পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব- ৪

0
1204

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৪
(নূর নাফিসা)
.
.
৫.
সেদিনের পর বৃষ্টি তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলে রেখেছে, রেজাল্টের পর তারা সিলেট বেড়াতে যাবে। তারা কমপক্ষে এক সপ্তাহ থাকবে সেখানে। কয়েকজন যেতে রাজি হয়েছে। তাদের মধ্যে ছেলেদের তো কোন সমস্যা নেই কিন্তু মেয়ে ফ্রেন্ডের বাসা থেকে এতোদূর যেতে দিবে না! এমনকি বৃষ্টিকেও সিলেটের জন্য ছাড়বে না তার বাবা মা এটা খুব ভালো করেই জানা আছে। তাই তারা পরিকল্পনা করে নিলো, বাসায় বলবে কুমিল্লা যাবে সাত দিনের জন্য।
বৃষ্টির রেজাল্টে তার বাবা মা অনেক খুশি। বেড়াতে যেতে দিতেও রাজি, কিন্তু কুমিল্লা যাবে সাত দিনের জন্য! এটা তাদের কাছে আপত্তিকর বিষয়!
– বৃষ্টি, সাত দিনের জন্য কুমিল্লা গিয়ে কি করবি শুনি! কুমিল্লা এক দিনেই ঘুরে আসা যায়।
– মা, তুমি কোন দিন আমার মতে একমত হয়েছো! সবসময় তোমার ছেলের পক্ষ টেনেছো। তোমার একটাই কথা, আমি যেন সারাদিন ঘরে বসে থাকি! তাই তো!
– তোকে কিছু বুঝানোই দায়!
– তোমার বুঝ তোমার কাছেই রাখো! আমাকে বুঝাতে হবে না। বাবা, তুমি কি যেতে দিবে না?
– তোর মা তো ঠিকই বলেছে। কুমিল্লা তো একদিনেই ঘুরে আসা যায়। শুধু শুধু সাতদিন কাটানো কি প্রয়োজন! এক এক দিন এক এক জায়গায় বেড়াতে যা।
– না, আমি একদিন ঘুরবো না। বলেছো আমি জিপিএ-৫ পেলে ভাইয়ার সাথে ট্রিপে যেতে দিবে। এদিকে তোমার ছেলে আগেই পালিয়ে গেছে! এখন আমি গোল্ডেন পেয়ে পাস করে কুমিল্লায় যেতে চাচ্ছি, তাও আপত্তি জানাচ্ছো!
– আপত্তি জানাচ্ছি না। আমি শুধু…
– আমি কোন কথা শুনবো না। ক্লিয়ার বলো যেতে দিবে কিনা?
– আচ্ছা যা।
– কালকেই যাবো। দশ হাজার টাকা রেডি করো।
– দশ হাজার! এতো টাকা লাগবে কুমিল্লা যেতে!
– সাত দিনের থাকা খাওয়া কি তোমার বাবা ঠিক করে রেখেছে আমার জন্য!
মেয়ের কথা শুনে রায়হান চৌধুরী হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,
– এতো টাকা ক্যাশ রাখলে চুরিও তো হতে পারে।
– আচ্ছা, পাচ হাজার দাও। আর বাকিটা যখন দরকার হবে, বিকাশে পাঠিয়ে দিবা।
রায়হান চৌধুরী বরাবরই রসিক মানুষ! তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– মোহিনী, তোমার ছেলে সিলেট বাড়াচ্ছে, মেয়ে কুমিল্লা বেড়াবে আমরা আর বাসায় বসে থাকবো কেন! চলো কোথাও হানিমুনে যাই!
বৃষ্টি খিলখিল করে হেসে উঠলো, আর মোহিনী চৌধুরী জবাব দিলো,
– আহ! বুইড়া বেটার শখ কতো! চলো তাহলে যাই। বাড়িটা আমি মাথায় নেই আর তোমার ব্যবসায় তুমি মাথায় নাও। এগুলো আবার থেকে যাবে কেন!
বৃষ্টি ও রায়হান চৌধুরী মোহিনীর কথা শুনে একজোটে হাসলো।
পরেরদিন পরিকল্পনা মোতাবেক দুজন ছেলে বন্ধু আর বৃষ্টিসহ তিনজন মেয়ে বাসায় ম্যানেজ করে রাজি করাতে পেরেছে। তারপরদিন ভোরে তারা পাচজন ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। বাসে বসে সবাই মিলে গুগলে সার্চ করে সিলেটের ম্যাপ দেখে নিয়েছে। কোথায় কোথায় ঘুরবে তাও ঠিক করে নিয়েছে। পথ ভুলে গেলে লোকেদের কাছে জিজ্ঞেস করলেই গন্তব্যে পৌছাতে পারবে সেই ধারনাও করে নিয়েছে। দুপুরের আগেই তারা মৌলভীবাজার শহরে এসেছে। বৃষ্টির খুব আনন্দ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে মেঘকে এখনই ফোন করে জানাতে সেও এখন সিলেটে আছে। কিন্তু মেঘকে জানাতে গেলে বাসায় জেনে যাবে আর তার বাসায় জেনে গেলে ফ্রেন্ডের বাসায়ও জেনে যাবে! তাই মেঘের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো। বাসায় ফিরে একবারেই জানাবে মেঘকে। মৌলভীবাজারের একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেড়ে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করেছে তারা। যদিও এতোক্ষণ ভ্রমণের পর রেস্ট নেওয়াটা প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু তারা আজই শ্রীমঙ্গল যাবে, আর সেখানেই একটা রিসোর্টে উঠবে। অত:পর মৌলভীবাজার থেকে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সন্ধ্যায় তারা শ্রীমঙ্গল পৌছেছে। সিলেটেও ঢাকার মতো জ্যাম! শ্রীমঙ্গলে একটা রিসোর্টে এসে দুটো রুম ভাড়া করেছে। রিসোর্টের রুম গুলো একদম ছোট ছোট। যা বৃষ্টির পছন্দ হয়নি! ছেলে দুটো এক রুমে আর মেয়ে তিনজন এক রুমে। ডিনার করে তারা নিজেদের রুমে ঘুমাতে চলে এলো। ছোট বিছানায় দুজন আঁটলেও তিনজনের জন্য কষ্টকর। তাও কিছুই করার নেই, কষ্ট করে তিনজনই এক বিছানায় শুয়ে পড়লো। সারাদিন ভ্রমণ করে ক্লান্ত আবার তাদের ইচ্ছে খুব সকালে উঠে চা বাগান ঘুরবে, তাই রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে, চা বিস্কুট নাস্তা করে চা বাগানে ছুটে চললো পাচ জন। বন্ধুবান্ধব যেখানে একসাথে হয় সেখানেই মজা লেগে থাকে। চা বাগানেও তাদের দুষ্টুমির শেষ নেই। চা বাগানে কাউকে রানী, কাউকে চাকরানি বানিয়ে ফটোশুট করে নিলো। সবারই বাসায় টুকটাক কথা হয়। দুপুরে গোসল করে লাঞ্চ সেড়ে মাধবপুর লেক দেখে কলাবনের দিকে অগ্রসর হলো। চা বাগান, লাউয়াছড়া পেরিয়ে কলাবনে ঘুরে নিলো। তারপর সন্ধ্যার দিকে রিসোর্টে ফিরে এলো।
গতকালই পরিকল্পনা করে রেখেছে আজ তারা জাফলং ঘুরবে এবং গোয়াইন নদীতে গোসল করবে। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা চলে গেলো সেখান। ঘুরাঘুরি শেষে খাসিয়াপল্লীঘাটে গোসল করতে চলে এসেছে সবাই। এখানেই ঘটলো এক বিপত্তি! বন্ধুবান্ধব ইচ্ছে মতো ঝাপাঝাপি করেছে পানিতে নেমে। প্রায় একঘন্টা ঝাপাঝাপির পর পানি থেকে উঠে আর বৃষ্টিকে দেখছে না বাকি চারজন! আশেপাশে তাকিয়ে অন্য কয়েকজনকে দেখতে পেয়েছে, কিন্তু বৃষ্টিকে দেখতে পাচ্ছে না। সবাই ভয়ে আতঙ্কিত! বৃষ্টি কোথায় গেলো! সে তো সাতার জানে! পানিতে ডোবার সম্ভাবনা তো কম! যথাসম্ভব নিজেরা স্থলে, পানিতে খোজাখুজি করছে। একপর্যায়ে তারা একপ্রকার চিৎকার শুরু করেছে। আশেপাশের লোকজন তাদের চিৎকার শুনে বিষয়টি জেনেছে তাদের কাছে। তারাও যথাসম্ভব খোঁজেছে। অবশেষে না পেয়ে পুলিশকে জানাতে বললো। পুলিশকে জানাতে সেখানকার লোকজন সাহায্য করলো।
৬.
রেজাল্টের পর আরো চারদিন পার হয়ে গেছে মেঘ নাফিসাদের বাসায় আছে। বিকেলে মেঘ আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে খাটে। ঘরের ভেতর থেকেই শুনতে পেল কেউ একজন নাফিসা আর তার মায়ের সাথে কথা বলছে। অন্যকথা বলতে বলতে হুট করেই বলে উঠলো,
– অই ফোয়া কিতা অনো বালা অইসে নানি! আর খইদিন থাকবাই ইবা ! পাক্কা টাল অই বইসে! যাইত কি নামও নের না!
আরো কিছু কথা বলে মহিলাটি চলে গেলো। কিন্তু এর প্রতুত্তরে নাফিসা কিংবা তার মা কিছু বলেনি। এর আগেও মেঘকে দেখতে এসে এ ধরনের অনেক কথা বলেছে অনেকে। যা মেঘ নিজেই শুনতে পেয়েছে। না আর থাকা যাবে না। আজ বা কালের মধ্যেই বাসা ছেড়ে কোন রিসোর্টে উঠবে মেঘ। এতোদিন এখানে পড়েছিলো দুটো কারণে। একে তো সে অসুস্থ অন্যদিকে পাহাড়ি কন্যার মায়া! একটু পর নাফিসা ঘরে ঢুকেই মেঘকে জিজ্ঞেস করলো,
– কবে যাবেন এখান থেকে?
মেঘ সবকিছু বুঝতে পেরেও বললো,
– কেন?
– যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দিন। কবে যাবেন?
– এখানে থাকতেই ভালো লাগছে। তাই ভাবছি যাবো না।
– আপনার ভাবনা মোতাবেক সব চলবে নাকি! এটা আপনার বাবা দাদার বাড়ি না যে দিনের পর দিন পড়ে থাকবেন এখানে!
– এটা আমার বাবা দাদার বাড়ি হতে যাবে কেন! এটা তো তোমার বাবা দাদার বাড়ি। বাড়িটা ভালো লেগেছে তাই পড়ে আছি এখানে।
– চুপ! একদম চুপ! আর একটা কথাও বলবেন না। বিপদে পড়েছিলেন তাই ঠাই দিয়েছি। তারমানে এই নয় যে দিনের পর দিন এখানে থেকে যাবেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। সুতরাং এখন, এই মুহূর্তে আপনার আসবাবপত্র নিয়ে বিদায় হবেন। বেরিয়ে যান বলছি।
মেয়ের চড়া গলা শুনে তার মা এ ঘরে প্রবেশ করলো।
– নাফিসা, মেহমানের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানা নেই তোর! এমন বাজে ব্যাবহার করছিস কেন!
– আম্মি, চুপ থাকো তুমি। কে মেহমান! কিসের মেহমান! রাস্তা থেকে তুলে এনে ঠাই দিয়েছি, সেবা করে সুস্থ করে তুলেছি। একজন মানুষ হিসেবে অন্যের যতটুকু সেবা করার তার চেয়েও অনেক বেশি করেছি। আর কতো ভালো ব্যবহার করতে বলছো তুমি! চলে যেতে বলো এখন। আর এক মুহুর্তও যেন এ বাড়িতে না থাকে।
নাফিসা হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। নাফিসার আম্মি মলিন সুরে বললো,
– বাবা ওর কথায় কিছু মনে করো না। আসলে লোকদের মুখের কথা শুনে ও বাজে ব্যবহার করছে। আমার মেয়েটা এমন না।
– না, আন্টি ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করি নি। আপনাদের মতো এমন দয়ালু মানুষ পৃথিবীতে খোঁজে পাওয়া দুষ্কর! এতোদিন এখানে থেকে নাফিসাকে একটু হলেও চিনেছি আমি। আর এভাবে কারো বাসায় পড়ে থাকলে লোকজন যা তা বলবেই। আমি চলে যাচ্ছি।
মেঘ ব্যাগ গোছাতে লাগলে আন্টি বললো,
– এখনি চলে যাবে! আজ থেকে যাও। কাল কোন একটা ব্যাবস্থা করো।
– না, আন্টি। এখনি যাবো। আর ভাববেন না আমি রাগ করেছি। আমিও আগে থেকেই ভাবছিলাম চলে যাবো। আপনারা যেটুকু করেছেন আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
মেঘ ব্যাগ গুছিয়ে আন্টির কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে নাফিসার রুমটা একবার ভালোভাবে দেখে নিলো যেখানে মেঘ এতোদিন থেকেছিলো। আর মনে মনে বললো,
– আজ আবার তোমার রুম ফিরে পাবে নাফিসা।
উঠোনের একপাশে চালতা গাছটার নিচে ছোট বেঞ্চিতে বসে ছিলো নাফিসা। মেঘ তার কাছে গিয়ে বললো,
– আমাকে আশ্রয় দিয়েই তুমি সবচেয়ে বড় ভুল করেছো। চলে যাচ্ছি আমি। কোন দাবি থাকলে বলো। শোধ করার চেষ্টা করবো।
– কিসের দাবি?
– যেমন, এখানে থেকেছি, খেয়েছি, আমার সেবাযত্ন করেছো এসবের কোন দাবি থাকলে বলো।
– এখান থেকে চলে গিয়ে উদ্ধার করুন। আর কোন দাবি নেই।
মেঘ মুচকি হেসে বললো,
– আচ্ছা, ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ।
.
মেঘ চলে গেলো বাসা থেকে। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রোকসানা নামক সেই মধ্যবয়সী মহিলাটা দরজায় হেলান দিয়ে ভাবছে ছেলেটা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু মেয়েকেও তো দোষ দেয়া যাচ্ছে না। সে ও তো লোকমুখে কথা শুনেই এমন ব্যবহার করেছে! ছেলেটা ভালোভাবে যেন বাড়ি ফিরতে পারে এই দোয়া করে তিনি খুব বড় একটা নিশ্বাস ছাড়লো। সন্ধ্যার পর নিজের রুমে এলো নাফিসা। রুমটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। প্রায় দু’সপ্তাহের মতো এই রুমটা অন্যের দখলে ছিল! কাপড়চোপড়, ওষুধপত্র এলোমেলো ভাবে থাকতো, নাফিসা চা বাগান থেকে এসে সব গুছিয়ে রাখতো। বিকেলে বাসায় ফিরে দেখতো তার বই মাথার পাশে রেখেই লোকটা ঘুমিয়ে পড়তো আর নাফিসা তা তুলে বুকশেলফে রেখে দিতো। ঠিকসময়ে খাবার এনে দিতো, ওষুধ হাতে তুলে দিতো, হাত পায়ে জলপট্টি লাগিয়ে দিতো! আজ সব কাজের ছুটি দিয়ে গেছে লোকটা।
নাফিসাদের বাসা ছেড়ে মেঘ ইকো রিসোর্টে উঠেছে। বাড়ি ছেড়েছে তো কি হয়েছে! এখান থেকে যাবে না সে। পাহাড়ি কন্যার মায়ায় যে পড়ে গেছে অনেক আগেই! ব্যাগটা ফ্লোরে ঢিল মেরে চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো মেঘ। হাতদুটো মাথার নিচে রেখে বললো,
– যদি ঢাকা ফিরতেই হয়, তাহলে তোমাকে সাথে নিয়েই ফিরবো, মেঘা! পাহাড়ি কন্যা তুমি এই মেঘের মেঘা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here