#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৭
শান্ত প্রকৃতি যখন অশান্ত হয় তখন পৃথিবীর নিজস্বতা এলোমেলো হয় যায়।তেমনি স্বভাবে শান্ত মানুষগুলো যখন রেগে যায় সে রাগ বড় ভয়ংকর হয়।বড় ভয়ংকর!
তানভীর রেগে আছে…এ রাগের সূত্রপাত কোথায় আর শেষ কোথায় তা পুনম জানে না। বর্তমানে পুনম বন্দী তানভীরের দুই হাতের মাঝে…. কি রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে মানুষটা! পুনমের হাঁসফাঁস লাগে!দৃষ্টি এলো মেলো হয়ে আসে ! পুনমের জিজ্ঞেস করতে মনে চায় কিসের এত রাগ আপনার?কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয় না। উদ্ভ্রান্ত কঠোর দৃষ্টিতে পুনম নিজেকে হারিয়ে ফেলে!
কিছুক্ষণ আগে আড্ডার মাঝখান থেকে হঠাৎই তানভীর উঠে যায়।আড্ডা শেষে পুনম দেখতে পায় তানভীর ফোন ফেলে গেছে।রাজুকেও দেখতে পায়না আশেপাশে। বল্টু রিমিকে নিয়ে ব্যস্ত..তাই পুনম নিজেই মোবাইল ফেরত দিতে আসে।আর সেই আসাই পুনমের কাল হয়।
ডোর নক করার পর তানভীর যখন দেখে পুনম দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে…তানভীরের হুট করেই অশান্ত মেজাজ আরো অশান্ত হয়!এই মেয়েটা ওকে কি পেয়েছে?
এই যে দিনরাত সব কিছু ছেড়ে মেয়েটার পিছনে পড়ে থাকে তাতেও বিন্দুমাত্র কোন ভ্রুক্ষেপ নেই!এতই ঠুনকো ও পুনম নামের মেয়েটির কাছে?এতই সস্তা ওর অনুভূতি? আজকে এর হিসাব চাই তানভীরের…. তানভীরের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে আছে…যেন এখনই আগুনের ফুলকি বের হবে….
তানভীর দরজায় দুই হাত মেলে কটমট করে জিজ্ঞেস করে,
—-কি চাই?
—আপনার মোবাইল….
—তো…
—মি.তানভীর আপনি মোবাইল ফেলে এসেছিলেন…
—আমি,আমার মোবাইল জাহান্নামে যাক….তাতে তোমার কি?
পুনম কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে…ওর মাথার উপর দিয়ে যায় তানভীরের কথা…
পুনম চুপচাপ মোবাইল এগিয়ে দিতে গেলে হটাৎই হ্যাচকা টানে তানভীর পুনমকে রুমের ভিতর নিয়ে যায়।পুনম তখন অবাকের উচ্চপর্য়ায়ে….মুখ ফুটে কিছু বলতে নিলেই তানভীর চিৎকার করে ওঠে…কি চাই?হ্যা কি চাই? জ্বলে পুড়ে শেষ করে তবে তুমি শান্তি পাবে পুনমি…..
পুনমকে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ফেলে তানভীর। পুনম ব্যথা পায়..চোখমুখ বুজে ব্যথা সহ্য করে।এতক্ষনে পুনম বুঝে গেছে তানভীর স্বাভাবিক নেই…. যে তানভীর ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে বড় অস্থির, এলোমেলো! পুনম নিজেকে শান্ত করে… চোখ মেলে তাকাতেই দেখে তানভীর ওর খুব কাছে…দেয়ালের দুপাশে হাত রেখে ওকেই দেখছে….মানুষটা শরীর দিয়ে চেপে ধরেছে ওকে…পুনম সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তানভীরের দিকে….কি অবস্থা মানুষটার….শান্ত চোখদুটো রক্তবর্ণ…রাগে কপালের দুপাশের রগ ফুলে উঠেছে..ঠোঁটের ভাজে রুক্ষতা!কালো শার্টটা বুকের কাছ থেকে দুটো বোতাম খুলা…কি অসহ্য দৃশ্য! পুনম চোখ ফিরিয়ে নেয়…..
পুনমের চোখ ফিরিয়ে নেয়া যেন তানভীরকে আরো কষ্ট দেয়… বুকের কাছটায় অসংখ্য পোকা খামচে ধরে…কন্ঠমণি রোধ হয়ে আসে..তানভীরের নিজেকে পাগল পাগল লাগে….পুনম নামের মেয়েটি কি জানে? তার গভীর চোখ, ঠোঁট চেপে হাসা,নাক ফুলিয়ে রাগ করা,কপাল কুঁচকে রাখা,দুই ভ্রুর মাঝখানের ওই কুচকুচে কালো তিল, ছিপছিপে গড়নে কঠোর পা ফেলে চলা…সব.. সব কিছু তানভীরকে মুগ্ধ করে! জানে না… কিচ্ছু জানে না!নিষ্ঠুর হৃদয়ের অধিকারীণির কাছে ও হৃদয় সমার্পণ করেছে…. এই মেয়েটিকে দেখলে বুকের জমিনে ঝুপঝপিয়ে পাথর পড়ে…অসহ্য ব্যথায় জর্জড়িত হয় বুকের কাছটা!
তানভীর ভেবে ছিলো কটাদিন পুনমের সাথে কথা না বললে হয়তো দুরত্ব থেকে বুঝবে তানভীরের অনুভুতি। না কিন্তু হয় নি।সবসময়ের মত পুনম স্বাভাবিক…. যেন তানভীরের থাকা না থাকায় কিচ্ছু যায় আসে না…এক্সিডেন্টের খবরটা পর্যন্ত দেয় নি। মেয়েটার এক্সিডেন্টের খবর যে কারো কাছে মৃত্যুসম তা কি করে বুঝবে নিষ্টুর মেয়েটা….
পুনম ধাক্কা দিয়ে তানভীরকে সরিয়ে দিতে চায় কিন্তু সফল হয় না….রাগ নিয়ে আরো চেপে ধরে দেয়ালের সাথে… তানভীর না ছাড়লে এখান থেকে পুনম নড়তে পারবেনা…চিৎকার চেচামেচি করলে আরো হিতে বিপরীত হবে…পুনম ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে…শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—-কি চাই আপনার?
তানভীর একটু ঝুকে আস্তে করে নিজের কপাল ছোঁয়ায় পুনমের কপলে…পুনম চমকে ওঠে… সে কি? মি.তানভীরের তো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে… কি গরম!
পুনম কিছু বলতে নেয়…. তানভীর পুনমের ঠোঁট আঙুল দিয়ে চেপে ধরে,কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
—তোমাকে চাই পুনমি! তোমাকে চাই….. দিনশেষে এই হেরে যাওয়া আমি তোমাকে জয় করতে চাই!
পরক্ষণেই পুনমের মাথাটা বুকের বা পাশে চেপে ধরে তানভীর…
—এই পুনমি শুনতে পাচ্ছো…কানপেতে শুনো.. বুকের ভিতর ঝড় উঠেছে…পথহারা অনুভুতির দল আজ তোমার নীড়ে ফিরতে চাইছে….তুমি শুনছো তো পুনমি…..আমার বুকের ভিতর তুমি নামের ধুকপুকানি!
পুনমের সহ্য হয় না…এত অসহায় কন্ঠে কথা কেন বলছে মানুষটা…. শক্ত খোলসে আবরিত পুনম হু হু করে কেঁদে ওঠে।তানভীরের বুকের কাছে শার্টটা খামছে ধরে….
তানভীর পুনমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়….
—বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন?এতটুকুতেই তুুমি কাঁদছো পুনমি….আর এই আমি বেঁচে থেকেও যে রোজ মরে যাচ্ছি… তারবেলা?
পুনম চুপটি করে সরে যায়… তানভীরের আবার রাগ ওঠে..পুনমের হাত শক্ত করে চেপে ধরে… পুনম হেরে যাওয়া কন্ঠে বলে,
—আপনার জ্বর এসেছে মি.তানভীর… ভীষণ জ্বরে আপনি ভুলভাল বকছেন…
তানভীরের চোখের মণি ক্রোধে ধ্বক করে ওঠে… কি সাহস পুনমের….ওর অনুভুতিকে জ্বর ফর বলে অবহেলা করছে….
পুনমের হাতছেড়ে দেয় তানভীর…
—-আপনার এখন ঔষধের প্রয়োজন।
—আমার তোমায় প্রয়োজন পুনমি!
—আপনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন মি.তানভীর।
—আমি তোমায় খুন করবো নিষ্ঠুর মেয়ে!
তাই করুন… বিড়বিড় করে বলে পুনম। পুনম ধীরপায়ে চলে যায় দরজার কাছে…তানভীরের মেজাজ চুড়ান্ত রকমের খারাপ হয়…জ্বরঘোড়ে তানভীর যেন পাগল হয়ে গিয়েছে… বাজপাখির মত ক্ষীপ্র ভাবে টেনে আনে পুনমকে নিজের কাছে…মুহুর্তেই দুই হাতে তালুবন্দি করে পুনমের সুন্দর মুখটি…তানভীরের চোখ ছলছল করে… ঐ চোখ যেন কতকিছু বলতে চায় পুনমকে! পুনম অসহায় কন্ঠে বলে,
—আমাকে ছাড়ুন মি.তানভীর। ছাড়ুন বলছি..
তানভীরের কর্ণকুহুরে সে কথা পৌছায় না…সে আজ প্রেয়সীর অবহেলায় উন্মাদ প্রেমিক…যে কিছুর মুল্যে আজ তার প্রেয়সীকে চাই…!
সবসময় থাকা শক্ত মেয়েটা তানভীরের এই আচরণে ভয় পেয়ে যায়…বেসামাল প্রেমীপুরুষকে কি করে সামলাতে হয় সে শিক্ষায় সে অনভিজ্ঞ? তাই পরাস্ত সৈনীর মত হু হু করে কেঁদে ওঠে…!
তানভীরের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠে…কি সুন্দর তার পুনমির কান্নামাখা মুখশ্রী! ভেজা চোখ, লাল নাক,ভেজা ঠোঁট মুহুর্তেই তানভীরকে পাগল করে দেয়…
দুই হাতে তালুবন্দি রাখা মুখটির সবচেয়ে নিখুঁত অধরে পূর্ণচুম্বন করে তানভীর! নিজের অধর দিয়ে যেন পিষে ফেলতে চায় প্রেয়সীর অধর!শুষে নিতে চায় পুরো পুনমকে…তার পুনমিকে!
পুনম বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।কি হচ্ছে তা বুঝতে সময় লেগে যায়।যখন বুঝতে পারে বাঘিনীর মত ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে পুনম।সোচ্চার হয় পুরো মস্তিষ্ক…. ছিটকে সরে আসতে নেয়… বাঁধা পেয়ে তানভীর যেন আরো ক্ষেপে যায়…আষ্টেপৃষ্ঠে শক্ত করে জরিয়ে ধরে পুনমকে….
প্রথমে ঠোঁটে তারপর নাকে গালে চোখে কপালে সবখানে চুম্বনে সিক্ত করে… আস্তে আস্তে নেমে আসে পৌরুষালী ঠোঁট পুনমের কন্ঠমণিতে…পুনম বাঁধা দেয়…তাতে কিছু যায় আসে না তানভীরের….অবহেলায় সিক্ত তানভীর যেন আজ তার সব রাগ এভাবেই মেটাতে চায়….
শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে পুনম ধাক্কা মারে তানভীরকে…তানভীর কিছুটা দূরে সরে যায়…পুনমের চোখে তখন অবিশ্বাস…সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে অচেনা লাগে…প্রচন্ড রাগে তানভীরের বুকে ধাক্কা মারে…শার্টের কর্লার দু হাতে খামচে ধরে….বুকে বসিয়ে দেয় অজস্র থাপ্পড়!
চোখে জল আর ধরে আসা কন্ঠে বলে,
—-কেন করলেন আপনি এমনটা?কেন করলেন?
তানভীর হাসে…সে হাসি দেখতে বড় রুক্ষ!ঠোঁটের ভাজে কঠোরতা আর চোখে চিকচিক করা জল নিয়ে বলে,
—তবে কে করলে খুশি হতে পুনমি?ঐ সাকিব নামের স্কাউন্ড্রালটা….
—-আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন…. স্রেফ বদ্ধ উন্মাদ…ও আমার বন্ধু…
তানভীর রাগে হিসহিসিয়ে বলে,
—-কে বন্ধু তা আমি তোমার কাছ থেকে জানবো না।কই বল্টু নাহিদ শিমুল এরা কেন তোমার দিকে ঐভাবে তাকায় না..
—-সব আপনার মনের নোংরা জেলাসি মি.তানভীর!
—-কোনটা জেলাসি? তোমাকে জরিয়ে ধরা নাকি তোমার কাছে বসে তোমার শরীর থেকে ঘ্রাণ নেওয়া? নাকি যখন তুমি বিচের পানিতে গোসল করো তখন তোমার ভিজা শরীরের লুকিয়ে ছবি তোলা?
—ছিঃ!
তানভীর এগিয়ে এসে পুনমকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে,
—একমদ ছিঃ! করবেনা..তখন কেন ছিঃ! বলনি?
পুনম চোখ বন্ধ করে ফেলে, দুচোখের বন্ধ পাতার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা অশ্রু….পুনম বিচের পাথরের উপর থেকে পড়ে যেতে নিলে সাকিব ধরে ফেলে…তখন জরিয়ে ধরে…হ্যা তবে সাকিবের চাহনি পুনমের প্রতি অন্যরকম। তবে সাকিব পুনমের সামনে কখনো বাজে আচরণ করেনি..সবমসময় পুনমের কাছাকাছি থেকে পুনমকে সাকিব বুঝাতে চায় তার ফিলিংস….পুনম জাষ্ট ইগনোর করতো…ট্যুরে এসে সাকিব আঠার মত লেগেছিল পুনমের পিছে…পুনম কিছুই বলেনি কেননা সে ট্যুরে কোন ঝামেলা চায় নি…এখন সেটাই কাল হয়েছে!
—আমার কাছে এই মুহুর্তে আপনি আর সাকিব একই!…বলে পুনম তানভীর কে সরিয়ে ছুটে চলে যেতে নেয়….তানভীর পুনমকে আটকাতে নেয়…কিন্তু ভুলবশত তানভীরের হাতে পুনমের জামার পিছনে গলার কাছে টান লাগে….পিছন গলার কাছ থেকে অনেকক্ষানি ছিড়ে যায়।তানভীর নিজেও হতভম্ব চোখে তাকায় আর পুনম অবিশ্বাসের চোখে….পুনমের মাথা ফাঁকা হয়ে যায়… পুনম ঝট করে পিছনে ফিরে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় তানভীরের গালে!
জ্বরগোরস্থ তানভীর ভেঙে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকায় আর পুনম কঠোর চাহনিতে কতক্ষণ তানভীরের চোখে তাকিয়ে থাকে…. তানভীর স্পষ্ট পড়তে পারে…পুনমের চোখ যেন বলছে, আপনি একদম আপনার বাবার মত
তানভীর! একদম!
তানভীর এলোমেলো ভাবে মাথা নাড়ায়….পুনম তার কাছে কি? একথা ও বলবে কার কাছে?পুনমের অপমান জেনে-বুঝে তানভীরের দ্বারা অসম্ভব!
জবাব দেয়ার আগেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে পুনম…আর পিছনে ফেলে যায় হতবিহ্বল এক পাগল প্রেমিককে!
প্রচন্ড রাগে যখন হোটেল কক্ষের জিনিস ভাঙচুর করছে তানভীর তখন পুনম ওয়াশরুমের দরজা আটকে কান্নায় ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে……
চলবে,
আজ শুধুই তানভীর আর পুনম💁♀️💁♀️💁♀️