কেন আমায়? তৃপ্তি মেটে না কেন কবু? ইচ্ছে তো করে প্রতিমুহূর্তে এমন মাতাল সুবাসে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে!
নাফিসা একহাতে মেঘের শার্ট খামচে ধরে বললো,
– মেঘ চুপ! সহ্য হয়না আমার এতো সুখ! হারানোর ভয় লেগে থাকে সর্বদা! প্লিজ, এতো সুখের সন্ধান আমায় দিও না! মরে যাবো আমি অতি সুখে!
– অভ্যাসে পরিণত করবো তোমায়। লুপে দিবো সুখের রাজ্য। শুধু সঙ্গী থেকো মোর, করো নাকো ত্যাজ্য!
নাফিসা তার দেহের সমস্ত ভাড় মেঘের উপর ছেড়ে দিয়ে মেঘের বুকে হেলে পড়লো। মেঘ একটু থমকে গিয়ে বললো,
– মেঘা!
নাফিসার মুখে হাসি দেখে মেঘও হেসে তার মাথাটা বুকে রেখে তাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সিটে হেলান দিলো। নাফিসা চোখ বুজে মেঘের হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলো। প্রতিটি স্পন্দন যেন চিৎকার করে বলছে, “ভালোবাসি মেঘা!” আর তার সাথে তাল মিলিয়ে নাফিসার স্পন্দন সাড়া দিচ্ছে “ভালোবাসি মেঘ!”
প্রথমে অস্বস্তি বোধ করলেও এখন খুব ভালো লাগছে নাফিসার! মেঘ তাকে প্রতিটি মুহুর্তে লোভ দেখিয়ে যায়! যার ফলে মন সবসময় সেই মুহূর্ত গুলো ফিরে পেতে চায়। কতোক্ষন তাদের এভাবে কাটলো জানা নেই! একটু পর মেঘ বললো,
– ঘুমিয়ে পড়েছো মেঘা?
– উহুম।
– উঠো একটু।
– পা ব্যাথা করছে না?
– উহুম।
নাফিসা উঠে দাড়ালো কিন্তু সিটে বসলো না। মেঘ খাবারের ব্যাগটা নিয়ে আবার আগের জায়গায় বসলো। নাফিসা তার দিকে তাকিয়েই দাড়িয়ে আছে। মেঘ মুচকি হেসে নাফিসাকে টেনে আবার কোলে বসালো। চিপসের প্যাকেট ছিড়ে নাফিসার হাতে দিলে নাফিসা বললো,
– আমি খাবো না।
– চিপস আবার কেউ না খায়! আমার বাবা মা ও চিপস খায়!
– এখন খেতে ভালো লাগছে না।
– চানাচুর খাবে?
– কিছু না।
– ওকে খেতে হবে না। আমাকে খায়িয়ে দাও।
– ঢং!
– হুম।
নাফিসা মেঘের উপর হেলান দিয়ে মেঘের মুখে চিপস তুলে দিচ্ছে। দু তিনটা দিতেই নিজেও খাওয়া শুরু করলো। দুজনেই টুকটাক গল্প করছে আর চিপস খাচ্ছে। এক পর্যায়ে প্যাকেট খালি হয়ে গেলে নাফিসা ইচ্ছাকৃত খালি প্যাকেট মেঘের মুখে দিলো আর মেঘ সেটাই কামড়ে ধরলো। মেঘকে বোকা বানাতে পেরে নাফিসা হিহি করে হেসে উঠলো! মেঘ প্যাকেট ফেলে তার কানে কামড় দিয়ে বললো,
– তুমিই যদি এতো দুষ্ট হও, ভবিষ্যতে আমাদের বাচ্চারা কতো দুষ্টু হবে, মেঘা! ভাবতে পারছো!
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না! তার লজ্জা লাগছে। মেঘ একবার যে প্রসঙ্গে প্রবেশ করে সহজে বের হয়না! তার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো!
মেঘের সাথে ট্রেনে সময় কাটাতে ভালো লাগলেও ঢাকার মাটিতে পা রাখতেই নাফিসা ভীতি অনুভব করছে! খুবই অসস্তিকর লাগছে! এই শহরের সাথে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে, কিছুই ভুলতে পারেনি আজও! এতোবছর পর আজ আবার এখানে পা ফেলেছে শুধুমাত্র মেঘের জন্য !

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here