পুনম পর্বঃ৩৭

0
1119

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৭

সুমন সেই সকাল থেকে রেজিস্ট্রি অফিসে বসে আছে।মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ বের হলো।চরম হতাশ সুমন।দলিল পত্রের ঝামেলা যে এতটা বিরক্তিকর তা সুমন জানতো না।কখনো দাগ মিলে তো খতিয়ান মিলে না। খতিয়ান মিলে তো রেকর্ড জনিত সমস্যা! এত এত সমস্য। অথচ সমাধান নেই! সুমন চেয়ার থেকে উঠে সামনের টেবিলে বসা মুহুরীকে জিজ্ঞেস করে,
“ভাই আর কতক্ষন? ”
মুহুরী সুমনের থেকেও চরম বিরক্তি নিয়ে বলে, ” আরে মিয়া ত্যক্ত কইরেন না তো।চুপচাপ বসেন।নাম আসলেই ডাক দিবো।”

সুমন আবার বসে পড়ে।হাতের ফাইলে আঙুল দিয়ে গটগট শব্দ করে! রাশেদ ভাই বলেছে এই নথিটা পেলে কাজ অনেকটা আগাবে। তাই এই বিরতিহীন অপেক্ষা!
যদি তাড়াতাড়ি কিছুর ব্যবস্থা হতো তবে পুনমের জন্য কিছু হলেও করতে পারতো।এই শূন্য হাতে কি করে সামনে দাঁড়াবে?পুনমের জন্য তার খুবই কষ্ট হয়!

*********

লাবণ্য মাথা নিচু করে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। তারুণ অনেক চেষ্টার পরও কান্না থামাতে পারলো না।তাই এখন সামনে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে। মেয়েটা একটুও সাজেনি।চুলগুলো এলোমেলো করে বেণী করা।গোলাপি একটা উলের চাদর শরীরে পেঁচানো।শ্যামলা মুখটা যেন কান্নার কারণে আরো মায়াবতচী লাগছে!কে বলে শুধু ফর্সা মানেই সুন্দর? সুন্দরের উপমা কি তারা জানেই না।এই যে তার সামনে দাঁড়ানো শ্যামবতীর কাছে সকল ফর্সা সুন্দরী হার মানবে!

” লাবণ্য এখন যদি কান্না না থামাস আমি কিন্তু চলে যাবো।”…..বিরক্তি নিয়ে বলে তারুণ।

লাবণ্য তারপরও কেঁদে যাচ্ছে। তাই তারুণ উল্টো হাঁটা ধরে।লাবণ্য তখন চোখ মুছে দৌড়ে গিয়ে তারুণের সামনে দাঁড়ায়। লাবণ্য ভেজা কন্ঠে বলে, ” চারপাশে এত কষ্ট কেন তারুণ?আমার দমবন্ধ লাগে!”

“সব ঠিক হয়ে যাবে লাবণ্য! ধৈর্য্য ধর।সব সামলে উঠবি দেখিস।সব ঝড়ই একসময় থেমে যায়!”

” কি করে সামলে উঠবো?আমার বাসার আনাচে কানাচে শুধু কষ্ট।এখন তুইও চলে যাচ্ছিস।কি করে সামলাবো আমি বলতো?”……কাঁদোস্বরে বলে লাবণ্য!

“চোখের আড়াল হচ্ছি লাবণ্য।তোর মনের আড়াল তো হচ্ছি না।আমি সবসময় তোর পাশে আছি।”….. বলে তারুণ লাবণ্যের হাত জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে।

************

পাবনী থম মেরে বসে আছে হসপিটালের করিডোরে। পুনম ডাক্তারের সাথে কথা বলছে তার কেবিনে।পাবনীর গলা বারবার শুকিয়ে আসছে।মায়ের অবস্থা শোচনীয়! সকাল থেকে একবারও পস্রাব হচ্ছে না।পেট ফুলে আছে।হসপিটালে কতগুলো বিল হয়েছে।সেই বিল দুই শতাংশ শোধ না করলে পরবর্তী চিকিৎসা তারা শুরু করতে পারছে না।মা ব্যথায় ছটফট করছে।এ দৃশ্য চোখে দেখার মত নয়। পুনম বের হলো দশ মিনিট পর। চুপচাপ বসলো পাবনীর পাশে।
সেজ আপাকে অনবরত ঘামতে দেখে পুনম বললো, ” কি হলো আপা এত ঘামছিস কেন?”

” পুনম রে মায়ের কি হবে বলতো? আমার ভীষণ অস্থির লাগছে।মা কি বিনে চিকিৎসায় মরে যাবে?”……অস্থির কন্ঠে বলে পাবনী।

“কি সব কথা বলছো সেজ আপা। এত চিন্তা করো না।ডক্টর গেছে। আবার চিকিৎসা শুরু হয়েছে।”

“টাকা কোথায় পেলি পুনম?….ব্যগ্রস্বরে জানতে চায় পাবনী।

” সেজ আপা কিছু গহনা ছিল মনে আছে ।সেগুলো বিক্রি করে দিলাম।মা যদি না থাকে তবে তা দিয়ে কি হবে? আগামী একসপ্তাহর জন্য আর কোন চিন্তা নেই।”….বলে পুনম সেজ আপার হাত শক্ত করে ধরে।

“আমি এতটা অর্কমা কেন হলাম বলতো পুনম?তুই একা কতকিছু করছিস অথচ আমি তোকে একটু সাহায্যও করতে পারছিনা।এই পরিবার টা কি একা তোর? আমরা শুধু তোর কাঁধে বোঝা হয়ে রইলাম”

পুনম সেজ আপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে।তারপর বলে, “আপা তোর ভালোবাসার ক্ষমতা অপরিসীম! সবাই ভালোবেসে আগলে রাখতে পারে না আপা।তুই পারছিস।আপা তুই আমার মানসিক শক্তি। তাই এতটা দূর্বল হোস না যে আমায় ভেঙে পড়তে হয়!”

পুনম সেজ আপাকে রেখে উঠে পড়ে।একটা টিউশনি করিয়ে রাশেদ ভাইয়ের কাছে যাবে পুনম।সামনে প্রতিটা পদক্ষেপ ওকে ভেবেচিন্তে রাখতে হবে।পুনম হারতে শিখেনি।ও হার মানলে বাকি ছয়টি মানুষও হেরে যাবে!

**********

তানভীর আর তারুণ বসে আছে তারিনের বসার ঘরে।তারুণ অনেকটা অবাক চোখে নিজের বোনকে দেখছে।আসার পর থেকেই দেখছে বুবু কাঁদছে আবার কতক্ষন হাসছে।হাসি আর কান্না দুটোই একসাথে। কোনটাই সামলাতে পারছে না।তারুণকে দেখার পরই জড়িয়ে ধরে দুগালে কপালে চুমু দিয়েছে। তারুণের মনে হলো এতদিন সে ভুল করছে।বুবু নামক মানুষটার থেকে দূরে থেকে।তানভীর বলে উঠলো, “বুবু ভাত খাবো।কি রেঁধেছো?”

তারিন চটপট করে চোখের জল মুছলো।তারপর বললো, “দেখ কি কান্ড। তোর পছন্দের বেগুন দিয়ে শুটকি রেঁধেছি। কিন্তু তারুণ তো খাবে না।কি করি?মুরগী রেধেছি খাবি ভাই?”
তারিনকে খুবই দুঃখী মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। ভাইদের কি দিয়ে খাওয়াবে তাই নিয়ে চিন্তিত সে।

“নিয়ে আসো বুবু।আজ তুমি আমাদের দুই ভাইকে খাইয়ে দিবে ছোটবেলার মত।”

তারিন হন্তদন্ত হয়ে কিচেনে গেলো। খাবার মেখে তারুণ আর তানভীর কে খাইয়ে দিলো।খাওয়ানোর সময় তারিন একপশলা কাঁদলো।শেষমেষ তারুণ বলে উঠলো, “বুবু তুমি খুব ছিঁচকাদুনে!”
তারিন হেসে দিয়ে হাত ধুয়ে দুই ভাইয়ের ঠোঁট মুছিয়ে দিলো পরম যত্নে । তারুণের মনে হলো,বুবুর আদর কেমন যেন মা মা আদর।

********
হায়দার হোসেন একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত এই খেলায় জিত তার হবে।টাকার কাছে সবকিছু নস্যি! সে চেয়েছিল পুনমের পরিবারকে আর্থিক ভাবে দূর্বল করতে সাথে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে পুনমের মায়ের রোগ তাকে আরো আশাবাদী করলো।এবার তানভীর পুনমের জন্য হলেও তার কথা মানবে।সে নিশ্চিত মনে তার এসিস্ট্যান্টকে ফোন করে বললো, “ওদিকের খবর কি বলো?”

এসিস্ট্যান্টের কাছে সকল আপডেট নিয়ে সন্তুষ্ট মনে সে ওয়াইনের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালো।

************

পুনম একটা কালো বোরখা পড়েছে।নাক মুখ সকল কিছু সুন্দর করে আটকানো। তার পরিচিত মানুষও পুনমকে চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ।পুনম কিছুটা নুয়ে নুয়ে হাঁটছে।মুরুব্বি কিসেমের বোরখার কারণে তাকে পুরো দমে মুরুব্বি মনে হচ্ছে ।চোখে একটা চশমা পড়া।পুনম একটা রিকশা নিয়ে তাতে উঠে বসলো।গন্তব্য তার জানা।শুধু গন্তব্য পর্যন্ত পৌছানো বাকি। পুনম কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছে তাকে একটা লোক ফলো করে তাই এই ব্যবস্থা। সেই লোকটির সামনে দিয়েই পুনম চলে গেলো কিন্তু লোকটি জানতেও পারলো না।

***********

রুমা নিজেকে খুঁটে খুঁটে আয়নায় দেখছে।কি কারণে তাকে হারুন ত্যাগ করলো সে জানতেই পারলো না।একটা সংসার টিকিয়ে রাখতে কি শুধু সৌন্দর্য থাকতে হয়?এই যে এতটা বছর সে মানুষটার সাথে থাকলো একটুও কি মায়া হয় না?রুমা দু হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ওঠে। এত কষ্ট কেন?কিসের শাস্তি সে ভোগ করছে? আর তার মেয়ে দুটো তারাই বা কিসের শাস্তি পাচ্ছে?

***********
তারুণ আর তানভীর বসে আছে তারিনদের বাসার ছাদে। আর একসপ্তাহ পর তারুণ চলে যাবে লন্ডন। আজ তানভীর আবদার করলো তারুণকে নিয়ে কিছু সময় কাটাবে।তাই এই বসা।দু ভাই রেলিংয়ে বসে পা ঝুলিয়ে রেখেছে।দুজনেই চেয়ে আছে আকাশ পানে। বাতাস এসে তানভীর আর তারুণের চুল এলোমেলো করে দিয়ে যায়। তানভীর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাই একটা গল্প শুনবি?”

তারুণ ভাইয়ের দিকে তাকালো। ভাইকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে।চোখমুখ শক্ত অথচ চোখের কোণে বিষন্নতা! ভাইকে দেখে তারুণের অবচেতন মন কেন যেন গল্পটি শুনার ইচ্ছা হলো না।কেন যেন মনে হলো, গল্পটি কোন সাধারণ গল্প নয়!গল্পটি শুনলে এমন কিছু জানা হবে যা না জানাই ভালো।তবু মুখে বললো, “বলো ভাই।”

তানভীর বলতে শুরু করলো মৃদুস্বরে। তানভীরকে দেখে মনে হচ্ছে তার কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here