#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০২
পুনমের রিকশা যখন বাসার সামনে থামলো তখন দুটো ছায়ামূর্তি নড়ে উঠলো।একজন হলো নিয়াজ সাহেবের আর একজন হলো পুনমের সাথে যার নাড়ীর সম্পর্ক।পুনমের সেজো আপা পাবনী। এই পরিবারের সবচেয়ে চুপচাপ,শান্ত ও গম্ভীর মেয়েটা হলো পাবনী।এই মেয়েটা নিজেকে আড়ালে রাখতে সবসময় পছন্দ করে।নিয়াজ সাহেবের মত পাবনীও অপেক্ষা করছিল পুনমের।
পুনমকে বাসায় ঢুকতে দেখে পাবনী ছাদ থেকে নেমে যায়। সে এতক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে ছটফট করেছে বোনের জন্য আর নিয়াজ সাহেব বারান্দায়। কিন্তু তফাৎ হলো নিয়াজ সাহেবের অস্থিরতা দেখা গেলেও পাবনীর টা জানা অব্দি যায় না। এই পৃথিবীতে যারা শান্ত প্রকৃতির তাদের ভিতরের অশান্তিটা থাকে সবার আড়ালে!
পুনম বাজারের ব্যাগ নিয়ে সোজা রান্না ঘরে মায়ের কাছে চলে গেলো,
—–মা হাঁস ড্রেসিং করে এনেছি,তুমি শুধু কুটে ধুয়ে চুলায় বসালেই হবে।
সালেহা বেগম অত্যান্ত অসন্তোষ গলায় বলে উঠলো,
——হ্যারে, পুনু এটা হাঁস আনার কোন সময়? বলতো কখন রান্না করবো কখন জামাইদের খাওয়াবো? তারা নামাজ পড়ে এই এলো বলে।
পুনম শান্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
—–মা আমি বসে থাকিনি সারাদিন।আর এখন রান্না করতে না পারো কাল করবে।তোমাদের জামাইদের যদি এত তোমার হাতের রান্না খেতে মন চেয়েছে তবে তারা কেন কিনে আনে নি?
পুনমের বড় বোন রুমা এতক্ষণ তার বড় মেয়ে ইষ্টিকে খাবার খাওয়াচ্ছিলো টেবিলে বসে। এবার সে ফোঁস করে বলে উঠলো,
—–তোর কথার একি ছিরি পুনু। তারা জামাই মানুষ তারা শবে বরাতের দিনে বাজার আনলে বাবা ছোট হয়ে যাবে না।বল?তারা ভাববে না যে বাবার জামাই আদর করার মত সামর্থ নেই।
——শোন বড় আপা, মানুষ এত তুচ্ছ বিষয়ে ছোট হয়ে যায় না।আর আমার বাবা তো নয়ই।তারা আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা জেনেও যখন নির্লজ্জের মত বলতে পারে তবে কিনে কেন আনতে পারবে না?
——মা তোমার মেয়েকে বলে দাও আমরা রোজ রোজ আসি না। যে এত কথা শুনবো।তোমার বড় জামাই কিনা পুনমকে এত ভালোবাসে আর ও এভাবে বললো তাকে।
—-শোন বড় আপা, এইসব ভালোবাসার ধার পুনম ধারে না। আপা তোরা বড়লোক, তোর জামাই ব্যবসায়ী তাকে বলে দিস মাঝে মাঝে জামাই বাজার করলে আমরা তাতে ছোট হবো না বরং দুলাভাইয়ের আত্মা দেখে খুশিতে গদগদ হবো।
মুচকি হাসি দিয়ে বললো পুনম……।
পুনমের কথা শুনে ইষ্টি ফিক করে হেসে দেয়। মেয়ের হাসি দেখে রুমা চপাং করে চড় বসিয়ে দেয় মেয়েকে।মায়ের চর খেয়ে ইষ্টি আরো হাসতে থাকে….যেন তাকে চড় নয় আদর দেয়া হয়েছে।
পুনম ইষ্টিকে নিয়ে নিজের রুমে যেতে নিয়েও আবার থেমে পিছনে ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
——মা আমার ভাই বেঁচে নেই তার জন্য তোমার দুলাভাইদের প্রতি দূর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। তাই বলে নিজের ছেলে আর পরের ছেলের তফাৎ দেখবেনা।তোমার বোকামির কারণে বাবা কতটা কষ্ট পায় জানো? শোন মা জামাই জামাই হয়। আলালের ঘরের দুলাল দিয়ে তৈরী হয় দুলাভাই, যাদের এক সেকেন্ডের ভরসা নাই!
খালামণির কথা শুনে ইষ্টি আবার হাসতে থাকে……..
পুনম নিজের রুমে গিয়ে দেখে তার বিছানার উপর গোসলের জন্য কাপড়, তোয়ালে রাখা।বেট সাইড টেবিলে লেবুর শরবত রাখা।সারাদিনের এত কষ্টের পর এতটুকু যত্ন দেখে পুনমের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সেজো আপা তাকে কেন এত বুঝে? একসাথে মায়ের গর্ভে এক নাড়ীর বন্ধনে ছিল বলে, নাকি পুনমকে একটু বেশিই ভালোবাসে বলে?
আধা ঘন্টা পর পুনম যখন বাবার সাথে দেখা করতে গেল তখনও বাবাকে নামাজ পড়তে দেখে পুনম রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে তার মা পরম আনন্দে রাত সাড়ে দশটার সময় রান্না করছে।তার মা এমন একজন মানুষ যার গোটা জীবনটা কেটে গেলো রান্নাঘর আর নিজের এই পাঁচ রুমের ঘর দেখে।বাহিরের জগৎ তার কাছে অচেনা! এই বোকাসোকা মানুষটার জন্য পুনমের বড্ড মায়া হয়!
পুনম নিজের রুমে ফিরে এসে দেখে তার মেজো আপা ঝুমা বসে আছে তার খাটে।
—–আপা তুমি এখানে।দুলাভাই কই? কিছু বলবে?
ঝুমা মিষ্টি হেসে বলে ওঠে,
—–বুঝেছিস পুনম তোর দুলাভাইটা হচ্ছে একটা বিড়াল,বিড়াল যেমন সারাদিন ম্যাও ম্যাও করে। আর তোর দুলাভাই করে বউ বউ!তাকে ছেড়ে একমুহুর্ত কোথাও যেতে পারি না।
——আপা এটা তো আরো ভালো,দুলাভাই তোমায় চোখে হারায়।
—–আরে সে তো একটা পাগল,আজ কি বলেছে জানিস?
আমাকে নাকি কমলা রঙের শাড়িতে তার দেখতে ইচ্ছা করছে।বলতো এখন কমলা রঙের শাড়ি আমি কই পাবো?
তবে বলেছে আবার নতুন চাকরি হলে সবার আগে কমলা রঙের শাড়ি কিনে দিবে।
—-আপা আমি তোমায় কমলা রঙের শাড়ি কিনে দিবো, তুমি পড়ে দুলাভাইকে চমকে দিবে ঠিকাছে,আগে বলবে না কিন্তু।।
—-সত্যি তুই কিনে দিবি?আমি তো এখনই দেখতে পাচ্ছি তোর গাধা দুলাভাই আমার দিকে ড্যাব ড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে,আর আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। হ্যা রে পুনম বাজারে কি লতি ওঠে? আমার না লতি চিংড়ী খেতে মন চাচ্ছে।
—–আপা আমি কাল দেখবো।
পুনম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে তার মেজো আপার খুশি, এই মেয়েটার দিনের প্রথম কথা শুরু হয় তার স্বামীর নামে আর দিনের শেষ কথাও হয় তার স্বামীকে দিয়ে।
—-পুনু সোনা বলনা আমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে? তবে তোর দুলাভাই বলেছে আমাদের বংশে যেহুতো মেয়ের ধারা বেশি আমারও নাকি মেয়ে হবে। তোর কি মনে হয়?বড় আপারও তো দুই মেয়ে।
—–আপা তোমার তিনমাস চলছে এখনই এসব কথা কেন?
—–আমার কি মনে হয় জানিস? আমার রাজপুত্র হবে।
—–আপা আমি এখন ঘুমাবো,তুমি গিয়ে দুলাভাইকে হাঁসের গোসত আর রুটি পিঠা খাওয়াও।
ঝুমা ছুটে বেড়িয়ে গেলো। যেনো কত বড় কাজ সে ফেলে এসেছে।
পুনম ঘুমানোর আগে লাবণ্যর সাথে দেখা করতে গেলো বাসায় আসার পর থেকে তার ছোট বোনের একবারও দেখা পেল না।
লাবণ্য ইষ্টির ছোট বোন মিষ্টির মেকাপ করছে এত রাতে। পুনম দরজায় নক করলো। ভিতর থেকে লাবণ্য বলে উঠলো, নয়াপু এখন ডিস্টার্ব করবে না তো আমি একটা মেকাপের ট্রায়াল দিচ্ছি। ভিষণ বিজি আমি তুমি পরে আসো। পুনম বেড়িয়ে গেলো।এখন হাজার বলেও লাবণ্যের মনোযোগ অন্য কোথাও সরাতে পারবে না, তার থেকে ঘুমানোই উত্তম।
***************———
নামাজ শেষে নিয়াজ উদ্দিন যখন পুনমের সাথে দেখা করতে এলো তখন পুনম ঘুমে বিভোর।নিয়াজ সাহেবের কষ্ট হয় তার এতটুকুন মেয়ে কত কষ্ট করে বাবার কষ্ট কমাবার জন্য! পুনম বাসায় ফিরে কখনোই বাবার সাথে আগে দেখা করে না।কারণ পুনম জানে বাবা তার ক্লান্ত মুখ দেখতে পারে না। তাই ফ্রেস হয়ে দেখা করতে যায়।
নিয়াজ সাহেব যখনই পুনমকে দেখে তখন তার মনে হয় আল্লাহ ভুলে তার ঘরে এমন রূপবতী আর গুনবতী একটা মেয়ে দিয়েছে। তার পাঁচ মেয়ের মধ্যে পুনম সব কিছুতে সেরা যেমন রুপ,তেমন পড়াশোনা, বিবেক বুদ্ধি,বাস্তব জ্ঞান। কি নেই তার পুনমের মধ্যে, কোন খুঁত সে পায় না। এই যে এবার মাস্টার্সে পড়ছে অন্যদিকে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সকালে বের হয় বাসা থেকে তারপর নিজের ক্লাস করে দুটো টিউশনি করায় এরপর শিক্ষার আলো কোচিং সেন্টারে কোচিং ক্লাস করিয়ে আরো দুটি টিউশন করিয়ে বাসায় আসে। এত পরিশ্রমের পরও পুনমের বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল মুখে হাসি থাকে সবসময়।
তার প্রথম সন্তান ছিলো একটা ছেলে।তারপরে রুমার জন্ম হয়। এ্যাকসিডেন্টে ছেলেটা মারা যাওয়ার পর সবাই ভেঙে পড়েছিল।এরপর জন্ম হয় আর একটি মেয়ের। রুমার সাথে নাম মিলিয়ে তার নাম রাখেন ঝুমা। ছেলের আশায় পরবর্তী সন্তান নিলেও আবার মেয়ে হয়।তবে জমজ কন্যা সন্তান। এক ঘন্টা আগে জন্মগ্রহণ করে পাবনী,এরপর পুনম।পাবনীর জন্ম থেকেই এক পায়ে সমস্যা। সে খুড়িয়ে হাটে। জমজ হলে কি হবে তাদের না আছে চেহারায় মিল না আছে স্বভাবে।এরপর তার ছোট মেয়ে লাবন্যর জন্ম হয়।
তার পাঁচ মেয়ে পাঁচ রকমের, কারো স্বভাবের সাথে কারো মিল নেই।তার বড় মেয়ে হিংসুটে ধরনের।যাকে বলে স্বার্থপর। বড় পরিবারের বউ হয়ে তো আর কাউকে গোনায়ই ধরে না।তবে তার নাতি দুটো অমায়িক।একজনের বয়স ১০ বছর,আর একজনের ৮ । তার মেজো মেয়ে তার মায়ের মত বোকা আর সরল স্বভাবের।যার পৃথিবীতে একটা কাজই হলো স্বামীকে নিয়ে কথা বলা,স্বামীর প্রাধান্য যার জীবনে অধিক। আর তার সেজো মেয়ে বড় গম্ভীর স্বভাবের।তাকে নিয়াজ সাহেব ঠিক বুঝে না।এই মেয়ের কোন কিছুর প্রতি আগ্রহ সে দেখে না। তিনি এড়িয়ে চলেন পাবনীকে সবসময়। আর তার পুনম বড় শক্ত মেয়ে, যে আবেগের থেকে বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেয় বেশি। পুনম নামের অর্থ পূর্ণিমার রাত।তার পুনম তার ঘরের পূর্ণিমার আলো। কিন্তু পেলব, মিঠে আলো নয়।চোখ ঝলসানো আলো। আর তার ছোট কন্যা লাবণ্য। যে একনম্বরের দুষ্টু আর পড়াশোনায় ফেল্টুস মার্কা স্টুডেন্ট।
নিযাজ উদ্দিন বাটিতে করে নিয়ে আসা বাটা মেহেদী ঘুমন্ত পুনমের হাতে আস্তে আস্তে দিতে থাকেন।ছোট বেলায় মেয়েটা শবে বরাতে সব সময় গাছের মেহেদী বেটে হাতে দিত। নিয়াজ সাহেব এক হাত দেওয়ার পর যখন অন্য হাতে দিতে যাবে তখন পাবনী এসে পুনমের মেহেদী ভরা হাত ধরে আর তার বাবা পুনমের অন্য হাতে মেহেদী লাগাতে থাকে। পাবনী কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে,
—–বাবা মা তোমায় খেতে ডাকে, ভাইয়ারা খেতে বসেছে।
—-তোমার বোকা মা তাদের খাওয়াক,আমি খাবো না। আমার মেয়েটা না খেয়ে ঘুমিয়েছে আর তারা হল্লা শুরু করেছে,হুহ্! পাবনী তুমি খেতে যাও।
—–বাবা আমি খাবো না,এখন আমি কিছুতেই খাবো না, আমি এখন ঘুমাবো।
পাবনী চট করে শুয়ে পড়ে।
মেহেদী দেয়ার পর নিয়াজ সাহেব পুনমের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন,কিছুক্ষণ পর যখন তিনি দেখেন পাবনী ঘুমিয়ে পড়েছে তিনি তখন পাবনীর হাতেও পরম যত্নে মেহেদী লাগাতে শুরু করেন।
আজ রাতে সে শুধু তার এই দুই মেয়ের হাতে মেহেদী লাগানোর কাজে নিয়োজিত এক আনন্দিত বাবা!নিযাজ উদ্দিন বুঝতে পারে আজ তার ঘুমটা খুব ভালো হবে!
চলবে…..
জানি না কেমন হয়েছে,সবাই ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।