পূর্ণময়ীর বিসর্জন পর্ব-৩

0
1622

#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_৩

দেখতে দেখতে চোখের পলক ঝপকানোর মতো করেই মূহুর্তে কেটে গেছে ১ সপ্তাহ। প্রথম ৪ দিন কতো শতো বিজ্ঞাপন, প্রচার করা হলো পূর্ণময়ীর নিখোঁজের খবর। কেও এলো না, ফোন করলো না যাকে বিশ্বাস করা যায়। অসৎ অনেক মানুষ অবশ্য পূর্ণময়ীর রুপ দেখে পূর্ণময়ীকে ক্লেইম করেছে। কিন্তু পূর্ণময়ী তাদের দেখে অজানা মানুষদের মতো ব্যবহার করেছে। আর রায়ানও খোঁজ নিয়ে সন্তুষ্ট হয়নি বলে যেতে দেয়নি। পূর্ণময়ীই শেষে একদিন খেলার ছলে জানিয়ে দিলো নিজের ব্যাপারে।

৪র্থ দিন রাতে,

পূর্ণময়ী রায়ানের সাথে ছাদে বসে আছে। রাত বাজে ১ টা। সবাই ঘুম। রায়ান ঘুম আসছে না বলে ছাদে এসে দেখে পূর্ণময়ী বসে আছে। সে এগিয়ে আসতে যাবে। তখনই কানে এলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে গানের সুন্দর স্বর,

– তুমি যাও, পরিচিত কোনো ডাকে
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে
দিবস রজনী তোমাতে সজনী
বাড়িঘর মাখামাখি
ব্যাকুল বাসরে
যে আলো দুঃখ
সে আলোতে আমি থাকি
তুমি যাও, যে শুধু তোমারই থাকে
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।

আকাশে ঘনালে মেঘ,
বাকি পথ হেঁটে এসে
শেষ হয়েও পড়ে থাকে অবশেষে
নিভিয়ে দিয়েছি, ফুরিয়ে গিয়েছি
ডুবিয়েছি কতো ভেলা
প্রেমিক নাবিক জানেনা সাগর
একা রাখা অবহেলা।

তুমি যাও, যে শুধু তোমারই থাকে
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।

গানটা পুরোটা শুনে চমকালো খুব রায়ান। এতো সুন্দর গান গাইতে পারা মেয়েটা কি আসলেই অটিজমে ভুগছে? পূর্ণময়ীর মাঝে কি রহস্যের গন্ধ শুধুই রায়ান পাচ্ছে? রায়ান সিদ্ধান্ত নিলো এক্ষুনি সব জিজ্ঞাসা করবে পূর্ণময়ীকে। সে গিয়ে পা ফেলে পূর্ণময়ীর পাশে বসতেই চমকে উঠলো পূর্ণ। তারপর রায়ানকে দেখেই ধুপ করে রায়ানের কোলে ট্রান্সফার করলো নিজের সিট। রায়ানের গলা ধরে রায়ানের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। রায়ান মৃদু হাসলো হাসবে না চেয়েও। পূর্ণ যে তাকে আস্তে আস্তে নির্ভরশীল করে ফেলেছে কিছু ছোট ছোট কাজে। যেমন প্রতিদিন সকালে রায়ান বের হবার সময় পূর্ণ দাঁড়িয়ে থাকে। পূর্ণ রায়ানের পাঞ্জাবির বোতাম লাগিয়ে দিলে রায়ান যেতে পারে। তারপর রায়ান না থাকলে রায়ানের ঘর গুছায় এলোমেলো হাতে। রায়ান ফিরে এসে আগে পূর্ণকে কোলে নেবে। তারপরই রায়ান উপরে নিজ রুমে যেতে পারবে। পূর্ণকে খাইয়ে দেওয়া, পূর্ণর সাথে বসে আড্ডা দেওয়া এসবই এখন রায়ানের অভ্যেস। রায়ান মুচকি হাসলো।
এরপর পূর্ণর হালকা বাদামী কেশরাশীর মাঝে আঙ্গুল ডুবিয়ে প্রশ্ন করলো,
– পূর্ণময়ী? পরিবার নিয়ে কিছু বলো।

এভাবে কখনোই পরিবার নিয়ে প্রশ্ন করা হয়নি পূর্ণময়ীকে। পূর্ণর মুখে অমাবশ্যার অন্ধকার ছেয়ে গেলো যেন। রায়ান আবারও বললো,
– কে কে আছে পরিবারে?

পূর্ণ মুখ কালো করে রায়ানের বুকে মাথা রেখে বললো,
– বাবা, মা, মামা, মামী। সব পঁচা। বাবা, মা, আমি নতুন বাসা। বাবা, মা আসে না আর। আমি একা ২ দিন। বাবা মা খুঁজি, পঁচা ভাইয়া আসে। পঁচা ভাইয়া, পঁচা কাজ, পঁচা ছোঁয়া। আমি গাড়ি ঘুম।

পূর্ণময়ীর এমন আধো আধো কথাতেই রায়ান বুঝে নিলো সবটা। মেয়েটা নিজের বাবা মা ও মামা মামীর সাথে থাকতো। বাবা মা-ই মেয়েটাকে ফেলে চলে গেছে। দুইদিন একা থেকেও বাবা মাকে না পেয়ে মেয়েটা হারিয়ে ফেলেছে রাস্তা। রায়ানের খুব ঘৃণা হলো মানুষের উপর। মানুষ এর মাঝে মানবতা নেই কেন আজকাল?
পূর্ণ এরপর কোনো খারাপ ছেলের খপ্পরে পড়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য পালাতে গিয়ে গাড়ি এক্সিডেন্ট। রায়ানের হাত মুঠো হয়ে এলো রাগে। পরমূহুর্তেই খিলখিল শব্দে হাত শিথিল হয়ে এলো। মুগ্ধতা নিয়ে পূর্ণময়ীর দিকে তাকাতেই দেখলো নিজের লম্বা চুলের একগাছি রায়ানের ঠোঁটের উপরে গোঁফের মতো ধরেছে। হেসে ফেললো রায়ান নিজেও। পূর্ণময়ী রায়ানের বুকেই শুয়ে পড়লো সে রাতে। ভোর হতেই পূর্ণকে পূর্ণর রুমে দিয়ে রায়ান নিজের রুমে চলে গেলো। কেন যেন রায়ানের পূর্ণময়ীকে মনে হয় না কোনো অটিজম রোগী। যদিও হ্যাঁ এটা ঠিক যে মানসিক ভাবে অটিস্টিক মানুষদের মাঝে প্রায়শই বিভিন্ন অত্যাশ্চর্য গুণ দেখা যায়। কিন্তু রায়ানের মন মানছে না এই মেয়েকে অটিজম ভিক্টিম হিসেবে। রায়ান সিদ্ধান্ত নিলো অতি দ্রুত মেয়েটিকে একটি ভালো ডাক্তার দেখাবে।
.
.

সে রাতের পর আর খোঁজ করা হয় না পূর্ণর বাবা মায়ের বা কারোর। রায়ান নিজেই সবাইকে জানিয়েছে পূর্ণর কথা সবটা। তবে এই একসপ্তাহে হয়ে গেছে অনেক কিছু। কোনো এক কারণে রায়ান বাবার সাথে বসে খাবার খেতেন না। আয়ান সাহেবের সামনে যেতেন না। কিন্তু পূর্ণর জন্যে সে অদৃশ্য অলিখিত নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। খুব বেশি ফ্রি না হলেও আয়ান সাহেবের আর রায়ানের অবস্থা ভালো হয়েছে। পূর্ণ বলতে পাগল রেহানা আর অনুবিকা হোসেন। রায়ানের হাত ছাড়া অবশ্য খাওয়া দাওয়া করানো কষ্টকর হয়ে পড়ে তাদের জন্য৷ আর পূর্ণ রায়ান পাগল। আয়ান সাহেবও পূর্ণকে পেয়ে যেন বাচ্চা হয়ে যায়। সারাদিন পূর্ণর রুটিন হলো শুধুই ঘুম থেকে উঠে রেহানাকে সঙ্গ দেওয়া, রায়ানের হাতে তিন বেলা মেপে খাওয়ার খাওয়া, অনুবিকার সাথে খেলাধুলা, অনুবিকা পড়তে বসলে তার টেবিলে রায়ানের রুম থেকে নেওয়া ইংলিশ উপন্যাসের বই নিয়ে বসে থাকা। যদিও অনুবিকা আর রেহানা ভালোই জানে এই মেয়ে অনুবিকাকে নকল করতেই বসে থাকে। তবে রাতের ঠিক ৮ টায় সে সোফায় পা গুটিয়ে ভদ্রমেয়ে হয়ে বসে থাকে রায়ানের অপেক্ষায়। রায়ান বেল বাজাতেই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে রায়ানকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। এরপরেই রায়ান ঢুকতে পারে। ঘরের সবাই পূর্ণকে নিয়ে অনেক খুশী।
.
.
রাত ৮ টা বাজে। পূর্ণ সোফায় বসে আছে। আজ সকালে রায়ানের বাইরে যাওয়ার পর থেকে সে অস্থির হয়ে আছে। রায়ান গেছে আজ একটা সভায়। পূর্ণর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। রেহানা আর অনুবিকা বিষয়টি দেখে বুঝবার চেষ্টা করলেও কিছু বুঝে আসেনি তাদের সারাদিনে। এদিকে ৮ টা পেরিয়ে বাজলো ১০টা। রেহানা আর অনুবিকা বিষয়টা স্বাভাবিক ভেবে রাখলো। কিন্তু পূর্ণ হঠাৎ কি অজানা কারণে কান্না করে দিলো। পূর্ণর কান্নার কারণ অনেক কষ্টে জানতে পেরেছেন আয়ান সাহেব, রেহানা আর অনুবিকা। কান্নার কারণ তার ভয় লাগছে। কেন ভয় লাগছে জিজ্ঞেস করলেই শুধু রায়ানের নাম নিচ্ছে। সবাই যখন পূর্ণর কান্না থামাতে ব্যস্ত। তখন রেহানার মোবাইল বেজে উঠলো। রেহানা ব্যস্ত হাতে তা রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে যা শুনলো তা শুনে সে মূহুর্তের মাঝে নিজ স্থানে জমে গেলো। অনুবিকা আর আয়ান অনেক করে জিজ্ঞেস করতেই কাঁপা কন্ঠে বললো,
– রায়ান হাসপাতালে।

পূর্ণর কান্নার দমক বাড়লো। রেহানাও যুক্ত হলো সাথে। অনুবিকা নীরবে কাঁদতে কাঁদতে সবাইকে সামাল দিয়ে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। আয়ান সাহেব ভাবতে লাগলেন পূর্ণর কান্না নিয়ে। মেয়েটা কি তাহলে মনে মনে আন্দাজ করে ফেলেছিলো রায়ানের ক্ষতি?
.
.
সবাই হাসপাতালে পৌছাতেই শুনলো রায়ানের অবস্থা এতোটাই ক্রিটিকাল যে ডাক্তাররা অপারেশন করতে ভয় পাচ্ছে। একটা কাঁচ খুব বাজে ভাবে ঠিক এমন স্থানে ঢুকেছে, যেখানে একটা ভুল হলেও ব্রেইনের উপর থাকা পর্দা ছিড়ে যেতে পারে। অনুবিকা নিজেই ছুটাছুটি করছে। তখন পূর্ণ ছুটে গেলো ডাক্তারদের কাছে,
– Can i invite Mr.Henrik? You people must have knowledge about his popularity. Plz approve my decision. ( আমি কি মিস্টার হেনরিক কে আমন্ত্রন জানাতে পারি? আপনারা নিশ্চয় তার খ্যাতি সম্পর্কে জানেন। দয়া করে আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিন)

অনুবিকা, রেহানা আর আয়ান চমকে তাকালো পূর্ণর দিকে। পূর্ণ এবার ছোটাছুটি শুরু করলো। হাসপাতালের রিসিপশন থেকে কল লাগালো তার হেন আংকেলকে। আর অনুবিকা, রেহানা ও আয়ান ভাবতে লাগলো কিভাবে সম্ভব একটা অটিস্টিক রোগীর পক্ষে আচমকা এতো ভালো ভাবে ইংলিশ বলা। অনুবিকার তখনই মনে আসলো একটি কথা। পূর্ণর বাংলাগুলো কেমন যেন ভাঙ্গা, চুলের রঙটাও স্বাভাবিক কালো নয়, বাদামী ধরনের। আর পূর্ণ কখনো তার টেবিল থেকে বাংলা সাহিত্যের কোনো বই নেয়নি। সবসময় ইংলিশ বই নিয়েছে। কিন্তু অনুবিকা, রেহানা ভেবেছিলো অনুবিকাকে নকল করতে এমন করতো পূর্ণ। আচমকা চোখের সামনে ছোটাছুটি বাড়তে দেখে সে ভাবনায় ইতি টানলো অনুবিকা। মিস্টার হেনরি ফ্লাইট নিয়ে আসতে লেইট হয়ে যাবে। তাই সে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অপারেশন থিয়েটারে লিড করবেন। হাসপাতালের ডাক্তাররা খুব অবাকই হলো। একটা সামান্য মেয়ের কথায় মিস্টার হেনরি রাজি হবেন তা ধারণা ছিলো না তাদের। তবুও তারা নিজেদের বেস্ট প্রুভ করতে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলো। যদিও ডাক্তাররা জানিয়ে গেছেন অপারেশনে ঝুঁকি বেশি।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here