পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব-৫১

0
406

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৫১
(নূর নাফিসা)
.
.
আকাশের রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে রুমটা দেখলো। সজ্জিতই আছে সব! ছেলে মানুষ এতো গুছিয়ে রাখতে জানে! তার ভাই মেঘ হলে রুমের বারোটা বাজিয়ে রাখতো, এটা সে নিশ্চিত! যদিও মেঘ অগুছালো না কিন্তু বৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে রাখার জন্য নিজে গুছায় না! দেয়ালে তিনটা ফ্রেম ঝুলানো আছে। একটাতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলা ও একজন পুরুষ সাথে আকাশ। হতে পারে আকাশের বাবা মা। আরেকটায় আকাশের সাথে একজন বৃদ্ধ মহিলা, ইনি আকাশের দাদু! আরেকটাতে কিছুই নেই! মনে হচ্ছে উপরে টিস্যুর আবরণ, ভেতরে কিছু আছে কিনা বুঝা দায়!
পাচ মিনিটের মতো অতিক্রম হতেই আকাশ বেরিয়ে এলো। কাপড়ের ছোট বালতিটা রুমের দরজার বাইরে রেখে আবার দরজা লাগিয়ে দিলো। মাথা মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়াতেই বৃষ্টি বললো,
– আকাশ, উনারা কি তোমার বাবা মা?
– হুম।
– আর উনি দাদু?
– হুম।
– সাদা ফ্রেম ঝুলিয়ে রেখেছো কেন?
– কোনটা?
– ওই যে!
– এটা সাদা! এর মতো রঙিন কোনো ফ্রেম নেই!
– ফ্রেম না, মানে আমি ছবির স্ক্রিনের কথা বলছি।
– আমিও সেটার কথাই বলছি!
বৃষ্টি বিরক্তবোধ করলো। আকাশ সব কথাতেই আজ মজা মিশিয়ে ফেলছে যেটা একদমই ভালো লাগছে না! সাদা ছবিকে বলছে রঙিন!
কেউ আর কোনো কথা বললো না। আকাশ সাজুগুজু করছে আর বৃষ্টি দেখছে আয়নায়। ভেজা চুলে, খালি গায়ে অসম্ভব সুন্দর লাগছে! আকাশ নিজের কাজ করতে করতেই বললো,
– পলক তো ফেলো একবার! এভাবে তাকালে লজ্জা লাগে আমার!
– স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, রিজভী ভাইয়ার বাতাস লেগেছে তোমার দেহে! প্রথম প্রথম একদম ভোলাভালা মনে হতো আর এখন পুচকে!
– ভোলাভালা মনে করেই প্রেমে পড়েছো তাই না!
বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে বাথরুমের দিকে যেতে লাগলো আর আকাশ বললো,
– আমি ছোট থেকেই অন্যরকম! কিন্তু ভোলাভালা না! একএকজনের কাছে এক এক ভাবে ধরা দেই। সহজে কারো কাছে নিজের আসল রূপ তুলে ধরি না!
বৃষ্টি কোনো প্রতুত্তর না করে বাথরুমে এসে চোখেমুখে পানি দিলো। আকাশ একটা টিশার্ট পড়লো অত:পর দুজনেই বের হলো রুম থেকে। আকাশ রুম লক করে বললো,
– বৃষ্টি, পায়ে কি খুব ব্যাথা লাগছে?
– উহুম।
– ব্যাথা নিয়ে বসে থেকো না। সত্যটা বলো, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
– একটু একটু লাগছে, এমনিতেই সেড়ে যাবে। প্রয়োজন হলে যাবো ডাক্তারের কাছে।
– ওকে। শ্বশুর বাড়ি দেখে যাও ঘুরেফিরে।
– না, তাহলে পরে আর ইন্টারেস্ট থাকবে না! এমনিতেই তুমি আমার শখের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো! চলো।
– দাদুর সাথে দেখা করবে না?
– দাদু বাড়িতে?
– হুম।
– আকাশ তুমি এতোক্ষণ আমাকে সেখানে বসিয়ে না রাখলেও পারতে!
– চুপ! বলো না আবার, এতোক্ষণ যে আমার বেডরুমে ছিলে!
– আর কে আছে বাসায়?
– দাদু আর দাদুর দেখাশোনা করার জন্য একজন মেয়ে। আর কেউ নেই। আব্বু আম্মু অফিসে। চলো।
আকাশ বৃষ্টিকে দাদুর কাছে নিয়ে এলো। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আবার বেরিয়ে এলো। গাড়িতে বসতেই রূপা কল করলো। বৃষ্টি জানিয়ে দিলো সে ঠিক আছে আর আজ তাদের সাথে জয়েন করছে না সে! কথা শেষ হলে গাড়ি চালাতে চালাতে আকাশ বললো,
– মাই ডিয়ার উডবি, কোন রেস্তোরাঁয় যাবো? বলো?
– আকাশ, এতো স্বপ্ন দেখাচ্ছো কেন! যদি আমি তোমার না ই হলাম! যদি বাবা মা তোমার সাথে আমার বিয়ে না ই দিলো!
– না দেওয়ার কারণ কি হতে পারে?
– যেমন ধরো, তুমি বেকার বলে তোমার কাছে বিয়ে দিবে না! তখন?
আকাশ হঠাৎ করেই গাড়ি ব্রেক করলো এবং কাশির ভাব ধরে বললো,
– তুমি চোখে কম দেখো! আমি এখনো গাড়ি চালাচ্ছি আর তুমি বলছো আমি বেকার! এটা কি কাজ না!
– গাড়ি চালাচ্ছো ঠিকই কিন্তু টো টো কোম্পানির ম্যানেজার! এতে কি তোমার উপার্জন হচ্ছে!
– উপার্জনের চিন্তা কেন করছো! বাবা বিজনেস ম্যান, মা বিজনেসম্যান! দুজনের উপার্জনে আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদেরও জীবন ফুরিয়ে যাবে! তার উপরও টান পড়লে তোমার বাবা আছে!
– ছি! কিসব কথাবার্তা! কেউ কখনো জিজ্ঞেস করলে কি বলবো! বোকার মতো চুপ করে থাকতে হবে!
আকাশ হেসে বললো,
– তখন বলে দিও, আসাদ আহমেদ কোম্পানির অংশীদার। আমিও তোমার ভাইয়ের মতো আব্বুর সহকর্মী! বেকার না আমি, মাঝে মাঝে যাই আরকি অফিসে। কাজ থাকে না তেমন, আব্বু আম্মুও কাজ করতে দেয় না। সেখানে আমার কি করার! আমি সময় বাচিয়ে নিয়ে আমার মতো করে বাচি!
আকাশ বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এলো। দুজনেই খেয়ে নিলো। আকাশ সারাদিন আজ বৃষ্টিকেই সময় দিলো। ঢাকার কয়েকটি জায়গা ঘুরে বিকেলে শপিংমলে এলো চুড়ি কেনার জন্য। বৃষ্টি চুড়ি পছন্দ করলো আর আকাশ সেগুলো রেখে অন্য ডিজাইনের চুড়ি তার হাতে পড়িয়ে দিলো। বৃষ্টি আশ্চর্য হয়ে বললো,
– মাথা খারাপ তোমার! আমি মায়ের জন্য চুড়ি কিনতে এসেছি!
আকাশ কাশির এক্টিং করে বললো,
– আগে বলবে তো! আর সমস্যা কি! এগুলো তোমার আর সেগুলো আন্টির জন্য নিয়ে নাও।
– আমি কোনো প্রোগ্রাম ছাড়া চুড়ি পড়ি না। থেকে থেকে শুধু শুধু নষ্ট হবে।
আকাশ কানের কাছে এসে বললো,
– আগে থেকেই অভ্যেস করো। বিয়ের পর পড়তে হবে। না হলে শাশুড়ির কটু কথা শুনবে!
বৃষ্টি চোখ কুচকে তাকালো তার দিকে কিন্তু কিছু বললো না। আকাশ মিটিমিটি হাসছে! শপিংমল থেকে বের হতেই আকাশের কাছে বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠেছে বৃষ্টি। তবুও আকাশ গাড়ি নিয়ে পিছু পিছু বাড়ি পর্যন্ত এসেছে। বৃষ্টি বাড়িতে প্রবেশ করলে আকাশ ফিরে গেলো।

৪৮.
মধুচন্দ্রিমা উপভোগ করতে মেঘ ও মেঘা আরও দুদিন কাটালো সাজেক ভ্যালিতে। সেখান থেকে ফিরে গেলো সিলেট।
আজ দুপুরে গোসল করে শাড়ি পড়েছে নাফিসা! সেজেছেও একটু! আম্মি খাবার খাওয়ার জন্য বললো কিন্তু সে খেলো না! দরজার সামনে বসে খরগোশ নিয়ে খেলা করছে। আর মেঘের জন্য অপেক্ষা।
একটু পরেই মেঘ বাসায় ফিরেছে। নাফিসাকে দেখতে পেল সেজেগুজে দরজার সামনে বসে আছে খরগোশ নিয়ে। মেঘকে দেখতে পেয়ে নাফিসা মুচকি হাসলো এবং সরে দাড়ালো। মেঘ মুচকি হেসে ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
– মেঘা, বেড়াতে যাবে নাকি আজ!
– হুম।
– কোথায়?
– আমি যেদিকে নিয়ে যাবো।
– তাই নাকি! তুমি বেড়াতে নিয়ে যাবে আজ!
– হুম।
– খেয়েছো?
– না।
– দিলে তো মুডটা খারাপ করে! দিনে ছয়বার খেতে বলেছি তোমাকে আর অর্ধেক দিন ফুরিয়ে গেছে তুমি একবার যে খেয়েছো সেটুকুতেই আছো!
– তোমার সাথে খাবো, তাই তো বসে আছি!
– বাচ্চাদের চেয়েও বেশি খারাপ তোমার আচরণ! আরও অনেক আগেই খাওয়া দরকার ছিলো তোমার, এখন আবার খেয়ে নিতে!
নাফিসা আর কিছু না বলে আলমারি থেকে মেঘের জামাকাপড় বের করে দিলো। মেঘ হাতমুখ ধুয়ে একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে আম্মিকে বলে বের হলো দুজন। সাথে শীতের জামা নিয়েছে। প্রথমে চা বাগান তারপর তাদের প্রথম দেখা হওয়া সেই পাহাড়ে এলো। আজ অনেক দিন পর এখানে এসেছে। মেঘ এসেই শুয়ে পড়লো। নাফিসা পাশে বসে আছে। মেঘ হাত বাড়িয়ে নাফিসাকে টেনে ঘাসের উপর শুয়িয়ে দিলো। আর নাফিসার আঁচল ছড়িয়ে তার উপর মাথা রেখে শুয়ে ঘাসফড়িং নিয়ে খেলা করতে করতে বললো,
” তোমার আমার প্রেম নামক মেলায়,
আজ ঘাসফড়িংয়ের সাথে করবো খেলা!
গহীন বনের নির্জন পথে হেটে দুজন,
আজ কাটিয়ে দেবো সারাবেলা!
মেঘা, সূর্যকে নিয়ে করেছো কভু খেলা?
চাদকে ভালোবেসেছো আর সূর্যকে করেছো অবহেলা!
তাহার রূপেও যে পরম মাধুর্য আছে,
বুঝবে কিভাবে, যদি না ই করো খেলা!”
নাফিসা মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে আর মেঘ নাফিসার এক হাত নিয়ে আকাশের দিকে তুলে খেলা করে যাচ্ছে। একটু পরই নাফিসা উঠে বসতে চাইলো এবং বললো,
– মেঘ, চলো না যাই
উঁচু নিচু গিরিপথ বেয়ে!
বেড়াবো তোমায় নিয়ে
সবুজ পাহাড় ছেয়ে!
আঁচল ছেড়ে উঠো এবার!
মেঘ উঠে বললো,
– এই অবস্থায় তোমার বেশিক্ষণ হাটাহাটি ঠিক হবে না।
– আজকেই তো ঘুরতে বেরিয়েছি, প্রতিদিন তো আর আসছি না! চলো।
নাফিসার কথায় মেঘ আবার পাহাড় থেকে নেমে এলো। কথা বলতে বলতে হাটতে লাগলো দুজন। বন জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেটেছে, ঝর্ণার ধারে হেটেছে, অত:পর যাচ্ছে এক পাহাড়ের দিকে। পাহাড় কেটে সুন্দর সিড়ি করা উপরে উঠার জন্য। হাত ধরে দুজন একসাথে উঠছে উপড়ে। মেঘ চেয়েছিলো নাফিসাকে কোলে করে উঠাতে কিন্তু নাফিসা উঠেনি। নিজ পায়ে হেটে যাচ্ছে, মেঘের সাথে তাল মিলিয়ে। মেঘ এভাবে তাল মিলিয়ে হাটতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মুচকি হেসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ থেমে যাওয়ায় সেও থেমে গেলো। কিছু বুঝতে না পেরে মেঘ বললো,
– দাড়িয়ে গেলে কেন!
নাফিসা স্থির হয়ে জবাব দিলো,
” ছিলো সাদামাটা জীবন ধারীনী এক পাহাড়ি কন্যা!
হঠাৎ এসেছে এক রাজকুমার, দেখেছে তাকে,
আর রঙিন আলো ছড়িয়ে, সৃষ্টি করেছে সুখের বন্যা!
ছিলো না জানা ভালোবাসা তাহার,
না ছিলো কোন পরিচয়!
তবুও জেনে গেছে আজ সে ভালোবাসা কি,
আর তাহার সাথে জড়িয়ে আছে অদ্ভুত মায়া!
হবেই না কেন! পড়েছে যে,
পাহাড়ে মেঘের ছায়া!
না সাদা না ধুসর!
তাহার মাঝে আছে শত রঙের বাহার!
এ নহে ভেসে বেড়ানো অম্বরের মেঘ!
এ তো মানব মেঘের ছায়া!”
মেঘ এতোক্ষণে লক্ষ্য করলো পশ্চিমাকাশে হেলে পড়া সূর্যের কিরন তার ছায়া ফেলেছে পাহাড়ের গায়ে আর ছায়ায় কদম ফেলে তাল মিলিয়ে হেটে যাচ্ছে নাফিসা! মেঘের মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি! নাফিসা আবার বললো,
– ভালোবাসি মেঘ,
আরও ভালোবাসি পড়েছে বলে পাহাড়ে মেঘের ছায়া!
মেঘ হুট করেই নাফিসাকে কোলে নিয়ে সিড়ির ধাপ অতিক্রম করতে করতে তার কথায় সুর ধরে বললো,
– আর মেঘকে জড়িয়েছে পাহাড়ি কন্যার মায়া! ভালোবাসি বেগম সাহেবা!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here