পূর্ণময়ীর বিসর্জন পর্ব-৪

0
1392

#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_৪

অপারেশন থিয়েটারের সামনে চাতক পাখির মতো বসে রইলো ৪ টি মানুষ। প্রায় ২ ঘন্টার কাছাকাছি শ্বাস রুদ্ধকর মূহুর্ত। অনুবিকা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাইটাকে সে বড্ড ভালোবাসে। ভয় পায় ঠিকই, কিন্তু ভালোও কম বাসে না। রেহানা আয়ান সাহেবের বুকে মাথা হেলিয়ে বসে আছেন। দু’জনের মাঝেই ছেলে হারানোর ভয়। প্রথম সন্তান তো সকলের বড্ড মায়ার হয়। ভালোবাসার প্রথম চিহ্ন। আর পূর্ণ সে করিডোরের এক মাথায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই এই মেয়েকে শান্ত করা যাবে না বুঝতে পারলো অনুবিকা ও রেহানা। তাই তারা চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে। ডাক্তাররা বের হয়ে আসলো খানিক বাদেই। পূর্ণ ছুটে গেলো। এরপর ছুটে গেলো অনুবিকাও। রেহানা আর আয়ান নিজ নিজ জায়গায় বসেই আকুল হয়ে তাকিয়ে রইলো সাদা এপ্রোন পড়া মানুষ গুলোর দিকে। ডাক্তারদের মাঝে যে অপারেশন লিড করছিলেন, ডাক্তার হানিফ। তিনি এগিয়ে আসলে এক পা। পূর্ণ আর অনুবিকার দিকে তাকিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,
– ফার্স্ট টাইম এতো ক্রিটিকাল অপারেশন আমরা এক্সিকিউট করেছি। থ্যাংক্স টু গুড এন্ড ডাক্তার হেনরি যে আমরা সফল হয়েছি। পেশেন্ট আউট অফ ডেঞ্জার। কিন্তু এখনো জ্ঞান আসেনি। এনেস্থিসিয়া কাটতে সময় লাগবে। আপনারা স্পেশাল কেবিনে দেখে নিতে পারবেন পেশেন্টকে।

শব্দ করেই কেঁদে উঠলো পূর্ণ। অনুবিকার চোখেও সুখের অশ্রু। মাথা নিচু রেখে সে পূর্ণকে আগলে নিলো বুকে। সব ডাক্তাররা চলে যাচ্ছিলেন। তখনই ডাক্তার হানিফ দাঁড়িয়ে পড়লেন। ফিরে আসলেন পূর্ণর কাছে। এরপর কৌতুহলী ভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
– ডাক্তার হেনরি কে কিভাবে রাজি করলেন?

পূর্ণ জলভরা চোখে নাক টেনে বোকা বোকা ভাবে তাকিয়ে রইলো। ডাক্তার তখনই ইংলিশে প্রশ্ন করলো আবারও,
– how did you manage him to stay connected? ( তুমি তাকে কিভাবে সাথে থাকতে রাজি করালে?)

পূর্ণ মৃদু হেসে বললো,
– He is my uncle.. He loves me more than his life. He was my neighbour in london. ( সে আমার আংকেল হয়। সে আমাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। লন্ডনে সে আমার প্রতিবেশী ছিলো)

ডাক্তার হানিফ মৃদু হেসে পূর্ণর মাথায় হাত রাখলেন। এরপর চলে গেলেন। অনুবিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। নিজ সিটে বসে থাকা আয়ান আর রেহানাও তাকিয়ে রইলো। লন্ডন? ইংলিশ? এসব পূর্ণর সাথে যেন যাই না। পূর্ণ দ্রুত এগিয়ে গেলো অপারেশন থিয়েটার থেকে স্ট্রেচার করে বের করে স্পেশাল কেবিনে নিয়ে যেতে থাকা রায়ানের দিকে। মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছে তার। পূর্ণর যেন বুক ফেঁটে কান্না আসছে। তবুও চুপ থাকলো। একদল ওয়ার্ড বয় আর নার্সের পিছন পিছন সেও দৌড়ে ছুটতে লাগলো স্পেশাল কেবিনের দিকে। আর মৃদু পায়ে অবাক হয়ে হেঁটে আসতে লাগলো অনুবিকা আর রেহানা-আয়ান।
.
.
পাক্কা ৩ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো রায়ানের। অনেকক্ষন চোখ বন্ধ রাখার কারণে বা অন্য কারণে মাথা ভাড় আর চোখে ঝাপসা লাগতে লাগলো সব। অনুভব করলো কেও তার হাতের উপর মাথা রেখে কাঁদছে। রায়ান শুকনো একটা ঢোক গিলে কয়েক বার চোখের পলক ঝাপকে নিলো। এরপর ঘাড় ঘোড়াতে গিয়ে বুঝলো মাথাটা একটু বেশিই ভাড় লাগছে তার। তবুও কোনোমতে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো পূর্ণ রায়ানের হাত ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে চোখের সাথে ধরে। রায়ানের মুখে ব্যাথাতুর একটি হাসি ফুটলো। একদিকে মেয়েটিকে কাঁদলে কোনো ঘন রহস্যমন্ডিত বনের মায়াবিনী রাণির মতো লাগে। আবার বুকের কোথাও ছুড়িকাঘাত ও হয় যেন। রায়ান কিছু বলতে যাবে। তখনই বুঝলো তার শরীর অতিরিক্ত মাত্রায় দূর্বল বোধ করছে। কানে এলো দরজা খুলার আওয়াজ। আলতো করে মাথা ফিরিয়ে দেখলো অনুবিকা, আয়ান সাহেব আর রেহানা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। রেহানা দ্রুত পায়ে ঢুকলেন রুমে। রায়ানের বুকে আলতো করে মাথা রেখে কেঁদে ফেললেন যেন। অনুবিকার চোখেও জল চিকচিক করছে। আয়ান সাহেব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও তার শুকনো মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে ছেলের এই অবস্থায়। রায়ান আলতো করে স্যালাইন চলতে থাকা ডান হাত তুলতে গিয়ে ” আহ ” করে আওয়াজ করে উঠলো। পূর্ণ ঝট করে মাথা তুলে তাকালো। দ্রুত চোখ মুখ মুছে সে উঠে দাঁড়ালো। রায়ানের দিকে রেগে মেগে তাকিয়ে বললো,
– আই হেইট ইউ রায়ান। আই হেইট ইউ। আই হেইট ইউ।

এই তিন বাক্যের কথাটা বলতে গিয়ে যেন কান্না আরো উপচে এসেছে পূর্ণর গলা দিয়ে। রায়ান অবাক হয়ে পূর্ণর এতো মোলায়েম ভাবে ইংলিশ বলার বিষয়টিতে তাকিয়ে থাকলো। হচ্ছে টা কি এসব? মাথা ঘুড়িয়ে অনুবিকার দিকে তাকাতেই অনুবিকা ইশারায় আশ্বস্ত করে বললো সব পরে জানাবে। রায়ান তবুও যেন শান্ত হতে পারলো না। তার মাঝে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো আগের সেই রহস্যের গন্ধ।
.
.
গতকালকে রায়ানের জ্ঞান ফেরার পর আবারও তাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। রেহানা আর আয়ান রুমের বাইরে অপেক্ষা করেছে আর অনুবিকা আর পূর্ণ রুমের ভেতর। আজকে সকালে ১২টার দিকে রায়ানের জ্ঞান ফিরার পর রেহানা ছেলেকে ধরে অনেকক্ষন কাঁদলেন। ঘুমটার পর কিছুটা ভালো অনুভব করলেও শরীরে অদ্ভুত এক দুর্বলতা আর মাথার হালকা ভাড় ভাবটা কাটেনি রায়ানের। তবুও মৃদু হাসি মুখে রেখে সে মাকে সামাল দিয়েছে। শত হোক মায়ের আবেগ যে সন্তানকে ঘিড়ে বেশিই হয় তা রায়ান বুঝে। আয়ান সাহেব চুপচাপ কিছুক্ষন ছেলের পাশে বসে ছিলেন শুধু। এরপর ছেলের মাথায় হাত রেখে উঠে গেলেন। রায়ান হয়তো অনেক কিছুই বলতে চাইছিলো আর আয়ান সাহেবও হয়তো বলতে চাইছিলেন অনেক কিছু। কিন্তু বলা হলো না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রত্যেকটা সন্তান মায়ের কাছাকাছিই থেকে যেতে পারে। কোনো এক কারণে দূরত্ব চলে আসে সারাজীবন নিজের মনে বেস্ট হিরো ভেবে আসা “বাবা ” নামক মানুষটির সাথে। কিন্তু ভালোবাসা আড়ালে আবডালেই রয়ে যায়।

অনুবিকা রায়ানকে খাইয়ে দিচ্ছে স্যুপ। একটু আগে রেহানা আর আয়ানকে একপ্রকার ধরে বেঁধে বাসায় পাঠানো গেলেও পূর্ণকে এই রুমের বাইরেই নেওয়া যায়নি। সে নিষ্পলক ভাবে রায়ানের দিকে তাকিয়ে রায়ানের মুখোমুখি এক সোফায় বসে আছে গালে হাত দিয়ে। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। নাকে একটু পর পর ঘষছে, কান্নার কারণে সর্দির মতো হয়ে গেছে বুঝা যাচ্ছে। রায়ানের খবরটা শোনার পর একগ্লাস পানিও খায়নি সে।অনুবিকা খেয়াল করলো তার ভাইয়ের একটানা নজর পূর্ণর দিকে স্থির। অনুবিকা আলতো কাশলো। রায়ান দ্রুত চোখে সড়িয়ে নিলো পূর্ণর থেকে। অপ্রস্তুত হাসলো অনুবিকার দিকে তাকিয়ে। অনুবিকা না চাইতেও ফিক করে হেসে ফেললো। এরপর বললো,
– জানিস ভাইয়া? কাল তুই সকালে বের হবার পর পূর্ণ খুব অস্থির অস্থির করছিলো। আমরা অনেক চেষ্টা করেও সামাল দিতে পারিনি। তোর আসার সময় পার হয়ে যাবার পর সে কি কান্না মেয়েটার। আমরা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম তোর কল না ধরা আর দেরিতে আসা ব্যাপারটাকে। পূর্ণই বুঝে গেছিলো কিছু একটা হয়েছে। যখন শুনলো তোর এক্সিডেন্ট হয়েছে। মা কি কাঁদবে, পূর্ণই সব ভাসিয়ে দিতে চাইলো যেন কেঁদে কুটে। হাসপাতালে এসে ডাক্তার জানালো অপারেশন করতে হবে কিন্তু তারা করবে না। কারণ অনেক ক্রিটিকাল অবস্থা ছিলো তোর। গাড়ির কাঁচ এমন বাহবে মাথায় গেঁথেছিলো যে একটু ভুল হলে হয়তো ব্রেইনে…

অনুবিকার চোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়লো। রায়ান ডান হাত কোনোমতে উঁচিয়ে বোনের চোখের জল মুছিয়ে দিলো হাসিমুখে। অনুবিকাও নিজেকে সামলে নিলো। ভাইয়ের সামনে কেঁদে ভাইকে উত্তেজিত করতে চায় না সে। অনুবিকা এরপর হাসি মুখে বললো,
– আমরা সবাই ভেঙ্গে পড়েছিলাম।তখনই বাচ্চাদের মতো পূর্ণ ছুটে গেছিলো ডাক্তারদের কাছে। বিখ্যাত ডাক্তার হেনরিক ফেয়োলকে ডাকানোর জন্য পারমিশন চাইলো। ডাক্তাররা হয়তো ভেবেছিলো পূর্ণ ঠাট্টা করছে। তাই পারমিশনও দিয়েছিলো। পূর্ণ ঠিকই হাসপাতালের রিসিপশন থেকে কল করলো ডাক্তার হেনরিককে। ডাক্তার হেনরিক নিজের পার্সোনাল কাজ ফেলে তোর অপারেশন থিয়েটার ভার্চ্যুয়াল ভাবে লিড করেছে। আর ফিজিক্যালি ডাক্তাররা অপারেশন করেছে। অপারেশনে অনেক ঝুঁকি ছিলো। তবুও সফল হয়েছে শুকরিয়া আল্লাহকে।

রায়ানের ভ্রু কুঁচকে রইলো। পূর্ণর এসব কাজ সে কোনোভাবে নিতে পারছে না। তাহলে কি এতোদিন পূর্ণ এতোদিন তাদের সাথে নাটক করে গেছে? এতোটা খারাপ কি হবে এই মায়াবিনী? রায়ান খুব অসহায় বোধ করতে লাগলো হঠাৎই। ঘাড় ঘুড়িয়ে মুখোমুখি বসে থাকা পূর্ণর দিকে তাকিয়ে দেখলো সোফাতেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রয়েছে সে অগোছালো ভাবে। অনুবিকাও ভাইয়ের নজর অনুসরণ করে তাকালো একবার। নিজের ভাইয়ের চোখে সে পূর্ণর জন্যে বিশেষ জায়গা দেখে এসেছে সবসময়। আজ সেখানে সন্দেহ দেখতে পেয়ে একনজরেই তাকিয়ে রইলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here